রূপান্তর

রূপান্তর

প্লেনটা ল্যান্ড করার প্রায় ঘন্টাখানেক পর সুজয় আর জেকব দুটো এয়ারপোর্ট ট্রলিতে নিজেদের ব্যাগপত্তর চাপিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বেরোলো। রণজয় হাত নাড়াল সুজয়দের উদ্দেশ্যে। সুজয়ও দূর থেকে দাদাকে দেখতে পেয়ে হাতটা তুলে ইশারা করল।
জেকবের দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে কিছু একটা বলে অঙ্গুলিনির্দেশ করল রণ-র দিকে। জেকব টুপিটা খুলে দূর থেকেই অভিবাদনের ভঙ্গি করল। রণজয়ও দূর থেকেই একটু হেসে অভ্যর্থনা জানাল। চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি জেকবকে।

সুজয়ের ফেসবুক প্রোফাইলের টাইমলাইনে ওর রিসার্চ ল্যাবের বন্ধুদের সাথে ছবি দেখেছিল। জেকবকেও ট্যাগ করা ছিল। সুদর্শন সুপুরুষ পেশীবহুল পেটানো চেহারার একটা বিদেশী ছেলে। জেকব, জেকব মন্টগোমেরী। সুজয়ের সাথে একসাথেই নিউইয়র্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করে, অ্যানথ্রোপলজি অর্থাৎ নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে।

– কী রে ভাইয়া! কেমন আছিস? জেঠুমণি জেঠিমণি সব কেমন আছে? আর টিয়া মিলি জিকো? তুই রোগা হয়ে গেছিস ভাইয়া।
চাকরি করতে গিয়ে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করছিস না নাকি?

– ওরে থাম থাম একসাথে কত প্রশ্ন করবি জয়? তোর বন্ধু তো আমাদের একটা কথাও বুঝতে পারছেনা।

– না না ও ভাঙা ভাঙা বাংলা বোঝে। ওর পি.এইচি.ডি.-র সুপারভাইজার একজন বাঙালী। আর আমার থেকেও শেখে একটু।
হেই জেকব মিট মাই ব্রো, মাই ভাইয়া মিষ্টার রণজয় রায়। হি ইজ আ কপ ইন আওয়ার নেটিভ প্লেস। তুমিও ওকে ভাইয়া বোলো বুঝলে?

একগাল হেসে জেকব হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল – নমসখার ভাইয়া! খুভ ভালো লাগলো আলাফ খরে!

রণজয়ও হেসে ওর হাতটা ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল – মাই প্লেজার।

জেকবের হাতটা ধরতেই গোটা গায়ে কাঁটা দিয়ে গেল রণজয়ের। বড্ড যেন ঠাণ্ডা। শুধু ওপর ওপর ঠাণ্ডা নয়, কেমন যেন মনে হলো ওর ফরসা চামড়ার নীচের শিরায় বয়ে চলা রক্তও যেন বুঝি জমাট বরফের মতো। তবে হাসিটা জেকবের বড্ড মনভোলানো। ইষৎ তীক্ষ্ন শ্বদন্ত দুটি আরও আকর্ষনীয় করে তোলে ওকে। রণজয়ের পুলিশের চোখ তো! বড্ড খুঁটিয়ে মানুষকে দেখা ওর অভ্যেস।

রায়বাড়ির কথা

সেই কোন সকালে বর্ধমানে ওদের গ্রাম কুসুমপুরা থেকে রওনা হয়েছে। খুড়তুতো ভাই সুজয় আর তার বন্ধু জেকবকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এয়ারপোর্ট থেকে পিক-আপ করতে। প্রায় ঘন্টা চারেকের পথ। সন্ধ্যের ফ্লাইট ছিল। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে প্রায়। রণজয় ওর বাবা মা বোন টিয়া, ছোটকা ছোটকাকীমণি আর ওদের মেয়ে মিলি আর ছেলে জিকো, এই আটটি মানুষ বাস করে ওদের গ্রামের বাড়িতে। এছাড়া কিছু চাকর বাকর। রণজয়ের বাবা গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর ছোটকা বর্ধমান শহরে ব্যবসাসূত্রে থাকেন, সপ্তাহান্তে বাড়ি ফেরেন। এ বছর টিয়া উচ্চমাধ্যমিক দেবে, মিলি মাধ্যমিক আর জিকো সবে সেভেন। সংসারের সব দায় দায়িত্ব রণর মা আর ছোটকাকীমণির ওপরেই। আর মেজকা মেজকাকীমণি থাকে দিল্লীতে কর্মসূত্রে। মেজকাদের ছেলেই হলো সুজয়, বিগত ক’বছর ধরে আমেরিকাবাসী।

এই পরিচয় ছাড়াও আরেকটা পরিচয় আছে ওদের এই রায় পরিবারের। এই কুসুমপুরা গ্রামের জমিদারদের বংশধর ওরা। ওদের স্বর্গতঃ ঠাকুর্দার বাবার আমলেই জমিদারি জাঁকজমক ফুরিয়ে আসে। এখন শুধু টিকে আছে বিশাল বড় ষোলো মহলের দোতলা বাড়ি, আর খুব সুন্দর একটা ঠাকুরদালান। সামনে একটা ঘাটবাঁধানো পুকুর আর আম জাম কাঁঠাল গাছে ভর্তি বড় একটা বাগানও আছে অবশ্য। জমিদারীর তালপুকুরে ঘটি না ডুবলেও ফি বছর ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়। গ্রামের একমাত্র পুজো বলে কথা!
তা এবার মেজকারা আসতে পারবেনা কিন্তু সুজয় ওর বন্ধু জেকবকে নিয়ে এবছর হাজির। কুসুমপুরায় পুজো কাটিয়ে ওরা দিল্লী যাবে, সেখানে ক’দিন কাটিয়ে ফের নিউইয়র্ক।

বড় টাটা সুমোটার পেছনে সব লাগেজ তুলে ওরা উঠে বসলো। রণ ড্রাইভারের পাশে আর বাকি দুজন মাঝের সিটটায়। সেপ্টেম্বরের শেষে মৃদু শীতল উত্তুরে হাওয়া সবে বইতে শুরু করেছে। জেকব জানলাগুলো বন্ধ করে দিল তাও। রিয়ার ভিউ মিররে একবার চোখাচুখি হয়ে গেল ওর সাথে। সানগ্লাসটা কিছুক্ষণের জন্য খুলে বোধহয় তাকিয়েছিল হাইওয়ের পাশে ছুটে ছুটে পেছনে চলে যাওয়া গাছগুলোর দিকে। চোখের দৃষ্টি বড্ড স্থির জেকবের। যেন পিঙ্গল বর্ণের দুটো পাথর বসানো। কে জানে সেজন্যই হয়ত রাতের বেলাতেও রোদচশমা পরে থাকে।
তবে গায়ের জামাকাপড়ও বেশ ঢাকা। পোশাকের ফাঁকে যেটুকু উন্মুক্ত ত্বক দেখা যাচ্ছে, ভীষণই ফর্সা। হ্যাঁ বিদেশিদের স্বাভাবিক গাত্রবর্ণ ফরসা তো বটে, কিন্তু এ যেন রক্তশূন্য ফ্যাকাশে ফরসা।

সুজয়ের কথা

গাড়িটা যখন রায়বাড়ির সামনে দাঁড়াল হই হই করে সব কুঁচো কাঁচাগুলো ছুটে এল। টিয়া মিলি জিকো, ওদের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। সম্ভবত বিদেশি অতিথির আগমণবার্তাই এই জন সমাগমের হেতু। দোতলার ঈশান কোণের বাগানমুখো বড় ঘরটায় জেকব-এর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক রাত আর ক্লান্তির কারণে কারওর সাথেই বিশেষ আলাপচারিতা এগোলোনা। সকলেই একটু হতাশ হয়ে যে যার ঘরে গেল। রাত্রের ডিনারেও জেকব ক্ষমা চেয়ে অনুপস্থিত রইল।

