বাসায় ফিরতে ইমরানের এখনো অনেক দেরি হবে। সারা সপ্তাহের মতো আজও রাত ১০টা বাজবে। একা একা সুমাইয়ার ভালো লাগে না। সন্ধ্যায় একাকিত্ব আরও বেশি অনুভূত হয়। তাই সে এ সময়টা ফেসবুকেই কাটায়। ইমরান অফিসে। বাসায় আর কেউ নেই। একা একা ভালো লাগছিল না বলে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিল সুমাইয়া— ‘একা একা ভালো লাগে না। পুরো বাড়িটা ভুতুড়ে মনে হচ্ছে! ফিলিং লোনলি!’
সুমাইয়া স্ট্যাটাসটি আপডেট করেছিল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।
সন্ধ্যা ৭টা ৫৮ মিনিট
আগামীকাল থেকে ছুটি শুরু। অফিসে কাজের চাপ বেশি। ইমরান নিজের ডেস্কে বসেই কাজ করছিল। ফোনটা বেজে উঠল। ফোন করেছেন তার শাশুড়ি—
: আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।
: ইমরান, তুমি এখনো অফিসে? (হন্তদন্ত কণ্ঠে)
: জি, আম্মা…
: তুমি এই সময়ে অফিসে বসে থাকতে পারলে?
: কী হয়েছে, আম্মা? কোনো সমস্যা?
: কী হইছে তুমি এখনো জানো না? আমি তাহলে কার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিলাম! এ কী হলো আমার কপালে! আমার মেয়ের এখন কী হবে?
ইমরান চেয়ারে বসে ছিল। শাশুড়ির কথায় দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘হ্যালো আম্মা, হ্যালো হ্যালো…।’ ফোনটা কেটে গেল। শাশুড়ির নম্বরে আবার ডায়াল করল। নম্বর বিজি।
রাত ৮টা ৫ মিনিট
ফেসবুকে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল সুমাইয়া। তাই লগআউট করে সিনেমা দেখতে শুরু করল। ইমরানের আসতে এখনো দু-তিন ঘণ্টা। বিয়ে হয়েছে বেশি দিন হয়নি তাদের। ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী দুজনই থাকে। ফোন বেজে উঠল। ফোন করেছে তার মা।
: হ্যালো, আম্মা। বলো, কী অবস্থা।
: কী অবস্থা মানে! তুই ভালো আছিস তো, মা?
: হ্যাঁ মা, কী হয়েছে?
: তোর বাসায় নাকি ভূতের আছর পড়েছে? কিচ্ছু হবে না, মা। চিন্তা করিস না। মনে মনে দোয়াদরুদ পড়। দোয়াদরুদ সব মনে আছে তো?
রাত ৮টা ১৫ মিনিট
ইতিমধ্যে ইমরান তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে মূল ঘটনা কী, সেটা জেনে গিয়েছে। কিন্তু তার ফোন বেজেই যাচ্ছে। এবার ফোন করেছেন স্বয়ং শ্বশুরমশাই!
: হ্যালো আব্বা, আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন, আব্বা?
: কেমন আর থাকব! বাসায় যে ভূত আছে, সেটা আগে জানা উচিত ছিল। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন একটা ব্যবস্থা করো। তোমার ছোট চাচাকে সব জানিয়েছি। সে বিশেষজ্ঞ। কিছু একটা উপায় বাতলে দেবে।
রাত ৮টা ৩০ মিনিট
কাউকে কিছু বোঝানো যাচ্ছে না। ফোন বাজছে। সুমাইয়ার বড় ফুফু ফোন করেছেন।
: হ্যালো ফুফু, বলো।
: মা, তুই টেনশন করিস না। আমি তোর ফুফাকে নিয়ে রওনা দিয়েছি। এখনো বাসের টিকিট পাইনি। আমার পরিচিত একজন ওঝা আছে। তাঁকে ফোন দিচ্ছি। কিন্তু পাচ্ছি না। মনে হয় তিনি কোনো অ্যাসাইনমেন্টে আছেন। তবে মা, তুই টেনশন নিস না।
: কিন্তু ফুফু, এ রকম কিছু…
: তুই ছোট মেয়ে, তুই কী বুঝবি! ফোন রাখ। ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে রাখিস। সঙ্গে আগুন রাখবি। ভূত আগুন ভয় পায়। যতক্ষণ আগুন আছে ততক্ষণ তুই নিরাপদ।
সুমাইয়া ক্লান্ত। দফায় দফায় ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এর কোনো সমাধান করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে সে স্ট্যাটাসটা ডিলিট করে দিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে! একটু আগে একটা অনলাইন নিউজ সাইট নিউজ করেছে—‘ভরসন্ধ্যায় বেডরুমে ভূত! (ভিডিওসহ)’।
রাত ৮টা ৪৫ মিনিট
হাতের কাজ শেষ করতে এখনো বেশ সময় লাগবে। চাইলেও উটকো সমস্যার অজুহাতে অফিস থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। ইমরানের ফোন আবার বেজে উঠল। ফোন দিয়েছে তার ছোট চাচাশ্বশুর।
: হ্যালো, চাচা।
: ভূতের ব্যাপারটা তোমার কী মনে হয়?
: আসলে চাচা, আপনি বুঝবেন…সুমাইয়া এমনি একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ভূত বলে তো আসলে কিছু নেই…
: হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম। ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু অশরীরী কিছু একটা যে আছে, সেটা অনেক সায়েন্টিস্ট স্বীকার করে। অতএব…
: জি, মানে, চাচা…
: শোনো, আমার পরিচিত একজন আছেন। উনাকে তোমার বাসার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। উনি যাবেন, ফুঁ দেবেন, ভূত বাপ বাপ করে পালাবে। আমরাও আসছি। তুমি একদম ভয় পেয়ো না। শক্ত থাকো। তুমি শক্ত থাকলে সুমাইয়াও শক্ত থাকবে।
রাত ৯টা ২ মিনিট
সুমাইয়ার শাশুড়ি মানে ইমরানের মা ফোন করেছেন। মোবাইল ফোন চার্জারে কানেক্ট করেই কথা বলতে হচ্ছে।
: হ্যালো আম্মা, আসসালামু আলাইকুম…
: ওয়ালাইকুম আসসালাম। মা, তুমি ঠিক আছ তো?
: হ্যাঁ, মা…
: গাধা ছেলেটাকে নিয়ে আর পারি না! ঘরে জিন-ভূত আছে, আগে জানাবে না! তাহলে না হয় আগেই একটা ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তোমার বাবা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার বন্ধুর খালাতো ভাইয়ের ফুফাতো ভাই এসব তাড়ায়। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
শাশুড়ির সঙ্গে কথা শেষ হতেই ফোন আবার বেজে উঠল। তার ছোট খালা ফোন দিয়েছেন।
: হ্যালো সুমাইয়া, তুই সত্যিই ভূত দেখেছিস? গায়ের রং কেমন ছিল রে? দাঁত কি সাদা? চুল কি কালো? তুই যখন দেখলি, তখন কি নড়াচড়া করছিল? এই সুমাইয়া, কথা বলিস না কেন?
রাত ৯টা ৩০ মিনিট
বসের হাতে-পায়ে ধরে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছে ইমরান। এবার তার মায়ের ফোন।
: হ্যালো, আম্মা।
: তুই এ রকম কেয়ারলেস কেন? বউমাকে একা একা একটা ভূতের বাসায় রেখে বসে আছিস! কত করে বললাম, একা একা থাকিস না! একসঙ্গে থাক। না, সে বউ নিয়ে আলাদা থাকবে। এখন বোঝ। বাসায় মুরব্বি না থাকলে হয় না। নে, তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।
: হ্যালো, আব্বা।
: তুমি কি সারা জীবন গাধাই থেকে যাবে? দ্রুত বাসায় যাও। আমরা তোমাদের বাসার কাছাকাছি।
: জি, আব্বা!
রাত ১০টা ৫ মিনিট
ইমরান-সুমাইয়াদের বাসায় মানুষের ঢল! সবাই শরীরের কোনায় কোনায় ভূত খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওঝা সাহেব রওনা দিয়েছেন। খবরটা শুনে আরেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ওঝা এলে তিনি চলে যাবেন! ঘটনা কীভাবে এমন হলো—এরই মধ্যে তা উদ্ঘাটিত হয়েছে। সুমাইয়ার দেওয়া স্ট্যাটাসটি নজরে আসে তার চাচাতো ভাই কফিলের। কফিল জানায় তার বোন রেবেকাকে। রেবেকা সেটা স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানায় তার ফেসবুক বন্ধুদের। সেখান থেকে জানতে পারে সুমাইয়ার খালাতো বোন। খালাতো বোন জানায় তার মাকে। সর্বশেষ তিনি সুমাইয়ার মাকে জানান, ‘আপা, সর্বনাশ হয়ে গেছে! সুমাইয়ার ঘরে তো ভূত! খুব নাকি কান্নাকাটি করছে…’
রাত ১১টা ৩ মিনিট
সবকিছু দেখে-শুনে সবাই একমত হলো, ভূত আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু অবশ্যই আবার আসবে। এসবের মধ্যে সুমাইয়া তার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে ওপেন করা ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে আছে উদাস দৃষ্টিতে। সামান্য সামাজিক যোগাযোগ করতে গিয়ে যে এমন গভীর সামাজিক যোগাযোগ হয়ে যাবে, তা সে ভাবতেই পারেনি! সুমাইয়া তাকিয়ে আছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে, ইমরান তাকিয়ে আছে সুমাইয়ার দিকে। অন্য সবাই তাকিয়ে আছে এ দুজনের দিকে। তারা নিশ্চিত, দুজনকেই ভূতে আছর করেছে!