অব্যক্ত স্মৃতিগুলো

অব্যক্ত স্মৃতিগুলো

ফাহাদ ভাই হলেন বেশ গম্ভীর টাইপের একটা ছেলে । আমাদের পাশের বাসাতেই থাকেন তিনি । আমাদের এলাকায় ওনার মতো কিউট ছেলে আর একটিও নেই । দুবছর হলো আমরা এই বাসাটা ভাড়া নিয়েছি । কিন্তু এর মাঝে একটা বারের জন্যও ওনাকে হাসতে দেখলাম না । বাড়িতে হয়তো তিনি একাই থাকেন কারন এতোদিনে তিনি ব্যতীত অন্য কাউকেই দেখি নি ওই বাড়িতে। রোজ সকালে অফিসে চলে যান আর আসেন সেই সন্ধ্যায় । আমার পড়ার টেবিলের পাশে একটা মস্ত বড় জানালা। আর সেই জানালার অপরদিক থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় ফাহাদ ভাইয়ের বাড়ির ফুলের টব দিয়ে সাজানো বারান্দাটি। মাঝেমাঝেই রাতের বেলা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি কিংবা চা পান করেন তিনি । তখন তার চেহারায় গম্ভীরতার সাথে সাথে অন্য কিছুও দেখতে পাই আমি । একটা অব্যক্ত চাপা কষ্টের ছাপ দেখতে পাই আমি ফাহাদ ভাইয়ের চোখেমুখে !

মাঝেমধ্যে আমার খুবই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে ,
” ভাইয়া , এতো গম্ভীর কেনো আপনি ?! আপনাকে এভাবে থাকলে অনেক পঁচা লাগে !”
কিন্তু তা আর মুখ ফুটে বলা হয় না। পাছে কিছু বলে কিনা এই ভয়ে ! এখানে আসার পরে মনে হয় বেশি হলে চার-পাঁচ বারই কথা বলেছি ওনার সাথে । আমার ছোট ভাই ফারহানকে দেখি প্রায়ই কথা বলে ওনার সাথে । ওকে বেশ ভালোবাসেন তিনি । প্রথম প্রথম ওনার গম্ভীরতা দেখে আমি খুব ভয় পেতাম । কিন্তু সেই ভয় কেটে গেছে তার গুছানো কথা গুলো শুনতে শুনতে । চেহারায় গম্ভীর ভাবটা বজায় রেখেও তিনি অনেক ভালোভাবে কথা বলতে পারেন !

ফাহাদ ভাইয়ের একটা জিনিস আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি এখানে আসার পর থেকে । এলাকার সকল ছেলে পুলেই ওনাকে অনেক মান্য করেন। ওনাকে দেখেই মাথা নিচু করে হাঁটে , এমনকি বয়সে বড়রাও । এইতো সেদিনই বান্ধবীদের সাথে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দুই তিন জন বখাটে ছেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে খুব বাজে বাজে কথা বলছিল । ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন ফাহাদ ভাই এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন তারপরে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই ওগুলো ভয়ে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে পালালো । আমি ফাহাদ ভাইকে ‘ধন্যবাদ’ জানালে তিনি সেই পুরনো গম্ভীর লুক দিয়ে চলে গেলেন । ছেলেটা সত্যিই আজব !

একটা মানুষ এভাবে কীভাবে থাকতে পারে ? আর ওনার বাবা মাও বা কোথায় থাকেন ?! কারও সাথেই তেমন একটা কথা বলেন না । একা একা থাকতেই বোধহয় ভালোবাসেন আজব ছেলেটা !

বেশ কিছুদিন ধরে আমি যেন সারাদিনই ওনার কার্যকলাপ দেখার জন্য বসে থাকি । কেনো এমনটা করি আমি তার আগা মাথাও বুঝি না । শুধু জানি ওনার এই গম্ভীরতা আমার ভালো লাগে । কেমন যেন একটা মিষ্টার পারফেক্ট পারফেক্ট ভাব আছে ওনার চেহারায় !

প্রতিদিন সন্ধ্যায়ই আমি পড়ার টেবিলে বসে পড়তে থাকি জানালা খোলা রেখে । অপরদিকে ফাহাদ ভাইও তার বারান্দার ইজি চেয়ারটায় বসে বসে কাপ হাতে নিয়ে কিছু একটা পান করেন । আমি তখন বইটা বন্ধ করে ওনার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি । তখন আমি ওনার চেহারায় ফুটে ওঠা বেদনাটা স্পষ্ট দেখতে পাই যেটা হয়তো তিনি কাউকে দেখাতে চান না !

