চোখের পাতা একটু খুলে চারপাশটা দেখার চেষ্টা করছি। পুরো রুম অন্ধকার, ঢুলু ঢুলু চোখে কিচ্ছু দেখতে পারছি না। হাতাহাতি করে বুঝলাম পাশে অয়ন নেই, কখন উঠল কখন গেল কিছুই টের পেলাম না। ওরা নিশ্চয়ই ওকে ফোন দিয়েছিল, রিংটোনের শব্দও শুনলাম না? নাহ্ ইদানিং ঘুমটা বেশি হয়ে যাচ্ছে, এত ঘুমালে অয়ন আবার যাচ্ছেতাই হয়ে যাবে। কয়দিন একটু ঠিক হয়েছিল, যা বলতাম ভালই শুনত।
চোখটা সয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মশারি, ফ্যান চলা, দরজা হালকা দেখতে পাচ্ছি। দরজার নিচ দিয়ে আলো আসছে, ড্রয়িং রুমে লাইট জ্বালিয়েছে কে? শোয়ার আগে তো সব লাইট ফ্যান বন্ধ করেই শুলাম।
বিছান থেকে নেমে দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেলাম অয়নের কন্ঠস্বর। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কি বলছে ও? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ড্রয়িং রুমে এসে দেখি আম্মার সাথে তুমুল ঝগড়া।
– তুমি এত মাতবরি কর কেন, হ্যাঁ? আমি যেইখানে খুশি সেইখানে যাব, যা ইচ্ছা খাবো তাতে তোমার কি? তুমি পান চাবাও, যাও। তোমার ছেলেমেয়েরে নিয়া নাচো, আমারে নিয়া নাক গলাবা না, একদম না। ফাজিল মহিলা কোথাকার। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে আম্মার সামনেই ওর গালে জোরে দুটা চড় মারলাম। নিজের মাকে নিয়ে এরকম কথা একটা মানুষ কিভাবে জোরে জোরে বলে? এটুকে কাজ হবে না, আরো মারতে হবে। নেশার ঘোর না ভাঙতে পারলে মাথায় কিছুই কাজ করবে না।
অয়নকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। দেয়াল ঘড়িতে চোখ ফেরাতেই দেখি ৩:৩০টা। ভোর হতে এখনও অনেক সময় আছে। ওড়নাটা বিছানে ছুঁড়ে বাথরুমে গেলাম। বের হয়ে দেখি, অয়ন গুচিমুচি হয়ে শুয়ে আছে। শীত লাগছে বোধহয়, আমার খুব গরম লাগছে তাও বন্ধ করলাম ফ্যানটা। এতক্ষণ ঠিক খেয়াল করিনি, এবার মনে হল অয়ন বোধ হয় কান্না করছে। ওর কাছে আসতেই দেখি ছেলেটা সত্যিই কাঁদছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেমন চুপচাপ অঝোরে কাঁদতে থাকে, ঠিক সেরকম। শুরুতে বুকটা মোচড় দিলেও মুহূর্তেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। এ নতুন কিছু নয়, যেদিনই ওকে প্রচন্ড বকাঝকা দিই, গায়ে হাত তুলে ফেলি সেদিন হঠাৎ হঠাৎ কান্না করে। এমনভাবে কাঁদে বোঝা যায় না বেশি কাঁদছে। কাছে গেলে দেখা যায় পানিতে পুরো মুখ, গলা ভিজে একাকার। প্রথম প্রথম আমারও খুব কান্না পেত, এখন আর পায় না। একই মুহূর্ত বারবার মানুষের মনে আঘাত হানলে, সে আঘাত একসময় সয়ে যায়। মনেই হয় না কোন কষ্ট হচ্ছে আমার, আঘাত পাচ্ছি আমি। প্রতিবারের মতো এখনো অয়নের মাথাটা ধরে কোলের উপর শোয়ালাম। দেখছ, দুষ্টু ছেলেটা এখনো কাঁদে।
– অয়ন, এই অয়ন সোনা।
– কি বল।
– কাঁদেন কেন আপনি, আপনি কি ছোট বাচ্চা?
– তুমি আমারে মারছো। তাও ঐ মহিলার সামনে।
– ছিঃ, মারে কেউ মহিলা বলে? আবার বকবো কিন্তু।
অয়ন কিছু বলে না। বাবুটার কান্না থেমেছে, আর কত কাঁদবে। এই লক্ষ্মীসোনার কষ্টটাতো কেউ বোঝে না আমি ছাড়া। আচ্ছা, আল্লাহ্ সবাইকে কখনো খুব সুখ দেয়, আবার খুব দুঃখ। কিন্তু এই বাবুটারে সবসময় এত কষ্ট দেয় কেন? এই সরল ছেলেটাকি তার বান্দা না?
প্রথম যখন ওকে দেখি তখনও বুঝিনি ওর সরল মনের প্রতিটা স্তরে স্তরে চাপা কষ্টের ছড়াছড়ি। সারাদিন দেখতাম খালি মিটিমিটি হাসত, যখনই দেখতাম। ওর বন্ধুদের তেমন পছন্দ হত না, ভাব দেখলে গা জ্বলে যেত। ভেবেছিলাম এও একটাইপ হবে। কিন্তু টানা ২ সপ্তাহের মত কথাবার্তা বলে, আচরণ দেখে একদম অবাক না হয়ে পারলামই না। ওর যেসব বন্ধুবান্ধব, তাদের থেকে ওর চতুরতা কিংবা বুদ্ধি নেহায়েত কমই বলা চলে। তবে ও অনেককিছু জানত, অনেক সাধারণ জ্ঞান ওর কাছ থেকে জানছি, যা জীবনেও জানতাম না। আরো যা জানলাম, শুনলাম – সেগুলোর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একবিন্দুও। যদিও ওগুলো বিয়ের পর জেনেছি।
এই বিয়ে নিয়ে আমার একটা আফসোস রয়েই যাবে। অবশ্য সেরকম পরিস্থিতি আসলে ছিল না তখন। হঠাৎ একদিন দুপুরে অয়ন জোর করে ওর বাসা থেকে দূরে কোন এক বিল্ডিং এর ছাদে নিয়ে আমার হাত-পা ধরে এমন অনুনয় শুরু করল, আমি তো একদম থতমত খেয়ে গেছি। একসময় বাচ্চাদের মত কেঁদেও ফেলল। তখনও ওর আর আমার মধ্যে গভীর ভালোবাসা এরকম কিছুই ছিল না।, খালি বন্ধুর মত কথা, দেখা করা হত। সবাই জানত আমরা কেবলই বন্ধু। আমি সেদিন বিকেলেই বাসা থেকে পালাই। একটা বারও ভাবিনি আমার ফ্যামিলির কথা। ঐদিন ঐ মুহূর্তে আমি যে কোন জগতে ছিলাম, অয়নের কান্না দেখে কেন আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম ঝরঝর করে তা আজো বুঝিনি আমি। মাঝে মাঝে ভাবি, কিন্তু ফলাফল যে শূন্যই আসে।
যেমনে যেভাবেই হোক ঝড়ের মতো কাজী অফিসে বিয়েটা হয়ে গেল। ওর বন্ধু-বান্ধব থেকে অনেক কিছুই শুনলাম, কত কথা, সতর্কবার্তা আরো কত কি! কিন্তু আমি তখন শুধু জানি, অয়ন আমার স্বামী, অয়নই আমার শেষ সম্বল। ওর ফ্যামিলির সবাই আমাকে দেখে বলতে গেলে তেমন অবাকই হয়নি। হবে কিভাবে, সবাই আছে যার যারটা নিয়ে। যেদিন এ বাড়িতে পা রাখলাম, তখন রুমে ঢোকার পর ওর বড় আপা আমাকে মিষ্টি খাওয়াল, অনেকক্ষণ গল্পটল্প করে চলে গেল। এই আপার কাছেই জানতে পারি অয়নের সবচেয়ে বড় কষ্টের কথা। অয়ন ওর মায়ের গর্ভের সন্তান ঠিকই, কিন্তু ওর যে আরো চার ভাইবোন আছে তাদের জন্মদাতা যিনি, তিনি অয়নের জন্মদাতা নন। মানে বাকি চারজনের বাবা তিনি হলেও অয়নের প্রকৃত বাবা তিনি নন। আর এই কথাটা অয়ন জানতে পারে, যখন ওর বয়স মাত্র সতের। যে বয়সের একটা ছেলে/মেয়ে থাকবে সম্পূর্ণ তার বাবা-মায়ের শাসনে, খেয়ালে, আদরে। এই বয়সেই পা রেখে অয়ন কিভাবে ওর মনকে, ওর নিজ সত্ত্বাকে সামলাবে? যে সত্ত্বার নির্দিষ্ট কোন পরিচয় নেই, নেই কোন শাসনকর্তা। কেউ বাবার নাম জানতে চাইলে হা করে চেয়ে থাকে, কিচ্ছু বলতে পারে না। কিছু যে বলার নেই ওর। কথাগুলো আমাকে বলতে বলতে কেঁদে দিয়েছিলেন বড় আপা। আমিও কেঁদেছি, বাথরুমের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছি। আর মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছি, পুরো পৃথিবীটা একদিকে আর আমার অয়ন আরেকদিকে। আমি জীবনেও পারব না এই বাবুটারে ছেড়ে যেতে।
তারপর থেকে শুরু আরেক যুদ্ধ। গভীর রাতে উঠে বাইরে গিয়ে নেশা করে বেড়ায়, অভ্যাসটা অনেকদিনের। আগেতো প্রায় প্রতিদিনই এরকম করত, আর দিনেও ছাদে বসে ছেলেপেলে মিলে কি সব ছাইপাশ খেত। মোবাইল যে কতগুলো মানুষকে দিয়ে দিয়ে হারিয়েছে তার হিসাব নেই। ধীরে ধীরে লক্ষী হয়ে উঠছে ছেলেটা। স্বামীর গায়ে হাত তোলা পাপ, কিন্তু আমি যে ওকে ভাল করেই ছাড়ব। বাবুটা অনেক লক্ষী হয়ে গেছে, মাঝে মাঝে নেশার জন্য পাগল হয়ে ওঠে তবুও মেরে বকে দমিয়ে রাখি। কখনো নিজেও ওর মারধর সহ্য করি, থাক যত খুশি মারুক। সবকিছুর বিনিময়ে আমি আমার অয়নকে খুব সুন্দর দেখতে চাই। অনেক সুন্দর।
ফজরের আযান কানে যেতেই চমকে উঠলাম। বিশাল এক ভাবনার ঘোরে ছিলাম তাহলে এতক্ষণ। চোখ-মুখ কেমন ভেজা লাগছে। কেঁদেছিলাম আমি? হয়তো তাই-ই, কতই এভাবে চোখ-মুখ ভিজে যায়।
অয়নটা গভীরভাবে ঘুমাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে এখন। আর আমি কিনা পাষাণের মত এই নিষ্পাপ গালে মেরেছিলাম। কিন্তু কি করব, আমি যে ওকে খুব লক্ষী করতে চাই। আমার লক্ষী সোনা, আমার অয়ন বাবু। আস্তে ওর কানের কাছে মুখ এনে বললাম, এই যে অয়ন, আমি কিন্তু আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।
ছেলেটা কি কিছু শুনল? থাক, শোনার দরকার নেই। খালি আদুরে দুষ্টুমি শুরু করবে।
লিখেছেন- আশিক পিয়াল