স্কুল পলায়ন, অতঃপর বেত শিক্ষা

স্কুল পলায়ন, অতঃপর বেত শিক্ষা

স্কুল পালানো কারো কারো জন্য একটি বিশেষ দক্ষতা। কারণ এই কাজ সবাই করতে পারেনা। বহু কষ্ট আর ত্যাগ তিতিক্ষার পরেই এই শিক্ষা অর্জন করতে হয়। বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় সহপাঠীদের মধ্যে কেউ না কেউ স্কুল পলায়নে বিশেষ পারদর্শী হয়। তাদের বেশির ভাগের ভাগ্যেই কারণে অকারণে স্কুল শিক্ষকদের বিভিন্ন আইটেমের শাস্তি কপালে জোটে। অনেক সময় শিক্ষকেরা অতিষ্ঠ হয়ে অভিভাবক ডেকে অপমান করতেও ভুলেন না।

স্কুল জীবনে টিফিন পিরিয়ডে কিংবা অন্য কোন সময়ে আমার পালিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা একেবারেই কম। ঠিক কতবার পালিয়েছি তা সংখ্যায় কম হলেও সঠিক সংখ্যা বলতে পারবো না। এই অল্প কয়েকটি স্কুল পালানোর ঘটনার মধ্যে আজ শুধু একটিই মনে করতে পারছি, যেটি আমার আজীবন মনে থাকবে। আমার শিক্ষা জীবনে মনে দাগ কেটে আছে এমন ঘটনাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম।

তখন আমি রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। স্কুলের নাম শুনলেই বোঝা যায় সেখানে নিয়ম-কানুন কতটা কঠিন। তার চাইতে বড় কথা আমাদের যে প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তিনি সে সব নিয়মের চাইতেও বেশী কঠিন ছিলেন। সে সময় আমি ক্লাসের সহজ সরল সাধারণ ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলাম। কোন ব্যপারেই খুব ভাল কিংবা খুব খারাপ রেকর্ড আমার ছিলনা। তাই আমি ছিলাম শিক্ষকদের চোখের আড়ালে।

সে বছর আমাদের ক্লাসের কিছু ছেলে মেয়ের মধ্যে হঠাৎ করেই স্কুল পালানোর ব্যরাম দেখা দিল। কারণ অকারণে সমস্ত বাধা বিপত্তিকে পেছনে ঠেলে যে ভাবেই হউক তাদের স্কুল পালাতে হবেই হবে। এদের কেউ কেউ আগে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল। এমন ছেলে মেয়েদের মধ্যেই অন্যতম ছিল সে সময়ের আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়ন। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে ওর সাথেই প্রতিদিন আমি হেঁটে হেঁটে আসতাম। মাঝে মাঝে নয়ন স্কুল পালাতো সে কারণে ফিরবার পথে আমি প্রায় একাকী হয়ে যেতাম। মাঝে মধ্যেই দেখা যেত টিফিন পিরিয়ডের পর সে সহ আরও কয়েক জন নেই।

এমন দিনগুলোর মধ্যেই একদিন আমি স্কুলে আসার পর থেকেই অসুস্থ বোধ করছিলাম। সামান্য জ্বরও ছিল শরীরে। সে কারণেই আমি নয়নকে আমার স্কুল পালানোর সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। সেদিন ওর নিজেরও ইচ্ছে ছিল স্কুল পালানোর, তাই আমাকে সাথে নিতে অমত করলনা। যথা সময়ে সুযোগ বুঝে স্কুল থেকে পালিয়ে গেলাম। ক্যান্টনমেন্টের বাহির দিয়ে স্কুলের যে গেইট ছিল সেটা দিয়ে পালানো কঠিন ছিল তাই ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিককার গেইট দিয়ে বের হয়ে দুই জনে হাঁটতে লাগলাম। আমার ভয় হচ্ছিল, কারণ এর আগে এত পরিকল্পিত ভাবে স্কুল পালাইনি। নয়নের ছোট একটি বাইসাইকেল ছিল। ওটাকে নয়ন আস্তে আস্তে চালাচ্ছিল আর আমি পাশে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম।

এক সময় হাঁটতে হাঁটতে আর্মি কোয়ার্টারের কাছাকাছি চলে এলাম। নিজেকে কিছুটা স্বাধীন মনে হচ্ছিল। বাসায় যেয়ে দিঘীর পানিতে ইচ্ছে মত ডুবাবো ভাবছিলাম। অথচ এ কাজটি করেই আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। নানা সুখ চিন্তার মাঝেই হঠাৎ ছেদ পড়লো। দিন দুপুরেই ভয়ে শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়তে লাগলো। নয়ন কি অবস্থায় ছিল তা আমি তাকে কখনো জিজ্ঞেস করিনি। শরীরের অবস্থা যাই হউক দুই জনের চোখ একদিকেই ছিল তখন। আমরা দেখছিলাম একটি চলতি মোটর সাইকেলের পেছনের সিটে বসা দীর্ঘকায় প্রধান শিক্ষক তারাজ উদ্দিন স্যারের টাক মাথাটা দুপুরের রোদের আলোয় চকচক করছে। প্রায় দুইশত মিটার দূর থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম স্যার আমাদের দেখে ফেলেছেন, তাই পালিয়ে লাভ নেই (যদিও আমি একবার সেটাই করতে চেয়েছিলাম)। এর মধ্যেই দুজনে স্কুল ব্যাচ আর ন্যামপ্লেট খুলে ফেলেছিলাম, যাতে কেউ বুঝতে না পারে কোন স্কুলের ছাত্র আমরা। কিন্তু স্যারের জহুরীর চোখ, সে চোখ ফাঁকি দিতে পারলামনা। তিনি মোটর সাইকেলটা আমাদের সামনেই থামালেন। সেটা থেকে না নেমেই, স্কুলের নাম ধাম না জিজ্ঞেস করেই বলতে লাগলেন, “কী! স্কুল থেকে টিফিন পিরিয়ডের পরে চইলা যাইতাছ, ক্লাস টিচারেরে দরখাস্ত দিয়া আসছ?” নয়ন উত্তর দিলনা। কিন্তু আমি একটা মিথ্যে কথা বলে ফেললাম। ভয় পেয়েই সে কাজটি করেছিলাম। আমি শুধু বলেছিলাম, “জী স্যার”। স্যার উত্তরে শুধু বললেন, “ঠিক আছে আমি গিয়া দেখতাছি দরখাস্ত দিছ কিনা?”

মিথ্যা বলায় নয়ন আমার উপরে রাগ করল। ও বলতে থাকল, তোর জন্য আমি ফেঁসে গেলাম। আমার নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী মনে হতে লাগল। বাকি রাস্তা চুপচাপ হেঁটে বাড়িতে গেলাম। তারপর দুইদিন জ্বরে ভুগলাম। ঘটনার পরে স্কুলে যেদিন গেলাম সে দিন বৃষ্টি হয়েছিল। আমার ভাগ্য ভাল সেদিন মাঠ কর্দমাক্ত থাকায় এস্যাম্বলী হয়ে ছিলনা। ক্লাসেই কোরআন তেলাওয়াত, শপথ পাঠ, জাতীয় সংগীত গাইতে হল। সবই ঠিক ছিল, শুধু নয়নকে দেখছিলাম না। অন্য ছেলেরা এমন কি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও বলছিল আমাকে নাকি টিসি দেয়া হতে পারে। সে সময় টিসিকে জম্মের মত ভয় পাইতাম। টিসি মানে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট তা আমি জানতাম না। শুধু জানতাম লাল কালীর স্বাক্ষর করে স্কুল থেকে বেড় করে দেয়ার নাম টিসি। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই বলল আমি নাকি খুব ভাগ্যবান। গত দুই দিন স্কুলে আসলে স্কুল মাঠে সবার সামনে শাস্তি দেয়া হত। কারণ সেদিনের ঘটনার পর সকল ক্লাসেই ছাত্রদের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়েছিল। তাতে শুধু আমাদের ক্লাসেরই তিন জন ধরা পড়েছিলাম। এই তিন জনের নামই মাইকে ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়েছিল। আমার বাকি দুই বন্ধু সেটা জেনেছিল তাই স্কুলে আর আসেনি।

যথারীতি শ্রেণী শিক্ষক এলেন, নাম প্রেজেন্টস শুরু হল। আমার নাম আসার পর তিনি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেলেন। তারপর বললেন যে, তুমি হেডস্যারের কাছ থেকে ক্লাসে থাকবার অনুমতি নিয়ে আস। আমি খুব চিন্তিত মনে ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলাম। খুব লজ্জা হচ্ছিল সেদিন। মনে হচ্ছিল আমার মাথায় আকাশ ভর করে আছে। বাইরে বেরুতেই সিঁড়িতেই হেডস্যারের সাথে দেখা হয়ে গেল। স্যার আমাকে চিনেও না চেনার ভান করলেন। স্যার আমাকে চলে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই আমি আমার জ্বরের অজুহাত দেখালাম। নিজেই ধরা দিলাম, সেদিন কেন আমি পালিয়েছিলাম। পালানোর কথা তিনি জিজ্ঞেস না করতেই আমি সব গড় গড় করে বলে দিলাম। স্যারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর মন গলে গেছে। কিন্তু তিনি আমাকে নিয়ে যেই না ক্লাসে উপস্থিত হলেন তারপরেই আমাকে ধমকা ধমকি শুরু করলেন। আমি পালিয়েছিলাম সেটার চাইতে মিথ্যা বলাকেই বেশী গুরত্ত দিলেন। স্যারের হাতে সব সময়তেই একটা টাইগার বেত থাকত। তিনি ধমকের সাথে সাথে সেটিও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার ছিপছিপে শরীরটির উপরে চালাচ্ছিলেন। পিঠে ব্যাগ ছিল তারপরেও পিঠে মেরেছিলেন। এখন বুঝি তিনি অন্ধ ছিলেননা। আমাকে ভয় দেখাতেই এই কাজ করেছিলেন। আমি তখন কিভাবে কেঁদেছিলাম তা বলতে পারছিলাম না। কেউ কেউ এ নিয়ে পরে আমাকে ক্ষেপিয়েছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি অনেকদিন স্কুলে পরিচিত ছিলাম।

দির্ঘ বেত শিক্ষার পর আমি যখন বাড়িতে এলাম, অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতালায় উঠেছিলাম। মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। চলন বলনে তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। প্রথমে আমাকে বকাঝকা করলেও পরে স্যারকে পাষাণ বলেছিলেন। আমার খুব মনে পরে মা বার বার আঘাতের চিনহগুলো দেখেতে চাইলে আমি দেখতে দেইনি। আমি একান্তে বসে বসে কেঁদেছিলাম আর গুনে গুনে দেখেছিলাম, আমার ছিপছিপে রোগা শরীরটিতে বেতের দাগ বসে আছে ষোলটি।

জানিনা স্যার এখনো বেঁচে আছেন কিনা। বেঁচে থাকলে তাঁর সুস্থতা কামনা করে গেলাম। আর আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গেলে তাঁর জন্য বেহেশত কামনা করলাম।

অনুপ্রেরনাঃ শ্রদ্ধেয় ব্লগার আবু হেনা আশরাফুল ইসলাম, যার একটি মন্তব্যের সূত্র ধরেই আমার এই লেখার প্রচেষ্টা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত