১.
সোনার বাংলা সরকারী প্রাথমিক উচ্চ বিদ্যালয় ।
সিরাজগঞ্জ সদরের অতি পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ( কাল্পনীক নাম ) বিশাল ময়দানটি সেদিন সকাল সাতটা বাজার অনেক আগেই একেবারে কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়ে উঠলো শত সহস্র নানা বয়সী মানুষের ভীড়ে । নারী পুরুষ নির্বিশেষে কারা নেই সেই ভীড়ের মধ্যে । মায়ের কোলে কাঁথা মুড়ানো সদ্যজাত শিশু থেকে শুরু করে অন্যের কাঁধে ভর করে আসা বয়সের ভারে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়া অশীতিপর বৃদ্ধ – যারা বলতে গেলে বিশেষ উপলক্ষ্যে এই ময়দানে জড়ো হতে শুরু হয়েছিল সেই ভোরের আলো ফোঁটার অনেক আগে থেকেই । এবং দেখা গেল সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই বিশাল ময়দানটির কোথাও আর তিল ধারণের মত জায়গাটি নেই । অথচ জলের বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতন পিলপিল করে বিরামহীন মানুষের মিছিল আসছে তো আসছেই !
এরা সবাই বানভাসী মানুষ । সর্বনাশা বন্যায় সহায় সম্বল সব হারিয়ে নিঃস্ব এই মানুষগুলো আজ শুধু প্রাণপন চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের অস্বিত্বটুকু কোনমতে টিকিয়ে রাখার লড়াই । শুধু এরাই নয়, সারা দেশ জুড়ে এই মুহুর্তে বন্য হাতির উন্মত্তায় প্রবল ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে প্রলয়ংকরী বন্যা ।অকল্পনীয় ধ্বংসলীলা সাধনকারী এই বন্যা দেশি বিদেশি প্রচারমাধ্যমে এদেশের শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বন্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে ।
আর যমুনা তীরবর্তী সিরাজগন্জ ও তার আশেপাশের বিস্তির্ন এলাকা এমনিতেই আমাদের দেশের অন্যতম বন্যাপ্রবন এলাকা হিসেবে পরিচিত । প্রায় ফি বছরের ছোট খাটো বন্যায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া এই অঞ্চলের লড়াকু মানুষগুলো অবধি যেন এবার রীতিমতন অসহায় হয়ে পড়েছে প্রকৃতির বিপূল দানবীয় শক্তির কাছে । বরাবরের সাহসী প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষগুলো তাই ছুটে এসেছে শহরের উদ্দেশ্যে । কারন শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সরকারী বেসরকারী ভবনগুলোতে চালু করা হয়েছে বন্যার্ত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র ।
যদিও আশ্রয়প্রার্থী মানুষের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ভীষণরকমের অপ্রতুল বলে প্রমানিত হয়েছে অনেক আগেই । ফলে গতকদিন ধরেই আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে আসা সর্বহারা মানুষগুলোকে আর ঠাঁই করে দেয়া যাচ্ছে না আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে । ফলে মানুষগুলো শেষ আশ্রয় হিসেবে যেভাবে পারে জায়গা করে নিচ্ছে ঢাকা – সিরাজগঞ্জ – পাবনা মহাসড়কের দুপাশ জুড়ে ।
এ সত্যিই এক অভাবনীয় দৃশ্য ! যতদূর চোখ যায় , মহাসড়কের দুইপাশ জুড়ে এখন শুধু চোখে পড়ে সারিসারি মানুষের ভীড় । পরিবার পরিজন নিয়ে যারা নিরুপায় হয়ে এখন মহাসড়কের উপরকার বাসিন্দা । যারা মাথার উপর টানিয়ে নিয়েছে কাপড় বা পলিথিনের আচ্ছাদন । কেউ কেউ আবার কোনভাবেই জোগাড় করতে পারেনি সেটুকুও । ফলে সেইসব আদমসন্তানকে রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে দিনরাত কাটিয়ে দিতে হচ্ছে খোলা আকাশের নীচের । হয়তো বা স্বান্তনা তাদের এইটুকু , মাথার উপর না হোক পায়ের নীচে অন্তত জোগাড় করে নিয়েছে দাড়ানোর মতন একফালি শক্ত মাটি !
