দীর্ঘ তিন বছর ধরে কর্মসূত্রে বাইরে ছিল রজত। আজকাল ব্যাঙ্কের পোস্টিং যা দেয় তা আর বলার নয়। চাকরি পাওয়ার পর যে উৎসাহে গাঁয়ের লোকজনকে মিষ্টি খাইয়েছিল সে উদ্যমে ভাঁটা পড়ে যায়, যখন জানতে পারল পুজোতে বাড়ি আসতে পারবে না। তখন এক বছরও হয়নি। ভালোই মন খারাপ হয়েছিল। মধ্যপ্রদেশের কোন ভিতরের একটা গ্রামে থাকতে হতো, সেখানে দুর্গাপুজোর অত রেওয়াজ নেই।
ওই ফোনেই ঢাকের আওয়াজ আর বাবা মা জেঠু জেঠির প্রণাম-আশীর্বাদ। তারপর দু’বছর ভালো কাজ করে যা হোক এবারে কাছাকাছি একটা জায়গায় পোস্টিং জুটিয়েছে। সাঁইথিয়া ব্রাঞ্চে। সেটা যদিও গ্রাম থেকে বেশ কয়েক মাইল। ওখানেই বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়। কিন্তু, তাও পুজোটা গ্রামে কাটাতে পারবে। এটা কি কম পাওয়া!
বনা অর্থাৎ বর্ণালি, জ্যাঠা মশাইয়ের মেয়েটা প্রতিবার পুজোর এক মাস আগেই শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসে। এবারেও তাই। আগে তো ছোটোবেলায় দুই ভাই-বোন মিলে পুজোর সময় কত হুজ্জোতি করে বেড়াত। কোন পাড়ায় কবে ঠাকুরে মাটি পড়ল, কতদূর কাজ হলো, কাদেরটা বেশি সুন্দর হচ্ছে সব ওদের নখদর্পণে থাকতো। এই তিন বছরে মাত্র একবারই গ্রামে আসতে পেয়েছে রজত। সেটা ওই বনার বিয়ের সময়। গেল বছরের আগের বছর মাঘে।
গাঁয়ে বড় পুজো দুটো। এছাড়া ছোটোবড়ো মিলিয়ে আরও গোটা ছয়েক পুজো হয়েই থাকে। রজতের সেসব দিনের কথা মনে পড়তেই টুক করে এক শনিবার চলেই এল গ্রামে। তখনও পুজোর প্রায় দিন কুড়ি বাকি। বাস স্ট্যান্ড থেকে হেঁটে বাড়ি আসার সময়ই চামুণ্ডা তলায় ঠাকুর গড়া দেখে এসেছে দাঁড়িয়ে। যাদবমিস্ত্রির সঙ্গে দু’দণ্ড গল্পও করেছে।
“কি গো মিস্ত্রি, শুনলাম নাকি শিবতলায় এবারে বড়ো ঠাকুর করছে!”, জোরে হাঁক পাড়ল রজত।
পঞ্চাশোর্ধ্ব যাদব ছাউনিতে বসে বিড়ি টানছিল। চশমাটা ঠিক করে চোখে লাগাতেই…
“একি রজত বাবা যে… তা এতদিনে এই পোড়া গাঁ–টার কথা মনে পড়ল বাবা? বলি, কেমন আছো?”
এই হলো এ গাঁয়ের মানুষ। যে পরিস্থিতিতেই গাঁয়ে ঢুকুক না কেন, প্রথমজন থেকে সবাই এমন আপন সুরে ডাক দেয়, আপনা হতেই মনটা হালকা হয়ে যায়। রজত একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল, “আর বোলো না, খুড়ো… ছিলাম ভিনরাজ্যে। সে গাঁয়ে না আছে পুজো, না আছে কিছু। এই তো কয়েকদিন হলো সাঁইথিয়ার বদলি নিয়ে এসেছি।”
“বল কি বাবা… ভিনরাজ্য থেকে একেবারে সাঁইথিয়া। সোনামুখো ছেলে গো আমাদের। তা চলো বাড়ির দিকে চলো। লাড়ু মিষ্টি খাবা।”
“নিজের বাড়িই ঢুকিনি খুড়ো। বাবা আমার সকাল থেকে বসে আছে। বিকেলের দিকে প্যান্ডেলে আসছি বুঝলা। তা গাঁয়ের খবর সব ভালো তো, খুড়ো?”, বলে চামুণ্ডা মায়ের মন্দিরে একবার প্রণাম করে বাড়ির দিকে পা বাড়াল সে।
দূর থেকে কাশতে কাশতে মিস্ত্রির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “হ্যাঁ… সে একরকম ভালোই। যাও ক্যানে … শুনতে পাবা।”
“ও মা, বাবা, কাকা… দ্যাখো দাদা এসে গেছে! কাকি এসো গো!”,বনা ছাদে শাড়ি মেলতে গেছিল। ওখান থেকেই দেখতে পেয়ে দৌড়ে নিচে নেমে এল। বাড়ির বাকিরাও সদরে চলে এল সব কাজ ফেলে। রজত পিঠের ব্যাগ ঠিক করতে করতে ঘরে ঢুকল। বারান্দায় কালু কুকুরটা ঝিমোচ্ছিল। ত্বরিতে উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়তে লাগল।
“আয় বাবা। আয়। ভেতরে ঠাণ্ডায় একটু বোস। বাইরে যা রোদ গরম দিয়েছে!”, রজতের জেঠি, বকুল, ওকে বসতে বলে শরবত আনতে গেল। রজত একে একে সবাইকে প্রণাম করল। দাদু ঠাকুমার ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে নমস্কার করল। তারপর বনার দিকে ঘুরে,
“কি রে, বনা, বর কেমন আছে? পুজোতে আসবে তো নাকি?”
বনা অকস্মাৎ সুমনের প্রসঙ্গে একটু লজ্জাই পেল। “কে জানে!” বলে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিতে উদ্যত হলো।
বাড়ির ভিতরে উঠোনময় শিউলি খেলে বেড়াচ্ছে। নারকেল গাছগুলোর ফাঁকে রোদ্দুরের চিকচিক, কাঠবিড়ালির চকিতে আসা যাওয়া, রান্নাঘরের চালের উপরে ডাঁসা পেয়ারা থোকায় থোকায় ঝুলছে … আরও উপরে তেঁতুল গাছে কাঠঠোকরা… তারও উপরে তাকালে সুনীল আকাশ ছেয়ে আছে। মধ্যে মধ্যে মেঘের আনাগোনা, হাওয়ার শনশনানি গাছ গাছালির ফাঁকে ফাঁকে … উদাস প্রকৃতি একটু একটু করে সেজে উঠছে পুরনো রঙে … স্বমহিমায়।
রজত মোহাচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে এসব নজর করছিল। ঘোর ভাঙল মায়ের প্রশ্নে, “সকালে কিছু খেয়েছিস, হ্যাঁ রে?”
দুপুরে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে ঘণ্টা খানেক ঘুমিয়ে গাঁ ঘুরতে বেরোল রজত। বনাকে বলল সঙ্গে যেতে, তা সে মা – কাকির সঙ্গে নাড়ু বানাতে বসে গেল। অগত্যা একাই বেরোল। বেরোবার আগে বলে গেল, “ফিরে এসে শাড়ি দেখাব তোমাদের। তখন যেন কোন কাজ রেখো না হাতে। দোহাই বাপু!”
রাস্তায় অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। ইস্কুলের বন্ধু সমীর, গোপাল ভাণ্ডারী, হালুইকার গোবিন্দ। সবাই বেশ ভালোই আছে। চাষবাসও দিব্যি চলছে। সমীর জিজ্ঞেস করল, “তা হ্যাঁ রে, আছিস তো ক’দিন? কালকে আয় মাঠে। ভলি খেলা হচ্ছে আজকাল।”
“না রে। কালকেই দুপুরে চলে যাব। তবে, এখানেই আছি। সাঁইথিয়া ব্রাঞ্চে। পুজোতে এসে বেশ কয়েকদিন থাকব। তখন যদি খেলিস তো ডাকিস। আমার আবার প্র্যাকটিস বলে কিছুই নেই রে।”
“সে তোর নাদুসমার্কা ভুঁড়ি দেখেই বুঝেছি। হাহাহা… আসিস বাড়ির দিকে।”, বলে সমীর গরু ডাকাতে ডাকাতে এগিয়ে গেল।
বল খেলার মাঠটা পেরোতেই পালেদের বাগান বাড়িতে কাশিকে দেখতে পেল রজত। খড় কাটছে একমনে। গলাটা ঝেড়ে নিয়ে ডাক দিল, “এই ব্যাটা কেশো!”
কাশি চট করে তাকাতেই ওর চোখে উল্লাসের ঝলকানি খেলে গেল। কাস্তে , খড় পাতনায় ফেলে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রজতের বুকে, “ছোট্টুউউউ!!”
রজত এই আবেগের বিস্ফোরণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাও, ঘেমে যাওয়া কাশিকে জড়িয়ে ধরল। কপালে তার খড় লেগে আছে, থাকুক গে। এককালে পিঠে চেপে কত ঘুরেছে গ্রাম কে গ্রাম, ইস্কুল, নদী, মাঠ… কই তখন তো ঘাম, খড় এসব চোখে পড়েনি।
“কি রে, কেমন আছিস?”, কাশি তাও নয় নয় করে দশ বছরের বড়ো। ছোটোবেলায় বাবা নাম ধরে ডাকত, সেই থেকে রজতও নাম ধরে ডাকা শুরু করেছে। বড়ো বেলায় ভুলটা টের পেলেও কাশীই বলেছিল, “তুই আমাকে কেশো বলেই ডাকবি, ছোট্টু!”
কাশি হাসি থামিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “এমনিতে তো ভালোই আছি রে। তবে ওই পরানে সুখ নাই।”
“সে কি রে, তুই আবার বাপ ঠাকুর্দার মতো কথা বলতে কবে শিখলি?”, আবহাওয়া হালকা করার জন্য রজত ভুরু নাচিয়ে বলল।
কাশি মৃদু হেসে বলল, “আয়। এখানে বস। আমি বলছি তোকে। কাউকে বলতে খুব ইচ্ছে হয় রে-”
রজত গোবরটা এড়িয়ে বাগানের ভিতরে একটা গরুর গাড়িতে উঠে বসল। একমাত্র খেলার মাঠ থেকে ছেলেরা ধুলো উড়িয়ে ফিরছে, অদূরে পশ্চিমে ছাই মাখা কিছু মেঘ উঁকি মারছে সূর্যের ফাঁক দিয়ে, বাগান বাড়ির গাছগুলোতে একটা দুটো করে ফিরে আসছে কাক, শালিক… আর রজত যে মুহূর্তে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, তুই ঘোষেদের বাড়িতে রাখাল ছিলিস তো। পালেদের বাগানে কি কচ্ছিস?”, তখুনি একটা মাছরাঙা বাগানের পিছনের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে উড়ে গেল।
“সেইটেই তো বলছি।”, বলে কাশি লুঙ্গির খুঁট থেকে একটা শুকনো বিড়ি বের করে ধরাল। “আমি তো প্রায় সাত বচ্ছর আনন্দদের বাড়িতে কাজ করেছি। আনন্দর বাপ রঘু, তেনার মতো মানুষ হয় না। আমাকে নিজের ছেলের মতোই দেখত। শুধু একটু বেশি খাটাতো। তাতে আমার কোনও সমস্যা ছিল না। লক্ষীশ্রী সংসার, আহা… সব ভেঙে গেল গো।”
“খামোকা ভেঙে যাবে কেন?”, রজত খানিকটা অবাকই হলো।
“খুড়োর বয়েস কিছু কম হয়নি। তাও জমিতে যাওয়া চাই! আর তারপর এই চোতে যা গরম পড়েছিল…। সেদিন আমি আর আনন্দ লাভপুর গেলাম মোটরটাকে সারাই করতে। আসছে খরায় লাগবে। ছোটোটা মানে আনন্দর ভাই সমু আর খুড়ো জমিতে ছিল। কদিন ধরেই অল্পতে হাঁফ ধরে যেছিল। বারণ করলেও শুনবে না। সেই যে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। তারপর শত হাকিম বদ্যি করেও খুড়ো আমাদের আর উঠল না।”, কাশির চোখ ছলছল করে উঠল। সানস্ট্রোকে মৃত্যু গ্রাম গঞ্জে খুব একটা বিরল নয়। রজত এ খবরটা পায়নি আগে। চুপচাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“… ইদিকে খুড়ো মরে যাওয়ার পর দু’ভাই-এর মধ্যে যা হয়। ক’দিনের মধ্যে কাজ কর্ম মিটে গেলে শুরু হলো সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি। আনন্দর বৌ উঠতে বসতে মিঠি মানে আমাদের ছোট জা’কে বরাত করত। আনন্দও কেমন যেন হিংসুটে হয়ে গেল। দেখতে দেখতে রান্নাঘর আলাদা হলো। পঞ্চায়েতের লোক এসে বসে জমি ভাগ করে দিলে। তবু অশান্তি কমে না। মুশকিল হতো বাচ্চাদুটোকে লিয়ে। চাঁপা আর পদ্দ। পিঠেপিঠেই জন্ম তো ওদের। দাদু মরে যাওয়ার পর ঘরে কী গোল লেগেছে সেসব ওরা জানতো না, বুঝতও না। গেলবারেই ওয়ানে ভর্তি হলো তো দুটো।”, এই দুই দস্যি মেয়েকে রজত বনার বিয়ের সময় একবার দেখেছিল। ফুটফুটে দুটো প্রাণ। মাঠে ঘাটে খেলে বেড়াত। দাদুর পিঠে চেপে ঘুরত। খুড়ি তো আগেই মারা গেছিলেন। কাজেই খুড়োই ছিল ওদের দাদু – ঠাম্মা। সেও চলে যাওয়াতে বাচ্চাদুটো কীভাবে সামলেছিল কে জানে!
কাশি বলে চলল, “কখনও চাঁপা চলে যায় সমুর ডেরায়, তো কখনও চাঁপার খোঁজে পদ্দ এসে হাজির হয় আনন্দর ঘরে। সেই নিয়ে প্রায় দিনই ঝটাপটি, মুখ খিস্তি চলত। মাঝখান থেকে মার খেত ওই দুটো। এসব দেখে আমি আর থাকতে পারিনি ছোট্টু। বাচ্চা দুটোর হয়ে বলতে গেলাম, বড় জা, আমাকেই এমন কথা শুনিয়ে দিলে… এত বছর ধরে আছি ঘোষেদের বাড়িতে কাজ করছি রে, কত ভালোবাসা, আদর পেয়েছি, … সেদিন ওরা আমাকে কাঁদিয়ে দিলে রে। ছেড়ে ছুড়ে চলে এলাম। সোনামুখো দুটো খুব মানা করেছিল। তাও চলে এসেছিলাম। এখন অবিশ্যি সমুরা ওই বাড়িতে আর থাকে না। খামারবাড়িতে সংসার পেতেছে।”, লুঙ্গিতে চোখের জল মুছল কাশি। “মনের দুক্ষ আর কাকে বলব রে ছোট্টু, তুই এলি, বলে একটু শান্তি পেলাম।”
“তুই পালেদের বাড়িতে কবে থেকে কাজ নিয়েছিস?”
“তা মাস দেড়েক হয়ে গেল রে!”
রজতের জেঠি সন্ধে জ্বেলে মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে নিয়ে এল। রজতের বাবা, দুলাল বারান্দায় কার সঙ্গে আড্ডা মারছে। নিউজ চ্যানেল খুলে বসল রজতের জেঠু, শান্তনু। বনা আর রজতের মা মিলে রান্নাঘরে তরকারি কাটছে। রজত ভাবছিল, এই যে ভরাট সংসার ওদের, আনন্দ উচ্ছল, হাসি খুশি –এটাও যদি ঘোষেদের বাড়ির মতো ভেঙে যায়? যেতেই পারত। রজতের দাদু মারা যাওয়ার পর তো কই ওর বাবা–কাকার মধ্যে লড়াই লাগেনি। বনা আর ও তো একসঙ্গেই মানুষ হয়েছে। এই ভরপুর জীবন ও কোথায় পেত ? মনে মনে মা দুর্গাকে প্রণাম করল।
“তা হ্যাঁ রে, রজু, পুজোতে এবারে তবলা শুনব তো তোর?”, জেঠু জিজ্ঞেস করল।
“হুম? ও চামুণ্ডা তলার ফাংশনে? হ্যাঁ সে বাজানোই যায়। তুমি বাজাবে না? বনা গান গাইবে নিশ্চয়?”
“এই বেসুরো গলায় গান শুনে শুনে গাঁয়ের লোক সব হেজে গেল। আবার আমাকে গাইতে বলছিস!”, মুড়ির বাটি নিয়ে বনা ঢুকল।
“বা রে। মনে নেই, আগে আমরা ভাইবোন মিলে পারফর্ম করতাম। এবারেও করব। রেওয়াজ করা শুরু করে দে তুই। জেঠু ওকে একটা ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলে দিও তো।”
“গাঁয়ের লোকে আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে না রে। ওদের ওই নাচন কোঁদন না হলে চলে না!”, একগাল মুড়ি চিবোতে চিবোতে রজতের মা বলল।
সেদিন উঠোনে শিউলি তলায় বসে ছোটোবেলার পুজো নিয়ে গল্প করতে করতে চাঁপা আর পদ্মার কথা পাড়ল রজত। বনা ব্যাপারটার সম্পর্কে জানত ঠিকই কিন্তু অত মাথা ঘামায়নি। আজকাল সম্পত্তি-সম্পত্তি করে অশান্তি তো ঘরে ঘরে। নতুন কী! মানুষের আদর ভালোবাসা সব কর্পূরের মতো উবে যায় যখন তার মধ্যে তুলনা চলে আসে, কেজো স্বার্থ চলে আসে।
“বাচ্চা দুটোর কী হবে তাহলে, ভেবে দেখেছিস?”, রজত জিজ্ঞেস করল।
“কী আবার হবে! যেমন চলছে ওরকমই চলবে। মাঝে মাঝে দেখি ওদের… কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে জানিস তো। জন্মাষ্টমীর সময় যখন এলাম তখন থেকেই ওরা আর একসাথে খেলত না। রাস্তায় একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত।… ”
“বাঃ! ছোট থেকেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। … ছিঃ! আচ্ছা আমরা কিছু করতে পারি না? মানে যদি ওদের বুঝিয়ে বলি। গ্রামের অনেকে মিলে? বাচ্চা দুটোর মুখ চেয়ে?”
“পাগল হয়েছিস! কেউ কিছু বলতে গেলেই তাকে অপমানিত হতে হবে। এসব বিষয়ে বিষয়টাই আগে দ্যাখে। বাদ দে।”
রজত খানিকক্ষণ পায়চারি করে কী একটা ভাবল। তারপর ঘুরে এসে বলল, “ আচ্ছা, এক কাজ করা যায় না? তুই তো গানটান ভালোই করিস!”
“ধ্যাত! পড়ল আবার গান নিয়ে। কেন কী হয়েছেটা কী তাতে?”
“ওদের গান শেখাতে পারবি?”
পরদিন রবিবার। বিশুদের বাতাবিলেবুর গাছের ফাঁকে ঝিরঝির করে বাতাস বইছে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে রজত বেরিয়ে গেল সাঁইথিয়ার উদ্দেশ্যে। গোটা গ্রামটা ঝলমলে রোদের চাদরে ঝিমিয়ে আছে। চাষিরা মাঠেই কোথাও গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছে। গরু মোষ পুকুর থেকে উঠে এসে জল ঝরাচ্ছে। কেউ কেউ তখনও স্নান হয়নি বলে দৌড়ে দিঘির দিকে চলল। আবার কেউ ভাত খেয়ে হাতপাখা নিয়ে কোনও বড়ো গাছের নীচে ঠেস দিয়ে বসল। কীভাবে দুপুর কেটে বিকেল হবে, সব দেখবে, পথচারী লোকজনের সঙ্গে আবহাওয়া, ফসলের ফলন, পুজো আসতে কদিন বাকি, এসব নিয়ে আলোচনা করবে — কখনও হয়তো একটু ঘুমিয়েও নেবে।
এরকমই একজন হলো কাশি। বাগানবাড়িতে গাছ গাছালির ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছিল। রজত যাওয়ার সময় একবার ঢুঁ মারল।
“কী রে কেশো! ঘুমোচ্ছিস নাকি? ভাত খেয়েছিস?”
“তা এই সময় একটু ঘুমোই বইকি। বউটা আজ মাছের মাথা দিয়ে মুসুরির ডাল করেছিল। একগাদা খেয়ে ফেলেছি রে। তুই চললি? তাড়াতাড়ি চলে আসিস!”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। ছুটি পেলেই এসে যাব। আর তোকে যা বললাম সকালে, খেয়াল আছে তো?”
“কোনটা! ও হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে আছে। বিকেলেই যাব তোদের বাড়ি। … সাবধানে যাস।”
রজত আস্তে আস্তে মোরামের রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল। উদাস প্রকৃতি আবার এক মিলনোৎসবের অপেক্ষায় …
দেখতে দেখতে পুজো এসেও গেল। রজত হাজার চেষ্টা করেও সপ্তমীর আগে ছুটি ম্যানেজ করতে পারল না। প্রায় তিনদিন ছোটাছুটি করে বনার জন্য পছন্দের শাড়ি জোগাড় করেছে। ফাংশনে ওটা পরেই গাইতে বলবে।
এদিকে আগের বার যখন গেছিল, জেঠুর প্যান্টের কোমর ঠিক হয়নি, সেটাও পাল্টেছে এই ক’দিনে। নিজেও একজোড়া জামা কিনেছে। আরও টুকটাক কেনাকাটা করে একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে নামল যখন, সপ্তমীর সূর্য প্রায় অস্তাচলে। দিগন্তে লাল আভা, মানুষের মনে আনন্দের ঢল।
না জানি কত মানুষ এসে জমায়েত হয় এই উৎসব উপলক্ষ্যে। এই হাসি মুখ, নির্বিবাদ ছুটে বেড়ানো, ধুনোর গন্ধে ঢাকের শব্দ— এগুলো থেকে প্রায় তিনবছর দূরে ছিল রজত। তাই নেমে থেকেই এসব দু’হাতে মাখতে মাখতে বাড়ির দিকে চলল। চামুণ্ডা তলায় জমিয়ে মেলা বসেছে। হরেকমাল দশটাকা থেকে আরম্ভ করে মোগলাই, বেলুন সব বসেছে। মানুষের ভিড়ও তেমনি।
এদেরকে নিয়ে টুকটাক খেলাও আয়োজন করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। হাঁড়ি ভাঙা, শাঁখে ফুঁ, মোমবাতি জ্বালানো ইত্যাদি। চারদিন ধরেই এসব চলে। তারপর দ্বাদশীর দিন মনোজ্ঞ সান্ধ্য অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়।
বারান্দাতেই বসে গল্প করছিল দুলাল আর শান্তনু। কাশিও ছিল। রজতকে আসতে দেখে কাশি চেঁচিয়ে বলল, “কী রে ছোট্টু, এত দেরি করলি! সপ্তমী তো প্রায় শেষ…”
“চল, ভেতরে চল। মিষ্টি এনেছি ভালো।”
বারান্দাতে জ্যাঠামশাই আলোর বন্দোবস্ত করেছিল। বাড়ির সব দিকে সুন্দর করে আলপনা আঁকা। দাদু ঠাকুমার ছবিতে সুগন্ধি মালা। দুর্গাপূজা মানেই তো এই… এই ভালোলাগা।
কাশিকে মিষ্টি খাইয়ে রজত ওকে একটা চেক চেক হাফ হাতা জামা উপহার দিল। সেটা পেয়ে কাশির খুশি দেখতে হয়! খুশির চোটে বেচারা কেঁদেই ফেলল হালকা।
“তারপর বনা, তোর রিহার্সাল কেমন চলছে? আমি কাল থেকে তবলাটা নিয়ে বসব।”
বনা হেসে বলল, “দিব্যি!”
সদর দরজা থেকে মিষ্টি গলায় কেউ ডাকল, “বনা মাসি, ও বনা মাসি, বাড়ি আছো?”
“হ্যাঁ। কে? পদ্দ নাকি রে?”, বনা চায়ের ট্রে’টা নামিয়ে রেখে দরজা খুলতে গেল।
দশমীর ঝক্কি কম! চ্যাটার্জি বাড়ির আজ অনেক কাজ। সক্কাল সক্কাল উঠে স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড় পরে নিল রজত। তখনই কাশি এক ডাল বেল পাতা নিয়ে ঢুকল।
“জেঠুমণি, এই রইল ঠাকুর ঘরের দাওয়ায়। আমি চললুম। নামোপাড়ার দোলা বিসর্জন দেখতে যাব।”
শান্তনু কলতলায় চান করছিল। সাবান ঘষতে ঘষতে বলল,”হ্যাঁ হ্যাঁ রাখ ওখানেই। বিকেলে আসিস। মুড়কি খেয়ে যাস।”
কাশি ‘আজ্ঞে’ বলে হেসে চলে গেল। দুলাল ধুতি পরে বাছা বাছা বেলপাতা সংগ্রহ করে আলাদা করল। রজতের মা জয়ন্তী এর মধ্যেই চন্দন বেঁটে রেডি করে রেখেছে।
বনা শাড়ি মেলে এসে বলল, “মা, বলছি সব সাদা তেল আজকেই শেষ করো না।” তারপর একটু লাজুক স্বরে বলল, “তেরোদশীর দিন আসবে বলল। ….শুনতে পেলে?!”
“আমি ভাবছি সুমনের সঙ্গেই লুচির কম্পিটিশনটা লাগাব। তোর তো আর সে ফর্ম নেই!”, বলেই মুচকি হাসল রজত।
“হুহ! বাজে না বকে চটপট বেলপাতা নে, ‘দুর্গায়ৈ নমঃ’, ‘গনেশায় নমঃ’ লিখে উদ্ধার কর আমায়!”, বেণী দুলিয়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকল বর্ণালী। লাল পেড়ে শাড়িতে যেন এক টুকরো সতেজ স্থলপদ্ম লাগছে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে বেলপাতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে ওরা চামুণ্ডা তলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। শেষবেলার অঞ্জলি দিতে….
বকুল হাঁক পাড়ল, “জয়ী, মুড়কির টোকাটা সামনাসামনি বের করে রাখো বাপু। সূয্যি ডুবলেই হাজির হবে সব ছেলে ছোকরারা।”
হঠাৎ, ঢাকের আওয়াজ শুনে জয়ন্তী ত্বরিতে উঠে এল, “বোধয় নামোপাড়ার বিসর্জন চলল গো, দিদি। চলো বারান্দা থেকে একটিবার প্রণাম করে আসি।”
বকুল তড়িঘড়ি স্টোভ কমিয়ে বলল, “চল চল!”
বকুল ভুল কিছু বলেনি। সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতে পাড়ার বাচ্চারা লাইন দিয়ে শেষ নতুন জামা প্যান্ট পরে হাজির ওদের বাড়িতে। এক এক করে সবাইকে প্রণাম করে চলল। যারা রজতকে দেখেনি, তারা তো উল্লাসে “আরে ছোট্টুদাদা, কেমন আছো গো?”
রজত আগেই উঠোনে শতরঞ্চি পেতে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ওখানেই ওদেরকে বসিয়ে নাড়ু মুড়কি পরিবেশন করে বনা।
একটু ফাঁকা হতে বকুল সন্ধে দিতে গেল। এরপর আবার বাবা মায়েরা আসবে। শাঁখে ফুঁ দেওয়া শেষ হয়েছে আর সদরে পাশের বাড়ির টুম্পা, টুম্পার মা বাবা হাজির।
রজতকে নিয়েই প্রধান আড্ডা চলছে সবার সঙ্গে। রজতও সবার সঙ্গে এই বছর তিনেকের অভিজ্ঞতা, গল্প সব ভাগ করে নিচ্ছে। এই প্রাপ্তি টুকুর জন্য সে চাতকের মতো চেয়েছিল এই ক’দিন।
“ছোট্টু!” হাঁক দিয়ে ঢুকেই পড়ল কাশি। “বড়মা, দেরি হয়ে গেল গো। মুড়কি আছে নিশ্চয়?”
“হ্যাঁ রে বাবা। আয় আয়। বোস।”, বলে একটা মোড়া এগিয়ে দিল দুলাল। কাশি গুছিয়ে বসল তাতে।
“ওই তো আনন্দ এসে গেছে। আয় আয়। পুচকিটা কই? আমার চাঁপা ফুল?… “, শান্তনুর কথা ফুরোবার আগেই ছুট্টে এসে কোলে উঠে পড়ল চম্পা, আনন্দের মেয়ে।
বেশ হাসি খুশি লাগল ওকে। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই আলাপ আলোচনা শুভেচ্ছা বিনিময় হল। কাশির সঙ্গেও ভাব হয়ে গেছে চাঁপার। কিন্তু, সদরে সমুর “কই গো, চাটুজ্জেরা, আছো নাকি সব?” শুনেই উঠে দাঁড়াল আনন্দ। “মা ঠাকরুন, আমরা এবার আসি। ভটচাজদের বাড়ি হয়ে যাব একবার।”
চাঁপা কিছুতেই কাশির কোল থেকে নামবে না। শিউলি ফুল গোনা শেষ করেই যাবে। আনন্দ ওকে টেনে নামিয়ে জোর করে নিয়ে গেল। বাচ্চাটা আরেকটু হলেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেলত। আনন্দরা বেরোতে যাবে আর তখনই সোমনাথ, মিঠি ঢুকল। পদ্দ চাঁপাকে জিগেস করল, “কটা লাড়ু খেলি? এই!” তখুনি মায়ের লাল চোখ দেখে মাথা নিচু করে জয়ন্তীর কোমর ঘেঁষে দাঁড়াল।
আনন্দ আর তার পরিবার বিনা বাক্য ব্যয়ে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য গতবছরও এরা একসাথেই এসেছিল। অথচ আজ….কাশির বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বনা আর রজত চকিতে হাসি বিনিময় করল। রেডিওতে শুরু হলো পূজা পরিক্রমা….
গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের স্রোত বেশ ধরা বাঁধা। বছরের সারাটা সময়ই প্রায় সবাই কাজে কর্মে নিজেদের নিয়োজিত রাখে। বাড়ির লোককে ভালো রাখে। গরু বাছুর পোষে। তাদেরও ভালো রাখে। এসবের মাঝে কারোর সম্পর্কে হিংসা বা খারাপ ভাবার ফুরসতও নেই, সে কাজে তেমন আগ্রহও এদের নেই।
সবাই কমবেশি ‘অন্যের ভালোতে নিজের ভালো’ ধারণায় বিশ্বাসী। কিন্তু, আজকাল নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, আর ঢেউ এসে লাগছে অন্য কিছুর। অন্য কোথাকার।
তবু উৎসব আসে। একে অপরকে মনে পড়ে। আনন্দ আদান প্রদান হয়। মন থেকে নারকেল নাড়ু মুখে ভরে দেয় সহাস্য প্রাণ। প্রিয় মানুষকে দূর থেকে জোরে ডাকতে কোনও বাধা নেই। উৎসব ফুরোলে এগুলোই টেনে নিয়ে যায় তাদের, বেঁধে রাখে মমতায়।
দশমীর বিসর্জনের পর “আসছে বছর আবার হবে-” এ যেন সেই বার্তারই অনুরণন।
চামুণ্ডা মাতা ক্লাবের পক্ষ থেকে এবারেও বেশ গুছিয়ে গান বাজনার আসর বসানো হয়েছে। উদ্বোধনী সঙ্গীতে “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে”র পর পঞ্চায়েত প্রধান অল্প কিছু কথা বলে নেমে গেলেন। এরপর থেকেই ক্লাব প্রাঙ্গণে ভিড় বাড়তে থাকে। চাটাই, বস্তা, শতরঞ্জি পেতে যথা সম্ভব জায়গা করা থাকে গ্রামবাসীদের জন্য।
তারা এসে এক এক করে বসে। আর মঞ্চে আসে এ গাঁয়েরই বাচ্চা বুড়ো মাঝারি শিল্পিরা। রজত আর বর্ণালি এই মঞ্চে অনেকবার গান পরিবেশন করেছে। রজতের জেঠু, শান্তনুও তবলা বাজিয়ে এসেছে দীর্ঘকাল। ওদের বাড়িতে এই গান বাজনার চল বহুদিনের। পারিবারিক সম্মিলনের এক অপরূপ সমন্বয় এই সঙ্গীত চর্চা।
“এবার আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসছেন, এ গাঁয়ের মেয়ে বর্ণালি চ্যাটার্জি। তবলায় সঙ্গত দেবেন তাঁরই দাদা রজত চ্যাটার্জি। রজত দীর্ঘ তিন বছর পর আবার চামুণ্ডা তলার মঞ্চে। সাঁইথিয়া ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছে। রজতের জন্য এবং বর্ণালির জন্য জোরে হাততালি !”
ঘোষণা করে সমীর নেমে গেল। মঞ্চে একটা শতরঞ্জির উপর হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনি রাখা আছে। বর্ণালি হারমোনিয়ামের কাছে গিয়ে বসল। মাইকের সামনে মুখ লাগিয়ে বলল –
“শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন সকলকে। গান তো হবেই। তবে তার আগে একটা একটু গল্প করি তোমাদের সঙ্গে। এ গাঁয়েই বড়ো হয়েছি। পুজোর সময় এখানেই চলে আসি। আমি এবং আমার দাদা রজত- আমরা দুজনেই গ্রামটাকে খুব ভালবাসি। এই গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, সকলকে। ছোটো থেকেই দেখেছি এখানকার মানুষের মধ্যে অদ্ভুত মেলবন্ধন। একে অপরের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জায়গা আমাদের এই গ্রাম।
আজ যেখানে শহরে, নগরে মানুষে মানুষে হানাহানি–রেষারেষি, ভাইয়ে ভাইয়ে হিংসা মারামারি চলছে… আমাদের গ্রাম কিন্তু সেখানে স্নেহ মমতার অচ্ছেদ্য আগলে সুরক্ষিত। কি তাই না?
আমার দাদু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা – কাকারা তো ছাড়াছাড়ি করে থাকতে পারতো। সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া বিবাদ সবই হতে পারতো। সেটা হলে আমরা আজ আলাদা হয়ে যেতাম। আমার দাদা আমার থেকে আলাদা হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হয়নি। পরিবারের ভালোবাসা কোনোদিন হারায় না। অর্থ, সম্পত্তি এসব তো তুচ্ছ তার কাছে।
আসুন আজ বিজয়ার রঙে উৎসবের মিলনে এইরকমই এক পরিবারের দুটি বাচ্চার গানে নিজেদের রাঙিয়ে নিই। হাসি, খুশি, মমতায় পরিবারের সুখ সৌন্দর্যে আর একতায় আমাদের জীবন পূর্ণ হয়ে উঠুক…”
ব্যাকস্টেজ থেকে সমীরের গলা শোনা গেল, “মঞ্চে ডেকে নেব কুমারী চম্পারানী ঘোষ এবং কুমারী পদ্মারানী ঘোষকে।”
ততক্ষণে বাচ্চা দুটোকে ওদের বাবা মায়ের থেকে আলাদা করে ব্যাকস্টেজে এনে হাজির করেছিল কাশি। রজতের দেওয়া জামাটা তাকে বেশ মানিয়েছে। নাচের মেয়েদের জন্য যে ঘরটা আছে সেখানে রজতের মা আর জেঠি মিলে পদ্মা আর চম্পাকে নতুন ফ্রক পরিয়ে চুল আঁচড়ে রেডি করছিল। বর্ণালির বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র ওদের হাত ধরে স্টেজে ঢুকল রজত। ততক্ষণে সমীর এক্সট্রা মাইক ব্যবস্থা করে ফেলেছে। বর্ণালি আর রজতের মাঝখানে শান্ত হয়ে বসল দুরন্ত দুই বোন। ক্লাব প্রাঙ্গণের দুই প্রান্তে দুই পরিবার তখন কৃতকর্মের লজ্জায় দগ্ধ হচ্ছে, চোখে তাদের মানবিক আর্তি। মিঠি তো বলেই উঠল, “কী সুন্দর লাগছে ওদের!”
তবলার তালে তালে শুরু হল সমবেত সঙ্গীত, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পূর্ণ করো এ জীবন পূর্ণ করো এ জীবন পূর্ণ করো দহন দানে আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে!”
পাকুড় গাছের মাথায়, নির্মেঘ আকাশে শত তারার মধ্যে একটা তারা একটু বেশিই উজ্জ্বল লাগছিল…