সুজয় আর রণজয় ছোটোবেলার মতো এক ঘরেই শুয়েছে। এটা ওটা গল্প চলতে থাকে দু’ভাই মিলে। রণজয় হঠাৎ সুজয়কে জিজ্ঞাসা করে –
– হ্যাঁরে জয়, তোর ওই বন্ধু এই আশ্বিন মাসের হাল্কা শীতেও গোটা গা ঢাকা জামা পরে থাকে কেন রে? তার ওপর রাত্রেও কালো চশমা পরে! ব্যাপারটা কী রে?
– ভাইয়া, আসলে ওর মাস কয়েক আগে একটা বড় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। আমাদের অ্যান্থ্রোপলজি বিভাগ থেকে বুঝতেই পারছিস মাঝে মধ্যে এক্সকার্সনে যেতে হয়। এই সামার-এ আমরা গেছিলাম নিউ অর্লিয়েন্স-এ। আমেরিকার লুইজিয়ানা রাজ্যের একটা বড় শহর। ওখানের ইউনিভার্সিটির অ্যান্থ্রোপলজি বিভাগ বিশ্ববিখ্যাত। আমাদের প্ল্যান ছিল কিছু মিউজিয়াম ভিজিট করব, তারপর ইউনিভার্সিটিতে একটা কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করে ফাইনালি ক্যাম্পিং-এ যাব। সবই ঠিকঠাক চলছিল। ক্যাম্পিং এ গিয়ে বেশ মজায় সময় কাটছিল। হঠাৎই একদিন বিকেলে জঙ্গলে ফোটো তুলতে গিয়ে জেকব উধাও হয়ে যায়। সেদিন সারা রাত, পরের দিন সারা সকাল গড়িয়ে শেষে সন্ধ্যেবেলায় একটা হাইওয়ের পাশ থেকে পুলিশ ওকে উদ্ধার করে। গোটা গা কেমন কেটে ছড়ে দগদগে হয়ে গেছিল। যেন পুড়ে গেছে বা বিষাক্ত কিছুর সংস্পর্শে এসেছে। কাউকে ও কিছু বলেনি কী ঘটেছিল। শুধু বলেছিল ছবি তুলতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে একটা টিলা থেকে গড়িয়ে নীচের খাদে পড়ে গেছিল। হয়ত কোনও টক্সিক গাছপাতা গায়ে লেগেছে। স্কিনের দাগগুলো বোধহয় এখনও মিলিয়ে যায়নি। তাই হয়ত ওরকম ঢাকা জামা পরে।
– হুমম বুঝলাম। তোরা কি একসাথেই থাকিস দুজন?
– হ্যাঁ রে। নিউ ইয়র্কে যা বাড়িভাড়া! একটা দু’কামরার ফ্ল্যাটে আমরা থাকি। ও যা পাগলা, সারাক্ষণ ঘরেই খিল দিয়ে থাকে।
অকাল্ট স্টাডিজ্-এ আবার ইদানীং ঝোঁক হয়েছে। ওই নিয়েই থাকে। কখন যে খায়, কী যে খায় ওই জানে!
– অকাল্ট স্টাডিজ মানে সুপারন্যাচরাল, অতিপ্রাকৃতিক জিনিসপত্র সব!
– হ্যাঁ তোকে ওর লেখা কয়েকটা অদ্ভূতুড়ে আর্টিকেল এর পিডিএফ পাঠাবো ই-মেল করে, পড়ে দেখিস। তবে এছাড়াও জেকব ভালো ছবি আঁকে কিন্তু। গুণী ছেলে তবে একটু ক্ষ্যাপাটে। এই দ্যাখনা আমার সাথে হঠাৎই ইন্ডিয়া আসবে বলে ক্ষেপে উঠলো। তড়িঘড়ি ভিসা করে চলেও এল।
-“একটু কাল্টিভেট করতে হবে দেখছি তোর জেকবকে! নে ঘুমো এবার নইলে জেটল্যাগ আর কাটবে না। ক’দিন পরে ধুনুচি নাচে ঢুলবি।

টিয়ার কথা

বাড়িতে পুজোর সময় একজন বিদেশি অতিথি এসেছে বলে কথা। যবে থেকে বন্ধুরা জেনেছে তবে থেকেই বলে রেখেছে আলাপ করানোর জন্য। কাল তো সে ভদ্রলোক সাত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন। আজ সক্কাল সক্কাল পাকড়াও করতে হবে বলে টিয়া ছুটলো দোতলায়। আগামীকাল ষষ্ঠী, সব বন্ধুরা আসবে ঠাকুর দেখতে ওদের বাড়ি। তার আগেই একটু আলাপটা শুরু করতে হবে তো। দোতলার ঘরটায় ঢুকতেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে লাগল। যেমন অনেকটা মাছের আঁশটে গন্ধ সেরকম। যাহ্ লোকটা তো ঘরে নেই। সকাল সকাল গেল কোথায়।
ও বাবা, ঘরের কোণে আবার একটা ক্যানভাসে ছবি আঁকতে শুরু করেছে লোকটা। টকটকে লাল রক্তের মতো রাঙা সূর্য, সাদা ক্যানভাসের মাঝে।
হঠাৎ করে ঘাড়ের কাছে একটা নিঃশ্বাসের শব্দে টিয়া চমকে ওঠে! জেকব! এ তো ঘরে ছিলনা, কোত্থেকে এল এরকম নিঃশব্দে মুহূর্তের মধ্যে! কালো চশমাটা নেই, চোখদুটো কেমন যেন স্থির অপলক! এ কী! দাঁত দুটো…

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে নামতে জিকোর সাথে দুম করে ধাক্কা লেগে দু’ধাপ গড়িয়ে পড়ল টিয়া।
– ওই বড়দিভাই! লাগল না কি রে তোর? দেখে হাঁটবি তো! সিঁড়ি দিয়ে কেউ এভাবে ছোটে? এই তোর গলার কাছটা কেটে গেল না কি রে? লাল মতো রক্ত বেরোচ্ছে তো?
– না না কিছু হয়নি রে। ওটা সিঁদুর, ঠাকুরের পুজোর জন্য নিয়ে আসছিলাম, লেগে গেল। তুই যা।
চটপট নিজের ঘরে ঢুকে গলার রক্তের দাগটা রুমালে মুছে, একটা ওড়না জড়িয়ে নেয়। কী করে কেটে গেল কি জানি!
কিছু মনে পড়ছে না যে ছাই! মা কাকীমণি দেখতে পেলে পূজোয় বন্ধুদের সাথে লাফালাফি বন্ধ করে দেবে একদম।

জেকবের কথা

ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেই অবাক হয়ে যায় জেকব। নিজের অবদমিত রিপুকে সংযত করতে না পারার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। তবে কি ওর ভেতরের ভয়াল ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূত তার কব্জায় নিয়ে নিল ওকে চিরতরে! আজ রক্তের স্বাদ এত ভাল লাগল ওর। এতদিন ধরে পশুর রক্তেই তো তৃপ্ত করছিল নিজের এই জান্তব রক্তপিপাসা। আজ হঠাৎ ছোটো মেয়েটা সামনে আসতে কী যে হলো! গলার ক্যারোটিড আর্টারীর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা রক্তের উষ্ণতা যেন ওকে মাতাল করে দিচ্ছিল। শ্বদন্তগুলো দিয়ে মেয়েটার গলায় গভীর ক্ষত করে! আআআহঃ কতদিন পর সেই স্বাদ!

মনে পড়ে যায় সেই প্রথম দিনটার কথা যেদিন এই অভিশাপ ওর জীবনে নেমে এসেছিল। নিউ অর্লিয়েন্সের সেই অ্যাক্সিডেন্টের সন্ধ্যেটা। টিলা থেকে পা পিছলে খাদে গড়িয়ে গেছিল। কে জানে কতক্ষণ জীবন্মৃত অবস্থায় পড়েছিল। অন্ধকারে চিরতরে তলিয়ে যাওয়ার আগে শুধু মনে পড়েছিল একটা অবয়ব তার মুখে কিছু একটা তরল ঢেলে দিচ্ছিল। যে কোনও তরল নয়, রক্ত!

এরপর যখন প্রায় ভোরের দিকে জ্ঞান ফেরে বুঝতে পারে সে বেঁচে থেকেও মৃত। ঠাণ্ডা রক্তের একটা মৃত্যুদূত। প্রবল পিপাসায় গলা চিরে যায়, জঙ্গলের একটা ঝোরা থেকে জল মুখে দেয়, বিস্বাদে বমি পায়। সামনে চরতে থাকা কটা কাঠবেড়ালীর দিকে চোখ পড়ে। কিচিরমিচির নয, কানে শুধু ভেসে আসে তাদের হৃদপিণ্ডের লাবডুব শব্দ। অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে কয়েকটাকে ধরে এক মোচড়ে ধড় মুন্ডু আলাদা করে গরম রক্ত ঢালে মুখে। কোথা থেকে যেন শরীরে অসীম বল আর গতি এসে গেছে তার।

নিজের ক্যাম্পের লোকেদের খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের সীমানায় হাইওয়েটার কাছে পৌঁছে যায়। জঙ্গলের গাছের ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে খোলা রাস্তার ধারে দাঁড়াতেই সকালের সূর্যের আলো স্পর্শ করে ওর শরীরকে। যন্ত্রণায় চীৎকার করে ওঠে ও। সূর্যকিরণ গলিত তপ্ত সোনার মতো যেন এসে পড়ে ওর গায়ে। উত্তাপে চামড়া যেন দগ্ধ হয়ে যায়। ছুটে গিয়ে আবার গাছের আড়ালে লুকোয়। প্রায় সংজ্ঞাহীণ অবস্থায় পড়ে থাকে অনেকক্ষণ। ফের সেই সূর্যাস্তের পর কোনওমতে বেরোয় রাস্তায়। সৌভাগ্যক্রমে একটা পুলিশের গাড়ি ওরই সন্ধানে রাস্তায় ঘুরছিল। তারাই উদ্ধার করে ওকে।

কিন্তু উদ্ধার কি সত্যিই তাকে করা সম্ভব !
সেই উত্তর খুঁজতেই কটা মাস যতরকমের অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের ওপর বই বা ইন্টারনেটে যা তথ্য আছে সেগুলো উজাড় করে ঘেঁটেছে। আশপাশের মানুষদের সাথে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেছে। মানুষ মানেই যে তার কাছে রক্ততৃষ্ণা মেটানোর ব্লাডব্যাঙ্ক। প্রখর শ্রবণশক্তিতে প্রতি মুহূর্তে ভেসে আসে তাজা রক্ত পাম্প করার ধুকপুক শব্দ। চামড়ার তলায় লুকোনো শিরায় ধমনীতে বয়ে চলা রক্তের ঘ্রাণ আসে তার নাকে। বেশিরভাগ সময়ই নিজের অতৃপ্তি মিটিয়েছে পশুর রক্তে।
সেও যে মানুষ নয়, নরপশু আজ। “ভ্যাম্পায়ার”।
হ্যাঁ! গল্প কাহিনীতে পড়া, সিনেমায়, নাটকে দেখা সেই সুপারন্যাচারাল এক আদিম আতঙ্ক, জেকব আজ নিজেই।

রক্তচোষার কথা

নিজের অভিজ্ঞতা আর বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জেকব এটা বুঝেছে যে ভ্যাম্পায়াররা নররক্তপিপাসু এক ভয়ঙ্কর “অ্যাবোমিনেশন অফ নেচার”। বিবর্তনের সমস্ত নিয়মের উর্দ্ধে এরা। এদের জন্ম প্রকৃতির হাতে না কি কোনও বিশাল ক্ষমতাধারী কোনও শয়তানী শক্তির হাতে সেটা স্বয়ং ঈশ্বরও জানেননা হয়ত। এক ভ্যাম্পায়ারের রক্ত শরীরে থাকা অবস্থায় যদি কোনও মানুষের মৃত্যু হয় তবে সেই মৃত মানুষ পুনরায় চোখ মেলে, কিন্তু চিরকালের মতো তাকে বয়ে বেড়াতে হয় এই রক্তচোষার অভিশাপ। যেটা হয়েছে জেকবের সাথে, নিউ অর্লিয়েন্সের টিলার সেই অবয়ব তবে তারই মতো ভ্যাম্পায়ার ছিল। হয়ত একাকীত্ব থেকে বাঁচতে নিজের দলে সামিল করতে চেয়েছিল ওকে। সত্যিই তো। ভ্যাম্পায়ারদের যে বয়স থমকে থাকে। জরা ব্যাধি তাদের প্রাণ নিতে পারেনা, তারা যে আসলে মৃতই। নতুন করে আর কী মরবে!
তবে কী ভ্যাম্পায়াররা অমর?!
না তাও নয়, ওদের মারার বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। সোজা ওদের হৃদপিন্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারলে বা আগুনে পোড়াতে পারলে তবেই ওদের নিকেশ করা সম্ভব।

জেকব আরও আবিষ্কার করেছে ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো অসম্ভব রকমের তীক্ষ্ন হয়ে গেছে। হিংস্র শ্বাপদের থেকেও বেশি গতিশীল ক্ষিপ্র হয়ে গেছে ও। গায়ে ওর হাতির বল। তাছাড়াও অদ্ভূত একটা ক্ষমতা ওর রয়েছে। সম্মোহনী শক্তি। কারওর চোখের দিকে তাকিয়ে ও কিছু বললে সেটা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা সেই মানুষটার থাকেনা। এই ক্ষমতার প্রয়োগ করেই ও এইবাড়ির মেয়েটিকে ভুলিয়ে দিয়েছে সকালের ওই ঘটনাটা। বহুবার ও নিজের স্বরূপটা লুকিয়ে রেখেছে এভাবেই।

যত দিন যাচ্ছে তত যেন এই রক্তচোষা প্রবৃত্তিগুলো গ্রাস করছে ওর মনুষ্যসত্ত্বাকে। জেকব এটাও জেনেছে যে এইটাই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ধীরে ধীরে সমস্ত মানবিক প্রবৃত্তি, দয়া মায়া মমতা সব মুছে যাবে ওর মন থেকে। এক নৃশংস রক্তচোষাতে রূপান্তরিত হবে। সেই প্রক্রিয়া যে ওর অন্তঃকরণে শুরু হয়ে গেছে ও বুঝতে পারে। আজকাল আর হত্যা করার পর অনুতাপ হয়না। পৈশাচিক আনন্দে মন ভরে ওঠে। এই অনন্ত যৌবন ওকে আকর্ষণ করে। অমরত্ব ওকে লোভ দেখায়। ভারতবর্ষে ও ছুটে এসেছিল এই ধারনায় যে এখানের যোগী সন্ন্যাসী তান্ত্রিকদের সহায়তায় যদি ও পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারে সেই চেষ্টা করতে। কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে ওর লোপ পেতে বসেছে। উল্টে ও ভাবছে ওর মতোই আরও কিছু রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার যদি ওর সঙ্গী হতো!

পুনরায় রণজয়ের কথা

আজ ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই হইচই এর মাঝে খুব বাজে কাণ্ড ঘটল একটা। বেচারা মিলির পোষা খরগোশ জোড়াকে রাতের অন্ধকারে ভাম টাম কিছুতে একটা তুলে নিয়ে গিয়ে ধড় মুণ্ডু আলাদা করে পেছনের বাগানে ফেলে দিয়েছে। অদ্ভূতভাবে বেচারা প্রাণীগুলোর শরীরে একবিন্দুও রক্ত ছিলনা। মিলি আর জিকো দুজনেরই খুব মন খারাপ। ভালো করে পুজোটাও উপভোগ করতে পারছেনা বাচ্ছাদুটো।
সপ্তমীতেও ফের দুর্ঘটনার খবর। গ্রামের এক পাগলাটে লোক বিশুদা, সাতকূলে কেউ নেই। এবাড়িতে পুজো দেখতে এসে একটু রাত করেই একা ফিরছিল কাল। আজ সকালে বিলের ধারে অর্ধেক জলে ডোবা অবস্থায় তার ডেডবডি পাওয়া গেছে। রণজয় লোকাল থানার ও. সি. তাই ওকে বাড়ির পুজো ফেলে দৌড়তে হয়েছে। বডি সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রায় সাদা শরীরটা দেখে সবাই ফিসফাস করছে যে, জলে ডুবে মারা যাওয়ার ফলে বডি ফুলে ওরকম সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু রণজয় বুঝতে পারে, মাত্র কয়েকঘন্টা জলে ডুবে এতটাও ফ্যাকাশে সাদা গাত্রবর্ণ হওয়ার কথা নয়। কালকের মৃত খরগোশগুলোর মতো ওই মানুষটার শরীরও রক্তশূন্য। শেষ বিন্দু অব্দি রক্ত ওর শরীর থেকে নিংড়ে বার করে নেওয়া হয়েছে।

পুরো সপ্তমীর দিন, অষ্টমীর দিন, বেশিটাই থানায় কাটল রণজয়ের। অষ্টমীর বিকেলে বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে ছুটল ঠাকুরদালানে। পুজো দেখতে দেখতে রণজয়ের একটু অবাক লাগল, যে জেকব পুজো দেখতে এতদূর ইন্ডিয়া এসেছে, পুজোদালানে তার পাত্তাই নেই। সুজয়ও ঠিক জানেনা ও কোথায় থাকে কী করে কী খায়। যাই হোক, রাত্রে সন্ধিপুজোর সময় রণজয় গেল দোতলার ঘরটায় জেকবকে ডাকতে।

কেউ নেই ফাঁকা ঘর। এদিক ওদিক দুচারটে জামাকাপড় ছড়ানো। অনেক পারফিউমের বোতল পড়ে বিছানায়, টেবিলে। এবং একটা ক্যানভাসে একটা অসমাপ্ত ছবি। ছবিটার দিকে এগিয়ে গেল রণজয়। বড্ড লাল রঙের আধিক্য ছবিটায়। সামনে যেতে একটা চেনা হাল্কা গন্ধ নাকে লাগল। পুলিশের চাকরির সুবাদে এই ঘ্রাণ অপরিচিত নয় রণজয়ের ইন্দ্রিয়র কাছে। একটু রঙ নখে করে খুঁটে নাকের কাছে আনে ও, জিভে ঠেকায়। রক্ত!
তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে ঘরের ল্যাপটপটা অন করে। জয়ের পাঠানো মেলটা খুলে পিডিএফটা ডাউনলোড করতে শুরু করে। বড্ড স্লো ইন্টারনেট। অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারী করতে থাকে। অবশেষে ডাউনলোড কমপ্লিট হয়। গোগ্রাসে গিলতে থাকে আর্টিকেলটা। একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায় ওর মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে। আর্টিকেলের শেষের প্রশ্নটা ঘুরপাক দেয় ওর মনে।
“আর দে রিয়্যাল? ডু দে এগজিস্ট? অ্যাট দিস ভেরি মোমেন্ট, ইজ দেয়ার আ থার্স্টি ভ্যাম্পায়ার স্ট্যান্ডিং বিহাইন্ড মি, স্মেলিং মাই ব্লাড?”

বিসর্জনের কথা

নবমী দশমী কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। সব খারাপ ঘটনাগুলো একটু সরিয়ে রেখে সকলেই আনন্দে মাতল। এক দুবার জেকবও এসে যোগ দিল ওদের সকলের সাথে। সব আনন্দের মাঝেও যতবার জেকবের দিকে চোখ যাচ্ছিল রণজয়ের ততবার যেন শিউরে উঠছিল ভেতর থেকে। ওর মতো সাহসী ছেলেরও যেন গা টা ছমছম করে উঠছিল জেকবের ঠোঁটের কোণের আলগা হাসিটা দেখে। শ্বদন্তটা যে দেখা যাচ্ছিল ও হাসলে, সেই প্রথমদিন থেকে অস্বস্তিটা গেঁথে রয়ে গেছে রণজয়ের মনে।

পুজোর কদিন এবাড়িতে নিরামিষ খাওয়ারই নিয়ম। বিসর্জন সেরে একাদশীর দিন বাড়িতে মাটন রান্না হয়। বাইরের রাঁধুনী ঠাকুর এসে রান্না করে। জেকবের ভারি উৎসাহ হঠাৎ। বারবার রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসছে। দুপুরে খাওয়ার টেবলে সবার সাথে এসে খেতেও বসেছে। এটা ওটা কথা চলছে। আগামী কালীপুজো নিয়েও খুব গল্পগাছা হচ্ছে।
হঠাৎ জেকব বলে –
– কালী ইজ ইওর গডেস অফ ঘোস্টস! রাইট? টোমরা ভূত স্পিরিট এই সব বিসওয়াস করো?
সবাই একটু মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
রণর বাবা বলেন –
– যদি শুভ শক্তি থাকে তাহলে অশুভ শক্তিও থাকবে নিশ্চয়ই।
– রাইট! আই থিংক ইভিল ইজ মাচ মোর পাওয়ারফুল দ্যান গুড, ইউ নো। বলে জেকব।
শ্বদন্ত ঝিকিয়ে ওঠে।
– ডু ইউ ওয়ান্ট প্রুফ? আই উইল গিভ ইউ ওয়ান। প্লিজ কেউ মুভ করবে না।
অদ্ভূত সম্মোহনী আওয়াজ আর দৃষ্টিতে সবাই যেন যে যার চেয়ারে বাধ্য হলো বসে থাকতে।
জেকব ফলকাটা ছুরিটা টেবল থেকে তুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল রণজয়ের বাবার দিকে।
– ভ্যাম্পায়ার কী জানো? ডু ইউ ওয়ান্ট টু সি ওয়ান?
তীক্ষ্ন শ্বদন্তগুলো আরো লম্বা হয়ে মুখের বাইরে বেরিয়ে এলো। এক কামড় বসাল সামনের অসহায় বৃদ্ধর গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। সবাই ডুকরে চীৎকার করে উঠল।
– শ্ শ্ শ্ ! ডোন্ট শাউট প্লিজ!
আবার সম্মোহণ, সবাই চুপ, নির্বাক যন্ত্রণায় চোখ ফেটে জল আসছে।
এরপর এগোলো জিকোর দিকে। পরিবারের সবচেয়ে ছোটো সদস্যর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা ভেবে অসহায় প্রচেষ্টা চালাতে থাকে সবাই এই সম্মোহনের জাল থেকে নিজেদের মুক্ত করার।
কিন্তু খোদ শয়তানের মায়াজাল ছিঁড়ে বেরোনো যে অসম্ভব।
আর সম্মোহনের জাল কেটে বেরোলেও তো নিস্তার নেই নেকড়ের মতো ক্ষিপ্র, হাতির মতো শক্তিধর এই বিভীষিকার করালগ্রাস থেকে। একে একে জিকো, মিলি, টিয়া সবাই লুটিয়ে পড়ে রক্তমাখা ডাইনিং টেবলে। রণজয়ের মা আর কাকীমণি অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ছোটকা বিস্ফারিত চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন।
সকলের এক দশা করল জেকব। কাউকে কামড়ে, কাউকে ছুরি দিয়ে, গলার ধমনী কেটে হত্যা করল সবাইকে। শয়তানের নরকে পরিণত হয়েছে রণজয়দের বাড়িটা।
সব শেষ, শুধু সুজয় আর রণজয় বাদে।
– বড্ড এখা হয়ে গেছিলাম। টোমরা এবার আমাকে কম্পানি দেবে। ডোন্ট ওয়ারি। দে আর ডেড বাট দে হ্যাভ ভ্যাম্পায়ার ব্লাড ইন দেয়ার বডিজ। আমি আজ রান্না মাটনে আমার ব্লাড মিক্স খরে দিয়েছি। দে উইল ওয়েক আপ অ্যাজ ভ্যাম্পায়ারস। লাইক মি!
– কী রণ? ইউ হ্যাভ রেড মাই আর্টিকল। ইউ নো এভরিথিং এবাউট আস।
অট্টহাস্য করে ওঠে জেকব।
– সুজয় মাই ফ্রেন্ড বল কী চাও? এটারনাল ইউথ অর ডেথ? রণজয়? কাম অন। ইউ গাইজ আর ফ্রি। আনসার মি। ওই দেখো, তোমাদের ফ্যামিলি মেম্বারসরা জেগে উঠছে। দে নীড ব্লাড। দে উইল ফিড অফ ইউ।

আতঙ্কে চেয়ে দেখে রণজয় আর সুজয় তাদের মৃত পরিবারের সদস্যরা জেগে উঠছে একে একে। সেই রক্তমাখা টেবল থেকে পারলে যেন নিজেদের রক্তই চেটে খায় এমন তাদের পাশবিক তৃষ্ণা। শ্বদন্তগুলো লম্বা হচ্ছে। চোখে রক্তপিপাসা।

হঠাৎ রণজয়ের মনে হয়, জেকব বলেছিল না ‘ইউ গাইজ আর ফ্রি’। তাহলে সম্মোহণ শক্তিতে তো আর বশ করতে পারবে না সুজয় রণজয়কে।
এক হ্যাঁচকা টানে সুজয়কে উঠিয়ে ঠাকুরদালানের দিকে দৌড়য় রণজয়। জেকবকে ততক্ষণে বাকিরা ঘিরে ধরেছে। সেই সুযোগে ওরা ছোটে।
ঠাকুরদালানে মুখোমুখি দুটো পেল্লায় কাঠের দরজা। সুজয়কে বলে পেছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে খিল লাগিয়ে দিয়ে ছাদে যেতে। আর নিজে সামনের দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। জেকব ও তার পেছনে বাকিরা এসে দৌড়ে ঢোকে ঠাকুরদালানে। রণজয় দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে চট করে বাইরে গিয়ে সামনের দরজা লাগিয়ে দেয়। জেকবসহ বাকিরা আটকা পড়ে ঠাকুরদালানের ভেতর। রণ পড়ি কী মরি করে ছোটে ছাদে সুজয়ের কাছে।

ঠাকুরদালানের ছাদের অংশটায় অনেক রঙীন কাঁচের শার্সি লাগানো, যাতে আলো আসে সেজন্য। সেগুলো এক এক করে খুলে দেয় দুজন মিলে। সূর্যের আলো এসে ঢোকে ঠাকুরদালানে। জেকব ও বাকিরা সেই আলোয় কুঁকড়ে যায় কষ্টে। ছাদে পুজোবাড়ির রান্নার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখান থেকে ব্যারেল ভর্তি কেরোসিন তেল নিয়ে ওরা ঢালতে থাকে নীচের মেঝেয়। চরম আক্রোশে গায়ের জ্বলন যন্ত্রণা ভুলে দেওয়াল বেয়ে সরীসৃপের মতো উঠতে থাকে জেকব। একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ভেতরে ছোঁড়ে সুজয়। সারা মেঝেতে তরল আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সদ্য রূপান্তরিত ভ্যাম্পায়ারদের চিতায় পরিণত হয় ঠাকুরদালানটা। এদিকে জেকব ততক্ষণে অনেকটা ওপরে চলে এসেছে। রণজয় ওকে হাতের কাছের একটা লাঠি তুলে মেরে নীচে ফেলে দিতে চায়। কিন্তু জেকব লাঠিটা ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দেয় যে রণজয় সহ জেকব ধড়াম করে নীচের জ্বলন্ত মেঝেতে আছড়ে পড়ে। ঝনঝন করে কাঁচের শার্সিও ভেঙে পড়ে। আর্তনাদ করে ওঠে সুজয়। নীচের সেই আগুনের তীব্র শিখার মধ্যে দিয়ে দেখতে পায় রণজয় সমস্ত শক্তি দিয়ে জেকবকে টেনে রেখেছে। জেকবও চেষ্টা করছে রণজয়ের বজ্র আঁটুনী থেকে নিজেকে মুক্ত করে ছাদের শার্সির দিকে বেয়ে উঠতে। বাকি সকল না-মানুষরা রণজয়ের দিকে এগিয়ে আসছে তাদের জ্বলন্ত শরীর নিয়ে। রণজয় এক হাতে জেকবকে আটকানোর চেষ্টা করছে অন্য হাতে লাঠিটা তুলে নিয়ে বাধা দিচ্ছে তাদের।
সেই জ্বলন্ত নরকের ভেতর থেকে রণজয়ের গলা ভেসে আসে
– পালা জয়, পালা!

গোটা মৃত পরিবারকে পুনরায় মৃত্যুর পথে যেতে দেখে সুজয় পাথর হয়ে গেছিল। রণজয়ের চীৎকারে সম্বিত ফেরে। একতলার ছাদ থেকে নীচের জমা করা খড়ের ওপর লাফ মেরে ছুটতে থাকে পাগলের মতো। পেছন থেকে কানে ভেসে আসছে জেকবসহ বাকি না-মানুষদের আর্তনাদ। ওর আপনজনদের গগনবিদারী চীৎকার। রণজয়ের গলাও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। আর ফিরে গিয়েও তো কোনও উপায় নেই ওদের বাঁচানোর।
বদ্ধ ঠাকুরদালানে জ্বলতে থাকা লেলিহান আগুনের শিখাকে পেছনে ফেলে, দুহাত দিয়ে কান ঢেকে ছুটতে থাকে সুজয়। হাসপাতালে যে করে হোক পৌঁছতে হবে। ওর পেটেও যে একটা বড় শার্সিভাঙা কাঁচের টুকরো বিঁধে আছে। ওকে বাঁচতে হবে। অন্তত যতক্ষণ না ওর শরীর থেকে ভ্যাম্পায়ারের রক্ত বেরিয়ে যায় ততক্ষণ। নাহলে যে মৃত্যুও শান্তি দেবে না ওকে।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত