প্রিন্সিপাল স্যার বলেছিলেন, সময় পেলে আমার মেয়েটাকে দেখবেন, ইংরেজিতে একটু কাঁচা।
সময় পেলে মানে কী, পুরো দেশের মধ্যে এখন বোধহয় এই একটিই এলাকা, যেখানে মুঠোফোন বাজে না। সিনেমা-থিয়েটার, এমনকি তেমন একটি মার্কেটও নেই। কর্ণফুলীর পানি এখানে নিথর, ঢেউ গোনা যায় না, বিকেলগুলোতে আমি নদীর পাড়ে বসে দূরের পাহাড়, পাহাড়ের ঢালে জুমচাষ আর তার ছায়ায় চা-বাগানের পুনরাবৃত্তি দেখি। সন্ধ্যার আগেই যেন রাত নেমে আসে। সুতরাং আমি রাজি।
কিন্তু জিনাত বলল, আমার স্যার দুটো শর্ত আছে।
আমি অবাক, শিক্ষার্থীর আবার শর্ত কী?
জিনাতের কথা-আছে, লেখাপড়া নিয়ে না স্যার, অন্য বিষয়।
-কী বিষয়?
-এক• আমার চেহারা নিয়ে কিছু বলা যাবে না। দুই• বই বা নোটের ভেতর কোনো চিরকুট গুঁজে দেওয়া যাবে না।
বুঝলাম। একটু অপমান (অভিমান) বোধও হলো। আমার কাজ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা আর ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্রাকচার নিয়ে কথা বলা-জিনাতের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটা কী, আর চিরকুট•••? আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ভালো ছাত্র, কপালফেরে কাপ্তাই মহিলা কলেজের লেকচারার, আমার রুচির সঙ্গে ওই চিরকুট-ফিরকুটের কোনো সম্পর্ক আছে?
শিক্ষা দান ও গ্রহণ শুরু হলো। প্রিন্সিপাল স্যার বলেছিলেন-একটু কাঁচা। বাস্তবে দেখা গেল, অনেক বেশি। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধে নেই, কারণ ওই যে বললাম, সময়। জিনাত ধীরেসুস্থে শিখুক, আমার তো সময়ের অভাব নেই, ধৈর্যেরও। সকালে কলেজে দুটো ক্লাস নিই, বিকেলে সময়ের আগেই পৌঁছে যাই প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে। মাঝে জ্ঞানদান প্রচেষ্টার মধ্যে সময় কখন গড়িয়ে যায়, বুঝতে পারি না। মাঝেমধ্যে জিনাতই থামিয়ে দেয়, আজ আর না স্যার। আমি অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসি।
এই অতৃপ্তির একপর্যায়ে একদিন বুঝতে পারলাম, জিনাতের শর্ত দুটো আসলেই বেশ কঠিন। আমার ফেলে আসা জীবনের ্নৃতি ও অভিজ্ঞতা ঘেঁটে এমন একটি মুখেরও সন্ধান পাই না, জিনাতের চেয়ে যা সুন্দর।
-আচ্ছা, তুমি শর্ত দুটো কেন দিয়েছিলে, জিনাত?
-এর আগে অঙ্ক, বাংলা, সমাজবিজ্ঞানের তিন স্যারই এ রকম করেছিলেন, শর্ত না দিলে আপনিও করতেন স্যার।
শুনে আবার অপমান (অভিমান) বোধ করলাম। মেয়েটা নিজেকে কী ভাবে! তুমি আমাকে চেননি মেয়ে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বললাম, আমি ওরকম করতাম না, কারণ আমি•••মানে আমি অনেক আগে থেকেই একজনকে ভালোবাসি, আমার মামাতো বোন লীলা•••ওর সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তাও ঠিক হয়ে আছে•••।
ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারি না বলে প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না। তবে মনে হলো, গুঁতো একটা খেয়েছে। সেটা পরে আরও স্পষ্ট বুঝতে পারি, যখন সে এটা-ওটা প্রসঙ্গে লীলার কথা জানতে চায়। আমিও মনের রঙে লীলাকে তৈরি করি। কীভাবে তার সঙ্গে সম্পর্কটা গড়ে উঠল-একসঙ্গে ছবি দেখতে যাওয়া, টিএসসির সামনে ফুচকা খাওয়া•••সব মিলিয়ে ইংরেজি পড়াশোনার বারোটা বাজিয়ে ডালপালা ছড়িয়ে গল্পটা প্রায় উপন্যাসে গড়াচ্ছে। এখন আর প্রিন্সিপাল কোয়ার্টার থেকে ফিরে আসার সময় অতৃপ্তি হয় না, বরং একটা ঈর্ষার ফুলকি জ্বালিয়ে রাখতে পারলাম ভেবে মহানন্দে পরের দিনের জন্য ধারাবাহিকের একটা নতুন পর্ব তৈরি করি। চলছিল বেশ। কর্ণফুলী, পাহাড়, জুমচাষ, চা-বাগান-সব যেন উধাও হয়ে গেল চোখের পাতা থেকে। শুধু জিনাত আর জিনাত, আর লীলার গল্পের নানা বাঁকবদল। কিন্তু বাদ সাধল মোশাররফ হোসেন। ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেল জিনাতের। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আমার, লীলার গল্পও থেমে গেল। জিনাত জিজ্ঞেস করে, লীলার খবর কী স্যার, চিঠিপত্র লেখেন না?
আমি উত্তর না দিয়ে বলি, মোশাররফ হোসেনকে তুমি দেখেছ জিনাত?
-দেখেছি, বুড়া বাঁদর।
-তবু তুমি রাজি হয়ে গেলে?
-কী করব স্যার? মুরব্বিরা ঠিক করেছেন•••
-তোমার একটা পছন্দ আছে না?
-আমার তো স্যার আর কারও সঙ্গে কিছু নাই, আপনার যেমন লীলা আছে, এখন বিয়ে একটা হলেই হয়•••
-তাই বলে মোশাররফ হোসেন!
জিনাত হাসে। আমি মন খারাপ করে ফিরে আসি। বহুদিন পর নদীর পাড়ে গিয়ে বসি, তার নিথর পানিতে ঢিল ছুড়ে ঢেউ তুলি। নিজের হাত কামড়াই, মাথার চুল ছিঁড়ি। মনে হয় লীলার গল্পটা না ফেঁদে বরং শর্ত ভঙ্গ করলেই ভালো ছিল।
পরদিন খুব সকালে প্রিন্সিপালের কোয়ার্টারে গিয়ে হাজির হই। সবে স্মান সেরে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জিনাত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার অপূর্ব স্মিগ্ধ মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আমার বুক ভেঙে যায়। বললাম, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
জিনাত বলল, জানি কী বলবেন।
-কী?
-আপনার লীলার গল্পটা বানানো•••
-বানানো•••তুমি কী করে জানলে?
-আপনি স্যার একটা হাবা, গল্পটার আগামাথা কিছু ঠিক নাই, একবার বলেছেন লীলার পুরো নাম শায়লা শারমীন, আরেকবার নাজনীন আক্তার। একবার বললেন, সে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিচার, আবার বলেছেন, বদরুন্নেসা কলেজে পড়ে, একবার মামাতো বোন, একবার ফুফুর মেয়ে•••এত ভুল তথ্য দিলে তো নমিনেশন বাতিল হয়ে যাবে, স্যার!
আমি বাকরুদ্ধ। কানমলা খাওয়া ছাত্রের মতো অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, কর্ণফুলীর জলে ডুবে যাচ্ছি, সাঁতার জানি না তো ডুবেই যাচ্ছি।
জিনাতই টেনে তুলল আমাকে। বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি স্যার, খুব ভেবে উত্তর দেবেন•••।
বুকের ধুকপুক শব্দ থামিয়ে বলি, বলো•••
-আপনি আমাকে বিয়ে করবেন?
বলে কি জিনাত! ভিখারিকে জিজ্ঞেস করছে ঘোড়ায় চড়বে কি না? আমি আমতা আমতা করে ক্ষীণস্বরে বললাম, মোশাররফ হোসেন?
-ওই বুড়া বাঁদরের কথা রাখেন, আপনি করবেন কি না বলেন!
ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি বললাম, হ্যাঁ, করব।
জিনাত মিষ্টি করে হাসল। অপূর্ব সেই হাসি। আমি আবেগের তোড়ে জিনাতের একটা হাত ধরে ফেললাম। জিনাত বলল, হাত ছাড়েন।
আমি হাত ছেড়ে বললাম, তুমি আমাকে ভালোবাস জিনাত?
হেসে বলল, কী করব, বাঁদরের চেয়ে ছাগল ভালো।
আমি ছুটে গেলাম নদীর ধারে। উজ্জ্বল আলোয় তখন আনন্দিত প্রকৃতি। পাহাড় ও নদীর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল-আমি ছাগল, আমি ঘাস খাই, ভ্যা ভ্যা করি•••তবু জিনাত আমাকে ভালোবাসে•••
লিখেছেন – বিশ্বজিৎ চৌধুরী |