শ্বশুড় বাড়ির সবাইকে কুকুরের মাংস খাইয়ে বড্ড তৃপ্তি পেলাম, এতদিনে মনের আশা পূর্ণ হলো, ওদের কুকুরের মাংস খাওয়ানোই উচিৎ কারন ওরা কুকুরের চেয়ে অধম।
এতদিন কিছু জেদ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলাম।
সবাই মিলে এক সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কারনে সুযোগটা পেয়ে গেলাম।
আমার সঙ্গে নূরের বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো কিন্তু এই এক বছরেও থামেনি নির্যাতন।
বাবার বাড়ি থেকে দামি জিনিস পত্র এবং টাকা না আনায় শ্বশুড় শাশুড়ী সবাই অসন্তুষ্ট।
বাবা অসচ্ছলতার জন্য মেটাতে পারেন না তাদের সকল আবদার। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে এমনটা কথা ছিলো না, আমার বাবা জানিয়ে ছিলেন এত বড় ঘরে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার মত মুদ্রাপূর্ণ শক্তি নেই আমাদের, তবুও আমার শাশুড়ী নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেন না, আমাদের সকল সংকোচ দূর করে জানালেন বিনা বরপণে তারা আমাকে তাদের ঘরের বউ বানাতে চান।
বিয়ে হওয়ার মত প্রথম যেদিন শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছিলাম সেদিন পাড়াপড়শি ভীর জমিয়ে ছিলেন আমায় দেখতে, তারা নিজেরা বলাবলি করছে ‘নূর বাবার বউটা কত সুন্দর দেখ, মেয়ের রূপ দেখে হৃদয় জুড়ালো, নিশ্চই বড়লোক ঘরের মেয়ে হবে’। তাদের কথা শুনে আমি গোমটা টেনে দিলাম, গোমটার আড়ালে চোখের কোণের পানি মুচলাম, যে কারণে আমার চোখে মেঘহীন বৃষ্টি জমেছে সেসবের আলোচনা শুরু হয়েছে, পাড়াপড়শি বলাবলি করছে ‘বড়লোক ঘরের মেয়ে যেহেতু নিশ্চই অনেক জিনিস পত্র নিয়ে এসেছে, চল চল দামি জিনিস গুলো দেখে আসি’।
কথা বলেই সবাই শাশুড়ীর রুমের দিকে চলে গেলো, আমি গোমটা তুলে তাকালাম, নূর আমার সামনে, নূর পকেট থেকে রুমাল বের করে বলে->
“কেঁদে লাভ কি? চোখের পানি মুচে নাও”
“উনারা যখন শুনবেন আমার বাবা কিছু দিতে পারেননি তখন কি করবে?”
“কি আর করবে! আমাদের মান-সন্মান চলে যাবে আর কি! তোমাকেও বলি ফাতেমা! তোমার বাবা তো ভিক্ষুক নয় যে সামান্য কিছু দিতে পারবে না, তাছাড়া ভিক্ষুকও নিজের মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে কিছু দেয় কিন্তু তোমার বাবা তোমায় বিয়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন!”
নূরের কথা শুনে আমি হা হয়ে চেয়ে রইলাম।
তবে কি বিয়েটা মন থেকে করেনি?
কিছুক্ষণের মধ্যে শাশুড়ী আসলেন রুমে।
এসে বললেন->
“বউমা শুধু কাঁদলে কি হবে? তোমার বাবাকে বলো আপাতত এখন নূরকে একটা হুন্ডা দিতে”
“আমার বাবার সেই সামার্থ নেই মা”
“তা বললে কি হয় বউমা? তুমি তার এক মাত্র মেয়ে, তোমার সুখের জন্য তোমার বাবা রক্ত বিক্রি করলেও মহামারী এমন কি!”
আমি শাশুড়ীর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।
জমাট বাঁধা বিনা কালো মেঘে শুধু আমার শরীরে বৃষ্টির ছোঁয়া পড়ছে, এসব আমি কি শুনছি!
শাশুড়ী মা মৃদু হেসে বললেন->
“বউমা কাঁদছো কেন? আমি যে তোমায় বকিনি”
“না মা কই কাঁদছি! কাঁদছি না তো”
“না কাঁদাই ভালো, কেঁদে কি হবে বলো? তারচে বরং তোমার বাবাকে বলো নূরের জন্য যেনো হুন্ডা কিনে তোমায় দেখতে আসে”
“জ্বি মা বলবো”
“বলবে বেশ ভালো কথা, বলার পর যেদিন তোমার বাবা হুন্ডা নিয়ে আসবে সেদিন আমার ছেলেকে তুমি পাবে, তার আগে তোমাদের মধ্যে কোনো শরীরগত সম্পর্ক হবে না”
বিছানা থেকে পা নামিয়ে শাশুড়ী মা নূরকে বললেন->
“চল বাবা, অন্য ঘরে ঘুমাবি চল”
“আম্মা না মানে.. ইয়ে..”
“কিরে দুষ্টু কিছু বলবি?”
“না মানে আম্মা নতুন বউ..রাত.. ইয়ে..”
“বুঝেছি আমার দুষ্টু ছেলের মনের কথা তবে বাবা সাবধান এখনি যেনো বাচ্চা নেস না”
“বাচ্চা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না আম্মা”
“ঠিক আছে আমি গেলাম তাহলে, বউমা আমার ছেলের যত্ন নিও”
“জ্বি মা”
আমি অপেক্ষা করছি কখন আমার স্বামী আমার ওপর হামলে পড়বে, হঠাৎ নূর হামলে পড়লো, পুরুষ্যত্ব দেখিয়ে নিজের গতর ঠান্ডা করে শুয়ে পড়লো, আমার অন্তরে গভীর চাপ! এ যেনো এক ব্যথার আসাদন। রাত ফুরিয়ে সকাল হলো।
শাশুড়ীর ভালো মন্দ কথার মিশ্রণে দিন ফুরিয়ে আবার রাত হলো, স্বামীর পুরুষ্যত্বের কাছে দূর্বল হৃদয় গলে পড়লো। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি মাস। স্বামীর পুরুষ্যত্বের কাছে দূর্বল আমি বললাম->
“হ্যা গো শুনছো”
“হুম বলো”
“আমার যে বড্ড শখ জন্মদাত্রী হওয়ার”
“তোমার বাবা কি জিনিসপত্র নিয়ে আসবে বলেছে?”
“না বলেনি! কেন?”
“জন্মদাত্রী হওয়ার জন্য লাফাচ্ছো দেখে জিজ্ঞেস করলাম”
“পণ কি সব নূর?”
“পণ কে চেয়েছে তোমাদের কাছে? মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে উপহার দেবে”
“আমাদের সন্তান কি এই পরিবারে সৃষ্ট উপহার হবে না নূর?”
“সম্ভব হলে তুমি একা সন্তান উপহার দাও, আমি এই উপহারে সামিল হতে পারবো না”
নূরের কথাটা হৃদপিণ্ড ছেদ করে গেলো।
কতটা নিষ্ঠুর তার মন!
আমার শ্বশুর-শাশুড়ীরও একই কথা।
আমার বাবা হুন্ডা না দিলে আমার গর্ভে সন্তান আসবে না, আমার অসচ্ছল বাবা পারেননি হুন্ডা দিতে কিন্তু নতুন বিছানা,সবার জন্য নতুন পোশাক,নূরের জন্য দামি ঘড়ি নিয়ে আমায় দেখতে আসলেন, বাবাকে বসতে দিয়ে শ্বশুর
বাবা বললেন-“এসবের কি প্রয়োজন ছিলো বেয়াই!”
“প্রথমবার মেয়েকে দেখতে এসেছি বেয়াই, খালি হাতে কি করে আসি! তাই সামান্য কিছু উপহার এনেছি আপনাদের জন্য”
“উপহার এনেছেন বেশ ভালো কথা দুপুরে খেয়ে তবেই যাবেন”
বাবা অমত করলেন না।
আমাকে রান্না করা থেকে আজ ছুটি দিয়েছেন শাশুড়ী মা।
রান্না শেষে বাবাকে ডাকলেন।
বাবা খাবার টেবিলে বসলেন।
শাশুড়ী মা একা খাবার টেবিলে আনলেন।
বাবার সামনে প্লেট দিয়ে শাশুড়ী মা ভাত,ডাল,আলু ভর্তা দিয়ে বললেন->
“বেয়াই নেন খান, অসুস্থ মানুষ আমি বেশি রান্না করতে পারিনি, আপনার মেয়ের কথা আর কি বলবো! সেই বিয়ে হওয়ার পর থেকে শুধু নিজের রুমেই বসে থাকে, কোনো রকম ঘরের কাজ করে না”
বাবা কোনো কথা না বলে খেয়ে উঠলেন।
শাশুড়ী মায়ের কথাটা কতখানি সত্য তা বাবা জানেন, বিকেলে বাবা বিদায় নিলেন।
সন্ধ্যার পর শাশুড়ী বললেন-“একজন ভিক্ষুকও এর চেয়ে ভালো জিনিস দেয়, যখন দিলোই ভালো জিনিস দিতে পারলো না?”
“বাবার সামার্থ মত দিয়েছে মা, এর বেশি সম্ভব ছিলো না”
শ্বশুর বললেন-” না দিলে না দিতো কিন্তু এমন কমদামি জিনিস দিয়ে নাম খারাপ করার কি ছিলো”
নূর বললো-“এসব না দিয়ে এই টাকা জমিয়ে সাথে আরো কিছু দিয়ে আমায় হুন্ডা দিলে এমন কি হতো!”
সবার কথা শুনে ধৈর্য্য হারিয়ে বসলাম।
আর কতদিন শুনবো এসব কথা!
শত চেষ্টা করেও সন্তান নিতে পারিনি শুধু পণের জন্য! এরা মানুষ? এরা অধম! কুকুরের চেয়ে অধম, এদের কুকুরের মাংস খাওয়া উচিত।
পরিকল্পনা সফল হলো, আমি সবাইকে কুকুরের মাংস খাইয়েছি।
আমার কেমন অস্তিত হচ্ছিলো।
মনে হচ্ছিলো নূর আমায় ডাকছে।
আমি চোখ খুলে তাকালাম।
নূর, আমার শ্রদ্ধীয় শাশুড়ী মা, আমার শ্রদ্ধীয় শ্বশুর বাবা আমার পাশে বসে আছেন।
চিন্তিত কণ্ঠে নূর বললো-“ফাতেমা তোমার কি হয়েছে? এত ঘামাচ্ছো কেন?”
শাশুড়ী মা বললেন-“মা ফাতেমা তুমি কি ঠিক আছো?”
শ্বশুর বাবা বললেন-“মামণি তুমি কি কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”
“হ্যা বাবা, আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”
“কি স্বপ্ন দেখেছো মামণি?”
সবটা বলার পর মা আমার কপালে জমে থাকা ঘাম আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন, বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া পাঠ করে কপালে ফু দিলেন, নূর আমার জন্য পানি নিয়ে আসে, পানি খেয়ে আমি মায়ের কাঁধে হেলে পড়ি। মা আমার চুল নাড়াতে নাড়াতে বলেন-“মা ফাতেমা স্বপ্নের মাঝে সয়তান তোমায় বিচলিত করার চেষ্টা করছিলো, ভুল পথে চালিত করার জন্য তোমায় এমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, তুমি ঘাবড়ে যেও না, কিছুক্ষণ পর আযান দেবে, নামাজ পড়ে একটু রেস্ট নাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।
মা নূর কে বললেন-“বাবা তুই গিয়ে পুকুর থেকে পানি তুলে নিয়ে আয়, ওর শরীর এখনো দূর্বল তাছাড়া পোয়াতি মেয়েদের এসময়ে বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না,ঘরে অযু করে নামাজ পড়ে বিশ্রাম নেবে”
নূর মায়ের কথা শুনে পানি আনতে গেলো।
মা আমার মাথা তুলে কপালে চুমু খেয়ে বলে-“আল্লাহ না করুক আমাদের লক্ষ্মী বউ মার উপর যেনো আমাদের দৃষ্টি স্বপ্নের মত না পড়ে”
আমি হেসে দিলাম।
শাশুড়ী মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-“তোমার ভিলেন রূপটা কেমন গো মা?”
মা হেসে দিলেন।
নূর পানি নিয়ে আসে।
অযু করে নামাজ আদায় করে মুনাজাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করি “আল্লাহ আমার ফুলের মত নিষ্পাপ শ্বশুর-শাশুড়ী আর নূরকে নিয়ে যেনো কখনো বাজে স্বপ্ন না দেখি, দুনিয়াতে আসতে চলছে আমাদের সন্তান, সে যেনো সর্বদা সুস্থ থাকে আমার মধ্যে এবং এই পৃথীবিতে”