অবশেষে গত পরশুদিন যেন এই মানুষগুলোর জন্য সত্যিকার একটু আশার বানী শুনিয়ে গেল হুডের উপর মাইক লাগানো একটি রিক্সা । যেটায় বসে থাকা মানুষটি মাইকের মাধ্যমে দরাজ কন্ঠে জানিয়ে দিয়ে গেল দুইদনের সফরে নিজ শহরে আগামী শুক্রবার বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের জন্য আসছেন সদর আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচন করেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ও এমনকি বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রনালয়েরর দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী এই সিরাজগঞ্জেরই কৃতি সন্তান জনাব আলহাজ্ব আব্দুস সালাম মোহাম্মদ চৌধুরী । ঐদিন প্রথমধাপেই তিনি দিনব্যাপি ত্রাণ বিতরন করবেন সোনার বাংলা স্কুলে ।
সেই থেকে শুরু হয়েছিল মহাসড়কেের পাশে অবস্হান নেয়া পীড়িত মানুষগুলোর আশায় বুক বেঁধে ধ্যানী কাকের মতন নির্দিষ্ট দিনের অপেক্ষায় প্রতীক্ষার প্রহর গোনা ।অবশেষে রাতের আঁধার কেটে কোনমতে দিনের আলো ফোটার আগেই ভেঙ্গে গেল অজানা প্রাপ্তির আশায় পথ চেয়ে উত্তেজিত মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ ।
নির্দিষ্ট স্হানটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে তাই ঘন্টা দেড়েকের বেশি লাগলো না কোনভাবেই !
( দুই / ২ ) ,
– তোমার কি বাজান খুব বেশি কষ্ট হইতাছে খাড়াইয়া থাকতে ? একটুখানি বইবার চাও বাজান ?
বাম হাত মেয়ের কাঁধে রেখে ভর দিয়ে দিয়ে মন্তাজ মিয়া অসহায় দৃষ্টি মেলে কোনমতে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মেয়ে মাটির দিকে । নিজের শরীরের বাম দিকের ভার বলতে গেলে পুরোটাই মাটির কাঁধের উপর অনেকক্ষণ যাবৎই ছেড়ে রেখেছে সে । বলতে গেলে পুরোপুরি হেলান দিয়েই আছে । কিন্তু তারপরও যেন নিজের এলিয়ে রাখা শরীরের ভারটুকু বহন করাটাও ক্রমশ অসহ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার পক্ষে । বিশেষ করে ডান হাতটা বগলের কাছ থেকে মনে হচ্ছে তীব্র জ্বালায় বুঝি আগুন ধরে যাবে ! সেইসাথে ডানপায়ের হাঁটুর প্রান্তসীমায় এসে যেন জমাট বেঁধেছে সমস্ত রক্ত । যারা বুঝি এখন আর কোনভাবেই চাইছে না ওই সীমারেখায় বন্দী থাকতে । ঝড়ের গতিতে ছুটে ফেঁটে পড়তে চাইছে ঝরণাধারা হয়ে ! যেন গোটা ডানপাটাই ছিঁড়ে পড়তে চাইছে তীব্র যন্ত্রণায় !
আসলে মন্তাজ মিয়ার ডান পায়ের কারনেই সৃষ্টি হচ্ছে সমস্ত প্রতিকুলতা ! কারণ ডান পাটা তার হাঁটুর ঠিক শুরু থেকে কাঁটা ! ফলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে তাকে ব্যবহার করতে হয় কাঠের ক্রাচ । কিন্তু একটানা বেশিক্ষন ক্রাচে ভর দিয়ে থাকাটা ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যপার । বরাবরই তাই মন্তাজ মিয়া চেষ্টা করেন নির্দিষ্ট সময় পরপর একটু বসে বিশ্রাম নেয়ার ।
আজ যেটা কোনভাবেই সম্ভব হয়ে উঠছে না । এই গাঁদাগাদি মানুষের ভীড়ের মধ্যে যেখানে ঠিকমত সোজা হয়ে দাঁড়াবার উপায় নেই , সেখানে একটু বসে জিরিয়ে নেয়ার কথা ভাবাটাও রীতিমতন দুঃস্বপ্নের ব্যাপার । অথচ সেই কোন রাত ভোর থেকে ডান বগলের নীচে ক্রাচটা চেপে রাখতে হয়েছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকাবস্হায় । আর এই মুহুর্তে বলতে গেলে ক্লান্তি আর যন্ত্রণার শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া মাঝবয়সী মন্তাজ মিয়ার শরীরটা আচমকাই থরথর করে কেঁপে উঠে যেন ঘোষণা করে জানান দিয়ে যায় সহ্যশক্তির চূড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রমের বার্তাটা ।
বাপের স্বাচ্ছন্দের দিকে এই ভীষণ প্রতিকুল পরিস্হিতির মধ্যেও সাধ্যমত খেয়াল রাখা মাটির কাছে সাথেসাথেই ধরা পড়ে মন্তাজ মিয়ার শরীরের কাঁপুনী । বাপকে আরো ভালোভাবে পেছন থেকে সামাল দেবার চেষ্টা করে । বাপের অসহায় চাহনী যেন ব্যকুল করে তোলে তাকে । বাপকে আর কোন প্রশ্ন না করে নিজেই উদ্যোগী হয় । সামনে পিছনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে বাপের অসুস্হতার কথা জানিয়ে কাঁকুতি মিনতি ও সেই সাথে কিছুক্ষণ বেপরোয়া ঠেলাধাক্কা চালিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে বেরও করে নেয় খানিকটা জায়গা । তারপর বের করা জায়গাটুকুর দখল বজায় রাখতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কোমর আর মাথা সামনের দিকে বাঁড়িয়ে দিয়ে হাত বাড়ায় বাপের দিকে ।
– দেও বাজান । তুমার কেরাচটা আমার আতে দিয়া এই আমার উপরে ভার দিয়া আস্তে আস্তে আমার আটুর মধ্যে হেইলা পিঠ লাগায়া বহো বাজান ।
মুখে নির্দেশ দিতে থাকলেও বাবার প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করে না মাটি । বরং কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই একহাতে ক্রাচটা নিয়ে নিজের শরীরে মন্তাজ মিয়ার ভারটুকু নিয়ে নেয় পুরোপুরি । তারপর ধীরে নিজের সামনের দিকে বাঁকিয়ে রাখা শরীর সোজা করতে করতেই অতি যত্নের সাথে বসিয়েও দেয় বাপকে নিজের দুই হাঁটুর মাঝে ।
বসতে পারা মাত্রই যেন মন্তাজ মিয়া বুঝতে পারে তার শরীরের করুণ দশার সঠিক অবস্হাটা । ক্লান্তি , অসুস্হতার চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়া মন্তাজ মিয়ার চোখদুটো অবসাদে আপনাআপনিই বুঁজে আসে বসার সাথে সাথেই ।
হবে নাই বা কেন ! গত কদিন ধরে তাদের উপর দিয়ে ধকল তো আর কম যায়নি । কতোকাল বাদে আবার তাকে নিজের ভিটামাটি ফেলে এমনকি শেষ অবধি নিজের গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে হলো যুবতী মেয়েটাকে নিয়ে শুধুমাত্র প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে । অথচ নিজেদের সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ওরা লড়াই করেছিল প্রকৃতির সাথে । বানের পানি বাড়তে বাড়তে যখন ছুঁয়ে ফেললো ঘরের চাল । তখনও ওরা মাঁচান করে থাকছিল নিজের ডুবে যাওয়া ঘরেরই চালের উপর ।
কিন্তু তারপরও তো শেষ রক্ষা হলো না । কদিন আগে ডুবে গেল চালটাও । ফলে বাধ্য হয়েই দরকারী যৎসামান্য জিনিসের সাথে কয়টা পরনের কাপড় ছোট একটা পোঁটলায় বেঁধে পঙ্গু হয়ে যাবার পর এই প্র্রথমবারের মত মেয়েকে সাথে নিয়ে বের হতে হয়েছিল মন্তাজ মিয়াকে মাথার উপর একটু ছাউনির খোঁজ করতে !
শহরে এসেও অবশ্য কোন লাভ হয়নি । কোন লাভ হয়নি বলতে ওরা একটু জায়গা পায়নি কোন আশ্রয়কেন্দ্রেই । আসলে ওরা দেরী করে ফেলেছিল অন্যদের তুলনায় ঘর ছাড়তে ।
পাঁচ দিন আগে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে সব কটি আশ্রয়কেন্দ্র । একে তো বহুকালের ক্ষুদ্র গন্ডিবদ্ধ জীবনের জড়তা আর তার উপর নিজেও সে পঙ্গু । সবমিলিয়ে হটাৎ শহরে এসে হকচকিয়ে যাওয়া মন্তাজ মিয়া আরো একবার নিজেকে ভীষণ অসহায় বোধ করে । বাধ্য হয়ে আরো অনেকের মতন মেয়েকে নিয়ে থান গেঁড়েছিল মহাসড়কের উপর যথাসম্ভব উঁচু আর শুকনো জায়গা খুঁজে নিয়ে । মেয়ের পরনের একটা শাড়ীকে ব্যবহার করেছিল চারপাশের বেঁড়া হিসেবে । আর মাথার উপর ছাউনি দিয়েছিল চেয়চিন্তে জোগাড় করা বড় একটুকরো পলিথিন দিয়ে ।
যদিও পরশু রাতে সেই বেঁড়া আর আচ্ছাদনটুকুও রক্ষা করা যায়নি । রাতের বেলা ওদের ঘুমের মধ্যে রেখেই কে বা কারা যেন ওগুলো চুরি করে নিয়ে যায় ! সেই সাথে তাদের যাবতীয় সম্পদের পোঁটলাটাও নিতে ভোলেনি অমানুষ ঐ চোরের দল । শুধু নিতে পারেনি তাদের পরনের কাপড়টুকু আর মন্তাজ মিয়ার লুঙ্গির কোটরে থাকা টাকা কয়টা । যা কিনা গত কদিনের জীবন যাপনের খরচ চালাতে গিয়ে প্রায় শেষ হবার পথে ।
গত দুদিন ধরে এক কাপড়ে থাকা বাপ মেয়ে তাই অনেক আশা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে এই স্কুল মাঠে । লোকমুখে ওরা শুনেছে মন্ত্রী সাহেব ভীষণ দরাজ মনের মানুষ । দু হাতে গরীবদের মধ্যে দান খয়রাত করেন । রিলিফ হিসাবেও কাপড় চোপড় আর খাবারের সাথে নাকি নগদ কিছু টাকাও প্রত্যেককে দেবার কথা আছে তার ।
হে আল্লাহ পাক তাই যেন হয় । তেমন কিছু হলে সামনের কয়টা দিন কোনমতে কেটে যেতে যাবে নিশ্চয়ই । এর মধ্যে আল্লাহ চাহে তো বানের পানিও নামা শুরু করবে হয়তো । তাহলেই তারা ফিরে যেতে পারবে নিজেদের আপন ঠিকানায় ।
মেয়ের হাঁটুতে হেলান দিয়ে মাটিতে বসা মন্তাজ মিয়া চোখ বন্ধ করে ক্রমাগত আল্লাহর দরবারে এই দোয়াই করতে থাকে !
মন্ত্রী সাহেবের জন্য বানানো মঞ্চের মাইক থেকে বুকে ব্যাজ লাগানো স্বেচ্ছাসেবকদলের একজন বারবার সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছে শান্ত সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে । মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় দশটার মধ্যে এখানে উপস্হিত হয়ে সকলের হাতে নিজে তুলে দেবেন ত্রাণ সামগ্রী । কেউ একজনও বাদ যাবে না কোনভাবেই ।
দশটা বাজতে আর কত দেরী কে জানে ?
( ৩ / তিন ) :
—————
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মন্ত্রীমহোদয় পৌঁছে গেলেন দশটার বরং কিছু আগেই । এমনকি যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সারতেও সময় নিলেন না খুব বেশি । দেখা গেল , নিজের বক্তৃতাও টেনে হিচড়ে অযথা লম্বা করার পথে গেলেন না ! যা প্রথমেই ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করলো মাঠে উপস্হিত সকলকে । বরং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শুরু করে দিলেন মূল কাজ । অর্থাৎ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ।
প্রথম দফায় টানা প্রায় দুঘন্টার বেশি চলল বিতরণ কার্য । সাপের মতন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরী হওয়া মানুষের বিশাল লাইন আশাতীত দ্রুততার সঙ্গে সামনের দিকে এগুচ্ছে । যদিও এতো বিপূল সংখ্যক মানুষের তৈরী শেকলের মধ্যে পুরোপুরি শৃংখলা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার । আর তা পারাও গেলো না । মাঝেমধ্যেই তাই লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে দেখা দিতে লাগলো অধৈর্য্য হয়ে পড়ে নিয়ম ভাঙ্গার লক্ষণ । তবে মাঠে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের একান্ত প্রচেষ্টা আর পরিশ্রমের ফলে কোন ঘটনাই শেষ পর্যন্ত মাত্রা ছাড়াতে পারেনি ।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বরং স্বাভাবিক হয়ে এল ক্রমশ । পুরো ব্যাপারটি চলতে লাগল নির্দিষ্ট একটা ছকের মধ্যে দিয়ে । লাইনের মানুষগুলো একজন বা দুজন করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে স্কুলের বারান্দা ঘিরে তৈরী করা বিশেষ মঞ্চের মাঝখানে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে । মন্ত্রী মহোদয়ের পাশে থাকা অতিথিবৃন্দ নারী পুরুষ আর শিশু বিবেচনায় বারান্দায় স্তপ করে রাখা সামগ্রীর প্যাকেট বেছে এগিয়ে দিচ্ছেন সামনের দিকের । কয়েকহাত হাত ঘুরে আসা প্যাকেটগুলো সবশেষে মন্ত্রীমহোদয় তুলে দিচ্ছেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাহায্যপ্রার্থীর হাতে । এরপরেই আর একদল স্বেচ্ছাসেবীর কজন বিদ্যালয়ের পেছনদিকের বিকল্প ছোট দরোজা দিয়ে বের করে দিচ্ছে সাহায্য পেয়ে যাওয়া মানুষজনকে । আবার এই ফাঁকে সামনে চলে আসছে বেরিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পেছনে অবস্হানকারীরা ।
পঙ্গু মনতাজ মিয়া অনেকের আগে এলেও শারীরিক অসুবিধার কারনে লাইন শুরু হবার সময় ধাক্কাধাক্কি করে সামনের দিকে অবস্হান নিতে পারেনি । বরং বাবাকে নিয়ে মাটির স্হান হয়েছিল হয়েছিল ভীড়ের একেবারে শেষ দিকে । বিশাল ময়দানের শেষ প্রান্ত থেকে এমনকি মঞ্চও দেখা যাচ্ছিল না মানুষের ভীড়ের কারণে । তারপরেও প্রথম দুঘন্টায় গুটি গুটি করে মঞ্চের প্রায় মাঝামাঝি দেখতে পাওয়ার মতন দূরত্বে এসে পৌঁছুতে পেরেছিল তারা ।
কিন্তু ঠিক এই সময় মাঠে উপস্হিত অপেক্ষমানদের হতাশ করে দিয়ে ঘোষণা করা হল জুম্মার নামায আর দুপুরের খাবারের বিরতি !
অন্যদের মতই হতাশ মন্তাজ মিয়া বুঝতে পারলো তাদের পালা আসতে আসতে সন্ধা গড়িয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয় ।
কে জানে সারাদিনের এই অমানুষিক ধকলের পর তাদের বাপ মেয়ের ভাগ্যে অদৌ কিছু জুটবে কিনা ! কিংবা কে জানে সময়ের অভাবে হয়তো তাদেরকে কিছু না দিয়েই বিদায় করে দিতে পারে । আর তাছাড়া যেই মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে এখনও তাতে এমনও তো হতে পারে শেষ অবধি তাদেরকে দেবার মত কিছুই আর অবশিষ্ট রইলো না !
বিরতির সময়টা এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই পার করে দিতে লাগলো অবসন্ন মন্তাজ মিয়া !
( ৪/চার )
————–
দুপুর তিনটার বেশি বেজে গেছে ।
নামায আর দুপুরের খাবার শেষে আবারও শুরু হয়েছে বিতরণ কাজ তাও আধা ঘন্টার বেশি হলো । আর বিরতির পর মানুষের অত্যধিক ভীড় দেখে শুরু হলো কয়েকজনের হাত দিয়ে সাহায্য বিতরণ । ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আশাতীতভাবে কমে যেতে শুরু করলো ময়দানে উপস্হিত সাহায্যপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা । সকাল থেকে দুঘন্টার বেশি সময় লাগিয়ে যতটুকুন না এগিয়েছিল মন্তাজ মিয়ারা , দুপুরের পর আধাঘন্টার কিছু বেশি সময়েই মাত্র তারচেয়ে এগিয়ে এখন মঞ্চের অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে মাটি আর মন্তাজ মিয়া। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে কর্মব্যস্ত মাননীয় অতিথীদের কার্যক্রম এখন অনেকটাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তারা । বিশেষত নতুন করে আশা ফিরে পাওয়া মন্তাজ মিয়া দারুন উৎসাহ ভরে অবলোকন করতে শুরু করেছে মঞ্চের কর্মযজ্ঞ ।
বিশেষ করে সে দেখতে চাইছে তাদের আজকের সমস্ত আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকা দানবীর মানুষটাকে । সাদা ধবধবে পাজামা পান্জাবী আর কালো কিস্তি টুপিতে মন্ত্রীমহোদয়কে দেখতে বেশ লাগে মন্তাজের । বিশেষ করে থুতনিতে কায়দা করে রাখা দাঁড়িতে লম্বা চওড়া মানুষটার সৌন্দর্য যেন আরো বেশি করে খুলেছে মনে হলো মন্তাজ মিয়ার কাছে । এমনকি মানুষটার বয়সও খুব বেশি বলে মনে হলো না ! বোঝাই যাচ্ছে খুব অল্প বয়সেই আজকের এই অবস্হানে আসতে পেরেছেন তিনি ।
গুনী মানুষ । গুন দিয়াই উইঠা আসছেন ।
মনে মনে নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই সায় দিয়ে মাথা নাড়ে মুগ্ধ মন্তাজ মিয়া ।
ততোক্ষণে আরো কাছাকাছি চলে আসায় মানুষটাকে আরো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । আর ঠিক তখনই মনে হলো মানুষটাকে যেন খুব চেনা মনে হচ্ছে তার কাছে । যদিও এমনটা মনে হওয়ার আসলে কোন কারন নেই । একে মানুষটা তার এলাকা থেকে ভোটে দাঁড়ায়নি । তার এখানে আসার পর লোকমুখে জানতে পেরেছে মন্তাজ যে মন্ত্রী মহোদয় বহুকাল বিদেশে কাটিয়ে মাত্রই কয়েকবছর হলো দেশে ফিরেছেন । এবং রাজনীতিতে নেমে দারুন দক্ষতা আর নানাবিধ যোগাযোগের মাধ্যমে অল্প সময়েই নিজের স্হান করে নিয়েছেন জাতিয় পর্যায়ের নেতা হিসাবে । শুধু তাই নয় , প্রথম দফায় নির্বাচন নেমেই বাজিমাৎ করে হয়ে গেছেন মন্ত্রীও ।
আর তা না হলেও অবশ্য কোন রাজনীতিবিদকে চেনার কথা নয় মন্তাজের একেবারে পুরনো কেউ না হলে । আসলে কি এক অজানা অভিমান বুকের ভেতর পুষে রেখে মন্তাজ মিয়া বলতে গেলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে খুবই ক্ষুদ্র একটা গন্ডীর ভেতরে। যে গন্ডিতে আছে শুধু তার একমাত্র মেয়ে মাটি । নিজের ছোট্ট ভিটায় বসবাস আর বাড়ীর ঠিক সামনের রাস্তার মুখে তার ছোট পান বিড়ি আর চায়ের দোকানে মুখ কান বন্ধ করে জীবন যাপনের ব্যবস্হাটা সচল রাখার প্রচেষটা ছাড়া এর বাইরে আর কোন কিছু নিয়ে ভাবে না মন্তজ আজ বহু বছর হয়ে গেছে । আর তার এই জীবনে যে জিনিসটাকে সযত্নে বিসর্জন দিয়েছে মন্তাজ তা হল রাজনীতি আর ভোট ।
তবে হতে পারে পেপার পত্রিকা বা অন্যকোনভাবে সে মন্ত্রী মহোদয়ের ছবি দেখেছে সামনা সামনি না দেখলেও !
না । তা নয় । মন্তাজের আসলে মনে হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয়ের চেহারার মধ্যে তার স্মরনীয় কোন মানুষের ছায়া যেন দেখতে পাচ্ছে ! এবং সেটা তার বর্তমান জীবনের সাথে পরিচিত কেউ নয় কোনভাবেই । বরং তার প্রায় ভুলতে চাওয়া অতীতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা কারুর ছায়া !
মন্তাজ মিয়ার মনের ভেতর তখন শুরু হয়ে গেছে কালবৈশাখী । বুকের মধ্যে বহুকাল ধরে লুকিয়ে রাখা এ্যালবামের পাতাগুলো তখন আপনা আপনি উল্টে তীব্র ঝড়ের দমকা হাওয়ায় । পেছনে ফেলে আসা মানুষগুলোর চেহারার সাথে দ্রুত মিলিয়ে নিতে থাকে এই মুহুর্তে মাত্র গজ দশেক দূরত্বে দূরের মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষমতাধর মানুষটির চেহারা । এবং ক্রমশ বিশ্বাস হতে থাকে লোকটাকে সে খুব ভালমতন চেনে । এবং জানে ।
নিশ্চিত হবার জন্য এবার বুঝি শেষবারের মতন মন্ত্রী সাহেবের চেহারা পরখ করতে মন্তাজ মিয়া মানুষটার দিকে মেলে পলকহীন তীর্যক দৃষ্টি । আর কয়েক পলকের মধ্যে সহসাই দূরে সরে যেতে শুরু করে স্মৃতির চারপাশে বহুকালের জমাট বাঁধা ধুলোর আস্তরণ । ধোঁয়াটে অতীত ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে চোখের সামনে ।
আরে তাইতো ! এইটা তো ঐ সেইল্যা !
পাকিস্হান আমলে যাকে সবাই চিনতো দাগী চোর ”চোরা সেইল্যা” নামে ! পরে যুদ্ধের সময় এই গোটা সিরাজগঞ্জ ও তার আশেপাশের এলাকায় চোরা সেইল্যা ব্যাপক পরিচিত পেয়েছিল কুখ্যাত রাজাকার হিসাবে । ঐ সময়ে এই সেইল্যাই পাক আর্মিদের দোসর হিসেবে কায়েম করেছিল অবিশ্বাস্য এক ত্রাসের রাজত্ব । সেই সময় তার পরিচিতি ছড়িয়েছিল সালু কমান্ডার নামে ।
হ্যা । আর কোন সন্দেহ নেই মন্তাজের মনে !
দাঁতে দাঁত চাপতে চাপতে নিজের অর্ধেকটা হাঁটুর ঠিক কাঁটা দাগের উপর হাত বুলিয়ে চলে মন্তাজ মিয়া !!