শহরের অদূরেই বেশ পুরনো একটি ডিসপেনসারি। বাইরে থেকে এর নাম বা ডাক্তারের পরিচিতি কিছুই বোঝা যায়না। খুব কাছ থেকে শুধু ডিসপেনসারি শব্দটিকেই অস্পষ্ট বোঝা যায়। সবাই অবশ্য এটিকে ডাক্তারখানা বলে।
প্রায় তিন দশক ধরে এই স্থানেই স্বপন ডাক্তার এই এলাকার হাজারো মানুষের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কোথায় থেকে তিনি ডাক্তারি পাশ করেছেন কিংবা ডাক্তারি প্র্যাকটিস করেছেন তা কারোই জানা নেই। শহরে পাশ করা ডাক্তারের অভাব নেই। তবুও সকলের একই কথা, “স্বপন ডাক্তারের হাত ভাল, রোগী ভাল হয় তাড়াতাড়ি”। এলাকায় তার নামে নানা অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য সব মুখরোচক ঘটনা প্রচলিত আছে। স্বপন ডাক্তারকে এই ব্যপারে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে তা এড়িয়ে যায়। তবে মাঝে মাঝে সে কিছু নতুন কথা জুড়ে দেয়।
স্বপন ডাক্তারের বহু পুরনো রোগী আছে। সে তার পুরনো রোগীদের আলাদাভাবে দেখভাল করে। নতুন রোগীদের সে ডাক্তারখানায় বসে চিকিৎসা দিলেও পুরনোদের প্রয়োজনে রাত বিরাতে তাদের বাসায় যেয়ে উপস্থিত হয়।
পৌষ মাসের এক ঠাণ্ডা রাতে স্বপন ডাক্তারের সাথে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে গেল। সেদিন মাঝারী ধরনের বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। শীতকালে সাধারণত এমন দিন খুব কমই পাওয়া যায়। ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেড়ে স্বপন ডাক্তার সন্ধ্যে না নামতেই ডিসপেনসারি বন্ধ করে দিল। তাদের বুড়ো আর বুড়ির ছোট্ট সংসার। ছেলেপুলের মুখ তারা দেখেনি। এই বৃদ্ধ বয়সেও এ জন্য বুড়িকে সে মাঝে মধ্যে বকা ঝকা করে। কিন্তু বুড়িকে ভুলে গিয়ে অন্য কারো সাথে সংসার পাতার ইচ্ছেও সে করেনি।
সেদিন ডিসপেনসারি বন্ধ করে ঘরে এসেই বুড়িকে চায়ের অর্ডার দিয়ে লেপের তলায় যেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল সে। শীতে তার হাত পা কাঁপছিল। পা দুটো গরম করতে হাত দিয়ে ডলতে থাকল। চায়ের আশায় বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন চা নিয়ে কেউ আসলনা, তখন তার মেজাজ বিগরে গেল। দেরী করার জন্য বুড়িকে গাল মন্দ করতে থাকল। কিন্তু অন্য দিনের মত আজ আর বুড়ি তার কথায় উত্তর দিচ্ছিলনা। এতে মেজাজ আরও বিগড়ে গেল। রাগের মাথায় ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেই রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দিল। সেখানে যেয়ে দেখল তার স্ত্রী সেখানে নেই। চুলোয় পানি গরম হচ্ছে ঠিকই। পাশেই তার চশমাটা রাখা। স্বপন ডাক্তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে লাগল। আশে পাশে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেলনা। স্বপন ডাক্তার ভাবল তাঁকে না বলেই বাইরে কারো উপকার করতে চলে গেছে। তাই সে রাগে গজরাতে গজরাতে নিজের খাটের পাশে গিয়ে বসল। সাথে সাথেই বাইরে থেকে অদ্ভুত এক কণ্ঠে কেউ তাকে ডেকে উঠল। ডাক শুনে স্বপন ডাক্তারের সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। মাঝ রাতেও তাকে অনেকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ এই সন্ধ্যে বেলাতেই এক ডাকে তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। স্বপন ডাক্তার উত্তরে বলল, “বাইরে কে ডাকে রে?”
বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ মিলল না। তারপর খুব রুগ্ন কণ্ঠে কারো ডাক শুনল। সে কান পেতে শুনল। কেউ তাকে বলছে, “ডাক্তারবাবু বাসায়? এখুনি একটু হাওলাদার বাড়ী চলেন না”।
হাওলাদার বাড়ির নাম শুনে স্বপন ডাক্তারের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। হাওলাদার মশায় অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। তার কাছে রাত বিরাতে গেলে একটু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু তিনি হাজার টাকা হাতে গুজে না দিয়ে তাকে আসতে দেন না। সাথে ফ্রী গরম চা সিগারেটতো আছেই। হাওলাদার মশাই তার পুরনো রোগী। আবার বুড়ির উপর একটু রাগ হচ্ছে। এই সুযোগে বউকেও একটা উচিত শিক্ষা দেয়া যাবে। তাই সেও ধুলো পড়ে যাওয়া রেইন কোটটা গায়ে চাপিয়ে বুড়িকে না বলেই হাওলাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। পেছনে দরজা খোলাই থাকল।
হাওলাদার বাড়ি তার বাড়ি থেকে খুব বেশী দুরের পথ না। আধা কিলোর কম হবে। রাস্তায় অন্ধকার। তাই বৃষ্টিতে টর্চ জ্বেলেও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। টর্চের চার্যও শেষের দিকে। কে জানত তাকে এমন দিনে বাইরে বেরুতে হবে। বেশ কিছুদূর যাবার পর তার মনে হল যে তাকে ডেকেছে সে লোকটিকে একবারের জন্যও সে দেখতে পায়নি। এতে খুব অবাক লাগল তার । কি এমন তাড়া ছিল যে লোকটি তাকে না বলেই চলে গেছে? স্বপন ডাক্তার একবার ভাবল ফিরে চলে যাবে। কিন্তু বুড়ির উপর জেদের কাছে পরাজিত হল। তারপর প্রায় বিশ মিনিট অনেক কষ্ট করে হেঁটে অবশেষে হাওলাদার বাড়িতে পৌছুলো।
হাওলাদার সাহেবের প্রকাণ্ড বাড়ি। বাড়িতে থাকবার জায়গার অভাব না থাকলে কি হবে, থাকার মানুষ নেই। তার স্ত্রী গত হয়েছেন দেড় বছর আগে। দুই ছেলেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মেয়েটিও পরিবার নিয়ে কানাডা থাকে। স্ত্রী মারা যাবার পর মেয়ের কাছে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। মেয়েটিও তাকে দেশে রেখে আবার বিদেশ চলে গেছে। যাবার আগে বলে গেছে, তার বাবাকে সেখানে দেখবার কেউ নেই। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরী করে। তার মা মারা যাবার পর সে নাকি বেশ পাগলামো করতে শুরু করে দিয়েছিল। সেদেশের আইন কানুন অনেক কড়া। কোন অঘটন ঘটলে তাদের আর সেখানে থাকবার উপায় থাকবেনা। অনেকেই তার মেয়ের এই যুক্তিগুলো মেনে নিলেও এলাকার বেশিরভাগ মানুষই হাওলাদার সাহেবের ছেলে মেয়েদের প্রচুর সমালোচনা করে। হাওলাদার সাহেব আগা গোরাই খিট খিটে মেজাজের হওয়ায় কেউ তাকে পছন্দ করত না। লোকজন বাড়ির আশে পাশেও খুব একটা আসত না। দুই জন কাজের লোক দিন রাত তার দেখ ভাল করত।
বাড়িতে প্রবেশ করে স্বপন ডাক্তার কাজের লোক দুটির কাউকেই দেখতে পেলনা। বেশ পুরনো বাড়ি। হিন্দু সম্পত্তি কিনেছিলেন হাওলাদার সাহেব। বাড়ির এখানে ওখানেই মানুষের মূর্তি এখনো অক্ষত আছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। চারদিকে বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া কিছুই স্বপন ডাক্তার কানে যাচ্ছিলোনা। বেশ অস্বস্তি লাগছিল তার। এমন ছমছমে পরিবেশে সে কখনো এ বাড়িতে আসেনি। সে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বাড়ির আঙ্গিনা পেড়িয়ে বারান্দায় উঠতে যাবে ঠিক তখনই হঠাৎ করে বাইরে মৃদু বিজলী চমকাল। আঁতকে উঠে স্বপন ডাক্তার সামনে চেয়েই ভয় পেয়ে গেল। তার মনে হল ঠিক তার সামনে একটি প্রকাণ্ড মূর্তি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার বুকটা ধক করে উঠল। আসলেই সেটা কি বুঝে উঠবার আগেই আকাশের আলো গায়েব হয়ে গেছে। সে নিজের টর্চ জ্বালালো। সামনে যেতে যেতে মুর্তিটিকে পার হয়ে গেছে ততক্ষনে। কি মনে করে আবারো সেই মুর্তিটির দিকে টর্চের আবছা আলো ফেলল। কিন্তু সাথে সাথেই টর্চ নিভিয়ে ফেলল। আবারো সে যা দেখল তা আর দেখতে চায়না। এতক্ষণ যা তার কাছে শুধু অদ্ভুত মনে হয়েছিল, এখন সেটা বাস্তব মনে হল। কারণ মুর্তিটি তখনো তার দিকে তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে সামানে এগুতে যেয়ে বৃষ্টিভেজা বারান্দায় সে পিছলে পড়ে গেল। স্বপন ডাক্তারের তখন মনে হল, আজ বুঝি তার আর রক্ষা নাই। ভীত কন্ঠে সে কাজের লোকের নাম ধরে ডাকতে যাবে ঠিক তখনই একটা ঘরের ভেতর থেকে কাউকে ডাকতে শুনলেন, “ডাক্তার মশাই, বাইরে দাঁড়িয়ে কি করেন? ভেতরে আসেন”।
অনেকটা হাওলাদার সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে সে অনেকটা স্বস্তি পেল। এ বাড়িতে এমন অভিজ্ঞতা তার কখনো হয়নি। এসেই অন্যরকম অভ্যর্থনা পেত সে। কিন্তু সেদিন কাউকেই দেখছিল না। ভয় পাবার লোক সে নয়। কিন্তু আজ বেশ ভয় পাচ্ছে। যে ঘর থেকে হাওলাদার সাহেব ডেকেছিলেন, সে ঘরে প্রবেশ করে প্রবেশ করে দেখল, ঘরে কেউই নেই। জানালা খোলা, সেখান দিয়ে অনবরত বৃষ্টির ছাট ঘরে প্রবেশ করছে। বোঝাই গেল অনেকক্ষণ ধরেই এই ঘরে কেউ আসেনি। তাহলে তাকে ডাকল কে? কথাটা ভেবে তার শরীরে শিহরন এল। এই ঘরে হাওলাদার সাহেব থাকতেন না কখনোই। তিনি উপরের তলায় থাকেন। কাজের লোকদের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে স্বপন ডাক্তার দোতালায় উঠে এল। উপরেও ঘন অন্ধকার। নিচে তাও কাজের লোকদের ঘরের বাতি থকে কিছু আলো পাওয়া যাচ্ছিল। উপরে এর ছিটা ফোটাও নেই। স্বপন ডাক্তার এইবার ভড়কে গেল। সে নিচে যে মুর্তিটিকে দেখেছে সে তার সম্মুখে আর যেতে চায়না। এর মানে তার এই বাড়ি থেকে বাইরে বেরুবার রাস্তা বন্ধ। এতক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করেও কাউকেই সে দেখছেনা। একেতো লোকজনের কোন হদিস নেই, অপরদিকে যার ডাকে এখানে এসেছে তার দেখাও মিলছেনা। শুধু অদ্ভুত এক কন্ঠে কেউ তাকে নির্দেশনা দিচ্ছে। নানা কথা চিন্তা করে সে সামনে না এগিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে টর্চ লাইটের নিভু নিভু আলো মেরে চারদিক দেখতে লাগল। কে জানত এমন অন্ধকার বাড়িতে রাত বিরাতে এসে তাকে এমন বিপদে পড়তে হবে। এখন তার নিজের উপরেও খুব রাগ হচ্ছে। রাগের মাথায় কিছু না ভেবেই চলে এসেছে। মোবাইলটাও সাথে আনতে ভুলে গেছে। একসাথে এতগুলো ভুল তার হয়না। আজ দিনটাই বুঝি অশুভ। অন্য কেউ হলে এতক্ষনে নানা দেবতা প্রভুর নাম ধরে ডাকতে শুরু করে দিত। কিন্তু স্বপন ডাক্তার যে পনের বছর ধরে রাম নাম মুখেই আনেনা। সেই যে তার ক্যান্সার রোগী মৃতপ্রায় দিদির আরোগ্যের জন্য মান্নত করে সে ব্যর্থ হয়েছিল, তা থেকে সে আর কাউকেই প্রভু মানেনা।
হঠাৎ করেই স্বপন ডাক্তার তার নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনল। ততক্ষণে টর্চের চার্য একেবারেই শেষ। বুঝার উপায় নেই কে তাকে ডাকছে। মনে হচ্ছে দূর থেকে কেউ তাকে হাওলাদার সাহেবের মত করে ডাকছে, “ডাক্তার মশাই এইদিকে আসেন”। চারদিক থেকে এই ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অথচ বাইরের বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছেনা। কারো পায়ের আওয়াজও না। সেই ডাক বার কয়েক শোনার পর আর তা শোনা যাচ্ছেনা। তবে সে তার ঘাড়ের উপরে অজানা কোন শক্তির প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে। সেটি তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্বপন ডাক্তারের গলা দিয়েও কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছেনা। ততক্ষণে সে একটি পচা দুর্গন্ধময় ঘরে এসে প্রবেশ করেছে। এরপরে কি ঘটবে সে অপেক্ষাতেই সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি সেকেন্ড যেন তার কাছে এক একটি মিনিট মনে হচ্ছে। হঠাৎ করেই হালকা আওয়াজে বজ্রপাত হল। জানলা দিয়ে যে আলো ঘরে এল তাতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল পচা গলা হাওলাদার সাহেবের লাশ বিছানার উপরে পড়ে আছে। আর সেই মুর্তির মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লাশটির চোখদুটি ঠিক স্বপন ডাক্তারের দিকেই চেয়ে আছে। লাশ দর্শনের পর কিভাবে যেন সেই শক্তিটি তার ঘাড় থেকে সরে গেছে। সুযোগ পেয়ে স্বপন ডাক্তারও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে অজানা অন্ধকারে ছুটল।
পরদিন সকালে স্বপন ডাক্তারের আধা মৃত দেহ সেই মুর্তিটির কাছেই পাওয়া গেল। পুলিশ এলে আরও জানা গেল হাওলাদার সাহেবের দুই চাকরের কুকর্মের কথা। তারা দুজনেই চেলাই মদ আনতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে আজ সাত দিন ধরে হাজত বাস করছে। এর মাঝেই কোন একদিন হাওলাদার সাহেব মারা গেছেন। কেউ জানতেও পারেনি ভেতরে কি হয়ে গেছে ?
সবাই ভেবেছিল এখানেই বুঝি ঘটনার শেষ। কিন্তু স্বপন ডাক্তারের ঘটনা আরও রহস্যময় করতে আরেকটু এগুলো। কেউ তার স্ত্রীর কাছে দুর্ঘটনার খবর বলতে গেলে তাকে নাকি আশ্চর্য হতেই দেখা গেছে। কারণ সে বলছিল, তার পতি যদি হাওলাদার বাড়িতে যেয়ে থাকে, তাহলে সারা রাত ধরে তার পাশে লেপের তলায় কে শুয়ে ছিল?