মেজাজটা বেশ ফুরফুরেই ছিল বিকেল থেকে। কিন্তু বাড়িতে না ঢুকতে ঢুকতেই মায়ের সপ্তম স্বর, “অনিক, তোকে কত বার মানা করেছিলাম ওদের বাড়ির হুলোটাকে প্রশ্রয় দিস না, দিস না। সেই ডেকে ডেকে এনে মাছটা, মাংসটা মুখের সামনে ধরিস!”
–“আহা, কি হয়েছে তাতে? একটা নিরীহ প্রাণীকে না হয় একটু ভালোই বেসেছি! একটু ভালো মন্দ খাইয়েছি! তাতে হয়েছেটা কি?”
–“কাল করেছ! দুধ কলা খাইয়ে কাল সাপ পুষেছ! আজ চার চারটে মাছ ভাজা খেয়ে পালিয়েছে!”
মায়ের রাগের কারণটা বুঝলাম।
–“কাম অন মা, তাতে কি হয়েচে! ও তো সুযোগ পেলে খাবেই। তুমি রান্নাঘর বন্ধ না করে দোষ করলে, আর দোষ চাপাচ্ছ ওই অবলা প্রাণীটার ওপরে?”
–“খবরদার, আর একটা কথা বলবি তো মেরে তোর মুখটা ভেঙে দেবো”
মা সপ্তমে চড়ে গেছে দেখে আমি শূন্যতে নেমে এলাম। আর কথা না বাড়িয়ে কানে হেডফোনটা গুঁজে ‘মাইয়া রে মাইয়া তুই অপরাধী রে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে’ চালিয়ে ঘরে গিয়ে সোফার ওপরে ধপাস হয়ে গেলাম। ওহ্, ওই বাংলাদেশী পোলাটা, কি যেন নাম! হ্যাঁ, আরমান আলিফ, ফাটিয়ে লিখেছে কিন্তু গানটা! যেন আমারই মনের কথা লিখেছে এক্কেবারে!
চোখ দুটো বন্ধ করে আয়েস করে গানের লিরিক্সের তালে তালে ঘাড়টা দোলাচ্ছি , অমনি একটা রণহুঙ্কার!
— ‘শুনছিস!’
চোখ খুলে দেখি রুদ্রমূর্তি মা! হাতে উঁচানো বেলন। রুটি করছিল হয়ত!–‘আর যদি হুলোকে এ বাড়িতে ঢোকাস, তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। এই বলে রাখলাম।’
–“ওহ্ মা, সামান্য এতটুকু ঘটনাকে এত রগড়াচ্ছ বলো তো? তুমি না তিল কে বড্ডো তাল করো!”
–“হ্যাঁ রে শয়তান, পেটের ছেলের মুখে এটাই শোনার বাকি ছিল। আমি তিল কে তাল করি না! আর ওই মুরগি ঝুঁটির মা, ধোয়া তুলসি পাতা, না? দুপুরবেলায় চিল্লিয়ে পাড়া মাত করে দিল–আমি নাকি আমার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছি ওর মেয়ের দিকে! শাঁকচুন্নি মহিলা কোথাকার, শখ করে বেড়াল পোষার বেলায় পুষেছে, খেতে দেবার নাম নেই! লোকের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। পুরো ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে! হাড়-বজ্জাত মহিলা একেবারে! চিনি না ওকে! সাত বছর ধরে এক দেওয়ালে বাস করছি! আবার আমার ছেলের নামে দোষ দেওয়া! বলে আমি নাকি লেলিয়ে দিয়েছি ওর মেয়ের দিকে! ওরকম মুরগি ঝুটির দিকে আমার ছেলে ফিরেও তাকায় না রে, ফিরেও তাকায় না।”
বুঝলাম, কেস বেশ জন্ডিস। নিশ্চয়ই রত্নার মায়ের সাথে হুলোর মাছ খাওয়া নিয়ে দুপুরে এক রাউন্ড নরমে-গরমে হয়ে গেছে। সেসবেরই রিপিট টেলিকাস্ট এখন আমার কাছে হচ্ছে। বাবা বাড়ি ফিরলেও আবার একবার হবে। বিরক্ত হয়ে বললাম–“ওহ, আস্তে বলো, শুনতে পাবে ওরা।”
–“তা আবার শুনতে পাবে না, দেওয়ালে কান পেতে লোকের কথা শোনার অভ্যাসটা তো আর ঘুচবে না” বলে সজোরে একটা একশো আশি ডিগ্রি টার্ন নিয়ে ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস গতিতে বেরিয়ে গেল।
মুরগি ঝুঁটি অর্থাৎ রত্নাদের সাথে এক দেওয়ালে ঘর আমাদের। আমার বাবা আর রত্নার বাবা মানে প্রবীরকাকু একসময় অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে বনেদিয়ানার সাক্ষ্যবাহক এই বাড়িটাকে দুজনে সমান ভাগে কিনেছিল দুই বন্ধু একসাথে কাটাবে বলে। কিন্তু এটা অদৃষ্টের লিখন কিনা জানিনা, দুই বন্ধুতে বন্ধুতে যতটা অন্তরঙ্গতা হয়, বন্ধুর বউদের সাথে ততটা হয় না!
দুই বাড়ির মধ্যে একটা চোরা কম্পিটিশন সবসময় লেগেই থাকত। ওদের বাড়িতে পাবদার ঝোল হলে পরদিন
আমাদের বাড়িতে ভেটকির পাতুরি বাঁধা ছিল। ওদের বাড়িতে দু’কেজি হিমসাগর এলে আমাদের বাড়িতে পাঁচ কেজির ফর্দ হত। না খেয়ে পচে গেলেও হত! ওদের ডাব্বা টিভি বদলে এল. সি. ডি এলো, আমাদেরও এল. ই. ডি এসে গেল পরের সপ্তাহেই।
রত্না খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে আসত। তখন দেয়ার ওয়াজ নো ঝুটঝামেলা নো ঝগড়াঝাঁটি। রত্না স্কুলে যাবার আগে আমার মা ওর মাথায় বার্বি-ঝুঁটি বেঁধে দিত পরিপাটি করে। বাবা ওর জন্মদিনে দামী ড্রেস কিনে আনত। আমার জন্মদিনে রত্নার বাবা ভিডিও গেম উপহার দিত। সামার ভ্যাকেশনে দুই পরিবার মিলে পুরী বা দার্জিলিং বেড়াতে যেতাম। সে এক ঝক্কাস সময় ছিল!
ওপরের কম্পিউটার রুমে সচরাচর রত্নার মা আসে না। আমি এলে হুলো চলে আসে ওপরের ঘরে। জানিনা আমার কোনো বিশেষ গন্ধ ও পায় কিনা! ডিও তো লাগাই রত্নাকে ইমপ্রেস করতে। যাতে কাছাকাছি এলে ডিও-র অ্যাড গুলোতে যা-যা দেখায় তার অন্তত কিছুটাও হয়। আশায় আশায় থাকি। কিন্তু সে আশায় জল ঢেলে দেয় হুলো। রত্নাদের বাড়িতে এলেই পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে আমার। লোকে দেখলে হয়ত বলবে হুলো বড্ড নেওটা আমার! কিন্তু আমি জানি মালটা কি জিনিস! ইদানিং আমার সন্দেহও হয় হুলো আমার গতিবিধির উপরে স্পাইগিরি শুরু করে নি তো?
চিলেকোঠা ঘরের দরজাটা খোলাই থাকে। রত্না নেক্সট গানটা চালায়। ‘এক পহেলী লীলা’-য় সানি লিওনের ডান্স দেখতে দেখতে রত্নার রোমকূপ খাঁড়া হয়ে ওঠছে। নৃত্যরত সানির উদ্দীপক শরীরী বিভঙ্গে চোখ আটকে গেছে আমারও। ভেসে যাচ্ছি আমি বাস্তবের সীমানা ছাড়িয়ে কল্পনার মায়াকাননে। সেখানে শুধু আমি আর রত্না। রত্না আর আমি। আমি রত্নার কোলে শুয়ে আছি। ওর খোলা চুল হাওয়ায় উড়ে এসে পড়ছে আমার কপালে। চুলে সদ্যস্নাত ডাভ-শ্যাম্পুর খুশবু। কোমল হাতে নমনীয়তার পরশ। স্নিগ্ধতার মায়াবী ছোঁয়া। কখনও রত্না পেঁজা তুলোর মেঘে বাড়িয়ে দিচ্ছে হাত। মেঘ তুলে আনছে আকাশের জমি থেকে। নির্জন প্রান্তরে নাম না জানা অজস্র ফুল মাথা নাড়াচ্ছে। সেইসব ফুল তুলে রত্নার কানে গুঁজে দিচ্ছি আমি।
–“অনীকদা, সানি লিওনের একটা সিনেমা দেখাবে গো?”
আমার স্বল্পদৈর্ঘ্যের কল্পনাচিত্র রত্নার আচমকা সংলাপে চুরমার হয়ে গেল।
–“হুম। তবে বাড়িতে দেখা যাবে না। সিনেমা হলে যেতে হবে।” বিজ্ঞের মত বললাম আমি।
শেষ ওর সাথে সিনেমা হলে বক্সে বসে দেখেছিলাম ‘প্রাক্তন’ সিনেমাটা । সপ্তমীর দিন। তারপর সারাটাদিন আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে কলকাতার রাজপথ, অলিগলি, ছোটো-বড়ো সব পুজো প্যান্ডেলে ঘুরে ঘুরে যখন পা অসাড় হয়ে গেছিল, তখন পিটার ক্যাট-এ বসে ওর পছন্দের চেলো কাবাব দিয়ে সান্ধ্যভোজ সেরেছিলাম।
কিন্তু অষ্টমীর পর থেকে সব ইতিহাস! রাতারাতি আমাদের বাড়িতে ও লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে থেকে মুরগি ঝুঁটি হয়ে গেল, আর ওদের বাড়িতে আমি অনিক থেকে লম্পট!
তবে এরই মাঝে বেশ কয়েকবার সন্ধেবেলায় ছাদের পাঁচিল টপকে ওর চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে দেখা করে এসেছি। ছাদে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে গল্প করে এসেছি। ডজন খানেক হলিউড সিনেমা লোড করে পেন ড্রাইভটা ওর হাতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। এসবের সাক্ষী আছে শুধু হুলো। ও নিশ্চয় আমার কোনো গন্ধ পায়, তা নাহলে আমি ছাদ টপকে এলেও ও টের পেয়ে নিচে থেকে গুটিগুটি উঠে আসে কি করে?
এর মধ্যে একদিন তো দুপুরবেলায় পুরো কেস খেয়ে গেছিলাম। পুরো হাতে হ্যারিকেন, পেছনে বাঁশ। রত্নার সাথে চিলেকোঠার আড়ালে বসে গল্প করছি। অমনি ভিজে কাপড় শুকোতে দিতে রত্নার মাও ছাদে উঠে এসেছে।
আমাদের একসাথে বসে থাকতে দেখে রত্নার মা চোখ কটমট করে রত্নাকে নির্দেশ দিল– “নিচে যা। ভরদুপুরে ছাদে কি হচ্ছে? কাজকম্ম নেই? ধিঙ্গি মেয়ে একটা!”
রত্না কাঁচুমাচু মুখে ছুট দিয়েছিল নিচে।
কোথা দিয়ে প্রস্থান করব ভেবে না পেয়ে ঠায় দাঁড়ান আমার দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে রইল কাকিমা। তারপর মোলায়েম কণ্ঠে একেবারে গুছিয়ে বিষদাঁতটা বসিয়ে দিলেন–“অনিক, তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।”
–হ্যাঁ, কাকিমা বলো।
— তোমরা এখন আর ছোটো নেই, বড়ো হয়েছ। তাই হুটহাট করে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করাটা দৃষ্টিকটু লাগে। আর আমিও চাই না তুমি আর এই বাড়িতে আসো।
কাকুর ভিজে লুঙ্গিটা আমার মুখের সামনে ঝড়াম ক’রে ঝেড়ে তারে শুকোতে দিতে দিতে বললেন, ‘বিষ গাছে ফল ধরার আগেই গাছটা কেটে ফেলায় শ্রেয়।’ কথাগুলো অ্যামন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন যেন ডাঁটা চিবোচ্ছেন।
–‘কিন্তু রত্নার তো কম্পিউটারে এম. এস. অ্যাকসেসটা এখনও শেখাই হয়নি।’ মরিয়া হয়ে বললাম আমি।
–ওর জন্য তোমায় চিন্তা করতে হবে না। ওর গার্ডিয়ান আমরা, তাই ওর চিন্তা আমাকেই করতে দাও। আর তোমার ভালোর জন্যই বলে রাখি আমরা রত্নার জন্য আলাদা কম্পিউটার টিচার রেখেছি। তাই আজকের পর থেকে অন্য কোনো রকম অজুহাত দেখিয়ে এ-বাড়িতে তোমার না এলেও চলবে।”
শেষ কথাগুলো বেশ কেটে কেটে বলে সিঁড়ির গেটটা আওয়াজ করে লাগিয়ে নিচে চলে গেলেন।
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল এভাবেই। রত্নার সাথে আর তেমন দেখা হয়না। ছাদ টপকে বার দু’য়েক গেছিলাম ওদের চিলেকোঠার ঘরে। দরজায় আলতো টোকা দিয়ে ওকে ডাকতেই ভূত দেখার মত লাফিয়ে উঠল ও। ঘরে তো ঢুকতে দিলই না, উপরন্তু মায়ের ভয় দেখিয়ে প্রায় ঠেলে ফেরত পাঠিয়ে দিল। পেন ড্রাইভে ওর জন্য হেট স্টোরি টু এর গান গুলোর ভিডিও এনেছিলাম, সেটুকু পর্যন্ত বলার সুযোগ পেলাম না।
সেই থেকে রত্নার সাথে কথাবার্তা তো দূরের কথা, দেখা-সাক্ষাত পর্যন্ত বন্ধ।
দুদিন আগে রত্নার কম্পিউটার টিচারকে দেখলাম। টল, হ্যান্ডসাম, সুদর্শন। চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে। কানাঘুষো শুনছি একটা সরকারি চাকরি নাকি পেয়েও গেছে, শুধু জয়নিং বাকি। এই স্যারকে দেখার পর থেকে কষ্টটা যেন টপ গিয়ারে উঠে গেছে। বুকের কাছে চিনচিনে একটা চাপা ব্যথা সবসময় ঘুরপাক খাচ্ছে।
ক’দিন ধ’রে রাতে ঘুমোতে পারছি না একদম। ভোর রাতে যেটুকু বা ঘুম হচ্ছে তাতে শর্ট ফিল্ম গোছের দু-একটা স্বপ্নও দেখে ফেলেছি রত্না আর ওর কম্পিউটার স্যারকে নিয়ে। দেখছি, রত্না খুব সুন্দর সেজেছে। হাত ভর্তি গয়না পড়েছে ও। পাড়ার রিক্সাওয়ালা দুটো নতুন ট্রলি ব্যাগ রিক্সায় চাপাচ্ছে। রত্না রিক্সায় গিয়ে বসল। পাশে ওর কম্পিউটার স্যার। রত্নার পিঠের পেছনে হাত দিয়ে ওকে আগলে রেখেছে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে রিক্সাটা যাওয়ার সময় জানালায় দাঁড়ানো আমাকে দেখে রত্না হাত নেড়ে বলছে– ‘হানিমুনে যাচ্ছি গো অনিকদা, মানালি। ফেসবুকে ছবি পোস্ট করবো, শেয়ার করবে কিন্তু। টাটা…’
আমার হাতটাও যেন সুবোধ বালক। সুবোধ না হলেও অবোধ তো বটেই। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার গুনে হাতটা পেন্ডুলামের দোলন হয়ে বাই বাই করে দিল! ‘না’–বলে চিৎকার করে উঠি। চোখ খুলে যায়। আর খুলতেই ঘুমঘোর ভেঙে একটা বিষাদ এসে তেঁতো করে দেয় জিভটা। সারাটাদিন সেই তেতকুটে ভাব নিয়ে কাটাই। কোনো কাজে মন বসে না। নিজের বাড়ির ছাদেই ইতিউতি পায়চারি করি। ছাদ টপকানোর সাহস হয়ে ওঠে না আর। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি যদি রত্না একবার ছাদে আসে!
ইদানিং রত্নাও আর ছাদে আসে না। ও কি কম্পিউটার টিচারটার দিকে ক্রমশঃ ঢলে যাচ্ছে? টনটন করে ওঠছে রগটা। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
সেদিন মোহনদার ফুচকার দোকানে দেখলাম রত্না ওর বান্ধবীদের সাথে ফুচকা খাচ্ছে। সাইকেল নিয়ে বাজার যাচ্ছিলাম, দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ডাকতেই এগিয়ে এল আমার কাছে। বললাম–“একবার সাইকেলে চাপ, তোর সাথে অনেক জরুরি কথা আছে। বকুলতলায় গিয়ে বলব।”
— “না গো অনিক দা, মা জানতে পারলে খুব বকবে। খুব অশান্তি করবে। মা বলেছে, তোমার সাথে আর কোনদিনও ঘুরতে দেখলে আমার খুব শিগগির বিয়ে দিয়ে দেবে। সেদিন ছাদে দু’জনকে একসাথে দেখে ফেলার পর মা খুব বকেছে। সারাদিন ঘরে আটকে রেখেছিল।”
আমি ওর হাতটা ধরলাম। কোনো ভ্যানতারা না করেই সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম–“রত্না, তুই আমাকে ভালোবাসিস?”
‘জানিনা’ বলেই হাতটা ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেল বান্ধবীদের ভিড়ে।
ও লজ্জা পেল, না ভয় পেল, কিছুই ঠাওর করতে পারলাম না!
তারপর আজকে হুলোর এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। পুরো ব্যাপারটা ঘেঁটে ঘন্ট হয়ে গেছে। মাথার ভেতর গমগম করে বাজছে মায়ের কথাগুলো। যাও বা কিছু আশা ছিল, সেটুকুও আইন দ্য ভগাম্মা!
‘এক্ষুনি, এক্ষুনি তোর বাবাকে ফোন কর। আজই একটা নেট নিয়ে এসে গ্রিলের ফাঁক গুলো বন্ধ করে দিক। যেমন বেয়ারা মালিক তার পোষ্যটাও তো তেমনই হবে। কিভাবে ওদের জব্দ করতে হয়, আমার ভালো ভাবে জানা আছে’
— “ওহ্ মা, তুমি একটু শান্ত হও তো। তোমাদের না গায়ে পড়ে ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, তোমরা আরও কাটা ঘায়ে নুন ছেটাচ্ছ।”
–“শান্ত হব? ওই শাকচুন্নিটা আমাকে এত বড় কথা বলল, যে আমার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছি। এর পরেও তুই বলছিস শান্ত হতে। তুই তো বলবিই! বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি। পেটের ছেলেও যে এরকম বলবে… জানতাম, আমি জানতাম যে তুইও একদিন এ কথা বলবি, আল্টিমেটলি বাপের রক্তই তো বইছে শরীরে…।
বলতে বলতে মায়ের গলা ধরে এলো। –“দে দে, তোর বাবাকে ফোনটা লাগিয়ে দে, যা বলার আমিই বলছি।”
সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের গ্রিলে নেট লেগে গেল। এখন হুলোর যাতায়াতের পথ পুরোপুরি বন্ধ। হুলো আমাদের বাড়ি এলে তবু রত্নার গন্ধ বয়ে আনত, সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ছাদে ধুপধাপ আওয়াজ শুনে উঠে দেখি রত্নার বাবা আর মা দুটো ইমার্জিন্সি লাইট ধ’রে দাঁড়িয়ে আছে আর দুজন রাজমিস্ত্রি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আমার একমাত্র টপকানোর জায়গাটায় একটার পর একটা ইট গেঁথে চলেছে। আর রত্নার মা সেনাবাহিনীর কমান্ড্যান্টের মত দাঁড়িয়ে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। মাত্র আধঘন্টার মধ্যে দু-বাড়ির কমন পাঁচিলের উচ্চতা তিন-ফুট থেকে বেড়ে ছ-ফুট হয়ে গেল।
মাত্র আধঘণ্টায়… যেটুকু আশা বেঁচে ছিল, এই আধঘন্টায় সেটুকুও শেষ হয়ে গেল। আরও মনমরা হয়ে গেলাম। খাওয়া-পড়া-বাঁচা—সব কিছুই যেন করতে হয় বলে করছি। যেন বাঁচতে হয় তাই বাঁচছি। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না এ জীবনে। রত্নাময় পৃথিবীটা ক্রমশ রত্নহীন হয়ে যাচ্ছে!
মা আজ মামারবাড়ি গেছে। দুপুরে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি। হঠাৎ রান্নাঘরে বাসন কোসনের আওয়াজ। পা টিপে টিপে চুপিসারে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, দুধের হাড়ির ঢাকনা সরিয়ে বেশ আয়েস করে হুলো দুধ খাচ্ছে । আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালো। ওর গোঁফে লেগে আছে দুধের পুরু সর। আমাকে দেখে ধীর পায়ে, ভয়-ডর হীন হাঁটতে হাঁটতে, সদর দরজার নিচের ছোট্ট ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে কেতাদুরস্ত চালে বেরিয়ে গেল। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় দাঁড়িয়ে দেখলাম ওর চলে যাওয়াটা। যাবার আগে হুলো পিছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে একবার চিৎকার করল– ‘ম্যাও’।
আমি যেন শুনলাম, হুলো ব’লে গেল– ‘চেষ্টা করলেই হয়…’
[সমাপ্ত]