যত দিন যাচ্ছে ততই আমি দূর্বল হয়ে পড়ছি এই বেরসিক গম্ভীর ছেলেটির উপর !
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে , আমি ওনাকে যদি একদিন না দেখতাম তাহলে ওই দিন আমার কোনো কিছুই ভালো লাগতো না !

বিষয়টা আমার বেস্টু মুনার কাছে জানালে ও বলল অন্য কথা !
— দিয়া , তোর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে তুই তোর ফাহাদ ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গেছোস । এখন ওসব ভাইয়া ডাকা বন্ধ করে বাবু ডাক যা ।

— মুনা তুই এসব কি বলছিস ? ছি ! আমি ফাহাদ ভাইকে অইভাবে দেখি না । আমার জাস্ট ওনাকে দেখলে ভালো লাগে । তাই বলে যে প্রেমে পড়েছি এটা কিন্তু না ।

— তোর লক্ষণে তো তাইই বলে । যাইহোক , দেরী না করে ওনাকে বলে ফেল যে তুই ওনাকে ভালোবাসিস ।
— ধ্যাত । থাম তো ! তোকে বলাই ঠিক হয় নি !

সেদিন মুনার সাথে এবিষয়ে আর কোনো কথা বললাম না । কিন্তু বাসায় আসার পড়ে ওর কথাগুলো বেশ ভাবালো আমাকে !

আজ দুদিন ধরে ফাহাদ ভাইকে দেখছি না । ওনার বাসায় তালা দেওয়া । আমি বেশ কয়েকবারই উঁকি দিয়েছি বারান্দায় কিন্তু ওনাকে দেখতে পাই নি !

চারদিনের দিন দেখতে পেলাম ওনাকে । বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওনার বাইকটা সাবানপানি দ্বারা ধৌত করতেছিলেন । আমি দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে দু মিনিটের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম ওনার সামনে । কোমরে দুহাত দিয়ে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি । উনি আমাকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন ।

— কিছু বলবে দিয়া ?
— আপনি এই তিনদিন কোথায় ছিলেন ?
— কেনো ?
— যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলুন । কোথায় ছিলেন বলুন !
— অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম । কিন্তু তুমি এতো রেগে আছো কেনো ?!
— পরেরবার যখন যাবেন তখন আমাকে অবশ্যই বলে যাবেন । তাহলে আর টেনশনে থাকব না !

কথাটি বলেই হনহন করে হেঁটে চলে এলাম । পেছনে তাকালে হয়তো দেখতে পেতাম ফাহাদ ভাই হা করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে !

এরপরে আবার চলতে লাগল আগের মতোই ! ইদানিং লক্ষ্য করছি সন্ধ্যায় বারান্দায় আর আগের মতো আসেন না তিনি ! আমি উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি কিন্তু তাকে কোথাও দেখি না !

আজ মুনা ও তনিমার সাথে একটা ফাস্টফুডের দোকানে যাই কিছু খেতে । সেখানে গিয়েই দেখলাম কর্ণারের একটা টেবিলে ফাহাদ ভাই বসে আছেন আর ওনার বিপরীতে একটা মেয়ে । সেটা দেখে আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল ফ্লোরে ! আকস্মিক শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়েই আমাকে দেখতে পেলেন তিনি । আমি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বাইরে চলে এলাম । মুনা এ তনিমা অনেক ডাকল কিন্তু আমি ওদের কথা কর্ণপাত না করেই রিকশা করে বাসায় চলে এলাম । বাসায় এসে অনেক কেঁদেছি দরজা বন্ধ করে !

পরেরদিন বিকেলে ফাহাদ ভাইয়ের বাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই তিনি আমাকে ডাক দিলেন । আমি ওনার দিকে তাকালাম ।

— কিছু বলবেন ফাহাদ ভাই ?
— কাল ওভাবে রিয়্যাক্ট করলে কেনো ?!
— কীভাবে রিয়্যাক্ট করেছি ?!
— আমাকে মেয়েটির সাথে দেখে হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল আর তুমি তোমার ফ্রেন্ডের কথা না শুনেই চলে এলে।
— আমি মোটেও আপনার উপর রিয়্যাক্ট করি নি ! আপনি কে যে আমি রিয়্যাক্ট করবো ?!
— সত্যি কি তাই ?! নাকি মনের কথাটা এভাবেই লুকিয়ে যাবে ?!
— আমি কিচ্ছু লুকোচ্ছি না ।
— মেয়েটি আমার কলিগ ছিল অফিসের । আর কিছুই না ।
— তাতে আমি কি করবো ?
— আচ্ছা যাও তাহলে !
— কেনো যাব ? রাস্তাটা কি আপনার নাকি ? আমি সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকব ! কি মনে করেন নিজেকে ? সারাদিন গম্ভীর থাকেন । এখন আবার এরকম কথা বলছেন । আপনি কি আদৌ কখনও হেসেছেন ?!
— তুমি কি আমার সাথে একটা জায়গায় যাবে ?!
— কোথায় যাব আমি আপনার সাথে ? আমার আব্বু পিটুনি দিবে কোনো ছেলের সাথে দেখলে !
— কিছু বলবে না । আমি বাইক বের করছি । তুমি দাঁড়াও এখানে !
— আরে .. আরে শুনুন তো !!

আমার কথা কানে না নিয়ে গ্যারেজ থেকে বাইকটা বের করলেন তিনি। তারপর আমাকে উঠতে বললেন । আমিও বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসলাম । কিন্তু ওনাকে স্পর্শ করলাম না ।
— কাঁধে হাত দিয়ে বসো , নয়তো পড়ে যাবে !
— না আমি ঠিক আছি !
— আচ্ছা ।

কিছুদূর যাওয়ার পরে গতি দেখে মনে হতে লাগল আমি বাইক থেকে পড়ে যাব । তাই ওনার কাঁধে হাত দিয়ে বসলাম। এই প্রথমই আমি ওনাকে স্পর্শ করলাম । আমার পুরো শরীর এক অজানা শিহরণে কেঁপে উঠল !
উনি ওনার মতো বাইক চালাচ্ছেন । কিছুক্ষন পরে একটা নির্জন রাস্তায় ঢুকলেন তিনি ।
আমি অনেক অবাক হলাম যখন উনি বাইকটি একটা পারিবারিক কবরস্থানের সামনে এসে থামালেন ! আমাকে বাইক থেকে নামতে বলে কবরস্থানের গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন । আমিও তার পিছু নিয়ে ঢুকে পড়লাম । তিনটা কবর, পাশে কিছু ফুলের গাছ লাগানো । হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে ফাহাদ ভাই কবরের সামনে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । তার চেহারায় ফুটে ওঠা কষ্ট আমি দেখেছি এতোদিন কিন্তু কোনোদিন এভাবে কাঁদতে দেখিনি !

ওনার কান্না দেখে আমারও চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল , কোনো কারন ছাড়াই !!! কিছুক্ষন কেঁদে উনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন । তারপর বললেন,

— এইযে ডান পাশের কবরটা দেখছো, এটা আমার বাবার কবর , আর বাম পাশের টা মায়ের ! মাঝখানে আমার ছোট বোন ফারিহার কবর !
— আপনার বাবা, মা , বোন কীভাবে মারা গেছেন ?!!
— আমার কারনেই মারা গেছেন ওরা ।
— মানে ?!! কি বলছেন এসব ?!
— তোমাকে আজ আমি একটা অন্য ফাহাদের গল্প শুনাবো । যার সাথে এই ফাহাদের কোনো মিলই নেই । তুমি কি শুনবে সেটা ?!
— হুমমম অবশ্যই শুনবো । আপনি বলুন !

ফাহাদ ভাইয়া আমাকে নিয়ে কবরস্থানের বাইরে চলে এলেন । তারপর গ্রাম্য একটা মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলতে লাগলেন !

— সাত বছর আগের কথা । বাবা , মা , ছোট বোনটা ও আমাকে নিয়ে ছিল আমাদের ছোট পরিবারটা । বাবা, মা এর ভালোবাসা ; বোনের সাথে খুনশুটি ও ভালোবাসা সব মিলে অনেক ভালোই ছিলাম । কিন্তু সমস্যাটা তখনই শুরু হয় যখন আমি প্রথমবারের জন্য রাজনীতিতে পদার্পণ করি । ছাত্রনেতা হওয়ার পরে থেকে আমি কেমন যেন হয়ে যাই । সারাদিন বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য ছেলেপুলের সাথে আড্ডা দিতাম আর সারাদিন মিছিল মিটিং করে সময় পার করতাম। ক্ষীপ্র হতে লাগলাম ধীরে ধীরে ! এলাকার মানুষ খুব ভয় পেত আমাকে ! কিন্তু আমি তাদের কিছুই বলতাম না । আমার প্রিয় বন্ধু ছিল সাগর । ও সবসময় আমার সাথেই থাকত । ও কলেজের হোস্টেলে খুব অসুবিধায় থাকতে তখন। প্রিয় বন্ধু হওয়ার সুবাধে একদিন ওকে আমার বাসায় নিয়ে আসি থাকার জন্য । কিন্তু সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল !

আমার সুন্দরী ছোট বোনটার দিকে ওর কুনজর পড়েছিল এটা আমি যেন খেয়ালই করতে পারিনি । আমার বোনটা যথেষ্ঠ শালীন ছিল বিশ্বাস করো । ওর পোশাক আশাকে কোনো ত্রুটি ছিল না ! একদিন বাবা মা বাড়ির বাইরে ছিল । আমিও সংগঠনের একটা কাজে বাইরে ছিলাম । সাগর সেদিন বাড়িতেই ছিল । আমার বোনটা প্রতিদিনের মতো স্কুল থেকে ফিরে এল বাসায় । সাগর দরজা খুলে দিলে ভিতরে ঢুকলো সে । তারপরে জানোয়ারটা…!

ফাহাদ ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন । চোখে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন অঝোরে । আমি তার হাতদুটোশক্ত করে ধরলাম । এটাই প্রথম ! তারপর ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— বলুন !
— সেদিন জানোয়ারটা আমার ছোট বোনটার ইজ্জ্বত কেড়ে নেয় ! ওর করুন আর্তনাদ শোনার জন্য কেউ ছিলাম না আমরা ! বোনটাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় কুকুরের বাচ্চাটা !!!
বিকেলের দিকে বাবা মা যখন বাড়িতে ফিরে আসে তখনও ফারিহা জীবিত ছিল ! বিবস্ত্র রক্তমাখা শরীরে পড়ে ছিল । মাবাবা ছুটে যায় ওর কাছে । তখন ও বলতে থাকে কথাগুলো ! সাগরের অত্যাচারের কথাগুলো ! আমাকে ফোন দিলে আমিও ছুটে আসি বাসায় । এ্যাম্বুলেন্স খবর দিয়ে ওকে নিয়ে একটা নামকরা হসপিটালে যাই । কিন্তু বাঁচাতে পারিনি বোনটাকে !! আমার বাবা নিতে পারে নি সেদিন এই বিষয়টা ! হার্ট এ্যাটাক করে সেও চলে যায় সেদিন আমাদের ছেড়ে ! এরপর থেকে আমি ঘর থেকে তেমন একটা বের হতাম না । একদিন ঘুম থেকে উঠে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখি মা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে আছেন । সেদিন থেকে আমি পুরোপুরো একা হয়ে গেলাম !
আমি অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন জানো ?!! খুব কেঁদেছিলাম । এরপরে আমি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এলাম । কিন্তু এলাকার মানুষ আমাকে এখনও ভয় ও সম্মান করে প্রচুর !

— সাগরকে আর খুঁজে পেলেন না ?!

মুচকি হাসলেন আমার কথাটি শুনে । প্রথমবারের মতো একটু হলেও হাসতে দেখলাম ওনাকে ! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন,

— বোনের সর্বনাশ করে বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিল ও । তারপর আমি অন্য একটা বন্ধুকে দিয়ে কল করিয়ে বলতে বলি বিশেষ একটা জায়গায় আসতে । সাগর কোনো কিছু না ভেবেই চলে আসে ওর সাথে দেখা করার জন্য নির্জন জঙ্গলে । কিন্তু এসে দেখে আমাকে !!!!
আবার উল্টো পথে দৌড়াতে চাইলো কিন্তু তার আগেই রামদাটা গেঁথে দেই ওর পিঠে !
— উফফ্ কি বিভৎস !!!!
— সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ওর শরীরের মাংস গুলো টুকরো টুকরো করে কাটতে থাকি । তারপর স্টিলের বড় বাক্সে ভরে ওখানেই মাটিচাপা দিয়ে দেই !
এরপরে পুলিশ ওকে অনেক খুঁজেছিল । আমাকে সন্দেহ করে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করছিল । কিন্তু কোনো ক্লু কিংবা প্রমাণ না পাওয়ায় কেইস ফাইল বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে ।
— চলুন না ওই নদীর পাড়টাতে গিয়ে বসি !

অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে । হয়তো ভাবছেন যে এসব শুনেই আমি তার সাথে কীভাবে কথা বলছি !

— কি হলো যাবেন না ?
— হুমম চলো !

ওনাকে নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালাম । তারপর এদিক ওদিক কয়েকবার তাকালাম । নাহ্ ! কোনো মানুষই নেই আশেপাশে ! হুঁট করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ফাহাদ ভাইকে ! আমি শিওর তখন উনি অবাক ও নির্বাক দুটো পর্যায়েই ছিলেন ! আমি এখনো জড়িয়ে ধরে আছি তাকে ! তবে এর মধ্যে ছিল এক পবিত্রতা !
সত্য প্রেমের পবিত্রতা !

— আপনি জানেন আপনাকে আমি কতোটা ভালোবাসি ?!
— কতোটা ভালোবাসো তা জানি না । কিন্তু ভালো যে বাসো সেটা জানি !
— ওইইই কীভাবে জানেন বলেন ?!
— তোমার লাজুক দৃষ্টি, অভিমানমাখা চাহনি সবই খেয়াল করেছি আমি । তবে পুরোপুরি সিওর ছিলাম না । তাই তোমার প্রিয় বান্ধবী মুনাকে সেদিন বলেছিলাম তোমাকে ওই ফাস্টফুডের দোকানে নিয়ে আসতে । আমি জানতাম কোনো মেয়ের সাথে দেখলে তুমি ওভাবেই রিয়্যাক্ট করবে !
— শয়তান , বদ ছেলে , খাটাস আপনি আমাকে এতো কষ্ট দিয়েছেন আবার কথা বলছেন । আরেকটা কথা বললে ফেলে দিবো নে নদীতে !
— এই এই কি করছো ! দাঁড়াও আমি সাঁতার পারিনা !
— আচ্ছা আপনি কি পারবেন না আবার আগের মতো হাসতে ?!! সকলের সাথে মিশতে ? অন্তত আমার কথা ভেবে!
— বিয়ে করবে আমাকে ?!
— কিহহ ?!!!!
— হুম । উইল ইউ ম্যারি মি দিয়া?!!
— ইয়েস !!অব কোর্স আই উইল ! ফাহাদ ভাইয়া !!
— এখনও ভাইয়া কেনো ডাকতেছো আমাকে ?!!
— আআআ সরিইই !!!

ফাহাদ জড়িয়ে ধরল আমাকে । আমিও ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম । আজ আমি ওর মুখে সেই হাসি দেখতে পেয়েছি । যে হাসি হয়তো সাত বছর আগে ও হেসেছিল !

আজ আমাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হলো । সেদিন আমাকে বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্য বাইক নিয়ে আমাদের বাসার গেইটে ঢুকে ফাহাদ । তখন বাবার মুখোমুখি হলাম দুজন । বাবা আমাদের ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন । আমি খুব ভয়ে ছিলাম বাবা বকবে এই ভেবে । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবার কাছে আমার হাতটি চেয়ে নিয়েছিল ফাহাদ । বাবা ফাহাদকে খুব স্নেহ করতেন । তাই সেদিন আমার চোখে সম্মতি দেখে বিয়েটা দিয়েই দিলেন আজ !
বাসর ঘরে মাথার উপর একহাত ঘোমটা দিয়ে বসে আছি ! একটু পড়ে মনে হলো কেউ একজন এসে দরজাটি আটকালো ! বুঝতে পারলাম সে এসে গেছে । ফাহাদ এসে আমার ঘোমটাটি তুলল , তারপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে !

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলাম । তখন ও বলল,
— খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে দিয়া ! আমি নতুন করে তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি !
— অন্তত তোমার এই হাসিটা দেখার জন্য হলেও আমি প্রতিদিন নতুনভাবে সাজব ফাহাদ !
— এটা অতি পবিত্র একটা রাত । তোমার কি কিছু চাওয়ার আছে আমার নিকট?!
— আমি চাই সারজীবন তোমার ওই হাসিমুখটা দেখতে । তুমি কি আমার চাওয়াটা পূর্ণ করবে!!
— হুমম অবশ্যই প্রিয়তমা ! একট আগে দেখে এলাম আকাশের চাঁদটা আজ অনেক আলোকিত করেছে পৃথিবীটাকে ! বারান্দায় যাবে কি আমার সাথে ?!
— হুমমম যাবো । চলো !

আমি বিছানা দিয়ে নামার সাথে সাথেই ফাহাদ আমাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল বারান্দায় । ওর মুখে কিছু পাওয়ার খুশিটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আজ !
বারান্দায় এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ইশারা করে চাঁদটি দেখিয়ে দিল !
আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে দেখতে লাগলাম চন্দ্রকে !
প্রতিটা পূর্ণিমায় আমি এভাবেই কাছে চাই ফাহাদকে !
আমার গম্ভীর ফাহাদ ভাইটাকে !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত