(১)
তাকে প্রথম দেখি শাহবাগেই, অন্য অনেকের মতোই। আমি তখন একটা আউটসোর্সিং ফার্মে কাজ করতাম; আমাদের মাঝে মাঝে নাইট শিফট করতে হতো, যেহেতু আমাদের ক্লায়েন্টগুলো সব ছিলো পশ্চিমা দেশগুলোর। আমি সারারাত, রাত ১১টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত কাজ করলাম। তখন আমার হাতে টাকা পয়সা ছিলনা বললেই চলে; আর ঐদিনই আমাদের সেলারী দেওয়ার কথা ছিল; তাই আমি বাসায় না গিয়ে রাত পর্যন্ত অফিসে ঘুমিয়ে আর বাইরে ঘুরে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
সকাল ৯ টার দিকে আমি হাটতে হাঁটতে শাহবাগ গেলাম। ঘটনাক্রমে ঐদিনই ছিল যুদ্ধাপরাধী কামরুজ্জামানের রায় ঘোষণার দিন। শাহবাগে আসা-যাওয়া করা অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। তাই সময়টা কাটাতে আমি ঐদিন শাহবাগে স্লোগান দিতে আসা গনজাগরণমঞ্চের ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশে গেলাম; উদ্দেশ্য এটাও ছিল – দেখি স্লোগান দিতে কেমন লাগে!
আমি শাহবাগ মোড়ে গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েদের সাথেই বসে গেলাম। আমার বাম পাশেই বসেছিল মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধন ভাই। আর সামনে ছিল স্লোগান কন্যারা; তারা মাঝে মাঝেই স্লোগান দিয়ে জমায়েতটাকে উজ্জীবিত রাখার কাজ করে আসছিল।
সেখানেই আমার/আমাদের পিচ্চি বোনটাকে প্রথম দেখি। পরনে তার ছিল কালো জিনসের প্যান্ট, সবুজ রঙের শর্ট কামিজ, আর তার উপরে ছিল কাল রঙের একটা কটি। দেখে বয়স আন্দাজ করা ছিল কঠিন; তবে মনে হল ১৮-১৯-এর বেশী নয়। তখনো তার মধ্যে একটা টিনএজ মেয়ের মুখচ্ছবিই দেখতে পেয়েছিলাম। দেখে মনে হল ভার্সিটির ফাস্ট ইয়ারে পড়ে। সেও স্লোগান দিতে আরম্ভ করলো। কচি একটা মুখ; কিন্তু তার মধ্যে একটা ঝাঝালো ভাব তখনই আবিস্কার করলাম। তার দেওয়া কিছু স্লোগান ছিল বেশ মজাদার, যেমনঃ “ আয়-ছেলেরা, আয় মেয়েরা শাহবাগে যাই, ফুলের মালে গলায় দিয়ে দেশটাকে সাজাই”। শুনে আমার বেশ মজাই লাগলো। আমার সময়টা ওদের মধ্যে ভালই কেটে যাচ্ছিল।
(২)
এরপরে তাকে আবারও দেখি প্রায় একই জায়গায়; প্রেক্ষাপটও প্রায় এক। সেদিন আরেক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের রায় ঘোষণা করা হল। গোলাম আযমের ফাসির রায় না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই গনজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েরা বেশ উত্তেজিত ছিল। তারা শাহবাগের রাস্তা ব্লক করে ওখানেই হ্যান্ড মাইক নিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করে। ওখানেই ওকে দ্বিতীয়বারের মতো দেখলাম। তখন ছিল গরমের দিন; কাঠ ফাটা রোদ। ওর মধ্যেই ওকে দেখলাম — ও প্রচন্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে গলার রগ ফুলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে।
শাহবাগ আন্দোলন বা গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি বাড়তি ফ্যাসিনেশন আমার কোনকালেই ছিলনা। কিন্তু ঐ অবস্থায় দুপুরের রোদে ওকে ঘেমে-নেয়ে স্লোগান দিতে দেখে কেমন জানি একটা মায়া পড়ে গেল মেয়েটার প্রতি। এরপর ফেসবুকে মেয়েটাকে অনেক খুঁজলাম। কিছুদিন পরে আমার বন্ধু নীলয় নীলের প্রোফাইলের এক ছবিতে ওকে ট্যাগ করা দেখলাম; রিকুয়েস্ট পাঠালাম। বেশ কিছুদিন রিকুয়েস্টের কোন জবাব পাইনি। তারপর একদিন পিচ্চি আপুটা আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলো। আর আমি ওকে বেশী করে জানার সুযোগ পেলাম।
ও ততদিনে ভাল একজন আন্দোলনকারী হিসেবে বাংলাদেশের সেক্যুলার, বাম ও শাহবাগের লোকজনের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। ওর কিছু ছবি আমি ফেসবুকে ও অনলাইনের বিভিন্ন জায়গায় পেলাম, যেখানে দেখলাম ও পুলিশ আর র্যা বের সাথে চিল্লাচিল্লি করতেছে; কোথাও বা তাদের সাথে আঙ্গুল উচিয়ে কথা বলছে; আবার কোথাও দেখলাম পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠাচ্ছে। ছবিগুলো দেখে আমার এতই ভাল লাগলো যে আমি এইসব ছবিগুলো নিয়ে আমার প্রোফাইলে একটা এলবাম তৈরী করলাম। সেখানে তার নাম দিয়ে এলবামের শিরোনাম দিয়ে উপ-শিরোনামে লিখলাম ‘আমাদের তেজস্বিনী’।
সেই এলবামটা সম্ভবত ওর চোখে পড়েছিল। সেটা বুঝেছিলাম কয়েকদিন পর ছাত্র ইউনিয়নের এক সেমিনারে সে যখন আমাকে ইনভাইট করলো তখন; সে আমাকে ফেসবুকে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। আমি প্রতিউত্তরে বললাম, “আমার পিচ্চি আপুটা আমাকে ইনভাইট করেছে, আমি অবশ্যই আসবো”। ও তখন হেসে প্রতিউত্তর দিলো। তার মোবাইল নাম্বার আমার ইনবক্সে দিয়ে বলল যে, “ভাইয়া, আসলে আমাকে ফোন দিবেন”।
(৩)
আমি ঐদিন ঠিকই সেইদিন ছাত্র ইউনিয়নের ঐ প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলাম। আমি গেট দিয়ে ঢুকেই দেখলাম পিচ্চি পরীটা একটা কাল জিন্স, আর সবুজ কামিজ পরে সামনের সারিতেই বসে আছে। আমি ধীরে সুস্থে গিয়ে পিছনে বসলাম; ওর থেকে কয়েক সারী পিছনে। আমি লক্ষ্য করলাম ও বারবার সেমিনার রুমে প্রবেশ দরজার দিকে তাকিচ্ছিলো; হয়তো হতে পারে সে আমি আসি কিনা সেটা দেখছিল, অথবা ওর অন্য অনেকেই আমন্ত্রিত হয়তো ছিল, যারা আসছে কিনা সেটা দেখার জন্য বারবার সে প্রবেশ দরজার দিকে তাকাচ্ছিল।
কিন্তু, আমি অনেকটাই অফিস ফাকি দিয়েই এসেছিলাম; তাই বেশীক্ষণ থাকতে পারিনি। আমি একটু পর সেখান থেকে চলে এলাম।
আমার উদ্দেশ্য ছিল ওর আমন্ত্রণ রক্ষা করে অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণের জন্য আশা। তারপর মোবাইলে ওকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয়া যে অফিসের কাজের জন্য আমি সেখানে বেশীক্ষন স্টে করতে পারিনি। আমি তাই করলাম। প্রতিউত্তরে ও আমাকে মেসেজে রিপ্লাই দিল, “আপনি এসেছেন জেনে খুশি হলাম। কিন্তু দেখা করলেন না কেন? রাগ করলাম”। আমি রিপ্লাই দিলাম, “ওরে বাবা, আমার পিচ্চি আপুটা দেখি রাগ করেছে! এখন বলো, তোমার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আমি করতে পারি”। আমি দেখলাম ও আর মেসেজের রিপ্লাই দিলনা।
(৪)
আমি মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করতে ভালবাসি। আর একটা ছেলে আর একটা মেয়ের সম্পর্ককে আমি কখনোই প্রবৃত্তিগত আকর্ষণ দিয়ে বিবেচনা করিনা। আশা ছিল ওর সাথে একটা ভাল সম্পর্ক তৈরী করতে পারবো। ওকে সত্যিকার অর্থে আমার একটা ছোট বোন হিসেবে পাব। আমার সেই ইচ্ছে অবশ্য পূর্ণ হয়নি। আমি এরপর ওর সাথে শাহবাগে দেখা করার জন্য একবার ফোন দিয়েছিলাম। ও জানিয়ে দিল ও আজ শাহবাগে আসবেনা। আমি কয়েকদিন পর আবার ওকে ফোন দিলাম। ও বললো, এখন শাহবাগে আসবেনা। আসলে কয়েক ঘন্টা পরে আসবে। আমি কয়েক ঘন্টা পর আবার ফোন দিলাম। দেখলাম ও ফোন ধরলোনা। এভাবে আরও বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম। ও ধরলোনা। বুঝলাম ও আমাকে এভয়েড করতে চাইছে। তবু, আমি জেদ থেকে আমার বন্ধু আরিফের ফোন থেকে ওকে কল দিলাম। ও ফোন ধরে আমাকে জানালো, “আমি এখন শাহবাগে আসবোনা”। আমিও আর তাই ওকে না ঘাটিয়ে বললাম, “ঠিক আছে সমস্যা নেই। আশা করি পরি কোন এক সময়ে আপনার সাথে আমার দেখা হবে”। এই কথা বলে কথা শেষ করলাম।
বিষয়টাতে আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। আমি জাস্ট এক বড় ভাই হিসেবে ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, ও বিষয়টাকে দেখলাম গুরুত্বই দেয়নি। এতে বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম; এরপর আর ওর সাথে দেখা করার জন্য চেস্টা করিনি। তবে, ওর ফেসবুক প্রোফাইলে ওকে সবসময় লাইক আর কমেন্ট দিয়ে যেতাম। যখন আমি ফেসবুকে ওর প্রোফাইলে ওর ছবি দেখতাম, মনে হত ও যেন আমার নিজেরই একটা ছোট বোন। ফেসবুকে বেশ কয়েকজন আদরের ছোট বোন আছে আমার, যারা আমার সাথে বেশ আল্লাদ করে। আশা ছিল ওর সাথে এমনই একটা সম্পর্ক বিল্ড আপ করতে পারবো; কিন্তু সেটা পারিনি।
এরপর ওকে আবার দেখলাম টিএসসির সামনে গত বছরের ফেব্রুয়ারীতে; রোদেলা প্রকাশনীকে বইমেলা থেকে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু সেকুল্যার তরুণ আর লেখক মানববন্ধনের আয়োজন করেছিল। সেখানে আমিও ছিলাম; তবে ক্যামেরার সামনে পড়তে না চেয়ে আমি ছিলাম ঠিক তার বিপরীত দিকে। ওখানে আবার আমার পিচ্চি বোনটাকে দেখলাম। ওর পরনে ছিলো কালো জিন্স, সবুজ ফতুয়া আর তার উপরে একটা জ্যাকেট টাইপের কিছু। ওর সাথে বেশ কিছুক্ষণ চোখাচোখি হল আমার। আমার ধারণা ছিলো, ও আমার সাথে ফেসবুক আর মোবাইলে কথা বললেও সামনাসামনি সে আমাকে চেনেনি। আসলেই তাই। আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও মনে হল মজা পেয়েছে। মজার একটা মৃদু হাসি ফুতে উঠল ওর ঠোঁটে।
পরে ওকে আবার পেলাম সেই ফেব্রুয়ারীতেই। ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিত রায়কে হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের ওখানে যে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল, সেখানে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। ওখানে সবাই স্লোগান তুলে প্রতিবাদ সমাবেশের সাথে তাদের একাত্মতা জানাচ্ছিলো।আমার ঠিক বামদিকে ও মাটিতে বসে ছিলো। সেই অবস্থাতেই ও স্লোগান তুললো, ‘জামাত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’। ওর পরনে ছিলো একটা গ্যাভার্ডিনের আটোসাটো প্যান্ট আর কাল একটা টি-শার্ট। ও-ওর ছোট্ট হাত দুটো তুলে স্লোগান দিচ্ছিল; বিষয়টাতে আমার বেশ মজা লাগলো।
পরে আবার ওর সাথে দেখা ৮ই মার্চ, বিশ্ব নারী দিবসের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছিল শাহবাগে, সেখানেই ওকে আবারও দেখলাম। লাল একটা স্কার্ট পরেছিলো ও। ওকে খুব কিউট লাগছিল ঐ ড্রেসে। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে বারবার বেশ কয়েকবার ওকে দেখলাম। সেও বিষয়টা লক্ষ্য করলো বেশ কয়েকবার আমার দিকে তাকিয়ে। তখন ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু দেখলাম ও এক মহিলার সাথে আলাপে ব্যস্ত। আমিও তখন আমার পথে রওয়ানা হলাম।
এরপর ওকে দেখলাম আবার মে মাসের দিকে। পহেলা বৈশাখে নারী নিপিড়ণের বিরুদ্ধে একটা কনসার্ট আয়োজন করেছিলো ছাত্র মৈত্রী। আমি ফেসবুকে কনসার্টের সম্মন্ধে খবর পেয়ে ওকে একটা ফোন দিলাম, কারণ পরদিন ছাত্র ইউনিয়নের আয়োজনে আরেকটা কনসার্ট অনুষ্ঠিত হতে যাছিলো। তাই আমি কনফিউজড ছিলাম যে, কনসার্টটা আলাদা, নাকি একই কনসার্ট ছিলো। বিষয়টা ক্লিয়ার হতেই ওকে ফোন দিয়েছিলাম। ও বললো, হ্যা, কনসার্ট আজকেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তাহলে যে আগামীকালের তারিখ দেয়া হয়েছে। ও বললো, আগামীকাল আরেকটা কনসার্ট।
আমি ফোনে অবশ্য আমার পরিচয় দেইনি। জাস্ট জানার উদ্দেশ্য ছিল কনসার্ট এখনই হচ্ছে কিনা, সেটা। আমি জলদি তখন সাইবার ক্যাফে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে রওয়ানা দিলাম।
ওখানে গিয়ে দেখি তাহসানের গান চলছে। আমি সবসময় সামনের দিকেই থাকতে পছন্দ করি। তাই, মনচের একেবারে সামনের দিকের সারিতে গিয়েই দাঁড়িয়ে কনসার্ট উপভোগ করতে লাগলাম। ওমা, একটু পরে দেখি আমার পিচচি বোনটা মনচে আসলো। দেখলাম ওই উপস্থাপিকা। সেই সময় ওর পরনে ছিলো একটা আটোসাটো কালো গ্যাভার্ডিনের প্যান্ট। আর খুব সুন্দর একটা ঝালর দেয়া জামা পরেছিলো ও, সবুজ রঙের। ওই ড্রেসআপে ওকে যেন একটা পরীর বাচচার মতই সুন্দর লাগছিল। আমি আমার পিচচি বোনটাকে দেখতে লাগলাম। মনচে দাঁড়িয়ে ও কথা বলছিলো; হঠাত দেখি ওর নজর আমার উপর পড়লো। আমাকে দেখা মাত্রই ও এমন একটা ভাব করলো, যে ভাবটা পিছনে লেগে থাকা কোন ছেলেকে দেখলে কোন মেয়ে করে থাকে। বুঝলাম ও আমাকে অন্যরকম কিছু ভাবছে। হয়তো শাহবাগে আমাদের আগের কয়েকবারের দর্শনের কারণে আমার চেহারাটা ওর হয়তো মনে ছিল। কিন্তু যে ছেলেটাকে ও ছাত্র ইউনিয়নের এক প্রোগ্রামে ইনভাইট করেছিল, যে ছেলেটা ওর সাথে ফেসবুকে কানেক্টেড, সেই ছেলেটার সাথেই যে শাহবাগে ওর মাঝেমাঝে ওর চোখাচোখি হত, সেটা সে হয়তো বুঝতে পারেনি। আর সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের সামনাসামনি কোনদিন কথা হয়নি।
(৫)
ঐ ছিল ওর সাথে আমার সামনাসামনি শেষ দেখা। এরপর বাংলাদেশে পরিস্থিতি ছিল বেশ খানিকটা ভিন্ন। ধর্ম-নিরপেক্ষ কিছু লেখককে হত্যা করা হলো। আমার ‘ছোট্ট বোনটা’ও ফেসবুকে মাঝেমাঝেই ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে লিখতো, সেগুলোর সমালোচনা করতো। তার পাশাপাশি ও’তো ছিল গণজাগরণ মনচের একজন সক্রিয় কর্মী। এইসব কারণে তাকে উগ্রবাদীরা মাঝেমধ্যেই ফেসবুকে আর ফোনে হুমকী দিত। একদিন নাকি ওকে দুটো ছেলে ওর বাসা থেকেই বেশ খানিকটা ফলো করতে করতে গিয়েছিলো। ও সেইদিনই থানায় জিডি করলো নিজের নিরাপত্তা চেয়ে। বেশ কিছু ব্লগার ও মুক্তচিন্তার লেখক খুন হওয়ায় পুলিশ প্রশাসনও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলো। এই কারণে ওর বাসার সামনে কয়েকজন পুলিশ পাহারা দিতো; আর যেখানে-যেতো, সেখানেই সাথে দুই-একজন পুলিশ থাকতো। কিন্তু, এভাবে দেশে থাকাটাকে তার কাছে সমাধান বলে মনে হয়নি। তাই, একসময় ফেসবুকেই খবর পেলাম সে জার্মানী পাড়ি জমিয়েছে।
কি কারণে ও বিদেশ গেছে, সেটা ওই ভাল জানে।সে হয়তো সত্যি বিপদের মধ্যে ছিলো; বিদেশ পাড়ি জমানোটাকেই তার কাছে হয়তো সমাধান বলে মনে হয়েছে। কিন্তু, ওর বিদেশ পাড়ি জমানোর খবরটা শুনে আমার মনটা একটু হলেও বিষন্ন হয়ে উঠলো। আগে শাহবাগে গেলে মাঝে মাঝে ওকে দেখতাম। এভাবে ও দেশে থাকলে হয়তো ওর সাথে আবারও দেখা হতো; একদিন হয়তো ওর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হতাম। ওর প্রতি আমার মমতার কিছু অংশ হয়তো প্রকাশ করতে পারতাম কিন্তু, এখন সেটাও একটু কঠিন হয়ে গেল।
আমার নিজের কোন ছোট বোন নেই। কিন্তু, কয়েকজন পাতানো ছোট বোন আছে, যাদেরকে আমি সত্যিই অনেক স্নেহ করি, ভালবাসি। তাদের অনেকেই আমার সাথে ফেসবুকে যথেষ্ট আহ্লাদ করে। আমি তাদেরকে মাঝে মাঝেই বলি, ‘কিরে, আউলা চুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? আয় বাবু, তোর চুলটা বেধে দিই’। দেখা হলে হয়তো এটা-ওটা কিনে খাওয়াই।
যদিও ও’হয়তো ওর প্রতি আমার মমতাটা কখনোই বুঝতে পারেনি; ভবিষ্যতে বুঝতে পারবে কিনা, তাও জানিনা। ও মোটামুটি টাকাওয়ালা ফ্যামিলীর মেয়ে যাকে বলে উচচ মধ্যবিত্ত। ওর জীবন হয়তো সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ। জীবনে ওর হয়তো কোন কিছুরই স্বল্পতা বা অপ্রাপ্তি নেই। যাদের জীবনে অপ্রাপ্তি বা সংগ্রাম তেমন একটা নেই, তারা তাদের ভিতরে হয়তো মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার প্রবণতা একটু কম থাকে। পক্ষান্তরে, যাদের জীবনে কিছুটা অপ্রাপ্তির হাহাকার থাকে বা অপূর্ণতা থাকে, তারা মানুষকে সহজেই আপন করে নিতে পারে, কেউ তাদেরকে ভালবাসলে সেটা ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমন, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদকে ফেসবুকে একটা জায়গায় ‘মা’ বলে সম্মোধন করেছিলাম। উনি রিপ্লাই দিয়েছিলেন, ‘ওরে জানপাখি’ বলে। যদিও শাওন মাহমুদের সাথেও আমার এখনো সামনাসামনি কখনো দেখাই হয়নি।এরকম সবাই পারেনা। তবে, যাই হোক, আমার ছোট্ট বোনটির প্রতি আমার ভালবাসা আর মমতা সবসময়ই থাকবে। যদি ও কখনো আবার বাংলাদেশে আসে, যদি আমাদের দেখা হয়, তাহলে বেশী কিছুনা, কেবল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চাই, আর যদি সম্ভব হয়, শাহবাগে বা টিএসসিতে দাঁড়িয়ে কোন কিছু একসাথে খাওয়ার সুযোগ হলে খাবারের একটা লোকমা ওর মুখে তুলে দিতে চাই। ব্যাস এইটুকুই। কারণ, সে আমার ছোট বোন, বড় আদরের …!