নাইনা, কুটুস এবং সিফাতের ভালোবাসা

নাইনা, কুটুস এবং সিফাতের ভালোবাসা

দুইদিন আগেও নাইনা তাঁর কোমলমতি সন্তানদের বুকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কখনও বাগানে রক্ষিত গোলাকৃত টেবিলের আড়ালে। কখনও বা রান্নাঘরের সামনে সিঁড়ির কোল ঘেঁষে পাতানো পাপোষের উপর শুয়ে-বসে।

এইভাবেই কাটছিলো নাইনার দিনগুলো প্রিয় সন্তানদের সাথে। সন্তানগুলো প্রতিকূল পরিবেশের কাছে হার না মেনে মায়ের সান্নিধ্যে আল্লাদি হয়ে উঠছিল দিনকে দিন। দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারলেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া তাঁদেরকে সর্বত্র ব্যতিব্যস্ত রেখেছে।বাইরের হিমেল হাওয়া মা-সন্তানদের জীবনকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছিল। সেই থেকেই নাইনাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে সিফাত। সাথে তাঁর মা-বাবা এবং ছোট্ট ভাইটিও।

সকাল থেকেই নাইনার ভীষণ মন খারাপ। নাইনা বারবার কেঁদে উঠছে। মিহি গলায় সন্তানদের ডাকছে। সন্তানদের খুঁজতে গিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে ছোট্ট বাড়িটির দিকে।আবার কখনো বাড়ির মানুষগুলোর দিকে স্থির চোখে।যেন এই বাড়িটিই তাঁর সন্তানদের গ্রাস করেছে কিছুক্ষণ আগে।চোখের সামনেই বাক্সবন্ধি করতে দেখেছে সন্তানদের।কিছুই ভুলতে পারছে না নাইনা।চারিদিকে খোঁজা খুঁজি করে।হিসেব মিলাতে পারছে না।গভীর রাত হতেই খোলা জানালা দিয়ে তুলতুলে হাত বাড়িয়ে আকুতি জানায় তাঁর সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে।এই যেন প্রভুর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়া।

সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি সময়ের কোনো একদিন।লন্ডনের তাপমাত্রা এই সময়ের তুলনায় একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছিল। ঝকঝকে দিন। দিনের শুরুতে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বদলে যায়। সিফাত তাঁর মা-বাবা ও ভাইয়ের সাথে অনেকদিন পর একসাথে বেড়াতে যায়।সারাদিন কেটে যায় ঘরের বাইরে।রাতে বাসায় ফিরেই দেখতে পায় বাড়ির পিছনের বাগানে নাইনার সাথে চার চারটি ফুটফুটে বাচ্চা।ফ্ল্যাশ লাইটে সাদা-কালো রঙের ফুটফুটে ছোট্ট বাচ্চাগুলো আলোতে ঝলমল করছে।মনের আনন্দে খেলাধুলা করছে সবুজ ঘাসের উপর।লতানো লাউ গাছ যেন তাঁদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আহা কী আনন্দ ! দেখে মনে হলো বাচ্চাগুলো পথ ভুল করে এসেছে নাইনার সাথে। সিফাত ও তাঁর ভাই বাচ্চাগুলোর মাকে খুঁজছিলো। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাচ্চাগুলোর সাথে নাইনাকেও বেশ ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছিল।

নাইনাকে সিফাত ও তাঁর পরিবাররের সদস্যরা অনেক দিন ধরেই চিনে-জানে।নাইনার সাথে আরও গোটা পাঁচেক বিড়াল প্রতিদিন খাবার খেতে আসে। বাচ্চাগুলো যে নাইনার হতে পারে এটা ধারণার মধ্যেই ছিল না তাঁদের। কারণ নাইনা বরাবরই ছিল রোগা প্রকৃতির।তাঁকে দেখে কখনও প্রেগনেন্ট হয়েছে বলে মনে হয়নি।বহুমূত্র রোগীর মতোই দেখতে অনেকটা স্লিম। নাইনা বেশ হিংসুটে স্বভাবের। সবসময়ই একরোখা ভাব। তাঁর গোত্রের কাউকে কখনই পাত্তা দেয় না সে। নিজের সবকিছুই যেনো ষোলআনা তাঁর চাইই চাই।খাবার দিলে একাই সব খেয়ে ফেলে। খাদ্য গ্রহনের সময় অন্য কাউকে কাছাকাছিও ভিড়তে দেয় না।

নাইনার আগমনে প্রথমে সিফাত সহ তাঁর পরিবারের কেউই সন্তুষ্ট ছিলো না। শুধু হিংসুটে নয়। নাইনা ছিল অনেকটা হিংস্র স্বভাবেরও।কখনো মনে হয়েছে খুব দুষ্টু প্রকৃতির। এবং বদ মেজাজি। ছাই ও ধূসর বর্ণের নাইনা আদর-যত্ন পেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর দুষ্টু স্বভাবও যেন পাল্টে ফেলে।সবাইকে আপন করে নেয়। দিনদিন হয়ে উঠে সিফাতের চোখের মণি।আর তখনই তাঁর নাম দেয়া হয় নাইনা।

নাইনাকে শুরুতে প্রভু ভক্ত মনে হয়নি।মাঝে-মধ্যে নাইনা কোথায় যে উধাও হয়ে যেতো। দিন কয়েক চলে গেলেও তাঁর হদিস মিলেনি।কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসতো।আর কাছে আসলেই সোহাগ করতো আদুরে সন্তানের মতো।নাইনার এই ভাবখানা ছিল বড়ই মজার।আমরা সকলেই উপভোগ করতাম মনে-প্রাণে।যখনই ফিরে আসতো তিন বেলা আহারও জুটতো সময়মতো ।

লন্ডন শহরে নাইনার মতো এভাবে যাযাবর দিনকাটে যাদের এরাই হলো ‘স্ট্রিট ক্যাট’। নাইনা তাঁদেরই একজন।নাইনার মতো অনেকেই খোলা আকাশের নিচে দিন কাটায়।যেখানে যা পায় তা খেয়েই জীবন চলে তাঁদের।অনেক পশুপ্রেমী আবার রাস্তার কোণে নিয়মিত খাবারের ব্যবস্থাও করে রাখে। নাইনাকেও দেখার কেউ ছিল না।বাড়ির আনাচে-কানাচে বসবাস করেই বেড়ে উঠেছে সে।

ইদানিং বেশ ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে নাইনাকে।খাবারের সময় হলেই চলে আসে গার্ডেনে।সকাল-বিকেল-রাতে।সুযোগ বুঝে কখনও কখনও ঘরেও ঢুকে পড়ে।এতে কেউ আপত্তিও করে না।বাচ্চাগুলো যে নাইনার এটা একদিন পরেই টের পাওয়া যায়।সন্তানগুলোর ব্রেস্ট ফিডিং দেখেই বোঝা যায় এইগুলো নাইনার বাচ্চা। নাইনা প্রেগনেন্ট হয়ে কখন,কোথায় বাচ্চা দিয়েছে এটা কারোই জানা ছিল না। নাইনার মতো আরও অনেকেই আসে এই বাড়িতে যত্ন পেতে।দু’বেলা খাবার খেতে। সিফাত সেই সুযোগটি কখনও হাতছাড়া করেনি। যখন যাকে কাছে পেয়েছে নাইনার মতোই আদর-যত্নে বড় করেছে।

বিড়াল পাগল মিষ্টি মেয়ে সিফাত।বিড়ালের সেবাযত্ন করতে যেনো কোনো ক্লান্তি নেই। কোনো কষ্ট নেই। আনন্দ পায়।বিড়ালের প্রতি এই ভালোবাসা যেন চূড়ান্ত নেশা।

শুধু নাইনা নয়।এর আগে কুটুসকে নিয়েও অনেক কাণ্ড বাধিয়েছে সিফাত।নাইনার মতো কুটুসেরও মালিক ছিলো না।বাগানের কর্ণারে নির্মিত শেডে এবং বিভিন্ন গাছ তলায় বাস করতো কুটুস। জন্মের পরে এইভাবে কয়েক মাস কাটিয়েছে তাঁর মায়ের সাথে। একটু বেড়ে উঠায় আর মায়ের সাথে থাকতে পারেনি কুটুস।মা আবারও নতুন সন্তান পেতে ছেলে বন্ধুদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।এই ফাঁকে সিফাতই যেন হয়ে উঠেছে কুটুসের মা-বাবা।কুটুসকেও পরম আদর স্নেহ দিয়ে ভালোবাসে সিফাত।সযত্নে ঘরে এনে থাকতে দেয়।খাবার দেয়। সিফাতের পোষা মিনিও কুটুসের সাথে ভাব জমায়।

কুটুস এখন আর নেই।কোথায় যে হারিয়ে গেছে তাও জানে না কেউ। কুটুস হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়।এই নিয়ে সিফাতের মন খারাপ।অপেক্ষায় ছিল এই বুঝি ফিরে আসবে।আর ফিরেনি। কুটুস বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না। এই না জানার কষ্ট সিফাতকে আরো কষ্ট দেয়। আহত করে। একবার নাকি স্বপ্নেও দেখেছে কুটুসকে। এখনো কুটুসকে নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত নেই। ভাবে এই হয়তো কুটুস ফিরে আসছে।

সিফাত দিন পাঁচেকের জন্যে বেড়াতে গিয়েছিলো। ফিরে এসেছে দুদিন হলো। পাহাড় দেখবে বলে স্কটল্যান্ড গিয়েছিল।এর আগে সমুদ্র দেখেছে মাস ছয়েক পূর্বে। পাহাড়-সমুদ্রের মিলনস্থলের নির্জন অঞ্চল সিফাতের অনেক ভালোলাগা বিষয়ের একটি। প্রকৃতির প্রতি গভীর মোহ আর নিরীহ পশুর প্রতি ভালোবাসা সিফাতকে দুর্বল করে দেয়। কেমন করে যেন ছন্নছাড়া প্রানীগুলোর সঙ্গে জীবনের সুতোয় নিজকে জড়িয়ে রেখেছে।ছোট্ট সব্জিবাগানের কোণে চাটাই পেতে থাকতে দেয় ওদের।কালো গোলাকৃতি থালায় জল ঢেলে দেয়। অন্য থালায় শুকনো খাবার ও দুধ দেয়। এরা চুকচুক করে দুধ খায়।এইভাবেই মায়ার জালে আটকে দিয়েছে নাইনা ও তাঁর বাচ্চাদের।

কুটুসকে হারিয়েছে মাস কয়েক আগে। কুটুসকে ভুলতে না পারলেও নাইনার বাচ্চাগুলোকে নিজ হাতে দূরে ঠেলে দিয়েছে সিফাত।এই কঠিন সিদ্ধান্তই তাঁকে নিতে হয়েছে এবার।কুটুসের হারিয়ে যাওয়া ছিলো বুকের ভিতর তাজা বজ্রাঘাত।এমনটি যেন নাইনার সন্তানদের ক্ষেত্রেও না ঘটে সেই দুঃশ্চিন্তা থেকেই এই সিদ্ধান্ত।সিফাতের মা-বাবাও এই সিদ্ধান্তে একমত।

নাইনার চার সন্তান।সব কটাই মেয়ে। খুব কিউট সন্তানগুলো। একটি হয়েছে মায়ের মতো।যেমন গায়ের রং তেমন স্বভাবেও। খুব জেদী।নিজের খাবারে কাউকে ভাগ বসাতে দিবে না।এতটুকুন বাচ্চার এমন জেদী লাইফ স্টাইল সিফাতকে চমকে দেয়।

সিফাতের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল কেরলাইনের। কেরলাইন একটি এনিম্যাল চ্যারিটিতে কাজ করে।ছন্নছাড়া বিড়ালদের খুঁজে বের করে সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দেয়।যে বিড়ালগুলো অনাদরে, অবহেলায় বেড়ে উঠে রাস্তা-ঘাটে তাঁদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয়াই কেরলাইনের কাজ।কেরলাইন এদেরকে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। উন্নত চিকিত্সা দেয়। ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেয়। এরপর পশুপ্রেমিকদের খুঁজে বের করে তাঁদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।এরাও সুন্দর জীবন ফিরে পায়।

নাইনার চারটি সন্তানকে কেরলাইনের হাতে তুলে দেয় সিফাত।বাক্সবন্ধি করে নিয়ে যায় কেরলাইন।বাচ্চাগুলোর সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন দেয়ার জন্যেই মায়ের কাছ থেকে সন্তানদের সরিয়ে দেয়। নাইনা একজন মা। সব মায়েদেরই কষ্ট হয় তাঁর সন্তান কেউ কেঁড়ে নিলে।সন্তান হারানোর কষ্ট মাকে যতটা আঘাত করে অন্য কাউকে এতটা কি করে? দুদিন ধরে সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে নাইনা কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে। নাইনার মিহি কণ্ঠের মিউ মিউ শব্দ সন্তান হারানোর আঘাতকেই স্মরণ করিয়ে দেয় বারবার।

ও নাইনা, তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও। আমরা তোমাকে ও তোমার সন্তানকে বড্ড ভালোবাসি। তাইতো তোমার সন্তানদের পাঠিয়েছি আশ্রয় কেন্দ্রে। তুমি আমাদের অভিশাপ দিওনা। তোমার ভরণ পোষণের দায়ভারও না হয় আমরাই নিয়ে নিবো। তবু কান্না থামাও নাইনা। আমাদেরও চোখে জল আসে তোমার কান্নার আওয়াজে !

বুকের ভিতর চাপা কষ্ট নিয়ে সিফাতেরও দিন কাটছে। সাথে তাঁর বাবা-মায়ের।নাইনাকে দেখলে যেনো আরো ভেঙ্গে পড়ে। নাইনা হয়তো বুঝতেই পারেনি তাঁর সন্তানদের সুন্দর ও সুস্থ্য জীবন দেয়ার জন্যেই সিফাত এমনটি করেছে। একটি মায়ের কাছ থেকে তাঁর সন্তানদের কেঁড়ে নিয়েছে। নাইনা কী তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিচার করতে পারবে তাঁর সন্তানদের মঙ্গলের জন্যই মায়ের কাছ থেকে চিরতরে কেঁড়ে নিয়েছে !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত