ডক্টর যখন ওর হাতের নাড়ি দেখে বলেছিল ও আর নেই তখন যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো!
-এক্সিডেন্টে কেবল জানালার সাথে আঘাত খেয়ে মাথা ফেটেছে আর কিছু যায়গায় সামান্য কেটে গেছে! কিন্তু এই আঘাতে এমন হয়ে যাওয়ার কথা নয়। খুব সম্ভব হার্ট দুর্বল হওয়ার জন্য এমনটা ঘটেছে!
উত্তরে আমি কিছুই বললাম না। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইছে আর মনেমনে মুচকি হেসে ভাবছি যে ছেলেটা হৃদয় থেকে এতো বিশাল ত্যাগ করতে পারে তার নাকি হার্ট দূর্বল! হার্টের অসুখ আর হার্ট দুর্বল এই কথা দুটো সবাই একই কথা বললে কেবল আমিই মানতে পারবো না! তাহলে তো হাসিব সেদিনই ও অচিনপুরে চলে যেত যেদিন ওই হৃদয় থেকে বিশাল ত্যাগ করেছিল!
কয়েকবছর আগের কথা। হাসিবরা আমাদের পাশের বাসায় এসে উঠেছিল তখন। দুজনেই নার্সারিতে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাসমেট আর পাশের বাসায় থাকার সুবাদে আমার আর ওর বন্ধুত্বটা ভালোই জমে উঠেছে অল্পদিনেই। ওর এক-দুই গণনা দেখে আমি খুব হেসেছিলাম। গণনাটা ঠিক এরকম ছিল এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ,ছয়,সাত,আট,
নয়,দশ,রস,জুস,আম,জাম,কমলা,আপেল,
আঙ্গুর,লিচু,আটচল্লিশ,নয়চল্লিশ,
পঞ্চাশ,একানব্বই,দুইয়ানব্বই,তিন
ানব্বই,চারানব্বই,মারানব্বই,ছয়া
নব্বই,মোয়ানব্বই,আটানব্বই,নয়ানব্বই, একশো…!
তখন বুঝতাম না বন্ধুত্ব কি! শুধু এটাই জানতাম ওকে ছাড়া আমার ভালো লাগেনা! সারাক্ষণ ওর সাথেই খেলতাম। আমি ওর মাকে তখন থেকেই কাকী বলতাম না, ছোটমা বলতাম। তারপর ধীরেধীরে দুজনে একসাথে বড় হতে লাগলাম। নাম ধরে ডাকতাম দুজন দুজনের। একবার আমার কাগজে আঁকা ড্রইং ছেঁড়ার কারণে হৃদয়ের সাথে ঝগড়া করছিলাম তারপর হৃদয় নিজের দোষ থাকা সত্ত্বেও উল্টো আমার চুল টেনে ধরছিল তারপর খেলার মাঠে আমি হাসিবকে বলাতে ও সেদিন বলেছিল ধরতো হারামিরে আজকেই মাথা ন্যাড়া করে দিবো! তারপর দুজনে মিলে ইচ্ছামত চুল টেনেছি ওর! এরপর সমবয়সী আর কেউ আমাদের সাথে ঝগড়া লাগেনি! পঞ্চম শ্রেনী ছিল আমার জন্য এক অভিশাপের নাম! এই ক্লাসে উঠার পর হাসিব বুক ব্যথা বলতে শুরু করে। প্রথমে ভাবছিল সবাই এটা ঠান্ডা থেকে আর এদিকে ওর বুক ব্যথা বেড়েই চলছিল! তারপর ওকে হাসপাতালে নিয়ে এক্সরে করা হলো! এক্সরে করার পর ও কয়েকদিনের জন্য হাসপাতালে ছিল। কিছু বুঝিনি তখন।শুধু এটুকুই বুঝতাম হাসিব অসুস্থ! এরপর বাসায় আসা সত্ত্বেও ও তিনমাস বের হয়নি ঘর থেকে। আমিও খেলাধুলা বাদ দিয়ে সারাটা বিকেল ওর কাছে গিয়ে আড্ডায় কটাতাম। হয়তো আড্ডা বুঝতাম না কিন্তু ওর সাথে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগতো!
তখন ছোটমা একটা কথাই বলেছিল হাসিবকে সবসময় আনন্দে রাখতে। ওর সাথে মারামারি আর ঝামেলা না করতে আর কেউ যেন ওর সাথে ঝামেলা না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে। ছোটমা কেন কথাগুলো বলেছিল সেদিন আমার বোধগম্য হয়নি। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে বড় কোনো কারণ আছে অবশ্যই!
তারপর সপ্তম শ্রেনীতে উঠার পর বুঝতে পারলাম এক্সরের পর হাসিব কেন কয়েকদিন মেডিকেলে ভর্তি ছিল।
কেন ছোটমা ওকে কোনো ঝামেলায় জড়াতে নিষেধ করছে। এক্সরে রিপোর্টে ওর হার্টে একটা ফুটো দেখা গিয়েছিল। আর ওটা অপারেশন করার জন্যই ও তখন হসপিটালে ভর্তি ছিল। ওর হার্ট সার্জারি করে রিং লাগানো হয়েছিল। এরপর থেকে আমার চঞ্চল বেষ্টুটা অনেক নিরব হয়ে গেল! ডাক্তার বলেছিল ওকে কোনোরকম টেনশন দেওয়া যাবে না, না হলে ওর হৃদক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমিও ওকে সবসময় হাসিখুশি রাখবো। ওর হাসির পাসওয়ার্ড হবো। নবম শ্রেনীতে ওঠার পর আমরা কেউ কাউকে বন্ধু বলতাম না। ভাই বলতাম। সম্পর্কটা যেন রক্তের এক বন্ধন। প্রত্যেকটি টিচার আমাদের বন্ধুত্বের কথা জানতো। আমি হোমওয়ার্ক না করার জন্য যখন ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকতাম তখন হাসিব হোমওয়ার্ক করেও তা লুকিয়ে রেখে আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকতো।
কলেজে ওঠার পর একদিন ইংরেজি পড়া না পারার জন্যে টিচার আমাকে অনেক অপমান করেছিল। পুরো ক্লাসভর্তি মেয়েগুলার সামনে অপমান করার প্রয়োজন কি ছিল! সারাদিন মুড অফ করে বসে আছি।
-কিরে কি হইছে?
-কি হইছে সেটা তো দেখলিই ক্লাসে?
-তোরে লজ্জা দেয়ার শোধ তুলবো ওই টাকলুডারে ভয় দেহাইয়া!তুই কোনডা কস?
-হ’ ভাই আমিতো ওইডাই কই! চল টাকলুটারে ভয় লাগাই!
-কিভাবে?
-ফোন দে। দিয়া উল্টাপাল্টা কিছু কইয়া দে!
-ওয়েট!
ফোন করার পর ওপাশ থেকে রিসিভ করলো।
-হ্যালো!
-হ্যালো স্যার!
-কে?
-স্যার আমি হাসিব।
-ও আচ্ছা। তা কি জন্য ফোন দিলে?
-স্যার শুভ্র কোথা থেকে উল্টাপাল্টা কি খাইয়া আপনার নামে বকবক করতেছে?
-কি বলে?
-বলে ওই টাকলুরে আমি একদম উধাও কইরা দিমু! ওই বেডায় আমারে অপমান করছে আমি ওর ঘাসবিহীন স্টুডিয়ামে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করমু! আমি ওরে মদ খাওয়াইয়া মানুষ করমু! আমি আজ মদ খাবো আর টাকলুর মাথা ফাটিয়ে দিবো! ওর ভুরি ফুটো করে দিবো! হিহাহাহা! আহো ভাতিজা আহো! খেলা হবে আজকে!
