– ময়নার মা! ও ময়নার মা।
স্বামী গফুর মিয়ার ডাকে তাড়াহুড়া করে ময়নার মা তার কাছে আসলো।
– কি হইছে? এত ছিল্লাচ্ছেন ক্যান?
– আরে হুন না। একটা সুখবর আছে?
– সুখবর! এই ভরদুপুরে আবার কি সুখবর নিয়ে আসলেন?
– আমাগো ময়নার জন্য একটা ভালা পুলা পাইছি। পুলার ম্যালা পয়সা আছে। বিদেশ থাইক্কা আইছে।
– পুলার বাড়ি কই?
– আমাগো পাশের গ্যারাম মেজেরকান্দি। পুলার বাপ আমার বন্ধু।
– আমাগো ময়নার তো সবে চৌদ্দ বছর হইছে! এহনই মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দিবেন?
– আমাগো ময়নাতো ম্যালা বড় হইছে। তারতো বিয়ে দেওন লাগবো। সব সময় ভালা পুলা পাওয়া যায় না। কি বল তুমি?
– আপনে যা ভালা মনে করেন।
– আল্লাহর মাল আমাগো মেয়ে তো পাঁচখান। একটা একটা কইরাতো সব্বাইরে বিয়া দিতে হইবো। তাই দেরি করা যাবে না।
– হ ঠিকই কইছেন। তা পুলাডার খোঁজ পাইলেন কই?
– ঐ যে ঘটক বিল্লাল ভাইকে ছিননা?
– হ ছিনি।
– হেই ঘটকের সাথে আজকা বাজারে দেহা হইছে। সেইতো আমারে কইছে পুলার সম্বন্ধে।
– ঠিক আছে। তয় বিয়ে দেওনের আগে পুলাডারে দেইখা নিয়েন।
– পুলা না দেইখা কি আর বিয়ে দিমু।
গফুর মিয়া বাঙালীনগর গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের যা জমি আছে তা চাষ করে কোন রকমে সংসার চালায়। একটি ছেলের আশায় তার সংসারে এখন পাঁচটি মেয়ে। প্রতি দুবছর পর পরই একটি মেয়ে জন্ম হয়েছে। এখন সে ছেলের আশা ছেড়েই দিয়েছে। পাঁচ মেয়ে নিয়েই বাকি জীবন পার করতে চায়। সংসারের অভাব অনটনের কারণে মেয়েদেরকে লেখাপড়াও করাতে পারছেন। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে বড় মেয়ে ময়নাকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর পর আর পড়ায়নি। অন্য মেয়েরাও কেউ স্কুলে যায় আবার কেউ যায় না। এই নিয়ে তার কোন চিন্তাও নেই। গফুর মিয়া পাঁচ মেয়েকে পর্যায়ক্রমে বিয়ে দিতে পারলেই সংসারের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করে। মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পর কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করে না।
গফুর মিয়া ও তার স্ত্রী জরিনা বেগম একেবারেই নিরক্ষর। ভালো মন্দের পার্থক্য তারা তেমন বুঝে না। অল্প বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে দিলে ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। তাদের একটিই কথা, বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে। বড় মেয়ে বিয়ে দিতে না পারলে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। ধারাবাহিকভাবে সব মেয়ের বিয়ে দিতে চায় তারা। তাইতো ঘটক বিল্লাল ভাই যখন বিয়ের প্রস্তাবের কথা বললো তখন সহজেই রাজি হয়ে গেলো সে।
গফুর মিয়ার সম্মতি নিয়ে আজ ঘটক বিল্লাল ভাই আসলো মেজেরকান্দি গ্রামের বাতেন মিয়ার বাড়িতে।
– কালার বাপ! ও কালার বাপ।
– কেডা আইছো এই সাতসহালে?
– আমি ঘটক বিল্লাল ভাই।
– ও চাচা আহেন।
বাতেন মিয়া ঘটক বিল্লাল ভাইকে একটি চেয়ার এনে ঘরে বসতে দিলো। তারপর বললো, কি মনে কইরা গরিবের বাড়িতে?
– ঘটকরা কি মনে কইরা আহে?
– হ বুঝবার পারছি। বিয়া শাদীর আলাপ সালাপ করতে?
– এইতো বুঝবার পারছো। হুনলাম তোমার পুলা কালা মিয়া নাকি বিদেশ থাইক্কা আইছে?
– হ ঠিকই হুনছো।
– তয় কয় দিনের ছুটি নিয়া আইছে?
– তিন মাসের।
– বিয়া শাদী করাইবা নাকি?
– বিয়া তো করামু। তয় ভালা একটা মাইয়া চাইতাছি।
– আমার কাছে একটা ভালা মাইয়া আছে।
– বাড়ি কোন গ্যারামে?
– বাঙালীনগর।
– কার মাইয়া?
– গফুর মিয়ার মাইয়া।
– কি কও। তারেতো আমি চিনি।
– হ সেওতো একই কথা কইছে।
– তার মাইয়া এত বড় অইয়া গেছে তাতো বুঝবার পারি নাই।
– মাইয়া মানুষ বড় হইতে বেশি দিন লাগে না। মাইয়া বিয়ার উপযুক্ত হইছে। দেখতে সুন্দর। গায় গতর নাদুস নুদুস। তোমার পুলাডার সাথে মানাইবো ভালা।
– কালা মিয়া যদি রাজি হয় তাইলে বিয়া করামু।
– রাজি হবে না ক্যান? গফুর মিয়ার কোন ছেলে নাই। সে মইরা গেলে সব জায়গা জমির মালিকতো মাইয়ারাই হইবো।
– বুঝবার পারছি। তয় পুলাডার সাথে একবার কথা কইয়া লই।
– ঠিক আছে ডাহ দেহি তোমার পুলারে। আর তোমার বউরে কও আমারে একখান পান দিতে।
বাতেন মিয়ার বড় ছেলে কালা মিয়া। নামের সাথে হুবহু গায়ের রঙ এর মিল আছে। এমন কালো মানুষ মেজেরকান্দি গ্রামে আর নেই। জন্মের সময় তার চেহারা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। গফুর মিয়ার ঘরে এমন কালো ছেলে এলো কি করে? তাদের বংশেতো এমন কালো মানুষ নেই! জন্মের সময় তার নাম রহিম মিয়া রাখলেও গায়ের রঙ কালো হওয়ায় সবাই তাকে কালা মিয়া বলেই ডাকতে ডাকতে সে কালা মিয়া নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বাতেন মিয়ার দুই ছেলে দুই মেয়ে। কালা মিয়া তার বড় ছেলে। অন্য ছেলেটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে। মেয়ে দুটো মায়ের মতো।
বাতেন মিয়া গ্রামের একজন কৃষক। সারাজীবন কৃষিকাজ করে যা আয় করেছে তা দিয়েই সংসার চালিয়েছে। নিজেও লেখা পড়া করে নাই। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার কথা চিন্তাও করে নাই। গত তিন বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে বড় ছেলে কালা মিয়াকে সৌদী আরব পাঠায়। সেই থেকে বাতেন মিয়ার ভাগ্য খুলে যায়। ছেলেটা বিদেশ গিয়ে ভালো পয়সার মালিক হয়েছে। এই তিন বছরে বাড়িতে একটা টিনশেড বিল্ডিং করেছে। ছোট ভাই করিম মিয়াকে বিদেশ নিয়েছে। বেশ কিছু জমিও রেখেছে।
এখন বাতেন মিয়ার ছেলে যেহেতু ছুটিতে বাড়িতে আসছে তাকে বিয়ে করাবে। তাই পাত্রী খুঁজছে। আজ ঘটক বিল্লাল ভাই বাড়িতে এসে তারই বন্ধু গফুর মিয়ার মেয়ের কথা বলাতে সে রাজি হয়েছে বিয়ে করাতে কিন্তু ছেলের মতামতের জন্য ছেলেকে ডাকছে।
– কালা মিয়া! ও কালা। কই গেছস?
– কি আব্বা? ক্যান ডাকছেন?
– তোর বিল্লাল দাদা আইছে। একটু কথা ক দেহি।
ঘটককে কালা মিয়া ছোট সময় থেকেই চিনে। তাই তাকে দেখে সালাম দিলো- আসসালামু আলাইকুম দাদা।
– ওয়ালাইকুম আসলাম। কেমন আছ নাতি?
– ভালা আছি। আপনি কেমন আছেন?
– তোমাগো দোয়াই ভালাই আছি। তয় তোমার সাথে একখান কথা আছিন।
– কি কথা কইবেন কন?
– হুনলাম তুমি নাকি বিয়া করবা?
– হ দাদা।
– আমার কাছে একখান সুন্দর মাইয়া আছিন। তোমার মত পাইলে কাজ শুরু কইরা দিবার পারি।
– আমার আবার কি মত। আব্বা যা ভালা মনে করেন তাই করেন। তয় বিয়ের আগে আমি মাইয়াডারে একনজর দেখতে চাই।
– তাতো অবশ্যই। কবে যাইবা?
– কালই চলেন।
– ঠিক আছে আমি মাইয়ার বাপের সাথে কথা কমু। তুমি এখন যাও।
ঘটক বিল্লাল ভাই আজ সকালেই ফোন করে গফুর মিয়াকে জানিয়ে দিলো ছেলেকে নিয়ে তার মেয়েকে দেখতে আসার কথা। ছেলের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করতে গফুর মিয়াকে বলে দলিো। গফুর মিয়া তার সাধ্যমতো খাবারের আয়োজন করল।
এদিকে ময়নাকে দেখতে আসবে এ খবর ময়নার মা ময়নাকে দেয়ার পর সে কিছুতেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।
– আমি এখন বিয়া বসব না।
– ক্যান বিয়া বসবি না?
– আমার এহন বিয়ার বয়স হয়নি।
– কেডা কইছে তোর বিয়ার বয়স হয়নি?
– কেডায় আবার কইবো? আমি কি বুঝি না?
– ভালা একটা পুলা পাওয়া গেছে।
– পুলার কি অভাব পড়বে মা?
– এমন ভালা পুলা পাওয়া যাইবো না।
– এতসব বুঝি না। আমি এহন বিয়া বসব না।
ময়নার এক কথা এখন সে বিয়ে করবে না। তার এখন বিয়ের বয়স হয়নি। এই কথা ময়না বুঝলেও তার পিতা-মাতা কেউ বুঝতে চাইছে না। তাদের এক কথা মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বিয়ে তাকে দিতে হবেই। এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়।
বিকেল বেলা ঘটক বিল্লাল ভাই, কালা মিয়া ও তাদের কয়েকজন মুরুব্বিকে নিয়ে গফুর মিয়ার বাড়িতে আসে। মেয়েকে দেখতে আসবে তাই গফুর মিয়া তার সাধ্যমত তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলো।
পাশের বাড়ির এক ভাবী ময়নাকে আজ সুন্দর করে সাজালো। তারপর তিনি ময়নাকে ধরে মুরুব্বিদের সামনে নিয়ে আসলো। ময়না সালাম দিয়ে একটি চেয়ারে বসলো। ভাবি ময়নার ঘোমটা খুলে বর পক্ষের সবাইকে দেখালো। ময়না বার বার লজ্জায় ঘোমটা টেনে দেয়। ছেলে পক্ষের মুরুব্বিরা খুটিয়ে খুটিয়ে ময়নার চেহারা দেখে। ঘটক সাহেব ময়নার কথাবার্তা শুনার জন্য কালা মিয়াকে ইশারা দিতেই সে ময়নাকে কিছু প্রশ্ন করল।
– তোমার নাম কি?
ময়না লাজুক ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল, ময়না।
– তোমরা ক’ভাই বোন?
– পাঁচ বোন, ভাই নেই।
– কোরআন পড়তে জান?
– হে জানি।
পরে সহকারী মহিলাটি ময়নার চুল কতটুকু লম্বা তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী কিনা তা দেখার জন্য তাকে হাঁটানো হয়। তার দাঁতগুলো মুক্তার মতো ঝক ঝক করে কিনা নাকি আঁকাবাঁকা তা দেখার জন্য হা করতে বলা হয়। পায়ের আঙ্গুল ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য পায়ের কাপড় সরিয়ে পা দেখানো হয়। হাতের কবজি পর্যন্ত দেখানো হয়। এমন আরো কত অশুভ আচরণ করা হয় ময়নার সাথে। ততক্ষণে ময়না রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু এই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না। পারলে এখনই তাদের সামনে থেকে চলে যেত। তার হাতের লেখা দেখার জন্য তার ঠিকানা লিখতে বলা হয়। ময়না সাদা কাগজে ঠিকানা লিখে দিলো। পরিশেষে কালা মিয়া ময়নার হাতে ৫০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বিদায় করে দিল।
ময়নাকে দেখে কালা মিয়ার পছন্দ হলো। ঘটক বিল্লাল ভাই এবার খুশী। দু’পক্ষকেই রাজি করাতে পারছে। সে বাতেন মিয়াকে তার ছেলের সম্মতির খবরটি দিলো। দু’পক্ষ আলাপ আলোচনা করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করলো। কালা মিয়া ১০০ বরযাত্রী নিয়ে আগামী শুক্রবার ময়নাকে বিয়ে করতে আসবে। দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজন সবাইকে ইতোমধ্যে দাওয়াত করা হয়ে গেছে।
আজ ময়নার বিয়ে। বাড়ির আশেপাশের সবাই আনন্দে ভাসছে। কিন্তু ময়নার মনে কোন আনন্দ নেই। সে একা কাঁদছে। তার কান্না কেউ দেখে না। সে এ বিয়েতে রাজী নয়। তাকে জোরপূর্বক এ বিয়েতে রাজী করানো হয়েছে। সে ভাবছে তার ভবিষ্যত নিয়ে। যে বয়সে সে লেখাপড়া করবে। আনন্দ ফূর্তি করে বেড়াবে সে বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে, সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি এগুলো সে কিছুই বুঝে না। যাদের সাথে চৌদ্দটা বছর থেকেছে তারাও বুঝল না ময়নার মনের কষ্ট।
বরযাত্রী আসল। বিয়ে হল। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে ময়না শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হলো। যাবার বেলা ময়না কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আত্মীয়স্বজন সবাই এই কান্নাকে স্বাভাবিক কান্না মনে করলেও আসলে ময়না স্বাভাবিকভাবে কাঁদেনি। নববধূকে যখন কালা মিয়াদের বাড়িতে আনা হল তখন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই নতুন বউ দেখতে আসল। সারাদিন মেয়েটা কিছু খায়নি। কান্নাকাটি করে একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর পর সবাইকে ঘোমটা উঠিয়ে দেখানো হচ্ছে। এতে করে তার খুবই বিরক্ত লাগছে।
কালা মিয়ার আজ বাসর রাত। তার মনে দারুন আনন্দ। অল্প বয়সী সুন্দরী বউ পেয়েছে সে। নতুন ঘরে বাসরঘর সাজানো হলো। রাত এখন ১ টা বাজে। কিছুক্ষণ আগে কালা মিয়া বাসর ঘরে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কালা মিয়া রুমে ঢুকেই দেখল ময়না ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে এবং মৃদুস্বরে কাঁদছে। সে এগিয়ে গেল নববধূর কাছে।
– কি হল ময়না তুমি কানতাছো ক্যান?
কালা মিয়ার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ময়না। শুধু কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
কালা মিয়া ময়নার থুতনীতে ধরে বললো, কি হলো কানতাছো ক্যান? বল তোমার কি হইছে? বাসর রাতে কেউ কান্দে?
এবার ময়না কালা মিয়ার দিকে একনজর তাকাল। ঐদিন সে মুরুব্বিদের সামনে ভালো করে কালা মিয়ার দিকে তাকায়নি। আজ সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে চমকে উঠল। একি দেখছে সে! মানুষ এত কালো হতে পারে। যেমন কালো তেমন মোটা। আর এমন একটা কালো মানুষের সাথে আমার আব্বা আমাকে বিয়া দিল। এ কথা ভাবতেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কালা মিয়া এ দৃশ্য দেখে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কি করব। এ মুহূর্তে কাউকে ডাকা উচিত হবে না। মানুষজন অন্য কিছু ভাবতে থাকবে। যা করার আমাকেই করতে হবে।
– ময়না! ও ময়না। উঠো। আমি তোমার সোয়ামী। বাসর রাতে কেউ এমন করে না। এই রাত আর কোন দিন আসবে না।
কিন্তু কিছুতেই ময়নার কোন সাড়া পাচ্ছে না কালা মিয়া। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বাহিরে বের হয়ে পানি নিয়ে আসল। ময়নার মাথায় পানি ঢালল। হাত পায়ে তেল মালিশ করল। অনেকক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরে এল।
– কেডা আপনি?
– আমি তোমার সোয়ামী।
– সোয়ামী! আমি আপনেকে চিনি না। আমারে ছুবেন না।
– এসব কি বলছ?
– আপনাকে আমার ভালা লাগেনি।
– ভালা না লাগলেও আমি তোমার সোয়ামী। তুমি আমার বউ। আমাকে তুমি মেনে নাও। বলেই কালা মিয়া ময়নার শরীরে হাত স্পর্শ করে।
– আমি কইছি আমারে ছুবেন না। তাহলে কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামু।
– ছি: ময়না এসব বলে না। গ্যারামের মানুষ তোমারে খারাপ কইবো।
– যা কওয়ার কোউক। তবুও আমি আপনের লগে থাকুম না।
– ক্যান থাকবানা? তাইলে কি তুমি বিয়ার আগে কোনো পুলার লগে পেরেম করছ?
– ছি: এসব কি বলেন। আমার কি পেরেম করার বয়স হয়ছে?
– তাইলে তুমি এই রাতে এমন করতাছো ক্যান?
– কইছি না আপনারে আমার ভালা লাগেনি।
কালা মিয়াকে ময়নার ভালো লাগেনি। তার শরীর স্পর্শ করতে নিষেধ করার পরও এক প্রকার জোর করেই কালা মিয়া ময়নার সাথে শারীরিক মিলন করে। কিশোরী বয়সে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের স্বামীর অত্যাচার সারা রাত নীরবেই সহ্য করেছে। এ কোন বাসর রাত নয়। বলতে পারেন জোর পূর্বক একজন কিশোরীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামী নামক ব্যক্তিটি ধর্ষণ করছে।
তারপর থেকে প্রতিদিনই ময়নার সাথে কালা মিয়ার শারীরিক ধর্ষণ হতো। দুই মাস পর কালা মিয়া সৌদি আরবে চলে যায়।
ইতোমধ্যে কিশোরী ময়না তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন টের পেল। কিছুদিন যাবত তার পেটে খুব ব্যথা করছে। তার ভয় হচ্ছে তার পেটে হয়তো বাচ্চা এসেছে। আমিতো একটা বাচ্চা মেয়ে; আমার পেট থেকে আরেকটা বাচ্চা বের হবে কি করে? কি করবে বুঝতে পারছে না ময়না। আজ ময়না হঠাৎ করে বমি করলো। সে তার শাশুড়িকে এই ঘটনা বললো। শাশুড়ি তখন বললো, তুমি বাচ্চার মা হতে চলেছো।
এই কথা শুনার পর সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এত অল্প বয়সে কিভাবে সে একটা বাচ্চার বোঝা বহন করবে। যেখানে সন্তান পেটে আসলে প্রতিটি মায়ের মনেই আনন্দ লাগে সেখানে ময়না তার উল্টোটা করছে। শাশুড়ি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, এত চিন্তা করছ ক্যান। আমরা আছি না? আমরা হগলেতো মা হইছি। সব মাইয়ারাই প্যাটে বাচ্চা লয়।
দিন যায়, মাস যায়। এভাবে নয়টি মাস চলে গেল। ময়নার বাচ্চা প্রসবের সময় এগিয়ে আসল। এতটা সময় একটা বাচ্চা ময়নার পেটে বেড়ে উঠছে। অথচ কালা মিয়ার পরিবার থেকে ময়নার প্রতি কোন যতœ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি কোন ডাক্তারি ঔষধ বা পরীক্ষানিরীক্ষাও করা হয়নি। ভালো কোন খাবার তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে দিয়ে ময়নার শাশুড়ি ভারী কাজ করাতো আর বলতো, এই সময় ভারী কাজ করতে হয়। তা না হলে বাচ্চা বড় হয়ে গেলে জন্ম নিতে কষ্ট হবে।
প্রসব বেদনায় অস্থির ময়না। কান্নায় ফেটে পড়লো। আর সহ্য হচ্ছে না তার। ময়নার শাশুড়ি পাশের বাড়ির দাই মাকে নিয়ে আসলো যে মেজেরকান্দি ও আশে পাশে গ্রামের সকলের সন্তান প্রসবের সময় হলে এগিয়ে যায়। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার হাতে অনেক নারী জীবন দিয়েছে। তারপরও অত্র এলাকার ভরসা এই দাই মা।
দাই ও তার একজন সহযোগি নিয়ে ময়নার ঘরে প্রবেশ করল। সাথে আছে ময়নার শাশুড়ি ও বাড়ির আশে পাশের কিছু মহিলা। ময়নার মা-বাবাকে খবর দেয়া হলো। দাই মা দীর্ঘ দুই ঘন্টা চেষ্টা করেও সন্তান প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়ে ময়নার শাশুড়িকে বললো, কালার মা। আমি আর পারছি না। আমার জীবনে অনেক বাচ্চা প্রসব করাইছি। এমন অবস্থা দেহি নাই। আমার মনে হয় বাচ্চা উইল্টা আছে।
– এসব কি কন খালাম্মা!
– হ। তোমরা জলদি কোন কবিরাজ ডাইকা আন। তা না হলে বাচ্চার মাকে বাঁচানো যাবে না। কবিরাজ ডেকে ঝাঁড়ফুক করে দেখ বাচ্চা সোজা হয় কিনা।
দাই মার কথা শুনে কালার মা দ্রুত পাশের গ্রামের নিমাই কবিরাজের বাড়িতে গেলো। নিমাই কবিরাজ আসলো। ততক্ষণে ময়না প্রসব যন্ত্রণায় কাতর। কবিরাজ কি যেন পড়ে ময়নার পেটে ফুঁ দিলো। আর কিছু তেল পড়া দিয়ে দাই মাকে বললো, এই তেল পড়া পেটে মালিশ করতে হবে। তিন ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা সোজা হয়ে যাবে। এ কথা বলে কবিরাজ চলে গেলো।
কিন্তু তিন ঘন্টা গিয়ে চার ঘন্টা পার হলো কিছুতেই বাচ্চা সোজা হচ্ছে না। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই ময়না বেহুশ হয়ে যাচ্ছে।
– মাগো আমি আর পারছি না। আমাকে মেরে ফেল।
ময়নার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর ময়নার বাবা-মা আসলো। তারাও মেয়ের এই বিপদে কোন সঠিক পরামর্শ দিতে পারছে না। গ্রামের কেউ কেউ বলতে লাগলো, এই মেয়েকে বাঁচাতে হলে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাতে সবাই সম্মতি দিল। কিন্তু মেজেরকান্দি গ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে। প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা। ময়নার বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ি একটি সিএনজি ভাড়া করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। দীর্ঘ চার ঘন্টা জার্নির পর শহরে এসে পৌঁছল। ময়না তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। দ্রুত তাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দীর্ঘ এক ঘন্টা অস্ত্রোপাচার করে একটি বাচ্চা বের করে ময়নার শাশুড়িকে দিয়ে বললেন, দু:খিত আমরা বাচ্চার মাকে বাঁচাতে পারলাম না। আপনারা অনেক দেরি করে এসেছেন।
এই কথা শুনার সাথে সাথে ময়নার বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তাদের কান্না দেখে ময়নার শ্বশুর-শাশুড়িও কাদঁতে লাগলেন।