সম্পর্ক

সম্পর্ক

– কিরে সাইফ কি করছিস? চল ঘুরে আসি। হঠাৎ বিকেল বেলা কাইফ সাইফের রুমে এসে হাজির।
– তুই এ সময়! কি মনে করে?
– কিছু মনে করে না। হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল তাই চলে আসলাম। এ ছাড়া অনেকদিন যাবত ভাবছি তোর সাথে একটা কথা শেয়ার করব?
– কি কথা?
– চল এখানে নয় অন্য কোথাও গিয়ে বলব।
– কোথায় যাবি?
– নদীর পাড়ে।
– ঠিক আছে চল।

সাইফ ও কাইফ দুই বন্ধু। সেই ছোট বেলা থেকেই দুই বন্ধু এক সাথে থাকে। একই গ্রামে তাদের বাড়ি। ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত একই সাথে পড়াশুনা করেছে। বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করে। কলেজে উঠার পর তারা পৃথক হয়ে গেছে। কাইফ একটু বেশী মেধাবী ছিল তাই সে নরসিংদী সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে। সাইফ কম মেধাবী হওয়ায় তাকে সলিমগঞ্জ কলেজে ভর্তি হতে হয়েছে। কাইফ নরসিংদী সরকারি কলেজ হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। দুজন দুই কলেজে ভর্তি হওয়ায় তাদের মধ্যে এখন আর বেশী দেখা হয় না। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে কাইফ বাড়ীতে আসছে। বাড়ীতে এসেই বন্ধু সাইফের কথা মনে পড়ায় ছুটে আসল তাদের বাড়ীতে। এরই মাঝে কলেজ জীবনে কাইফের জীবনে ঘটে গেল এক কাহিনী। যা সাইফ জানে না। জীবনের সব ঘটনাই কাইফ সাইফের সাথে শেয়ার করেছে কিন্তু এই ঘটনাটি গোপন করেছে। কিন্তু আজ আর তা গোপন করতে পারল না। তাইতো কাইফ সাইফকে ডেকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসছে।

সাইফ ও কাইফ চরমধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছে। এ গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে মেঘনা নদী। গ্রাম থেকে ২০০ গজ সামনেই নদীর পাড়। প্রায় বিকেল বেলাই সাইফ ও কাইফ নদীর পাড়ে বসে গল্প করত।

পড়ন্ত বিকেল। এখনও সন্ধ্যা হওয়ার বেশ খানিকটা বাকী। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে বসে সূর্য ডুবার দৃশ্য দেখতে বড়ই চমৎকার লাগে। গ্রামের অসংখ্য লোক এখানে এসে বসে বিকেল বেলার গোধূলীলগ্ন উপভোগ করে। সাইফ ও কাইফ নদীর পাড় ঘেষে হাঁটছে। একটু দূরে গিয়ে তারা দুজনেই বসে পড়ল।
সাইফ বলল, কি যেন বলবি বল।
সাইফ বলল, জীবনের সব কথাই তোর সাথে শেয়ার করেছি কিন্তু একটি কথা গোপন করলাম তা আজ আর না বলে পারছি না।
– কি এমন কথা আমাকে বলিছনি।
– সেটাইতো এখন বলব।
– ঠিক আছে বল আমি শুনছি।
– কিছুদিন আগে আমার এক বড় ভাই আমাকে একটি টিউশনি ঠিক করে দিল। একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী। তারা দুই ভাই বোন। বোনটি ক্লাশ নাইনে পড়ে আর ভাইটি ক্লাশ ফাইভে পড়ে।
– ভাল কথা। টিউশনি পেয়েছিস এটা গোপন করার কি আছে? আর আজই বা হঠাৎ করে বলছিস কেন?
– আমাকে শেষ করতে দে না। পুরো কথা না শুনেই মন্তব্য করছিস কেন?
– ঠিক আছে বল তারপর কি হয়েছে?
– প্রথম দিন গেলাম তাদেরকে পড়াতে। আমি পড়ার রুমে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর ছাত্র-ছাত্রী দুজনই আসল। আমিতো ছাত্রীকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এত সুন্দর মেয়ে আমি আর কোন দিন দেখিনি। গোলাগাল চেহারা। চোখ দুটো হরিণের মতো। ঠোঁট দুটো কমলার কোয়ার মতো। গায়ের রঙ ফর্সা। এ যেন ঠিক পরীর মতো।

– গেছস টিউশনি করতে আর বর্ণনা দিচ্ছিস মেয়ের রূপের!
– আরে বোকা পুরো বর্ণনা না দিলে বুঝবি কি করে যে, মেয়েটি কেমন সুন্দর। তুইতো গাদা গ্রামে থাকিস। এত সুন্দর মেয়ে জীবনে দেখসনি। তাই বুঝবি কি?
– হয়েছে এবার বল পরে কি হলো।
– তাকে দেখেতো আর চোখ নামাতে পারছি না। কতক্ষণ যে এভাবে চেয়ে রইলাম তা বলতে পারছি না। যখন ছাত্রী আমাকে বলল, কি হল স্যার শুধু চেয়েই থাকবেন, পড়াবেন না। তখন আমার সেন্স ফিরল। আমি খুবই লজ্জা পেলাম। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। তখন জানিস সে কি বলল?
– কি বলল?
– তখন সে আমাকে বলল, স্যার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এই বয়সে এমন সুন্দরী মেয়ে দেখলে এমন হওয়া অস্বাভাবিকের কিছু নয়।
– তারপর তুই কি করলি?
– আমি আর তখন কি করব। এমনিতেই লজ্জায় মুখে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু সে আমাকে থামিয়ে দিল। তারপর কোন রকমে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। পরে তার সিলেবাস সর্ম্পকে কিছু ধারনা দিয়ে ঐদিনের মতো বিদায় নিলাম।
– তা তোর ছাত্রীর নাম কি ছিল?
– কারিনা।
– কি বললি, কারিনা! বলিউড নায়িকা কারিনা কাপুর নাকি?
– এইসব কি বলিস, কারিনা কাপুর হবে কেন?
– নাম শুনেতো তাই মনে হল।
– নামে নামে নামতো থাকতেই পারে কি বলিস?
– তা ঠিক। তা তোর ছাত্রী কারিনা কি বলিউড নায়িকা কারিনা কাপুরের মতো সুন্দরী ছিল?
– কি বলিস কারিনা কাপুর কোন সুন্দরী মেয়ে হলো নাকি? ওরাতো অভিনয় করার সময় মেকাপ করে অভিনয় করে তাই তোদের চোখে সুন্দরী মনে হয়। তাদেরকে বাস্তবে দেখলে বিশ্রী মনে হবে। আমার ছাত্রী কারিনা কাপুরের চেয়ে দ্বিগুন সুন্দরী। যা না দেখলে বুঝতে পারবি না।
– তাহলেতো একদিন দেখতে হয় সুন্দরী কারিনাকে।
– অবশ্যই দেখবি।
– তা কাইফ খান ঢালিউড নায়িকা কারিনার প্রেমে পড়েছিস কি?
– আরে সেটা বলার জন্যইতো তুকে এখানে আনলাম।
– তাহলে বলছিস না কেন?
– বলতে দিলি কৈ? তুইতো আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছিস?
– ঠিক আছে এবার বল।
– সেদিনের পর থেকে আমার হৃদয়ে স্থান পেলো কারিনা। শয়নে স্বপনে সারাক্ষণ তাকে নিয়ে ভাবতাম। মনে মনে তাকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন দেখতাম। প্রতিদিনই তাকে যখন পড়াতে যেতাম তখন পড়ার প্রতি আমার কোন মনযোগ ছিলনা। দীর্ঘ সময় ধরে তার দিকে চেয়ে থাকতাম। তাকে নিয়ে ভাবতাম। আস্তে আস্তে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলাম। তার হাতের একটু স্পর্শ পেলে শিহরিত হয়ে উঠতাম। আমার এই দুর্বলতা সে লক্ষ্য করল। একদিন কারিনা পড়া শেষে আমাকে বলল, স্যার আপনি যাবেন না। একটু বসেন। আপনার সাথে কথা আছে।

তার কথায় আমি খুব আনন্দিত হলাম। আর ভাবছি আজ হয়তো আমাকে ভালোবাসার কথা বলবে। আবার উল্টোটাও ভাবছি।
কিছুক্ষণ পর কারিনা আমার জন্য কিছু ফল ও বিস্কুট নিয়ে আসলো। আমি সেগুলো খেলাম। তারপর সে বলল, স্যার আমি কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করে দেখলাম আপনি আমার প্রতি বেশী দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এভাবে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেলেতো আমাকে পড়াতে পারবেন না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।

আমি বললাম, কি করব বল। আমি যে আর পারছি না। যেদিন থেকে আমি তোমাকে দেখছি সেদিন থেকেই আমার হৃদয়ের মনি কোঠায় তোমাকে স্থান দিয়ে রেখেছি।
– তা হতে পারে না স্যার। আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি শিক্ষক আর আমি ছাত্রী।
– তাতে কি হয়েছে? ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কি প্রেম হয় না?
– হয়। কিন্তু সমাজের চোখে সেটা খুবই খারাপ। মানুষ আমাদের নিয়ে সমালোচনা করবে।
– করুক তাতে কি আসে যায়।
– বুঝতে পারছি স্যার আপনার মধ্যে আবেগ কাজ করছে। একটু বিবেক দিয়ে চিন্তা করে দেখুন।
– তা ঠিক বলেছো কারিনা। মানুষ যখন কারো প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় তখন বিবেক লোপ পেয়ে আবেগ কাজ করে।
– বিবেককে বাদ দিয়ে আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে প্রশ্চাতে হবে স্যার।
– কিন্তু কিছু করার নেই কারিনা। আমি আনেক দিন যাবত তোমাকে আমার হৃদয়ের কথাগুলো বলবো বলে ভাবছি, কিন্তু সাহস করে বলতে পারছিলাম না। আজ যেহেতু তুমি শুরু করেছো তাই আজই আমি তোমাকে আমার হৃদয়ের কথাগুলো বলতে চাই।
– আচ্ছা আপনি কি বলতে চান বলুন।