-সত্যি ও এগুলা বলছে? (ভীত কন্ঠে)
-হুম স্যার বলছে!
-হাসিব তুমিতো গুড বয়। ওর সাথে মিশবে না খুব একটা। ও খারাপ ছেলে তোমাকে যেকোনো সময় ফাঁসাইয়া দিবে। ওর সাথে মাঝেমাঝে তাল দিয়া চলবে যাতে তোমার ক্ষতি করতে না পারে! মনে থাকবে?
-হুম স্যার মনে থাকবে।
-হুম। গুড বয়। শুভ্র যে এগুলা বলছে এগুলা যেন আর কেউ না জানে।
-আচ্ছা স্যার।
-তুমি ওকে তেতুল টক খাইয়ে দাও ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা স্যার!
আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থায়! স্যার হয়তো জন্মের ভয় পাইছে! কি এক্টিংটাই না করলো হাসিব! এগুলোও সম্ভব! ভাবা যায়!
দুদিন পরঃ
-এই হাসিব শুনো।
– জ্বী স্যার বলুন।
-আজকে দেখলাম তোমাকে শুভ্রর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলে! তোমাকে না বলেছিলাম ও খারাপ ছেলে, ওর সাথে কম মিশতে?
-স্যার আপনিই তো বললেন ও যখন তখন আমার ক্ষতি করতে পারে তাই ওর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে! আমিতো তাই করছিলাম স্যার!
-হুম। গুড গুড! অল দ্যা বেষ্ট।
ধন্যবাদ স্যার।
এভাবেই দুষ্টামিমাখা ছিল বন্ধুত্বের মুহূর্তগুলো!
তারপর অনার্সে ভর্তির পর হাসিবের খোঁচা দাড়ির সাথে চিকন ফ্রেমের গোল চশমাটার উপর যেন রীতিমত মেয়েদের ক্রাশ বেড়েই চলছে! আমি যে সাথে এতো কিউট একটা ছেলে আছি কেউ তাকাচ্ছেই না! এদিকে ক্লাসের সবাই আমাকে জানে সবচাইতে দুষ্টু ছাত্র হিসেবে, আর হাসিবকে জানে একদম নিরব প্রকৃতির! তাছাড়া হাসিব ভালো কবিতাও লিখতে জানে।
একদিন!
-এই যে! মিস্টার গোমড়ামুখো!
-শুভ্র তোকে ডাকছে!
-ধুর বেটা! আমি কি তোর মতো গোমড়া মুখ করে বসে থাকি নাকি!
-কাকে বলছিলেন?
-আজ্ঞে আপনাকে!
-বিশেষ প্রয়োজন?
-না! শুধু এটুকু জানতে এসেছিলাম আপনি কি হাসতে শিখেন নি কখনও? সবসময় যেন ক্লাসে সুপার গ্লু ঠোঁটে লাগিয়ে বসে থাকেন! আপনি মানুষ নাকি রোবট?
-আরে আশ্চর্য তো! আমি কেমন আচরণ করবো চুপ থাকবো কি কথা বলবো সেটা আপনি ঠিক করবেন নাকি!
– আমি তো সেটা বলিনি! আমি বলেছি হাসলে মন ফ্রেস থাকে! ব্রেইন সার্ফ হয় তাই আপনি হাসবেন! বাই! খুব শীঘ্র দেখা হবে!
-পরেরদিন আমি আর হাসিব লাইব্রেরীরে গেলাম! হুমায়ুন আহমেদের খ্যাতি অনেক শুনেছি লোকমুখে। আজ তার গল্প পড়বো। নিজের নামে গল্প দেখে কিছুনা ভেবেই উৎসাহ নিয়ে শুভ্র সমগ্র বইটা পড়ছি! আর হাসিব পড়তেছে হিমুর অমনিবাস। এমন সময় হাসিবের উদ্দেশ্য করে হিমুর অমনিবাস বুঝি?
-আরে আপনি আবার!
-বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই আবার দেখা হবে?
-আপনার সাথে দেখা হওয়া মোটেই সুখকর নয়।
-কেন?
-আপনি কেমন যেন!
-কেমন!
-অদ্ভুত!
-কেন মনে হলো!
-এমন ভাবে কথা বলেন যেন কতকাল আমায় চিনেন!
-যাই হোক! হুমায়ুন আহমেদের গল্পগুলা আমার অনেক ভালো লাগে। আগে কখনওবা পড়েছেন?
-না!
-আমি পড়েছি। মিসির আলি! আপনি কোথায়, দ্বৈরথ, মিসির আলির চশমা, হলুদ হিমু ও কালো র্যাব, রূপা, আজ হিমুর বিয়ে, কিছু শৈশব, হিমুর একান্ত সাক্ষাতকার, সবাই গেছে বনে, লিলুয়া বাতাস,হিমুর অমনিবাস, শুভ্র সমগ্র ! গল্পগুলো সুন্দর। হুমায়ুন আহমেদের গল্পগুলা প্রেমের গল্প, যে কেউ গল্পের প্রেমে পড়ে যাবে! হুমায়ুন স্যার খুব সম্ভব মোটা ফ্রেমের চশমায় মিসির আলিকে নিজের জীবনের থেকে একটা চরিত্র সাজিয়েছিলেন। হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি নিজেকেই মিসির আলীর মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন। আর হিমুর ক্ষেত্রেও তাই যেখানে রূপা নামের মেয়েটি ছিল অনেক ধনী পরিবারের আদরের মেয়ে আর হিমু সাদাসিধে চরিত্রের একটি ছেলে! যেটা হুমায়ুন আহমেদের যুবক জীবনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ! আর শুভ্র…
-সাহিত্যপাঠ মোটামুটি ভালোই দেখছি।
-এইতো অবসর সময়ে বিভিন্ন লেখকের বই নিয়ে বসা হয়।
-ওহ ভালো!
-হুম। আমি কবিতা! আপনি হাসিব তাই না?
-আমার বন্ধু, শুভ্র!
-আমি আপনার কথা জানতে চেয়েছি,উনার কথা নয়!
-আরে আপনি তো বললেনই আমি হাসিব! আমার কথা আবার নতুন করে বলার কি আছে!
-আপনি একটা…
-কি?
-গোমড়ামুখো!
-আপনার যা ইচ্ছে বলতে পারেন!
-ধ্যাত!
কবিতা চলে যাওয়ার পর!
-কিরে হাসিব তোকে দেখে যে আজকাল মেয়েদের মনে লাড্ডু ফুটছে!
-ধুর হারামি! কি সব বলিস!
– এই যে জনাব হাসিব!
-আরে আপনি আবার! এই মাত্র না আপনি চলে গেছিলেন?
-হুম। আবার আসলাম। আপনার মোবাইল নাম্বারটা দিন তো!
-আমার মোবাইল নাম্বার নাই।
-জ্বী না ভাবী ও মিথ্যে বলছে। এই নিন নাম্বার জিরো ওয়ান………
-থ্যাংকইউ ভাইয়া!
-হারামি তোরে কে বলছে আমার নাম্বার দিতে? কয়েকটা কিল-ঘুসি দিয়ে ওই হারামি তোর কোন জন্মের ভাবী হলোরে?
-কেন তোকে আমি ভাই বলি না? তুই তো আমার ভাই!
-সেটাতো আমি জানি কিন্তু ওই মেয়ে আমার অর্ধাঙ্গিনী হলো কীভাবে?
-হয়নি তো হতে কতক্ষণ!
-আমি প্রেমে বিশ্বাস করি না!
-দেখা যাবে! ডুবে ডুবে জল এতো বেশি খাইও না যে সোনার চাঁন, পেট ফুলে টাংকি হয়ে যায়!
-যা ভাগ!
পরের দিন।
-কিরে রাতে কবিতা ফোন দিয়েছিল?
-বাদ দে!
-ও এখনই ডুবেডুবে জল খাওয়া হচ্ছে বুঝি?
-না! মেয়েটা আমাকে ভালোলাগা,ভালোবাসার আলাপ করতে ফোন দিয়েছিল।
-বেশ তো!
-আমি স্রেফ বলে দিয়েছি আমার দ্বারা এসব হবে না। -তারপর?
-আরও বেশি পাগলামি শুরু করছে!
-কি বলছে?
-আমার বাবাকে এসে বলবে ও নাকি আমাদের বাড়ির বউমা হবে!
-ভালো তো! মেয়ে খারাপ কিসে?
এভাবে চলে গেল প্রায় একটি বছর প্রতিদিনই কবিতা এটাওটা অযুহাতে হাসিবের সাথে কথা বলতে আসতো! আর হাসিব ইগনোর করতো। এবার আমরা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।
-এই যে হাসিব।
-আবার কেন এলে!
-তোমাকে নিয়ে যেতে!
-কোথায়?
-আমাদের বাড়ি! আমার বাবার সাথে তোমাকে দেখা করিয়ে আনতে! বাবাকে গিয়ে বলবো আমরা তিন বছর ধরে একে অন্যকে ভালোবাসি!(একটু বাড়াবাড়ি মিথ্যা)
-প্লিজ লিভ মি এলোন! অনেক হয়েছে! গত এক বছরে আমার লাইফটা পুরো হেল করে দিছো তুমি! আই হেট ইউ, আই হেট ইউ, আই হেট ইউ!
কবিতা কাঁদতে কাঁদতে চলে যাওয়ার পর।
-কিরে হাসিব। মেয়েটাকে কাঁদিয়ে দিলি? মেয়েটা সত্যিই কিন্তু কিন্তু তোকে ভালোবাসে।
-আমাকে ভালোবেসে কি পাবে ও! তুইতো জানিস আমার হার্ট প্রব্লেম,আমি যেকোনো সময় টুক করে টাটা গুড বাই হয়ে যাবো!
-চুপ! এসব কথা বলতে নাইরে ভাই!
-কিন্তু আমিতো ওকে কষ্ট দিতে চাইনা বলেই বলছি ভালোবাসিনা! কারণ আমি ওর চোখে সত্যিকার ভালোবাসা দেখছি!
-তুই ভালোবাসবি না?
-তুই ভালোবাসবি ওকে!
-মানে!
-হ্যা আজ থেকে ওকে তুই ভালোবাসবি!
-কি বলছিস এসব!
-হ্যা ভাই। শুভ্র বল তুই ওকে কষ্ট দিবি না। আমি জানি তুই পারবি ওকে অনেক ভালোবাসতে। ওকে হ্যাপি রাখতে! আমার কথা রাখার জন্য হলেও ওকে ভালো রাখতে পারবি। আমি জানি আমি যদি ওকে বলি যখন তখন আমার হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে ও তখন বলবে আমি একদিন থাকলেও ওর সাথেই বাঁচতে হবে। কিন্তু পরে সারাজীবন মেয়েটা কাঁদবে!
-ধুর তুই একটা কথা বললি! মানুষের নিশ্বাসের বিশ্বাস নাই যেকোনো সময় যে কেউ চলে যেতে পারে। তবুও কি মানুষ নিজের ভালোবাসাকে পেতে চায় না?
-কিন্তু আমি জেনেশুনে কেন মেয়েটাকে অনিশ্চিত ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধবো!
-এখন কি করবি।
-তোকে যেটা বলছি সেটা।
-তুই ভালোই যখন বাসিস না তাহলে কাঁদছিস কেন ওর জন্য?
-তোকে বলেছি বাসিনা? কবিতা আসতেছে আবার এইদিকে। আমি যা বলবো চুপ করে থাকবি। যা বলবো সব মেনে নিবি।
বলেই ও চোখ মুছে নিলো!
– আমি অন্যদের মতো আহামরি সুন্দরি নই বলে আমাকে ভালোবাসতে তোমার অপরাধবোধ হয় তাই না?
-তোমাকে বলেছি তুমি সুন্দর না? তোমার মতো এমন মায়াবতী চেহারা আর ক’জনের থাকে! এমন তোমাতে যে কেউ হারিয়ে যাবে প্রেমের গহিনে!
-তুমি তাহলে কেন ভালোবাসতে পারোনা?
-কারণ আমার বন্ধু শুভ্র তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসে। বলতে পারেনি তোমাকে হারানোর ভয়ে! এতোটাই ভালোবাসে যে তোমাকে হারানোর ভয়ে ভালোবাসাটা প্রকাশ করতেই পারেনি! আর তুমি কিনা এতো ভালোবাসা বুঝতেই পারলে না!
-তাই নাকি শুভ্র?
-হুম।
-তাহলে কেন হাসিবকে ভালোবাসা সত্ত্বেও আমায় হেল্প করেছিলে?
-আরে ও তোমাকে খুশি দেখতে চেয়েছিল তাই নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিচ্ছিল! ভাবতে পারো কতটা ভালোবাসলে এরকম ত্যাগ করা যায়!
-তাই নাকি শুভ্র?
-হুম! (মনেমনে ভাবছি বিসর্জন দিলো কে আর বললি কার কথা)
-কতটা?
-যতটা ভালোবাসলে তোমাকে হারাতে হবেনা কখনওই!
-সত্যিতো?
-হুম সত্যি!
-আমি কি বোকা কেউ একজন আমাকে এতো ভালোবাসে আর আমি তা বুঝলামই না!
-হুম বুঝলেই তো না!
তারপর আরও এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। আমি আর কবিতা দুজনের পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেছি কিছুদিন হলো! আজ হঠাৎ করে ফোন এলো হাইওয়েতে একটি বাস এক্সিডেন্ট হয়েছে! দূর্ঘটনার শিকার হওয়া সব ব্যক্তির ফোন থেকে তাদের ফ্যামিলিতে জানানো হচ্ছে! হাসিবের মোবাইলে তো ভাই দিয়ে আমার নাম্বার সেইভ করে রাখছে! তাই বলেই হয়তো ওর মোবাইল থেকে আমাকে ফোন করেছে! হাসিব আজকে জেলা মেডিকেলে যাওয়ার কথা ছিল। আর ওখানে যাওয়ার পথেই হাইওয়েতে বাস এক্সিডেন্ট! আমি খবর শুনে ছোট মাকে জানিয়ে দ্রুত সেখানে চলে গেলাম। একটা গাড়িতে উঠিয়ে ওকে দ্রুত নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে! হাতের
কুনুইয়ের মধ্যে জানালার কাঁচ দিয়ে ছিঁড়ে গেছে! সাথে পিঠের দিকে দুই একটা কাটা দাগ। হসপিটালে নেওয়ার পর ডক্টর এসে হাতের নাড়ি টিপেই বললেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো কথাটা!
বুকে আঘাত লাগার কারণে ওর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে যেহেতু ওর হার্টে রিং লাগানো আছে আগে থেকে।যাদের হার্ট প্রবলেম আছে তাদের যেকোনো অপারেশন করতে হলেও বড় বড় ডাক্তাররা পিছুপা হয়ে যায়! তারা নিশ্চয়তা দিতে পারেনা! হার্ট দূর্বল হলে সেদিন কিভাবে ওর ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে পারলো!
ছোটমা এসেই কান্না জুড়ে দিল। কবিতার চোখ বেয়ে নিরবে অশ্রু ঝরছে! আংকেল যেন শোকে পাথর হয়ে বসে আছে! আচ্ছা পাথরের কি অনুভূতি শক্তি আছে! হয়তোবা! নয়তো আংকেলের চোখে কেন বারিধারা!
ভাই ফিরে আয়, ভাই! কে আমাকে সাপোর্ট দিবে সবসময়! কে আমাকে হারামি বলে কিল দিয়ে আবার ভাই বলে বুকে টেনে আগলে ধরবে! কে বুঝবে তোর মতো ভাই! তোকে ছাড়া জীবন আমি ভাবতে পারিনা! বন্ধুরে তুই ফিরে আয়, ফিরে বুকে জড়াতে! ফিরে আয় হারামি বলে গালি দিতে, যে গালিটা আমার কাছে তোর মুখেই মানায়!
অভিমান করে একদিন কথা না বললে জীবনের স্বাদ যেন পানসে হয়ে যেতো! এখন বল তোকে ছাড়া আমি ক্যামনে রবো!
ছোটমা কান্নাস্বরে বলছে আমায় বাপের বাড়ির বদনাম করে রাগিয়ে দিবিনা খোকা? কে আমায় বলবে মা তুমি আঁচলে টাকা লুকিয়ে রেখো খুঁজে পেতে আমার যেন কষ্ট না হয়!
কবিতা আর আংকেল তো যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলছে!
ও মা, আমার কবর হয় যেন গো ভাইয়ের কবর পাশে,
আবার যেন পাই ফিরে ভাইকে অচীনপুরের দেশে!
মাগো, ভাইয়ের যে হার্ট প্রব্লেম ক্যামনে থাকবে শীতল মাটিতে,
পারতাম যদি বুকে রেখে ভাইকে আমি নিচে থাকতে!
আঁধার ভয় পাওয়া ভাইটি আমার কেবা করে রবে,
ভাইরে তুই মন গহিনে গভীর অনুভবে!
আমিও একদিন টুক করে ভাই আসবোরে তোর কাছে,
দুটি দেহ ভেঙ্গে যেথা গড়বে একটি ছাঁচে!
আরও বছর খানেক পর।
আমি বাবা হলাম। হাসিব আর আমার নামের সাথে মিলিয়ে ওর নাম রাখছি অভ্র হিমেল! ওকে নিয়ে ছোটমার কাছে যাওয়ার পর হাসিবের রুমে ঢুকে নিরব অশ্রু ঝরছে! প্রতিটি দেয়াল যেন আমার আর ওর বন্ধুত্বের ক্যানভাস! পুরো রুমজুড়ে সেই পুরনো স্মৃতি। হঠাৎ কবিতা হাসিবের ডায়েরীটি নিয়ে শেষের পৃষ্ঠায় তাকিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখল আমায়!
আমিও দেখলাম কি ছিল ওখানে লেখা!
লেখাটা ছিল,
কাজল চোখের মেয়ে বিসর্জন দেওয়ার জন্যই হয়তো তোকে ভালোবাসা,
তোকে নিয়ে সুখ সংসার সেতো মিথ্যে মনের আশা!
তোর সুখের লাগিয়া যদি আপন সুখ বিসর্জন দেওয়া হয় যদি ভালোবাসা তাহলে আমিও ভালোবাসি,
তবু কাগজের নৌকায় তো আর নদী পাড়ি দেওয়া যায়না ওরে পরবাসী!
মায়াবতী মেয়ে তোকে সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসি!
কবিতা আজ তোমায় দিলাম ছুটি!
যেকথাটা একদিন তুই কাউকে বলেতে না করেছিস। যে সত্যিটা কবিতার আড়াল করতে আমার থেকে কথা নিয়েছিস সেই সত্যিটা আজ কবিতার সামনে! ডায়েরীতে তোর অশ্রুফোটা অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে এখন যে ফের নতুন করে অশ্রুফোটা জমা হবে ডায়েরীর পাতায়!