বিকেলের সময়টা কেন যেন নিজেকে খুব একা লাগে। আগে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল, এখন নিদ্রা দেবীও আর দশটা মেয়ের মত আমার কাছ থেকে একটু দূরে থাকতেই পছন্দ করে। হয়তো অন্যকারো সাথে বিকেলের সুন্দর সময়টাতে তাঁর দেখা করার কথা থাকে। এমন এক বিকেলে যখন কিছু ভালো লাগছিলো না, আমি ক্যাম্পাসে গিয়ে ক্যাফের সামনের চত্বরে একা বসে ছিলাম। নিঃসংগতায় সিগারেটের চেয়ে ভালো কোন বন্ধু থাকতে পারেনা। তাই একাকিত্বের অট্রহাসি উপেক্ষা করতে একটা সিগারেট ধরালাম। একমনে সিগারেট টানছি আর ছাইপাশ ভাবছি। খেয়াল করিনি ধোঁয়ার অপর পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
তুমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ো না? এক মিষ্টি মেয়েলী কন্ঠ শুনতে পেলাম।
পাশে তাকাতে দেখি শ্যামলা রঙের মায়াবী চেহারার আয়ত চোখের এক মেয়ে দাঁড়ানো। পরনে ফতুয়া আর জিন্স। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ। চিনতে পারলাম না। আগে হয়তো দেখেছি, খেয়াল করিনি।
-হুম।সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। তোমাকে তো চিনলাম না। তুমি কে?
-আমি রুপা। থার্ড ইয়ারে পড়ি।
-স্যরি আপু। তুমি করে বলে ফেললাম।
-না ঠিক আছে। এইসব আপনি-তুমি বিষয়ক ন্যাকামি নিয়ে আমার কোন মাথা-ব্যাথা নেই।
রুপা নামের অপরিচিত মেয়েটি কী ভেবে যেন আমার পাশে বসল। আড়চোখে দেখলাম তার ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি। কেন হাসছিল বুঝতে পারলাম না।
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব মাথায় আসছিল না। সেও চুপ করে রইল। অস্বস্তিকর নিরবতা। আমিই শেষমেষ নিরবতা ভাঙলাম।
-তুমি কি আমাকে চেন? কিছু বলতে চাও?
তুমি করেই তাকে প্রশ্ন করলাম, যেহেতু তার সম্বোধনবাচক শব্দে কোন এলার্জি ছিলনা।
-তেমন কিছু না, তোমাকে প্রায়ই দেখি এই সময়টাতে এই জায়গায় একা বসে ধোঁয়া উড়াও। ছ্যাঁকা-ট্যাকা খেয়েছ নাকি?
সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মেয়ের মুখে এই ধরনের কথা শুনে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছিলনা।
মেয়েটি আমার মনের অবস্থা বু্ঝতে পারছিল। মিটিমিটি হাসতে লাগল সে।
-আচ্ছা থাক বলতে হবেনা। বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্যি।
-কীভাবে বুঝলে ঘটনা সত্যি? তুমিও কি ছ্যাঁকা-ট্যাকা খেয়েছ নাকি? নাকি তুমি ছ্যাঁকা বিশেষজ্ঞ?
কিছুটা রাগ দেখিয়ে জানতে চাইলাম।যদিও এটা সত্য ছিল যে কয়েক মাস আগে লীনার সাথে আমার ব্রেক-আপ হয়েছে।
-হ্যাঁ, আমিও খেয়েছি।
তার এমন সোজা-সাপটা উত্তরে আমি আবার বিস্মিত হলাম। একটা মেয়ে এভাবে কথা বলে কীভাবে। আশ্চর্য!
-আর আজকে আমার ছ্যাঁকা খাওয়ার তিন বছর পূর্তি হল।
এবার যেন কিছুটা দুঃখী শোনাল তার গলা।
আমি আবার চুপ হয়ে গেলাম। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বুঝলাম মেয়েটি দুঃখ ভাগা-ভাগি করার জন্য আমার কাছে এসেছে।
-সেও কি আপনার সাথে প্রতারণা করেছে? যেমনটা হয়েছে আমার সাথে?
আমি জানতে চাইলাম ইতস্তত করে।
-তোমার সাথে সে কেমন প্রতারণা করেছ তো আমি জানিনা। তোমার ব্রেক-আপ হলো কীভাবে?
-সেই পুরুনো ব্যাপার। আমার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়ে আরো কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক চালাত। মেয়েরা যেমন হয়।
-হুম। আমার সাথেও সে প্রতারণাই করেছিল।
এবার আগের চাইতে বিষাদী শোনাল তার কন্ঠ।
-আচ্ছা আমাকে বলুন। দুঃখের কথা ভাগা-ভাগি করলে কিছুটা হালকা বোধ করতে পারেন।
রুপা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হয়তো বলার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। আমি আরেকটি সিগারেট ধরালাম। বেলা কথার ফুলঝুরি ছোটাল।
-তখন আমি স্কুলে পড়তাম। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছি। ও-লেভেলস এর তখন কয়েক মাস বাকী। ক্লাস, ক্লাবের কাজ, গানের ক্লাস, বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি- এইসব নিয়ে ভালোই কাটছিল আমার সময়। একদিন স্কুল শেষে বাসায় এসে টিভি দেখছিলাম। তখন বিকেল ৪ টা। বাবা-মা কেউ তখন বাসায় থাকেনা। দু’জনেই অফিসে থাকেন। সেই সময় হঠাত বাসার টি.এন.টিতে ফোন আসল। আমি ফোন ধরলাম, কেউ কথা বলল না। আমি বিরক্ত হয়ে রেখে দিলাম। ভাবলাম রঙ নাম্বার হবে হয়তো। পরদিন আবার একই সময়ে ফোন আসল। আগের দিনের কথা মনে ছিলো না। আমি ফোন ধরলাম। এইবার কেউ একজন কথা বলল।
তুমি রুপা?
হ্যাঁ।
তুমি কে?
আমকে তুমি চিনবেনা।
না চিনলে তো ক্থা বলবনা।
আচ্ছা ঠিক আছে রাখি।
বলে ফোন কেটে দিল। আমি ভাবলাম আমার ক্লাসের কোন ছেলে হয়তো ফাজলামো করছে। মাথা ঘামালামনা খুব একটা। কিন্তু তারপর দিন আবার একই সময়ে ফোন আসল। আমি ফোন উঠাবনা উঠাবনা করে করে কেন যেন উঠালাম। ঐদিন অনেকক্ষণ তার সাথে কথা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটি তার নাম বলল না। শুধু আমার ব্যাপারে যা যা জানে তাই বলে গেল। ছেলেটি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারত। কী যেন ছিল তার কথায়। কিছু একটা, জাদুর মত। আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। সম্ভবত তার মজা করে আর সহজ করে কথা বলার ক্ষমতা। আমি বুঝলাম না সে কীভাবে জানত কখন আমার বাবা-মা বাসায় থাকতনা। আর আমার ব্যাপারে এত সব কীভাবে জানত তাও বুঝে উঠতে পারলাম না। এভাবে দিন যেতে থাকে। আমি একসময় তার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ছুটির দিনগুলোয়ও যখন বাবা-মা বাড়ি থাকতনা ঠিক সেই সময়েই সে ফোন দিত। আমি আরো অবাক হতাম। সে কীভাবে বুঝত কখন বাসায় কেউ থাকেনা? এইসব প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেত। একদিন আমি সরাসরি তাকে জানিয়ে দিলাম- সে কে এটা না বললে আমি আর তার সাথে কথা বলবনা। অবশেষে ছেলেটা তার পরিচয় দিল। জানতে পারলাম সে আমাদের পাশের বাসায় থাকে। তার নাম শাহেদ। জানালা দিয়ে সে আমাকে দেখে, আমার বাসায় কে আসল-না আসল সব দেখে। আমি মনে মনে নিজেকে ভর্তসনা করলাম এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে না পারার জন্য। ততদিনে আমাদের দেখা হয়নি, অথচ আমি আবিষ্কার করে ফেললাম যে আমি সারাক্ষণ তার কথাই ভাবি। হ্যাঁ, আর দশটা মূর্খ কিশোরীর মতো আমি তখন তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি।
পরে আমাদের দেখা হল। একবার, দুইবার, অনেক বার। প্রথম যেদিন দেখা হল সেদিন খুব চমকে গিয়েছিলাম। খুব সুদর্শন ছিল সে। কিন্তু এত গম্ভীর মনে হয়েছিল যে একটু ভয়ই পেয়েছিলাম তাকে দেখে। আসলে সে ছিল অনেকটা শামুকের মত, বাইরের শক্ত খোলসের ভেতরে কোমলতার অবয়ব। প্রথম কথা বলার প্রায় ছয়মাস পর আমরা প্রথম দেখা করি।
একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলার পর বেলা একটু জিরিয়ে নিল। আমি পুরোটা সময় চুপ করে ছিলাম। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। আমি আরেকটা সিগারেট বের করলাম।
-ভালবাসি কে আগে বলেছিল। তুমি না সে?
সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চাইলাম।
-সে বলেছিল। যেদিন দেখা হয়, সে দিনই।
-তুমি সাথে সাথে হ্যাঁ বলেছিলে?
-না দুইদিন পরে। ঐ দুইদিন যে তার কী অবস্থা হয়েছিল। দুইদিন পর যখন তার সাথে দেখা করলাম তখন তাকে মমির মত ফ্যাকাসে লাগছিল। যখন হ্যাঁ বললাম, তখন শুধু এক ফোঁটা অশ্রু দিয়ে সে বুঝিয়েছিল কত সহস্র বিন্দুর গভীরতা ছিল তার ভালোবাসায়।
-এরপর?
-হ্যাঁ স্বপ্নের মত সুন্দর কিছু সময় কাটছিল আমাদের। ও ছিল আর দশটা ছেলে থেকে অনেক আলাদা। আমার প্রেমিক ছিল বলে বলছিনা। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবে। আমার বাবার এক বন্ধুর ছেলে একদিন আমাকে প্রপোজ করতে গিয়ে হঠাৎ আমার হাত ধরে ফেলে। আমি অনেক রেগে গিয়েছিলাম তার উপর। ঘটনাটি শাহেদকে বলতে সে হেসে আমাকে বলল, শুধু হাতই তো ধরতে চেয়েছে। তুমি যা সুন্দর তাতে তো অনেক কিছু ধরতে ইচ্ছে হওয়ার কথা। বুঝো অবস্থা।
আমি হাসলাম। দেখি তার চোখেও হাসির চিহ্ন। বুঝলাম রুপা নামের এই মেয়েটি তার জীবনের মধুরতম সময়গুলোর কথা মনে করে গাঢ় তৃপ্তি পাচ্ছে।
-হুম। তো সে তোমাকে ছেড়ে গেল কেন?
-বলছি সব। আমাদের সম্পর্কের কথা বাসায় গোপন ছিলো না। শাহেদের গ্রাজুয়েশন করতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা চলছিল। আমি বাঁধা দিলাম না। কারণ শাহেদ ওখানকার টপ ভার্সিটিতে সুযোগ পেয়েছিল। কথা ছিল, গ্রাজুয়েশন শেষ করে এসে আমাদের বিয়ে হবে। আমাদের বাবা-মাও কোন অমত করেন নি।
_তো তারপর কি হল? বাইরে গিয়ে সে তোমাকে ভুলে গেল?
-হুম। ওখনে গিয়েই সে প্রতারণা করে আমার সাথে।
-এটা তো খুব কমন ব্যাপার। আজকাল কার পোলাপান বাইরে গেলে দেশের সব ভুলে যায়।
আচ্ছা একটা ব্যাপার বুঝলাম না, সে প্রতারণা করল আর তুমি এখনো ওর কথা ভেবে ভেবে দুঃখী হচ্ছ কেন? আর ভালবাসা তো দুইজনেরই ছিল, তাহলে কীভাবে এতো সহজে তোমাকে ভুলে গেল্ সে?
-সে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করত আমার সাথে। মেইল দিত, ফোন করত। ভয়েস চ্যাট হত।
-তাহলে প্রতারণাটা করল কীভাবে?
-বলছি। তার প্রতারণার খবরটা পাই আমি তার মামার থেকে।
-কেমন? ওখানে আর কাউকে বিয়ে করে ফেলেছিল? আর কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল?
-না, তবে খুব খারাপ ভাবে আমাকে ঠকিয়েছে।
-আমি তোমার কথা কিছুই বুঝছিনা। কাউকে বিয়ে না করলে, কারো সাথে সম্পর্কে না জড়ালে প্রতারণাটা করল কীভাবে?
-হ্যাঁ যা বলছিলাম। খবরটা পাই তার মামার কাছ থেকে। সেদিন ছিল ২৩ মার্চ। খবরটা পাওয়ার আট দিন পর তাকে দেখি। যখন দেখি সে কোন কথা বলতে পারছিল না। আমি অনেক কাঁদছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, তবুও সে কোন কথা বলেনি। ২২ মার্চ এক যন্ত্র দানবের চাকার নিচে পড়ে সে আমার সাথে প্রতারণা করে চলে যায়। আমাকে একা রেখে চলে যায় এই পৃথিবীতে।
শেষের কথাগুলো শুনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। শিক্ষা জীবনে অর্জিত সমস্ত শব্দ হাঁতড়েও তাকে বলার জন্য কিম্বা সান্তনা দেওয়ার জন্য কোন কথা খুঁজে পেলাম না। রুপার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিলনা আমার। শেষের দিকে তার ভাঙ্গা কন্ঠ শুনে বুঝতে কষ্ট হয়নি তার দু’চোখ তখন পাহাড়ী ঝর্না।
কী নির্মম এই জীবন, কী অদ্ভূত এইসব ভালোবাসা!
লিখেছেন – জিমরান মোহাম্মদ সায়েক |