আমি তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। হঠাৎ কারিনার দুহাত চেপে ধরে বললাম, কারিনা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
– এসব কি করছেন স্যার। ছাড়ুন আমাকে। এ হয় না। এখনও আমার প্রেমে পড়ার বয়স হয়নি।
– প্রেমে পড়ার জন্য কি নির্দিষ্ট বয়স লাগে? আমিতো মনে করি প্রেমে পড়ার জন্য কোন বয়স লাগে না। যে বয়সে একটা মেয়ে আরেকটা ছেলেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে সেটাই প্রেমে পড়ার বয়স। তুমি কি আমাকে নিয়ে ভাবনাই। সত্যি করে বলতো?
– ভাবছি।
– তাহলে কেন শুধু শুধু আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছ?
– তাছাড়া…
– তাছাড়া কি?
– আমার বাবা মা জানলে আপনাকে এ বাড়ীতে আসতে দিবে না। আর আমার কি হবে জানি না।
– সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
– কথায় আছে স্যার, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।
– আমি তোমার এত কথা শুনতে চাই না। তুমি বল আমাকে ভালোবাসো কিনা।
– যদি ভালো না বাসি তাহলে কি করবেন?
– তুমি দেখতে চাও আমি কি করতে পারি?
– জীবন দিবেন?
– তুমি কি তাই চাও?
– আমি চাই না আমার জন্য আপনি জীবন দেন? কিন্তু এ পৃথিবীতে ক’জন আছে একজন আরেক জনের জন্য জীবন দেয়।
– অনেক উদাহরণ আছে।
– তাছাড়া আমার মাঝে কি এমন পেলেন যে, প্রথম দেখাতেই আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। যার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত?
– যা অন্যের কাছ থেকে পাইনি, তা তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।
– আচ্ছা স্যার এসব কথা বাদ দেন। যা সম্ভব নয় তা নিয়ে কল্পনা করবেন না। আমি যাচ্ছি বলেই কারিনা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো।
– এই শোন একটা সমাধান দিয়ে যাও।
– স্যার আমাকে একটু ভাবতে দিন।
– ঠিক আছে তোমাকে আমি তিন দিনের সময় দিলাম।
এই বলেই কাইফ থামল। সাইফ বলল, তিনদিন পর কি হলো?
– পর পর দুদিন আমি আর কারিনাকে পড়াতে যাইনি। তাকে ভাবার সময় দিলাম। তৃতীয় দিন আমি গেলাম। দেখলাম তার মনটা খুবই ভালো। খুব সেজে গুজে আমার সামনে এসেছে। পড়া শেষে তার ভাই যখন চলে গেল তখন আমি বললাম, ভেবেছো কিছু?
কারিনা মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ ভেবেছি।
– তাহলে বলো।
– কি বলব?
– তোমার মনের কথা।
– শুনতে চান আমার মনের কথা?
– হ্যাঁ শুনতে চাই। আজ প্রায় এক মাস যাবত তোমার মনের কথা শুনার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছি। বল আমার যে আর তর সইছে না।
– আমার যে লজ্জা করছে।
– লজ্জা কিসের?
– এখন বলব না।
– কখন বলবে?
– রাতে।
– রাতে! রাতে কিভাবে বলবে?
– কেন? মোবাইলে।
– তোমার মোবাইল আছে?
– হ্যাঁ।
– তাতো আগে বলনি।
– দরকার মনে করিনি, তাই বলিনি।
– তাহলে মোবাইল নম্বর দাও।
পরে কারিনা আমাকে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে সর্তক করে দিল আপনি আমাকে ফোন দিবেন না। আমি আপনাকে রাত বারটার পর ফোন দিব। আপনি অপেক্ষায় থাকবেন।
আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন রাত ১২টা বাজবে। একবার ইচ্ছে করছিল আমি ফোন দেই আবার ভাবছি না ও যেহেতু ফোন দিবে অপেক্ষায় থাকি। মনটা ছটফট করছে কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কখন আমার মনের ময়না আমাকে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। অপেক্ষার প্রহর শেষ। রাত এখন বারোটা বাজে।
কারিনা ফোন দিল। আমি রিসিভ করলাম।
– হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি কণ্ঠ। স্যার আমি কারিনা।
– কেমন আছ?
– ভালো না।
– কি হয়েছে? মন খারাপ?
– না।
– জ্বর?
– না।
– মাথা ব্যথা?
– না। তবে অন্য কিছু হয়েছে।
– আহা বলনা কি হয়েছে?
– প্রেম রোগ। যে রুগের ঔষুধ আপনার কাছে আছে। আপনি সেই ঔষুধ দিলে আমি ভালো হয়ে যাব।
কাইফ বলল, খুব রসিকতো মেয়েটি।
সাইফ বলল, তার এই কথা শুনে আমি তখন হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।
– তারপর তুই কি বললি?
– আমি বললাম, ঠিক আছে। আমার কাছে চলে আস ঔষধ দিয়ে দিব।
কারিনা বলল, না কাছে আসতে হবে না। মোবাইলে দিলেই চলবে।
– আগে বল তোমার মনের কথা তারপর দেখি কি করা যায়?
– ঠিক আছে বলছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।
– আপনাকে নয় বল ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
– আমি তোমাকে ভালোবাসি।

তারপর সেদিন সারারাত তার সাথে কথা বললাম। ভোর পাঁচটায় ঘুমাতে গেলাম। এর পর থেকে প্রতিদিন তাকে কল দেই। প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত কথা হয়। যতই দিন যাচ্ছে ততই আমাদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।
কাইফের প্রেমের গল্পটা অনেকদিন পর বন্ধু সাইফকে বলতে পেরে তার মনটা হালকা হলো। এবার বলল, দোস্ত উঠ, সন্ধ্যা হয়ে গেল। আজ আর নয়।

সাইফ বলল, খুব মজা পেলাম। অরেকদিন বাকী গল্প শুনব। এই বলেই দুজন নদীর তীর ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী চলে আসল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত