সে কথা

সে কথা

ছোটবাবু আপনাকে আপনার পিসিমনি ডেকেছেন। মামুন অনেকটা খুশি হয়ে বললেন, পিসি, কখন আসলেন উনি? আচ্ছা রহিম চাচা, আপনি কেমন মানুষ বলুন তো? পিসি এসেছে আর আপনি আমাকে বলবেন না? রহিম চাচা বললেন, এইমাত্র এসেছেন উনি। এসেই আপনার খোঁজ করলেন উনি। মামুন আর কিছু না বলে বসার ঘরে চলে গেলেন। পিসিমনিকে দেখেই পায়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরল মামুন। মামুনের পিসিমনিও অনেক আদরে জড়িয়ে নিল মামুনকে। মামুন বলল, কেমন আছো পিসিমনি? পিসিমনি মুখটা উজ্জল করে বললেন, এইতো আছি। তুই কেমন আছিস? আমাকে তো ভুলেই গেছিস তুই? কতদিন হল একটু দেখতেও যাস না।

মামুন অনেকটা হেসে বলল, তোমাকে কি ভোলা সম্ভব? আজকাল মহল সংস্কারের কাজ চলতেছে তাই ওখানে একটু দেখাশোনার জন্য কোথাও যেতে পারিনি। কাজ প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু তুমি তো আসতে পারতে। তুমি কেন আসনি হুম? পিসিমনি এবার মুচকি হেসে বলল, এইতো এসেছি আমি। আচ্ছা তোকে একটা কথা বলবো, রাখবি? মামুন বলল, বিয়ে বাদ দিয়ে অন্য যে কোন ব্যাপারে বলতে পারো। পিসিমনি এবার একটু চুপ থেকে বলতে লাগলো, তোর বাবাকে আমি বলেছিলাম তোকে যেন বাইরে না পাঠায়। বাইরে পাঠিয়েই তুই কি থেকে কেমন যেন হয়ে গেলি। আমার তো কোন কথাই শুনিস না। বংশের কি কোন স্মৃতি রাখবি না তুই? এসব শুনতে শুনতে মামুন ওর পিসিমনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি যে আর কারও হতে পারবো না পিসি। এটা তোমাকে অনেকবার বলেছি কিন্তু তুমি বুঝছোই না। আমি এখানে একা আছি, আছে কিছু লোকজন, আর শুধু তুমি। তাছাড়া আর যারা আছে এরা শুধুই আমাদের এই প্রতিপত্তির জন্য। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কাছের মানুষদের জন্য কিছু করে বাকি সব আমি অসহায় দুস্থদের সাহায্যের জন্য বিলিয়ে দেবো। আশা করছি তুমি এতে কোন দ্বিমত করবে না। পিসিমনি কিছু না বলে মামুনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। বললেন, তোর কি হয়েছে আমায় বল। কত ইচ্ছে ছিল যে তোর বিয়ে অনেক ধুমধাম করে দিব। কিন্তু কি এমন হল যে তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না। মামুন কিছু বলল না।

পিসিমনি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। একসময় পরে পিসিমনি ওকে বলে, আজ কি খাবি বল? আজ আমি তোর জন্য রান্না করব। মামুন অনেকটা হেসে বলল, এ বয়সে এখনও কি পারবে এসব তুমি? পিসিমনি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, পারবো না মানে। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি নাকি? মামুন এসব শুনে হেসেই চলেছে। হাসতেই হাসতেই ও বলল, আচ্ছা তবে মাছের মুড়িঘন্টো করতে পারবে? অনেকদিন খাইনা তোমার হাতের মুড়িঘন্টো। পিসিমনি এবার হেসে ফেললেন। বললেন, আচ্ছা রহিমকে পাঠিয়ে দে পুকুর থেকে বড় কিছু মাছ ধরতে। মামুন উঠে বলল, তুমি একটু বিশ্রাম করো আমি রহিম চাচাকে বলে দিচ্ছি। এটা বলেই মামুন রহিম চাচার খোজে বেরিয়ে পরলেন। রহিম চাচা এই বাড়ির দেখাশোনা করে অনেক আগে থেকেই। মামুন এই বাড়ির একমাত্র ছেলে। ওর দাদু ইংরেজদের সময় জমিদার ছিলেন। জমিদারী ছেড়ে তারা সাধারন জিবন শুরু করলেও তখনও নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছেন তারা। ওর দাদু যখন মারা যান তখন মামুনের বাবা এসবের দায়িত্ব নেন। রহিম চাচা তখন থেকেই এবাড়ির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। রহিম চাচা মামুনের বাবাকে বড়বাবু আর ছোঠ মামুনকে ছোঠ থেকেই ছোটবাবু বলে ডাকতেন। মামুনও কখনও রহিম চাচাকে অসম্মান করেনি। ছোট থেকেই চাচা বলেই ডেকেছেন তাকে। মামুন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তখন মামুনের বাবা মারা যায়। মামুন তখন অনেক একা। একটা বিদ্ধস্ত জিবন যেন তার সাথে লেগে যায়। তখন তার পিসিমনি তাকে আগলে রাখে। আর এজন্যই মামুন তার পিসিকে এতটা ভালবাসে।

রহিম চাচাকে বাড়ির কোথাও পেল না মামুন। বাড়ির অন্য যারা কাজের লোক আছে তারা বলল, উনি নাকি মহলের দিকে গেছেন। মামুনের দাদু মারা যাওয়ার ওর বাবা মহল ছেড়ে এই বাড়িতে এসে থাকেন। বাড়িটাও অনেক বড়। মামুন উঠোনের সামনে ইজি চেয়ারে এসে বসলেন। খানিক বাদে রহিম চাচা অনেক হাপিয়ে এসে বললেন, ছোটবাবু আমাকে নাকি খুজছিলেন? মামুন রহিম চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, কই ছিলেন আপনি? আজ নাকি পিসি রান্না করবে তাই পুকুর থেকে বড় কিছু মাছ ধরার ব্যবস্থা করেন। আর রান্নার সব সরঞ্জামাদি যেন তৈরী থাকে, পিসির যেন বেশি কষ্ট না হয় এদিকে খেয়াল রাখবেন। রহিম চাচা বললেন, যেমনটা বলেছেন ছোটবাবু। এটা বলেও রহিম চাচা দাড়িয়ে থাকলেন। মামুন এটা দেখে বললেন, কিছু বলবেন কি? একটু ইতস্ততঃ হয়ে রহিম চাচা বললেন, আসলে একটা সমস্যা হইছে ছোটবাবু। মহলের তো কাজ এখনও শেষ হয় নাই। কিন্তু শহর থেকে এক আপামনি এসেছে মহলের কিছু ছবি তুলবেন বলে। আমি বললাম যে কিছুদিনের জন্য মহলে সবার যাওয়া নিষেধ। মহল সংস্কারের কাজ চলছে তাই। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা । বলছেন যে খবরের কাগজের একটা প্রতিবেদনে এই মহল সম্পর্কে কিছু লিখবেন বলেই অনেক দুর থেকে এসেছেন। মামুন এবার একটু উঠে দাড়ালো।

খবরের কাগজে কাজ করতো এমন একজনকে জানে সে। জানে বলে কি অনেক ভালভাবে জানে। তার অনেক ইচ্ছে ছিল এসব পুরনো ঐতিহ্যবাহী সব কিছুকে একে একে তার প্রতিবেদনে সাজাবে। সেই আবার এলো না তো? মামুনের মনে অনেক প্রশ্ন। রহিম চাচাকে সঙ্গে নিয়ে মামুন তখনই মহলের দিকে যেতে লাগলো। মহলে পৌছে দেখলো সাদা রং এর এক গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে এক মহিলা দাড়িয়ে আছেন। তার পরেই তার ক্যামেরার জন্য আরও একজন মেয়ে আর একজন ছেলে। পেছন থেকে দেখে মহিলাকে খুব একটা বোঝা গেলো না তাই সামনে গিয়ে দাড়ালো। মামুন তখন হতভম্ব হয়ে আছে। যাকে ভেবেছিল সেই এসেছে। রুবি। এখনও আগের মতই আছে শুধু একটু মুটিয়ে গেছে। তারপরও তাকে আগের মতই সুন্দর লাগছে। চশমার ফ্রেমটা আগের থেকে একটু মোটা হয়েছে। বয়স হয়েছে এটা ওকে দেখেই বুঝতে পারলো মামুন। হঠাৎ রুবি বলে উঠলো, কই আপনাদের এই মহলের দায়িত্বে কে আছে? আমি উনার সাথে কথা বলব। মামুন কি বলবে ভেবে পেল না। শুধু ভাবছে, সেকি আমাকে চিনতে পারেনি? তখনি রুবি আবারও বলল, কি হল কথা বলছেন না কেন? মামুন একটু মুখে হাসি এনে বলল, জি আপনারা আপনাদের কাজ করুন। সমস্যা নেই। ভেতরে কাজ চলছে তাই আপনাদের জন্য দুজন লোক দিচ্ছি। তারা আপনাদের কাজে সাহায্য করবে। তবে সাবধানে কাজ করবেন। এটা শুনে রুবি শুষ্ক একটা ধন্যবাদ দিয়ে মহলের দিকে যেতে লাগলো কিন্তু তখনি ফিরে এসে বলল, আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মামুন মৃদু হেসে চলে আসলো। দুজন লোক তাদের সবকিছু বলছে।

মামুন মহল থেকে বাড়িতে আসলো। তার রুমে যেয়ে পুরনো ডায়রীটা খুলে আবারও বসলো। কত বিচিত্র সেই ডায়রীর লিখাগুলো। শুধু কথাগুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই। নামবিহিন এই ডায়রীর লিখাগুলো কারও জন্য তীব্র এক অনুভুতি। কিন্তু সেই চরিত্রটিও নামবিহিন। ডায়রীটা বসার ঘরে ভুলে টি টেবিলের ওপর রেখেই বাইরে এসে রহিম চাচাকে ডেকে রুবি এবং তার দলকে দুপুরের খাওয়ারটা বাড়িতেই খাওয়ার নিমন্ত্রন জানানোর জন্য পাঠালেন। রহিম চাচা মহলে গিয়ে রুবি এবং তার দলের পেছনে গিয়ে আপামনি বলে ডাকলেন। রুবি পেছনে ফিরে তাকালো। রহিম চাচা বললেন, ছোটবাবু আপনাদের দুপুরে বড়বাড়িতে নিমন্ত্রন করেছেন। রুবি একটু অবাক হয়ে বলল, আপনাদের ছোটবাবুকে তো দেখলাম না। রহিম চাচা একটু বেঘাত সুরে বললেন, কিছুক্ষন আগেই তো উনিই আপনাদের মহল ঘুরে দেখার জন্য অনুমতি দিলেন। রুবি আবারও অবাক হয়। মাথাটা একটু নিচে করে বলল, আমি জানতাম না যে উনি আপনাদের ছোটবাবু। রহিম চাচা বললেন, তাহলে আপনারা আসছেন তো? রুবি এবার মুখ উঠিয়ে বলল, জি অবশ্যই। অন্তত উনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য হলেও। রহিম চাচা উনাদের সময়মত নিয়ে আসার জন্য বাকি দুজন লোককে বলে দিলেন।

মাছ ধরা হলে মামুনের পিসিমনি রান্নার কাজে হাত দিলেন। বাড়িতে কেন যেন আজ এক আয়োজনের আমেজ পরেছে। পিসিমনি বাড়ির সব রান্নার কাজের লোকদের সব কিছু শিখিয়ে দিচ্ছেন। দুপুর হতে হতেই রুবি এবং তার দল বড়বাড়িতে চলে এলো। তাদের বসার ঘরে বসতে দেওয়া হল। রহিম চাচা এসে তাদের বললেন, আপনারা একটু বসুন। একটু পরেই খাওয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। রুবি মৃদু হেসে সম্মতি জানালো। একটু পরেই তাদের খাওয়ার টেবিলে নিয়ে আসা হল। হরেক রকমের খাওয়ার আয়োজন। তবে মাছের মুড়িভর্তাটাই তার কাছে বেশি পছন্দ হল। খাওয়ার সময় রহিম চাচাকে রুবি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে যে আপনাদের ছোটবাবু কোথায়? উনাকে ছাড়াই খাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এর মাঝেই আবার মামুনের পিসিমনি এসে দুবার তাদের দেখে গেছেন। খেতে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করেছেন। রহিম চাচা মৃদু হেসে রুবিকে বলল, আপনারা খাওয়া শেষে বিশ্রাম করুন। ছোটবাবু বাইরে গেছেন, একটু পরেই ফিরবেন। রুবি অনেকদিন পর গ্রাম্য আমেজের খাওয়া পেয়ে অস্বস্তি সত্যেও মোটামুটি ভালই খাওয়া করলো। এরপর তারা বসার ঘরে বসে আছেন। তাদের জন্য কিছু মিষ্টান্ন পাঠানো হল। কিন্ত রুবি শুধুু টি টেবিলের উপরের রাখা ডায়রীটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের মনের সাথে অনেকক্ষন থেকেই যুদ্ধ করছে ওটা পড়বে কিনা। পড়াটা কি ঠিক হবে? এটা ভেবেও সে ডায়রীটা হাতে নিল। অদ্ভুত হলেও কেন যেন তার কাছে ডায়রীটা অন্য কারও মনে হল না। ডায়রীর প্রথম থেকেই সে পড়া শুরু করলো ।

ছেলেটি চেয়ে থাকতো উদাসী মনে। কখন তুমি আসবে। চিকন হাতে সরু কাল ঘড়িটা তোমার জন্যই তৈরী এটা প্রায়ই মনে হত। ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে হেটে আসার সময় অবাধ্য চুলগুলো নিমিষেই মুখের সামনে এসে আবার চলে যায়। মাঝে মাঝে মনে হত থাকনা সেই অবাধ্য চুলগুলো মুখের সামনে। একটু অপেক্ষার পরে চুলগুলো তোমার কানের পাশে নাহয় আমিই গুজে দিতাম। এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে চলমান ব্যস্ততা নিয়ে যখন সামনে এগিয়ে আমার পাশে দিয়ে হেটে যেতে, তখন আমার ঘড়িতে সময় কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে যেতো। চোখ বন্ধ করে যতক্ষন এই অনুভুতিটা নিজের করে নিতাম ততোক্ষনে তুমি ক্লাসে চলে যেতে। একটানা আক্ষেপ থেকেই যেতো, আরেকবার যদি দেখতে পেতাম। রাতে যখন তারাগুলো নিজেদের মধ্যে ছোটাছুটির খেলা করতো, তখন আমি তাদের মাঝে তোমার আর আমার সমীকরন মেলানোর চেষ্টায় মগ্ন।

একদিন ক্যাম্পাসে এমনিভাবেই তোমার অপেক্ষায় রাস্তার পাশে গাছে হেলানো অবস্থায় দাড়িয়ে আছি। সেদিন তুমি পাশে দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় আড়চোখে বোধহয় একবার তাকিয়েছিলে। কেন এভাবে তাকিয়েছিলে তুমি? আমার রাতের ঘুমটা কি তোমার সহ্য হল না? আড়চোখে তাকিয়ে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগছিলো এটা কি জানতে? পরেরদিন আবারও আমার সামনে দিয়ে চলে গেলে। সেদিনও চোখ বন্ধ করে নিজের অনুভুতির জানান দিচ্ছিলাম। চোখ খুলে দেখি তুমি সামনে দাড়িয়ে। কিছুটা রেগে ছিলে হয়তো। আমি যে কিছু বলব তারও কোন উপায় ছিল না। গলার ভেতর থেকে বাগযন্ত্রটা যেন অবশ হয়ে গেছে। তুমিই বললে, এভাবে প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকেন কেন? এভাবে প্রতিদিন দাড়িয়ে থেকে কি দেখেন আপনি? এতো এতো ভাল লোকদের মাঝে আপনি এরকমটা কেন? এতো সব রুক্ষ কথার মাঝেও আমি তোমায় কিছু বলিনি। কেন বলিনি ভেবেছিলে কি? হয়তো ভালবাসার তুলনায় তোমাকে অনেকটা বেশিই ভালবাসতাম তাই। আমি যখন তোমার কথার উত্তর দিলাম না তখন আবারও কেমন যেন করুন চোখে তাকিয়ে চলে গিয়েছিলে। আমি তো বুঝেছিলাম, তোমার কষ্ট হয় তাই হয়তো এসব বলেছো। তাই সেদিন থেকে আর দাড়ালাম না ওখানে। তবে ভালবাসিত তাই লুকিয়ে দেখার ইচ্ছেটাকে দমাতে পারতাম না। রোজ সেই মাথার ওপর রোদের মাঝে এসেও লুকিয়ে তোমার বাসস্টপে নামাটা আমি প্রায়ই উপভোগ করতাম। বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক কেন যেন তাকাতে। হয়তো কাউকে খুঁজতে। আমি ভাবতাম, তুমি যদি আমাকে এভাবে খুঁজতে। ওই ভাবা পর্যন্তই আমার শেষ। আর কিছুতো চাইলেও পারতাম না। তোমাকে অনেকটা ছন্দে মনে হতো যখন তুমি তোমার বন্ধুদের সামনে নিজের বিজ্ঞাপনের আর্টিকেল গুলো পড়ে শোনাতে।

একবারও কি ভেবেছিলে তোমার এই আর্টিকেলগুলো কে বিজ্ঞাপনে ছাড়িয়েছিল। তুমি জানতে, তুমি লিখে জমা দেওয়ায় সেটা প্রকশিত হয়ে যেতো। তাহলে কখনও কি ভাবনি তোমার মত আরও অনেকজনই লিখা প্রকাশ করতে চাইতো, কিন্তু তোমার মত তাদেরটা প্রকাশ হতো না কেন?

একদিন প্রখর রোদের মাঝে বাসস্টপের ঠিক পেছনে তোমাকে দেখার জন্য দাড়িয়ে আছি। বাস এসে থামলো কিন্তু তুমি নামলে না। হয়তো আজ আসবেনা। তাই পেছনে ঘুরে চলে আসব আর তুমি সেই পেছনেই দাড়িয়ে আছো। একেবারে আমার সামনে। বললে, আজ আসেনি তাই না? কি চান আমার থেকে বলুন? আমার অনেক হাসি পেয়েছিল কিন্তু সেটা দমিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলাম, কিছু চাই না। সত্যি করে বলছি, বলতে চেয়েছিলাম তোমাকেই চাই। কিন্তু কি এক অদৃশ্য বাধায় সেটা আর বলা হয়নি। তুমি একরাশ নিঃশ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলে। তবে তোমার ঐ নিঃশ্বাসটাও আমাকে ভাবাতো। তবে কি আমার থেকে তুৃমি কিছু জানতে চেয়েছিলে? এভাবে দেখতে দেখতে যখন অনেক সময় চলে গেলো তখনও তোমার একটা বড় বুলেটিন বিজ্ঞাপনে আসলো। তুমি সেদিন অনেক খুশি। তোমার বন্ধুদের সাথে খুশির সময় কাটাতেই তুমি ব্যস্ত। কিন্তু আমার হাতে বেশি সময় ছিল না। চলে যেতে হবে। তাই অনেক সাহস নিয়ে একটু দুরে দাড়িয়ে ছিলাম এই খুশির দিনে তোমায় কিছু বলব বলে। তোমায় ডাকতে পারিনি আমি। তবে এটুকু বলতে পারি, ভাল হোক আর খারাপ হোক তুমিও আমায় নিয়ে ভাবতে। বন্ধুদের সাথে আড্ডার ফাকে অপেক্ষায় থাকলাম আমি। কখন তুমি এদিকে তাকাবে, একটিবার দেখবে আমায়। হয়েও গেলো তাই। তুমি তাকালে, আমায় দেখলে। কেমন করে যেন তাকিয়েই ছিলে। একটা সময় সেখান থেকে আমার দিকে হেটে আসলে। সামনে এসে শান্ত গলায় বললে, কিছু বলবেন? আমি কিছু না বলে হ্যা সুচক মাথা নাড়ালাম। তুমি অনেকটা উজ্জল মুখে বললে, তো বলুন না কি বলতে চান?

আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, গত চারটে বছর তোমায় দেখছি। কখনও ভাবিনি কিছু বলতে পারবো। শুধু দেখেই নিজেকে ভাল রেখেছি। তবে আমার হাতে আর সময় নেই তাই সাহস না থেকেও অনেক কষ্ট করে সাহস করিয়েছি। সত্যি বলতে অনেক ভালবেসেছি তোমায় দুরে থেকে তবে এবার কি একটু ভালবাসা পেতে পারি। আমি কোন কিছু ভাবতে চাই না। তুমি শুধু এটুকু বলো, আমায় ভালবাসবে কি না? যদি উত্তরটা হ্যা হয় তবে তুমি শুধু আমার সাথে থেকো, আমি সব সামলে নেবো। আর যদি উত্তরটা না হয় তবে বুঝবো, আমি বলে তোমার জিবনে কেউ ছিলাম না। যাকে আমি ভাবলবাসতাম সে আমার মনের বিদ্রোহের এক অশান্ত কল্পনা। এসব বলেই যখন তার উত্তরের অপেক্ষায় আছি তখনি দেখি তার মুখে ঘন অন্ধকার। ও বলল, প্রথমদিন আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি তাই আমি দুঃখিত। আর কিছু না বলেই সে চলে যাচ্ছিলো। আমি পেছন থেকে কড়া শব্দে বলেছিলাম, দাড়াও। তুমি থেমে গিয়েছিলে। মৃদু গলায় বলেছিলাম, এটা আমার উত্তর হল না। তুমি এবার তোমার বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল রুপটা আমায় দেখিয়ে আবারও চলে গেলে। আমি বুঝিনি এমন কিছু একটা হবে। হয়তো তুমি আমায় জানতে না তাই। সেদিন চলে এসেছিলাম সেই মায়া থেকে। কিন্তু সমস্যাটা হল আমায় নিয়ে। আমি আর অন্য কাউকে ভালবাসতে পারলাম না। বসাতে পারলাম কাউকে আমার মনে বাস করা সেই রাণীর সিংহাসনে। নিজ নিরালায় এসে আমি তৈরী করেছি আমার নিজের সিংহাসন। যেটা শুধু আমার জন্য। তুমি ভালো থেকো আর মনে রেখো আমিও ছিলাম আমার রাণীর সিংহাসনের পাশেই। যেটা এখনও দখল করে আছে শুধু তোমার অস্তিত্ব।

ডায়রীর শেষ কথাগুলো পড়তে পড়তে রুবির চোখে পানি এসেছে। এই সময় আবার মামুন বসার ঘরে ঢুকলো। রুবির হাতে ডায়রীটা দেখে সে নিজেও কেমন একটা চুপ হয়ে গেলো। মামুন চলে আসাতে রুবি ও তার সাথের দুজন দাড়িয়ে গেলো। মামুন রুবির চোখের পানি দেখতে পেলো। হেসে ফেলে বলল, কেমন আছেন আপনারা? দুঃখিত একটু বাইরে ছিলাম তাই দেরী হয়ে গেলো। খওয়ায় কোন ত্রুটি হয়নি তো? রুবি শুধু শুনছিলো এসব। বাকি দুজন ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলল, না না এসব কোন কিছু হয়নি। অনেক ভালভাবে খেয়েছি আমরা। রুবি মনে মনে ভাবছে, ছোট ছোট দাড়ি সাথে ফুলহাতা শার্টে ও যাকে জানতো তাকেই কেমন এখন একগুচ্ছ দাড়ি আর পান্জাবীতে সে চিনতে পারেনি। হঠাৎ রুবি জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন আপনি? মামুন শুধু মুচকি হাসলো। আর এটার কারনেই রুবি মুখ ঢেকে বাইরে পুকুরঘাটে এসে দাড়ালো। মামুন বাকি দুজনকে বলল, আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি। বাইরে এসে রুবির পাশে এসে দাড়ালো মামুন। বলল, কেমন আছো মিসেস রুবি? রুবি সামনে তাকিয়ে তার চোখের পানি আটকাতে ব্যস্ত। তবুও বলল, সেদিনের পর চলে এসেছিলেন কেন? আর কিছুদিন থাকা যেতো না কি? মামুন বলল, মানুষের ডায়রী পড়াটা ঠিক না। আর পড়লেও বলে পড়তে হয়। রুবি বলল, আর কিছুদিন থাকলেই তো নিজের রানীর সিংহাসনে আমাকেই পেতেন। কত খুঁজেছি আপনাকে জানেন? মামুন বলল, কিছু অপুর্নতার মাঝেও পুর্নতা আছে। আমি এভাবেই পুর্ন। রুবি বলল, ডায়রীতে আমায় নিয়ে এতো কিছু লিখেছেন অথচ কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারলেন না? মামুন হেসে বলল, অপেক্ষার প্রহর অনেক দীর্ঘায়িত হত যদি চলে না আসতাম। রুবি বলল, কি করে এতোটা ভালবেসেছিলেন আমায়? মামুন কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত গলায় বলল, তুমি হিন্দু আমি মুসলিম এটাই কি তবে আমাদের এক না হওয়ার কারন?

আমি বিশ্বাস করি তুমিও আমায় ভাবতে, ভালবাসতে। তবে কেন সেদিন ফিরে গিয়েছিলে? রুবি মৃদু গলায় বলল, আমার ধর্মকে আমি সম্মান করি তাই সেটা হারাতে চাই নি। মামুন হেসে বলল, আমি তোমায় ভালবাসি তার মানে তোমার সম্মান রাখা আমার দায়িত্ব। বলেছিলাম তোমায়, উত্তরটা হ্যা হলে আমি সব সামলে নিব। কিন্তু উত্তরটাই নেই।রুবি আর কিছু বলছে না। মামুন বলল, পুরনো কথা ভেবে আর কি লাভ। অামি জানতাম তুমি একদিন আসবে। হলো তাই। বাদ দাও, তোমার কাজ কি শেষ? রুবি কিছু না বলে মামুনের দিকে তাকালো। বলল, আপনিও জেনে রাখুন, আমিও ভালবেসেছিলাম তবে সময়টা পেরিয়ে গিয়েছিল। বলেই আর দাড়ালো না। বাড়ির বাইরে রহিম চাচা আর মামুন রুবি এবং তার দলকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে এসেছে। রুবি গাড়িতে ওঠার আগে মামুন ওকে ডায়রীটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, সেই সময়ে কারও প্রতি ভালবাসা থেকে লিখা, লিখাটা এই মহলের সাথে প্রকাশ করতে পারো। তবে শেষ পৃষ্ঠায় নামহীন সেই চরিত্রের নামটা আমি বসিয়ে দিয়েছি। রুবি রায়, একটি অলিখিত অনুভুতি, যা কেবল দুটি মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ। রুবি ডায়রীটা নিয়ে মামুনের হাত ধরে বলে, রাণী’র সিংহাসনে কি অন্য কাউকে বসানো যায় না? আমি যে আর পারবো না সেই অনুভুতিগুলোকে জিবন্ত করতে। মামুন একগাদা হেসে বলল, এই অনুভুতিগুলো আমার কাছে কখনই মৃত ছিল না। এগুলো আজীবন জিবন্ত আমার কাছে। ভালো থোকো বলই রুবিকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল মামুন।

সামনে গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আড়চোখে চোখের জল মুছার দৃশ্যটা মামুনের চোখ এড়ায়নি। মামুনের চোখেও কি একটু পানি জমেছে। হয়তো জমেছে। এই সব অনুভুতি নিয়েই বেঁচে আছে মামুন। তাই চোখের পানিটা অপ্রত্যাশিত নয়। না আর না। রাতগুলো পরে আছে এই অনুভুতিগুলোর জন্য। এখন বাড়িতে যেতে হবে। পিসিমনির হাতে খেতে হবে। কতদিন তার সাথে খাওয়া হয় না…
রোদজোলা দুপুরে, সুর তোলে নুপুরে…
বাস থেকে তুমি যবে নামতে,
একটি কিশোর ছেলে একা কেন দাড়িয়ে
সে কথা কি কোন দিনও ভাবতে…
মনে পরে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে
একদিন কতো করে ডেকেছি,
আজ হায় রুবি রায় ডেকে বলো আমাকে
তোমাকে কোথায় যেনো দেখেছি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত