অনিশ্চিত পদধূলি

অনিশ্চিত পদধূলি

লোকটির সাথে যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন এই বটগাছটির সামনে শ্রীতিলতা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল তাও আবার তার নতুন বিয়ে করা স্বামীর সামনে। আমি সেদিন পর্যন্ত নিজেকে ধাতস্থ করে ছিলাম কিন্তু সেদিনের পর পারিনি। বটগাছটা প্রতিদিনের মত সেদিনও ছায়া বিছিয়ে শান্তি দিয়ে কষ্ট কুরোচ্ছিলো। শান বাধানো এই বটগাছের একটু পাশেই আনমনে সামনে চেয়ে থাকা লোকটিও একটু তাকিয়ে দেখেছিল আমাদের। কিন্তু কেন যেন তার চোখে কোন বিষ্ময় দেখিনি। কিছু কথা বলে শ্রীতিলতা যখন চলে গিয়েছিল তখন এই বটবৃক্ষের নিচে বসে অনেকক্ষন কেঁদেছিলাম আমি। যার সাক্ষী এই বটগাছ আর সেই লোকটা। বঠগাছটা এখনও আছে শুধু সেই মানুষটাকে আর পাইনি। যাকে এখনও খুজছি আমি শত মানুষের প্রেরনার ভিড়ে। শত প্রেমের সমাহারের এই পৃথিবীতে আমার জিবনে দ্বিতীয়বার ভালবাসার মানুষের জন্য ওই মানুষটির কিছু কথাই আমাকে পাল্টে ফেলেছিল। তবে কেন জানি মনে হয় আমার তার সাথে দেখা হবে।

কার্জন হলের সামনে এসে কোথায় যাব এমন একটা চিন্তা নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস তাই মনের মাঝে অজানা অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় কিছু বড় ভাই এসে অনেকভাবে মজা নেওয়া শুরু করল। সাধারনভাবে যেটাকে হেনস্থ করা বা র‍্যাগ বলে আরকি। প্রথম দিন তাই মাথা পেতে সহ্য করা ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। এদের থেকে ছাড়া পেয়ে ক্লাসের দিকে যাচ্ছি তখনিই ঘাসের ওপর বসে থাকা এক ছেলে ডেকে বলল, এই ছেলে এদিকে আয়। নিরুপায় হয়ে আরেকবার হেনস্থ হওয়ার জন্য মানুষিক প্রস্তুতি নিয়ে ওই ছেলের দিকে যাচ্ছি। কাছে গিয়ে বললাম, জি বলেন। ছেলেটি মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলল, বড়ভাইদের সালাম দিতে হয় এই ভদ্রতাটাও কি শিখিয়ে দিতে হবে? বাসায় কিছু শেখায় নি? আমি মাথা নিচু করে সালাম দিলাম। সালাম নিয়ে আবারও বলল, কোন ডিপার্টমেন্ট? আমি মৃদু শব্দে বললাম, ইংলিশ। ছেলেটি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। একটু পরে বলল, আমিও। আমি এবার ওর দিকে একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছি। বসা থেকে উঠে একটু কাছে এসে ছেলেটি বলল, বেটা আমিও তোর ব্যাচের। আর একই ডিপার্টমেন্টে। তোকে র‍্যাগ দিয়ে কিন্তু অনেক মজা। এসব বলেই ও হাসছে। আমার মেজাজ তখন তুঙ্গে উঠে গেছে। বেটাকে ধরে ঘাসের উপর ফেলে যেই মারতে যাব তখনি পেছন থেকে একটা মেয়ে তেড়ে এসে বলল, এই ছেলে ওকে মাড়ছো কেন? পেছনে না তাকিয়ে বললাম, ও আমার ব্যাচের হয়েও বেটা আমাকে র‍্যাগ দিয়েছে তাই মারছি। এ কথা বলে পেছনে তাকাতেই দেখি উজ্জল শ্যামলা বর্নের এক মেয়ে যার চুল কোমরকেও ছাড়িয়ে গেছে সাথে ছোট একটা হ্যান্ড বেগ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকতেই মেয়েটা প্রান উজাড় করে হাসছে আর পেছনে থাকা ছেলেটাও হাসছে। তখনি ওরা দুহাতে হাত মিলিয়ে হাই ফাইভ করল। আমি তখন শুধু তাদের দেখছি। এক সময় ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, দেখেছিস আমি পেরেছি। এবার চল খাওয়াবি। মেয়েটা হাসতে হাসতে সম্মতি দিলে ওরা দুজনে আমাকে সহ খেতে নিয়ে গেল। টিএসসিতে বসে চা খাচ্ছি। খেতে খেতে শুনলাম যে এই মেয়েটা আর ছেলেটা একসাথে কোচিং করেছিল। ভার্সিটির প্রথম দিনে এসেই কোন বলদ টাইপের এক ছেলেকে ধরে র‍্যাগ দিবে বলে ছেলেটা মেয়েটার সাথে বাজি ধরেছিল। মেয়েটাও বলছিল খাওয়াবে কিন্তু কি খাওয়াবে সেটা বলেনি। তাই তো এখন বসে শুধু চা খাচ্ছি। একদিকে ছেলেটা রাগে ফুসছে শুধু চা খাওয়ানোর জন্য আর অন্যদিকে মেয়েটা তার চালাকি খাটিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আর মাঝখানে আমি বলদ চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিচ্ছি। প্রথম দিন ভার্সিটিতে এভাবে যাবে ভাবতেই পারিনি। এর মাঝে ওদের সাথে পরিচয় হয়েছে। ছেলেটির নাম নাহিদ আর মেয়েটির নাম শ্রীতিলতা। মেয়েটা সনাতন ধর্মের ছিল। নামটা শুনে একটু খারাপ লেগেছিল। প্রথম দেখাতে যদিও মেয়েটাকে অনেক ভাল লেগেছিল তবে ও অন্য ধর্মের এটা জানার পর কেমন যেন উদ্ভট একটা খারাপ অনুভুতি হয়েছিল। পরবর্তিতে যদিও নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম কিন্তু কতদিনই বা পেরেছি। ক্লাস করার সময় যখন মৃদু গতিতে ধেয়ে আসা বাতাশে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যেত তখন আমি নিজেও অনেকটা এলোমেলো হয়ে যাই।

ক্লাস না করে তার দিকে তাকিয়ে থাকাটা কেন যেন একটা নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে যেত যখন ভাবতাম সে অন্য ধর্মের। এটা ব্যতীত তার সবকিছুই আমাকে ভাল লাগার ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিল। ক্লাসের পরে তিনজনে আড্ডায় বসে বিভিন্ন কথায় মাতিয়ে রাখতাম নিজেদের। কিন্তু এর মাঝেও তাকে লুকিয়ে দেখার সুযোগটা মিস করতাম না। এর মাঝে আবার নাহিদের এক মেয়ের সাথে কিছু একটা হয়ে গেল। তিনজন থেকে হয়ে গেলাম দুইজন। নাহিদ যেন আড্ডায় এসেও নেই। দুজনে খুব একটা কথা বলতে পারতাম না। এরপরেও চলে যেত দিন। তাকে বলতে পারতাম না নিজের ভালবাসার কথা। শুধু ভাবতাম, সমাজ যেটা মেনে নিতে পারে না সেটা ও একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে মেনে নিবে? তাছাড়া ও আমাকে ভালবাসে কিনা এটা তো জানিনা? এমনি একদিন ক্লাস করছিলাম আমরা। বরাবরের মত আমি শ্রীতিলতার থেকে চোখ ফেরাতে গিয়েও পারছি না। তখনি নাহিদ ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, কবে বলবি? যদি না বলতে পারিস তাহলে অনেকেই অবশ্য চিন্তা করছে যে ভালবাসার কথা বলেই দিবে ওকে। কিছু না বোঝার ভান করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি আমি। মুচকি হেসে ও বলল, আর নাটক করিস না। আমি জানি সবকিছু। আমি তখন ওর দিক থেকে মাথা ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছিনা আর এদিকে শ্রীতিলতাকে হারানোর ভয়টাও নিজেকে পেয়ে বসেছে। তখনি নাহিদ একটা রজনীগন্ধা ফুল বাড়িয়ে বলল, আজ আড্ডাতে গিয়ে এই ফুলটা দিয়ে প্রোপজ করবি। ওর হাত থেকে ফুলটা নিয়ে ভাবছি, আমি কি পারব এতটা সাহস নিয়ে কথাগুলো বলতে? এসব ভাবতে ভাবতেই একটু পরেই ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। শ্রীতিলতা ক্লাস থেকে বের হওয়ার আগে আমায় আর নাহিদকে ডেকে বলল, মাঠে আয় আজ পার্টি দিব। দুজনে বুঝেছি যে ও চা খাওয়াবে। তাই কোন কিছু বললাম না। কিন্তু আমার পা যেন অবশ হয়ে গেছে। কেন জানি এগোতেই পারছে না। আচ্ছা ওকে প্রোপজ করলে ও যদি না করে দেয় তাহলে কি কিছু হবে? সে কি কখনও কথা বলবে আমার সাথে? আচ্ছা সে মানলেও কি পরে এই সমাজটা মেনে নেবে? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মাঠে নাহিদ নিয়ে এসেছে টেরই পাইনি। শ্রীতিলতার পাশে দুজনে বসলাম। কেউ কিছু বলছিনা। একটু পরে নাহিদ আমায় বলল, তুই বলা শুরু কর আমি এখনি একটা গুরুত্বপুর্ন জিনিস নিয়ে আসছি। ও চলে গেলে শ্রীতিলতা আমাকে বলল, তুমি কি কিছু বলবে? ও তো কিছু বলার জন্য বলে গেল। আমি মুখে একটু হাসি আর অনেকটা ভয়ের মত চেহারা নিয়ে তার দিকে তোতলিয়ে বললাম, কিছু না তো। ও মজা করেছে হয়তো। মনে মনে ভাবছি রজনীগন্ধা ফুলটাও তো হাতে ঘুরাতে গিয়ে ফেলে দিয়েছি। এটা বলে ওর দিক থেকে অন্য দিকে চেয়ে আছি। একটু পরে যখন ওর দিকে তাকালাম, দেখলাম ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু পরে নাহিদ এসে হাতে কিছু কচুরিপানার ফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কিরে বলেছিস? আমি মুখ হা করে চেয়ে আছি ওর দিকে। মনে মনে শ্রীতিলতার কথা ভেবেও লজ্জা পাচ্ছি।

মেয়েটা যে কি ভাবছে? তবে নাহিদের দিকে তাকিয়ে অনেক রাগ লাগছে তাই মৃদু গলায় চোখ রাঙ্গিয়ে শুধু বললাম, কচুরীপানার ফুল দিয়ে এসব কেউ করে? তুই কি ভাই? ও অনেকটা হাপাতে হাপাতে বলল, আরে আশেপাশে অন্য কোন ফুল পেলাম না তাই এগুলোই নিয়ে আসলাম। তখনি নাহিদের হাত থেকে শ্রীতিলতা ফুলগুলো নিয়ে ওকে বলল, ওই যে তোর জুলিয়েট তোকে ডাকছে। জলদি যা আর আমাদের বিরক্ত করিস না। নাহিদ অনেকটা হেসে ফেলে আমার ঘাড়ে দুটো ঢুস মেরে বলল, শুভ কামনা তোর জন্য। এটা বলেই ও চলে গেল। আর আমি এদিকে শুধু ভেবেই চলেছি যে শ্রীতিলতা কেন ওকে চলে যেতে বলল? কিন্তু ওর দিকে তাকানোর সাহসটাও কেন যেন হচ্ছে না আমার। একটু পরে ও পাশে থেকে আমার হাতটা ধরে বলল, থাক আর ভয় পেতে হবে না। ভালবাসাগুলো ভয়ের জন্য ভালমত দৃশ্যমান হচ্ছে না আমার কাছে। এবার আমি ওর দিকে তাকালাম। তার হাতের স্পর্শে আমার সব লোমগুলো দাড়িয়ে গেছে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও লজ্জা পাচ্ছে অনেকটা। অন্যদিকে তাকিয়েই ফুলগুলো সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। অদ্ভুত এক সাহস আর ভালোলাগা আমায় গ্রাস করে ফেলল। তাই ফুলগুলো তার থেকে নিয়ে তার সামনে বসে একটু ভঙ্গি করেই তাকে প্রোপজ করলাম। লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখেই আমার এই পাগলামির জন্য তার হাসিটাও মনে হয় তার প্রতি আমার প্রেমের কারন। শুরু হল একসাথে পথচলা। তবে এই কচুরিপানা ফুলগুলোকেই আমার সবচেয়ে সুন্দর ফুল মনে হল। সেদিন আর ক্লাস করতে পারিনি। একে অপরের ভালোলাগা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ খুজতে খুজতেই সময় পার করে ফেলেছি। অথচ পুরোটা সময়েই আমার মনেই হয়নি যে ও অন্য ধর্মের। তাকেও এসব ব্যাপারে কখনও চিন্তিত হতে দেখিনি। যতদিন বেড়েছে তার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতাও অনেক বেড়েছে। প্রায় সময় আমরা এই শান বাধানো বটগাছের নিচে বসে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছি। তবে আমার একটা আক্ষেপ থেকেই যেত। মনে হত, তাকে আমি যতটা ভালোবাসি এতটা আমি বোঝাতেই পারি না। অন্যদিকে সেও আমাকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসতো। রমনা বটমুলের আগাছায় আমাদের অনেকভাবে নাম লিখা ছিল। এসবের সবথেকে বেশি সেই লিখেছিল। তার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোকে মনে করলে কোন কারন ছাড়াই মন ভালো হয়ে যায়। ইচ্ছের বিপীতেও নিজেকে ভাল রাখতে ইচ্ছে হয়। সাথে কাটিয়েছি পাঁচটি বছর কিন্তু কখনও তাকে এতটুকুও বিরক্ত মনে হয় নি। অনেকেই বলে প্রম মানেই প্যারা। অনেকটা ঠিক। বর্তমানে যেসব লুতুপুতু ঢং গুলোকে আমরা প্রেম বলে চালিয়ে দেই ওটা আসলেই প্যারা। তবে এই মেয়েটিই আমায় শিখিয়েছিল যে প্রেম হল দুটি মনের এক অদ্ভুত টান যার কারনে আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারি না। তাই আমার এটাকে প্যারা মনে হয়নি। তবে স্বীকার করি যে একটু হলেও প্যারা। অনেক নিয়ম মেনেও চলতে হয় তবে এটারও ও একটা সুন্দর কথা বলেছিল। বলেছিল, আমি তোমাকে কখনই তোমার কোন জিনিসে বাধা দিব না।

তুমি আমাকে ভালবেসে থাকলে সেটা নিজে থেকেই পরিবর্তন করে নিবে। এটা নিজের ওপর প্রভাব কাটিয়ে নয়, আমাকে ভালবেসে করবে, দেখবে তুমি করে ফেলেছো। এটা তোমার প্রতি আমার ভালবাসা। আমাকে কিছু বলতেই হবে না অথচ তুমি বুঝে যাবে আমি কোনটা পছন্দ করি না আর কেন করিনা। ও যখন এসব কথা বলতো আমি শুধুই তার দিকে চেয়ে এসব শুনতাম। তার সাথে থাকলে আমার কখনও মনেই হত না সমাজের চরম বাস্তবতার কথা। কখনও ভাবতামও না যে সে আর আমি অন্য ধর্মের এটা কিভাবে আমাদের এক হতে দেবে। অথচ এই চিন্তা আমি ওর মুখে কখনও দেখিনি। শুধু বলতো, তুমি আমার হাতটা ধরে যেদিকেই যাবে তোমার সাথে সেদিকেই যাব। তবে এর জন্য তোমাকে আমার হাতটা ধরে থাকতে হবে। আমি শান্তি পেতাম এটা শুনে। তখনি ওর হাতটা শক্ত করে ধরতাম অনেক। ওর হয়তো হাতে ব্যাথাও করত আমি শক্ত করে ধরাতে। একবার তো চোখ দিয়ে পানিও বেরিয়েছিল তবুও সে করুন চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। হয়তো বুঝেছিল আমার ভালবাসাটা অথবা বুঝেছিল তাকে হারানোর ভয়টা। কিন্তু কি যে হল না। গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছি আর ও মাস্টার্স এ ভর্তি হল। প্রথম বিসিএস এ প্রিলি আর রিটেন এ টিকলাম। আশা করছি ভাইভাতে ডাক পাবো। কিন্তু এর মাঝে ও একদিন বলল, বাসা থেকে বিয়ের কথা বলছে। ও বলল, অনেক কিছু বলে বাসায় কাটিয়ে দিবে আমি যেন চিন্তা না করে ঠিকমত পড়াশুনা না করি। কিন্তু এটা কি শান্তনায় হয়। এদিকে বাবা হঠাত অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাসায় এসে দেখি বাবা খুবি অসুস্থ। বাসায় কিছুদিন থাকতেই ভাইভাতে ডাক আসলো। কিন্তু যেদিন ভাইভা দিতে যাব সেদিন বাবা অনেক অসুস্থ। আমি কোনমতেই যেতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু বাবা আমাকে যেতে বলে। তাই চোখে কান্না নিয়েও আমার আসতে হয়। আমি বুঝেছিলাম বাবার অবস্থা। বারবার মনে হচ্ছিল আমি চলে গেলেই কিছু একটা খারাপ হবে। ভাইভা দিতে এসে এসব চিন্তার কারনে ঠিকমত কিছুই হল না। কিন্তু ফিরে এসে বাবা আর জিজ্ঞেস করেনি কিছুই। বলেনি আবার কিরে ভাইভা কেমন হল? বাবা আমি যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই নাকি চলে গিয়েছিল আমাদের ছেড়ে। সেদিন আমি কাঁদতেও পারিনি। চোখ দিয়ে পানিটা মনে হয় চোখেই শুকিয়ে গেছিল। ছোট ভাইটা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে আমি শান্ত ছিলাম সেদিন। কিন্তু রাতে পারিনি নিজেকে সামলাতে। কবরের সামনে গিয়ে একা একা অনেক কেঁদেও নিজেকে হালকা করতে পারিনি। শুধু বারবার এটাই মনে হয়েছিল, বাবা বলছে, এই বোকা, কাঁদছিস কেন? আমি তো আছি তোর সাথে। তোর ভাইটা আর মাকে দেখিস৷ আমি কিন্তু ওদের দায়িত্ব তোকে দিলাম। তখন থেকে এই পরিবারটার দায়িত্বও আমার। পারিবারিক অবস্থা খুব একটা খারাপ ছিল না। বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা আর কিছু জমিজমা ছিল যা দিয়ে ভালমতই চলছিল। কিছুদিন পর বিসিএস এর রেজাল্ট দিল। আমি টিকলাম না। আমার মাথায় আরও চাপ। এদিকে শ্রীতিলতা তার পরিবারের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছে।

ভেবেছিলাম যদি সরকারী বড় কর্মকর্তা হতে পারি তবে সমাজকে মানিয়ে নিয়ে ওকে নিজের করে নিব। তানাহলে সমাজের ওই বর্বর চোখগুলো এটা মেনে নিবে না। পরের বিসিএসের রিটেন পরিক্ষা শেষে যখন অন্য সরকারী পরিক্ষাগুলোর প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন শ্রীতিলতা একদিন দেখা করতে বলল। আমি ওর সাথে দেখা করার পর থেকেই তাকে চিন্তিত দেখছি। সেদিন সে শ্রীতিলতা ছিল না। সেদিন এসেছিল সে এই সমাজের হয়ে। আমাকে অনেক বোঝালো যে আমরা এক হতে পারি না। এটা কোনভাবেই হবে না। এই সমাজ আমাদের মেনে নিবে না। ও এসব বলছিল কিন্তু আমি কিছুই বুঝিনি সেদিন। তাকে ছাড়া আমাকে থাকতে হবে এটা একবারও আমার মাথায় আসে নি। শেষ মুহুর্তে যাওয়ার সময় ও বলেছিল, পরশু আমার বিয়ে। এরপর চলে গিয়েছে সে। এতটা শক্তভাবে কিভাবে এসব বলল সে? অথচ ও আমার সামনে তাকিয়ে একটা তর্ক কখনও করেনি। ওর চোখের পানি আমার কাছে ছিল মায়া আর ভালবাসা। কিন্তু সেদিন তার চোখে পানিও দেখিনি। আমি তার কথায় কিছু ভাবতে পারিনি। বিয়ের দিনে ওর বাসায় গিয়ে ওকে নিয়ে আসি। ওর হাতটি ধরে আমি ফিরে আসি এই ব্যস্ত শহরে যেখানে শুধু শ্রীতিলতা আর আমার সুখের দিনগুলো অপেক্ষা করছে। সারাটাক্ষন ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু যখন বাবার কথা মনে হল যে মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম। এখন যদি আমি শ্রীতিলতাকে নিয়ে আমার জীবন সাজাই তো আমাকে এই সমাজ মেনে নিবে না। তাহলে আমার মা ভাইটার কি হবে? এসব চিন্তা যখন আমার মাথায় গ্রাস করল তখন শ্রীতিলতার হাতটা ছেড়ে দিয়ে আমি দুহাতে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরি। শ্রীতিলতা আমার পাশে বসে ওর চোখের পানিটা মুছে আমাকে শান্তনা দিয়েছিল। বলেছিল, জীবনে অনেক কিছুই আমরা চাইলে করতে পারিনা তাই না? আমি কিছু বলিনি সেদিন। আরও বলেছিল, এই জীবনে হয়তো তোমার হওয়া হল না তবে যেটুকু ভালবেসেছো সেটুকু নিয়ে আমি জিবনটা কাটিয়ে দিতে পারব। তোমাকেও এভাবেই বাঁচতে হবে। যাও আরাফ, তোমার পরিবার তোমার দিকে চেয়ে আছে। আমি কিছু না বলে কেঁদেছি শুধু। ও ধীর পায়ে উঠে ফিরে গিয়েছিল সেদিন। আমি ছিলাম অপারগ। পরে শুনেছিলাম যার সাথে বিয়ের কথা ছিল তার সাথেই বিয়ে হয়েছে তার। ছেলেটা সবকিছু জেনেই নাকি বিয়ে করেছিল। আমার ভেতরে অনেক শুন্যতা তবুও কেমন করে যেন এই আমি মানুষের সামনে নিজেকে পুর্নতায় ভরপুর দেখাতে পারতাম। এবারও বিসিএসের ভাইভাতে ডাক পেয়েছি। তবে এবারেরটা আগের মত জরুরী নয়। জিবনটা এখন এভাবেই পার করে দিতে ইচ্ছে হয়।

তেমনি একদিন ব্যস্ত শহরের এই বটগাছের নিরিবিলি জাগায় এসে বসে বসে ঘাস চিবুচ্ছিলাম। তখন কোথা থেকে শ্রীতিলতা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি অবাক চোখে তাকে দেখে বসা থেকে দাড়িয়ে গেছি। কিছু না বলেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার অবাকের পালাটা আরও বেড়ে যায়। পেছনে এক লোককে দেখলাম এদিকে তাকিয়ে ছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরতে দেখে মাথা চুলকিয়ে ঘুড়ে দাড়ালো। শ্রীতিলতা ছেড়ে দিয়ে চোখে পানি নিয়ে বলল, একটু কি ভাল থাকবে না। কি অবস্থা করেছো নিজের? কি বা করার ছিল তোমার? এখন কি জিবনটা নিজের পরিবারের জন্য নতুন করে গোছানো যায় না? আমি মাথা নিচু করে আছি। একটু পরে শ্রীতিলতা ওই দুরে দাড়িয়ে থাকা লোকটিকে নিয়ে এসে বলল, উনি আমার স্বামী। এখন থেকে উনি আমার সব। মনে রেখো তোমার শ্রীতিলতা এই মানুষটির কাছেই ভাল আছে। আমি লোকটির দিকে চেয়ে হাসলাম। লোকটি বলল, জীবনে আমরা অনেক কিছুই পাই কিন্তু কিছু জিনিসের অপুর্নতা থেকেই যায় ভাই। তা কখনও পুরন হবার নয়। আপনি নতুন করে শুরু করুন। জীবন থেমে থাকার জন্য নয়। তার সাথে হাত নাড়িয়ে আমি বললাম, চেষ্টা করব ভাই। ওকে দেখে রাখবেন। বিদায়ের সময় শ্রীতিলতা ওর স্বামীকে বলল, তুমি যাও আমি একটু আসছি।

ওর স্বামী আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলে ও আমার একটা হাত ধরে বলে, আর কতদিন থাকবে এভাবে? এবারতো একটু ভাল ভাবে থাকো। আমাদের দেখছো না। শুধু ভেবে রেখো আমি ভাল আছি তাই তোমাকেও ভাল থাকতে হবে। একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও। আর ভালো থেকো বলেই চলে গেলো। যাওয়ার সময় পেছন থেকে তার চোখের পানিটা আমার অচেনা নয়। তখন কেমন যেন আমিও অনেকটা ভেঙ্গে পরি। ওখানে বসেই পাগলের মত কেঁদেছি আমি। তখনই পেছনে হাত দিয়ে আমাকে একজন আশ্বস্ত করছিল। তাকিয়ে দেখি এক লোককে। কিছু কথার মধ্যে লোকটি বলেছিল, জীবন আমাদের অনেক কিছুই দেখায় তবে এর মধ্যে না পাওয়ার ব্যর্থতা গুলোই বেশি। তবে জীবন নিরাশ করে না। লেগে থাকেন, জীবন একটা সময় এমন কিছু দেয় যার গুন বুঝে শেষ করা যায় না। বিয়ের পরেও একজন মানুষ তার স্বামীর সামনে তার পুরনো প্রমিককে এসে জড়িয়ে ধরে। এই অর্জনটাও কম নয়। তবে চেষ্টা করেন হাজারো মানুষের ভিড়ে আপনি আর আপনার জীবনের গল্পটা যেন হারিয়ে না যায়। এটা বলেই লোকটি চলে গিয়েছিল। লোকটির কথা তখন আমি বুঝিনি। তবে পরে বুঝতে পেরেছি এই কথাগুলি আমার জীবনে কি পরিবর্তন এনেছিল। বিসিএসের ভাইভা এবারও দিয়েছিলাম। কিছু বলতে পারিনি। তারা বলেছিল, আপনি কি ভাইভা দিতে এসেছে নাকি আমাদের চেহারা দেখতে? মাথা নিচু করে আমার হাসিমুখে কান্না করছিলাম। বেশ কয়েকমাস পর যখন হলুদ খামে এক চিঠি আমি পেলাম আর খুলে দেখলাম, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। নিজের মধ্যে তেমন একটা অনুভুতি হয়নি। শুধু বাবার কবরে গিয়ে বলেছিলাম, আজ এই খুশির খবরটা শোনার জন্য তোমার মত কেউ নেই বাবা। কাকে বলব এই খুশীর খবরটা বলতো? মা আর ভাইটার খুশি দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল। আমি বুঝেছিলাম, বাবা চলে যাওয়ার পর সমাজে আমাদের অবস্থান কতটুকু। কিন্তু এখন একটা ভাল অবস্থান আছে। শ্রীতিলতার শশুরবাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। বাড়ির সব লাইটগুলো নিভে গেলে আমি দির্ঘ্যশ্বাস ছেড়ে চলে আসি। পেছনে ফিরে একবার ভেবেছিলাম, বিসিএস ক্যাডার হয়েও আজ তোমাকে পেলাম না আমি। এরপর ব্যস্ত জীবনে জড়িত হয়ে নিজের জীবন অতিবাহিত করাই ছিল আবশ্যক।

তো বিয়ে করলেন কেন? কে করতে বলেছিল?

হঠাৎ পাশের জনের এই কথাটা শুনে আমার কেমন যেন একটা খারাপ লাগলো। দেখলাম পাশের জন এক গাঁদা অভিমান নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। বললাম, তুমি শুনতে চেয়েছো দেখেই কিন্তু বলেছি সবটা। আর এখনও শেষ হয়নি আরেকটু শুনো।

কিছুদিন পর মা যখন আমাকে বিয়ের কথা বলে তখন আমি একেবারেই নিষেধ করে দেই। তবুও মা দেখি এক ঘটকের সাথে কথা বলছে। ঘটক ব্যাটারে একদিন ডেকে এনে বাসায় যেতে নিষেধ করি। বেচারা একটু ভয়ই পেয়েছিল। কিন্তু মা খুব মন খারাপ করে। তাই মায়ের জন্যই একটু একটু মেয়ে দেখা হচ্ছিল। যেখানেই যাই সেখানেই সবাই রাজী। সবাইকে যখন বলাতাম আমার একটা অতীত আছে। তখন তারা বলতো, এরকম এখন সবারই থাকে তাই সমস্যা নেই। ম্যাজিস্ট্রেট বলে সবাই সব কিছু মেনে নিতে রাজি আছে। তাই ভাল কাউকে পাওয়ার জন্য ঘটক ব্যাটাকে বলি যে এবার থেকে পাত্রী পক্ষকে বলবি যে পাত্র শুধুই একজন সরকারী হিসাবরক্ষক। আর কিছু নয়। তখন অনেক সমন্ধই আসলো কিন্তু অতীত সমন্ধে কিছু বললে তারা না করে দিত। তারপর তো একদিন দেখতে গেলাম রিমি নামের এক মেয়েকে। সবাই রাজি ছিল।

মেয়েটিকে আর আমাকে যখন এক ঘোরে পাঠানো হল, তখন সেই প্রথম বলেছিল আপনার কি কোন অতীত আছে? মেয়েটাকে সংক্ষেপে কিছুটা বলি। এটা শোনার পর রিমি বলে, ভবিষ্যতে এরকম কোন কিছু হওয়ার কথা আছে কি? আমি মৃদুভাবে নাসূচক মাথা দুলিয়েছিলাম। কেন জানি আমার মনে হয়েছিল, রিমি মেয়েটি আমাকে বুঝবে। তাকে শুধু একটা কথা বলেছিলাম, সারাজীবন এই হাতটি ধরে কাটিয়ে দিতে পারবেন? মেয়েটি মৃদু হাসলো। অনেকটা ভাললাগা অনেকদিন পর নিজের মাঝে আন্দোলিত হল। উত্তরে মেয়েটি বলেছিল, যতদিন না আপনি মেরে ফেলছেন ততোদিন ছাড়ছি না। আমার মুখেও তখন খানিকটা প্রসারীত হাসি। এরপর আমাদের বিয়ে হল। মেয়েটি বাসায় এসে অনুষ্ঠানে জানতে পারল আমি ম্যাজিস্ট্রেট। বাসর ঘরে ঢুকে আমি সালাম দিয়ে যখন কথা বলতে যাব তখনি মেয়েটি বলল, আমাকে এভাবে ধোকা না দিলেও পারতেন। আমি বলেছিলাম, আপনি কি খুশি হননি যে আপনার স্বামী একজন ম্যাজিস্ট্রেট? উত্তরে মেয়েটি বলল, আমি ভালবেসেছিলাম একজন হিসাবরক্ষক কে, কোন ম্যাজিস্ট্রেটকে নয়। বলেই চুপ করে ছিল। আমার ভেতরে তখন শুধুই ভাললাগার অনুভুতি। আমি তবে সত্যিকারের কাউকে পেয়েছি। সারারাত কথা হল না। এমনকি বউভাতের দিনও একটা কথা হল না। পরেরদিন সে বাসা থেকে ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেল। শুধু মাকে বলেছিল, ভাল থাকবেন মা। মাও কিছু বলেনি। শুধু আমার ওপর এক ডালি রাগ ছুড়ে দিল। আমি আবার তাকে আটকানোর চেষ্টা করিনি। সত্যি বলতে ওতোটা ফ্রি হতে পারিনি আমি তখনও। তাই ভাবলাম তাকে একটু সময় দেই। কিন্তু বিধিবাম সেইদিনই অনেক জ্বর আসলো আমার। এমন জ্বর যে আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছি না। মা আর ছোটভাইটা ডাক্তার ডেকে এনে অনেক কিছু দিয়েছে। তবুও কেন জানি জ্বরটা সারলো না। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো। ডাক্তার এসে স্যালাইন ঝুলিয়ে দিল। কিন্তু মনে হয়না কিছু হবে। আমি এই অবস্থায় ভাবছিলাম, আমি বুঝি এবার শেষ। চতুর্থ দিনে কারও হাতের ঠান্ডা স্পর্শে ঘুম ভাঙলো। স্যালাইন তখনও চলছে। মেয়েটিকে দেখে আমি অবাক। রিমি এখানে এসেছে। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর হাতের স্যালাইনটা সে খুলে নিল। আমি ভ্রু কুচকে ভাবছি, কি ব্যাপার এই মেয়ে কি আমাকে মেরেই ফেলবে নাকি? তারপর ও প্রেসক্রিপশন দেখে বাইরে গেল। পানি নিয়ে আসলো। তারপর দেখছি শার্ট খুলছে। আমি তো শার্ট দুহাত দিয়ে ধরে আছি যেন খুলতে না পারে। রিমি কপট রাগী চোখে তাকিয়ে হাত দুটো সরিয়ে দিল। আমি শুধু তখন দোয়া করছিলাম আল্লাহ বাচাও। কিন্তু একটু পরে ও আমাকে উঠে বসিয়ে গা টা পানি দিয়ে মুছে দিল।

মাথাটা ধুয়ে দিয়ে ভালভাবে মুছে দিল। তারপর প্লেটে কিছু খাবার এনে খাইয়ে দিল। এর মাঝে মা একবার আর ভাই বেশ কয়েকবার এসে দেখে গেছে। ভাইকে মনে মনে বলছি তোর ভাবীর সাথে রোমান্স চলছে এখন যা। পরে আসলেই আর এলো না সে। এদিকে ও আমাকে খাইয়ে দিয়ে সাথে কিছু ওষুধও খাইয়ে দিল। তারপর বিছানাটা ঠিক করে আমাকে চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে বলল। কিছুক্ষন পরে যখন ডাক্তার এলো তখন রিমিকে দেখেই বলল, আপনি স্যালাইন বন্ধ করেছেন কেন? রিমি তখন হেসে বলল, ডাক্তার সাহেব আপনাকে আর এখানে আসতে হবে না। ওনার দায়িত্ব এখন আমার। আর আমিও একজন ডাক্তার। এই নিন আমার কার্ড। পরে ডাক্তার আর কিছু বলল না। হয়তো সাহস পেলো না। কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম ওকে। ও যে ডাক্তার সেটা তো বলেনি। তাই ভাবলাম সুস্থ হলে এটা বলে আমিও রেগে থাকবো। কিন্তু হল কই। তার কাছে সময়ই নেই। বিকেলোর দিকে নিজেকে একটু হালকা লাগলো। তাই বারান্দায় আস্তে হেটে গেলাম। একটু পরেই ও পেছনে এসে বলল, এই চা টা খেয়ে নিন। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ফিরে এলে যে? ও অনেকটা ঝাড়ি দিয়ে বলল, সমস্যা করছি, চলে যাই? আমি হাসলাম এটা শুনে। বললাম, তুমিতো বলেছিলে ছেড়ে দেবেনা এই হাতগুলো। তবে কেন চলে গেলে? ও বলল, আমি এমন একজনকে চেয়েছিলাম যে শুধু আমাকে ভালবাসবে। আপনি তো অনেক বড় মানুষ আপনার কাছে তো আমাকেই নিচু হয়ে চলতে হবে। আর এজন্যই আমি ডাক্তার হয়েও একজন হিসাবরক্ষক কেই বিয়ে করতে চেয়েছি। কিন্তু আমার কপালেই নেই কিছু আর এসব বলে কি হবে? আমি চায়ের কাপটা নিয়ে বললাম, বের হবে আমার সাথে, একটা জায়গায় যাব। ও চিন্তিত মুখে বলল, আপনি এই অবস্থায় কোথায় যাবেন? ওকে বললাম, তুমি রেডি হয়ে নাও আমি আসছি। আরও বললাম, মাথায় টিপ দিও।

এরপর তো তাকে নিয়ে এই বটগাছের নিচে চলে আসি। আর এতোক্ষন রিমিকেই এসব বলছিলাম। সবটা বলে যখন একটু থামলাম তখন রিমি বলল, তো এরপর শ্রীতিলতার সাথে আর কখনও দেখা হয়েছিল? আমি বললাম, না দেখা হয়নি। হয়তো সমাজ আমাদের মেনে নেয়নি তবে সমাজকে উপেক্ষা করে আমরা একে অপরের প্রতি সম্মানটা বজায় রেখেছি। আর ওকে সেদিনই ফেলে এসেছি যেদিন আমার কাছে সেই স্বপ্নের কাঙ্খিত হলুদ খামটা হাতে এসেছিলো। আর একটা কথা বলি। ও কিছু বলল না। তাই বললাম ম্যাজিস্ট্রেটরাও মানুষ, এরাও ভালবাসতে জানে। তাই ভালবাসার কমতি হবে না আশা করি। আর তুমি আমার স্ত্রী তাই তোমার আমার মধ্যে কোন উচু নিচু বিভেদ না থাকাই শ্রেয়। আশা করি তুমি আমাকে বুঝেছো। হঠাৎ দেখি পাশে বসা মেয়েটা আমার হাত শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আমি ওর মাথাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, একটু সত্যিকারের ভালবাসা খুজতেই কিন্তু মিথ্যে বলে বিয়ে করা। তবে সত্যিকারের মানুষটা এখনও আমার বুকটা খালি করেই রেখেছে। তখন ও বুকে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমাকে অনেক ভালবাসতে হবে কিন্তু। আমিও তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে নিলাম। বললাম ভালবাসার দিক থেকে বিন্দুমাত্র কমতি থাকবে না। তবে আমিও কিন্তু একটু ভালবাসার অপেক্ষায় থাকব। ও বুকে মাথা রেখেই বলল, অপেক্ষায় থাকতে হবে না, এমনিতেই পেয়ে যাবেন। ও যখন বুক থেকে মাথা উঠালো তখন আমার পড়নের শার্ট টাতে ওর লালা আর লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। ওকে বললাম, মানুষ কি বলবে এসব দেখলে? আর মা কি ভাববে ভেবেছো?

ও অনেকটা জোরেই বলল, মানুষের কথা শুনে কি বিয়ে করেছেন? মানুষের কথা শোনার সময় এখন নয়। অনেক তো হারিয়েছেন তবে এই সমাজের মানুষেরা আপনাকে কি দিয়েছে? আমি মৃদু শব্দে বললাম, এই যে তোমাকে দিয়েছে। এটা শুনে ও চুপ হয়ে গেল। আমি ওর একটা হাত ধরে বললাম, আচ্ছা মা কি ভাববে বলতো? ও বলল, কি আর ভাববে? ভাববে যে উনার ছেলে বিয়ে করেছে সাথে…… এটা বলেই ও চুপ হয়ে গেল। আমি বললাম, সাথে কি? লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা নিয়ে ও আর কিছু বলল না। শুধু ওর হাতটা ধরে সামনের ফাকা রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি। গন্তব্য সেই লোকটির খোজ আর একটি ভালবাসার কুঁড়েঘর এর খোজে। কারন একদিন এক চিঠি এসেছিলো, যেখানে লিখা ছিল, মামুন বলছি। অনেক ভাল লাগলো আপনাকে দেখে। নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছেন। আশা করি আপনিও একজন স্বপ্নচোরই হবেন। শুধু একটু মানুষদের দেখবেন। যারা আপনার মত কিছু খোজের অপেক্ষায়। প্রথম প্রেমকে ভোলা যায় না তবে মানুষের শুরুটা ওখান থেকেই হয়। আপনি পেরেছেন তবে আপনার প্রমিকাও কিন্তু পেরেছে। বুঝতে পারছি আপনারা দুজনি অসাধারন। এখন নতুন জিবনে আপনাকে স্বাগতম জানাই। তবে অতীতটা ভুলবেন না। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিন।

আর কিছু ছিল না। তাই আমার খোজ এখন সেই লোকটি। লোকটি কে ছিল। রিমিকে বলেছিলাম আমি লোকটির কথা। সেও আশ্চর্য হয়েছিল তবে খুব একটা মাথায় নেয় নি। হঠাৎ চলতে চলতে রিমি আমায় বলল, আপনার ওই লোকটার সাথে কখনও দেখা হয়েছিল আর? আমি কিছু বলার আগেই পাশেই একটা সুন্দর একতলা বাড়ি দেখলাম আর সাথে দেখলাম সেই লোকটি কিছু বাচ্চার সাথে কানামাছি খেলছে। রিমিকে বললাম, মাত্র দেখা হল। কিন্তু তার কাছে গেলাম না। লোকটিও আমাদের দেখল তবে কিছুটা তাকিয়ে আবার খেলায় মত্ত হল। লোকটির নাম মামুন আর সে নাকি স্বপ্নচোর। তবে লোকটির কাছে আমি অনেকটা কৃতজ্ঞ। তাকে এসব বলে আটকাতে চাই না কারন স্বপ্নচোরদের বাধা হতে নেই। তারা এভাবেই মানুষের মনে স্বপ্ন চুরী করে জমা করে রাখে। এখন শ্রীতিলতার জন্য কিছু কথা শুধুই মনে রয়ে যায়,

মনে পরে শ্রীতিলতা
কবিতায় তোমাকে, একদিন কত করে ডেকেছি।
আজ হায় শ্রীতিলতা
দেখা হলে বলব, তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত