নিখাদ ভালবাসা

নিখাদ ভালবাসা

বলতে গেলে অনেক জেদ করেই আমার ভালবাসার শুরুটা হয়েছিল। যদিও যত সহজে বললাম ভালবাসা শুরু হয়েছিল, সত্যিকার অর্থে মোটেও তা সহজ ছিলোনা।

আমার এক বন্ধুর আত্মীয় ছিল ও (ওর নাম অর্পি), এবং ঐ বন্ধুর সাথে জেদ করেই আমি অর্পি মোবাইল নাম্বার কালেক্ট করি আর যোগাযোগ শুরু করি। প্রথম দিকে ও আমাকে মোটেও পাত্তা দিতনা। অনেক কষ্ট করে ওকে পটাতে হয়েছিল! তারপর রেগুলার ফোনে কথা হত। হঠাত একদিন ও আমাকে দেখা করার কথা বলল। আমিও গেলাম দেখা করতে। জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের সাথে এইভাবে দেখা করতে গেলাম, তাই অনেক সংকোচ কাজ করছিল। যাই হোক দেখা হোল, এবং আমি প্রথম দেখাতেই ওর প্রেমে পরে যাই। প্রেমে পড়ার কারণ অবশ্য ৩টা জিনিস : কালো টিপ, চোখে কাজল আর লম্বা চুল যা আমার খুব পছন্দের। তারপর চলতে থাকে আমাদের বন্ধুত্বের চাকা। বন্ধুত্ব বললাম কারণ আমাদের প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল অনেক পরে। ওকে দেখার পর থেকেই ওর প্রতি টান বেড়ে যায়, আর ফোনে কথা বলতে বলতে আরো বেড়ে যায়। তারপর অনেকবার বিভিন্ন জায়গায় ওর সাথে দেখা হয়েছে। পরিচয়ের প্রায় ৫ মাস পরে ওকে প্রেমের প্রস্তাব দেই। কিন্তু ও আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ একটাই। আমরা হিন্দু ধর্মের মানুষরা জাতকে অনেক প্রাধান্য দেই। ধর্মের হিসেবে ও ছিল বড় জাতের, আর আমি ছোট জাতের । তাই বলে কি ভালবাসা জাতের বৃত্তের বাইরে আসতে পারবেনা?

ওর বাবা খুব restricted মাইন্ডের মানুষ, তাই ওর ভয় ওর বাবা কখনই আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না। ও আমাকে ঠিকই ভালোবাসতো। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস পেতনা ওর পরিবারের জন্য। যদিও ওর সাথে আমার দেখা হত, কথাও হত মোবাইলে, কিন্তু আমি ওকে অফার করেছিলাম মেসেজের মাধ্যমে। সারারাত মেসেজ চালাচালি হোল কিন্তু ওকে কোনভাবেই বোঝাতে পারলাম না, শেষে সব আশা ছেড়ে দিয়ে ভোর ৫টার দিকে ঘুমালাম। তারপর কয়েকদিন কথা বলার পর ডিসিশান নিচ্ছিলাম দেখা করা বন্ধ করে দিব। কিন্তু ওর মত ছিলোনা। কারণ আমার ফ্রেন্ডের অভাব ছিলোনা, আর যেটার প্রয়োজন (ভালবাসার মানুষ) সেটাই আমার নাই।

যেই ভাবনা সেই কাজ! একদিন সকাল থেকে সব ধরনের যোগাযোগ ( ফোন, মেসেজ, মিসকল) বন্ধ করে দিলাম। প্রচণ্ড খারাপ কাটল দিনটা। খালি বারবার ওর কথা মনে পরল। দিনের মধ্যে কতবার যে কল করতাম, মেসেজ দিতাম, কিন্তু ঐদিন কিছুই হলনা। আসলে এটা আমার এক ধরনের জেদ ছিল, যাতে ও রাজি হয়। সারাদিন গেল।

সন্ধ্যার দিকে, সময় টা সম্ভবত সাড়ে ৭টার দিকে, মোবাইল এ একটা মেসেজ আসে। মেসেজ টা দেখে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারিনি। বলাই বাহুল্য মেসেজের কথাটা ছিল ‘”tume saradin amr satay kotha na bola takla kivabay.ajk thakay amr pora suru hoisa bt i kichu porta parta c na.amr matat sudu tumar cinta gurtasa.tume kano bujo na j tumar amr ai somporko kokhono somvob na.phöne a kotha bolta tho kuno problem nai,plz”:::

ঐ দিন থেকে ওর HSC এর পড়া শুরু হয়েছিল। মেসেজ টা পড়ে সাথে সাথে ওকে কল দিলাম, কারণ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। সেই থেকে শুরু হয়ে এখনো চলছে। তবে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির কথা এখন বলব…………

ওর সাথে পরিচয়ের ৮ মাসের মাথায় আমার জীবনে প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় আসে। সেইদিন ছিল ২০০৮ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বার। আমি রোড এক্সিডেন্টে spinal cord injured হই। গলা থেকে সারা শরীর পেরালাইসড হয়ে যায়। আমি তখন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে দুলছি। মৃত্যুর সাথে প্রায় ৩ মাস পাঞ্জা লড়েছি। ঐ ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে অর্পি আমার মানসিক শক্তি হয়ে আমার সাথে ছিল। আমি হাত নাড়তেও পারতাম না। আমার এক বন্ধু প্রতিদিন আমাকে দেখতে হাসপাতালে যেত। অর্পি আমার ঐ বন্ধুর মোবাইল এ কল করে আমার সাথে কথা বলত। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হয়ে যাওয়াতে কথা বলতেও পারতাম না। তখন ও অভিমান করতো। কিন্তু ও অনেক দূরে থাকায় অনুমান করতে পারতোনা আমার শরীর কি পরিমানে খারাপ ছিল। ওর ঐ অভিমান হয়তো ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যে ওর কথা শুনে আমি নিজেকে অন্য ভাবে আবিষ্কার করতাম আর ভাবতাম ও যদি আমাকে ভালো নাই বাসে তাহলে আমার জন্য এত টান কেন? আমি যখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ওর কথা চিন্তা করতাম তখন আমার দুচোখ বেয়ে অবিরাম জল পরত। কোন কারণে আমার সেই বন্ধু হাসপাতালে না আসতে পারলে ও আমার খোঁজ নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পরত। একদিন ডাক্তার আমাকে অন্য একটা হাসপাতালে রেফার করলেন। আর ঐ হাসপাতালে রুগির মোবাইল ব্যাবহার করা, কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। তখন অর্পি আমার আরেকটা ফ্রেন্ডের মাধ্যমে আমার খোঁজ নিত।

আমার শরীরে এক্সিডেন্টের প্রায় ৫ মাস পর থেকে আস্তে আস্তে পরিবর্তন দেখা যেতে থাকে। আমার হাতে একটু একটু শক্তি আসা শুরু হয় এবং হাত দিয়ে মোবাইল ও ব্যাবহার করা শুরু করি, কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে। শুধু অর্পি সাথে কথা বলার জন্যই সাথে মোবাইল রাখতাম। তারপর থেকে যতদিন ঐ হাসপাতালে ছিলাম, কমপক্ষে একবার হলেও কথা বলতাম। আর ঐ সময়টা তেই আমাদের বন্ধুত্ব ভালবাসার দিকে মোড় নেয়। আমি ওকে ‘জান’ বলে সম্বোধন করি, আর ও আমার ডাকটা মেনে নেয়। তারপর থেকে কতবার যে ওকে আই লাভ ইউ বলেছি তার হিসেব নেই।

এর পর থেকে রেগুলার ওর সাথে আমার যোগাযোগ হয়। আমি ঢাকা থেকে ট্রিটমেন্ট শেষ করে যখন সিলেট আসি ততদিনে ৯ মাস পার হয়ে গেছে, এবং সেই সময় ওর সাথে আমার দীর্ঘদিন পর আবার দেখা হয়। ও আমাকে দেখতে যায়, আর ওকে দেখে আমার কি অনুভূতি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। তারপর আবার ১ মাস পর দেখা হয়। যতবার ই ওর সাথে দেখা হয় আমি ভাবতাম, এই মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়, সংস্পর্শ খুব বেশি নয়, কিন্তু এই মেয়ে আমার দুর্দিনে এত দীর্ঘ সময় ধরে আমার পাশে ছায়ার মত ছিল। আজকের দুনিয়ায় এটা তো বিরল! অর্পি আমাকে সবসময় সাহস জুগায়, ওর চোখে চোখ রেখে আমি নতুন করে পৃথিবীকে দেখতে শিখছি, স্বপ্ন দেখতে শিখছি। আমি ঠিকমতো হাটতে পারিনা, কিন্তু ওকে নিজের জীবনে পাওয়ার জন্য নিজেকে established করার তাগাদা অনুভব করি। আমি এখনো ফিসিকালি ফিট না। কিন্তু আমার জন্য ওর ভালবাসার কোন পরিবর্তন নেই। আমি সারাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। এইত লাস্ট পহেলা বৈশাখ আমরা একসাথে celebrate করলাম। এই প্রথম কোন অকেশানে আমরা একসাথে ছিলাম। আমি নিজেকে শুধুই ভাগ্যবান না, সৌভাগ্যবান মনে করি। অর্পি এইভাবেই সারাজীবন ভালবেসে যেতে চাই…………

লিখেছেন – অনুপম দেব |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত