গল্পটা ভালোবাসারও হতে পারত

গল্পটা ভালোবাসারও হতে পারত

সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা, ইয়ার্কি-ফাজলামি করে এরকম ছেলেদের আমি পছন্দ করতাম না। ছেলে মানুষ হবে একটু রাশভারী, গম্ভীর ধরনের, তা না হলে তো পুরুষ পুরুষ ভাবই আসে না। তবে ঐ যে একটা কথা আছে না “বিপ্লবের পরদিনই কট্টর বিপ্লবীও রক্ষণশীলে পরিণত হয়।” আমারও সেই দশাই হয়েছিল।

রাতুল আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম। সহপাঠী হিসেবে যতটুকু জানাশোনা থাকা সম্ভব ,সেটুকুই ছিল। দেখতাম সারা ক্লাস হইচই করে বেড়াত, ঠাট্টা তামাশা এগুলো নিয়েই মশগুল থাকত। সুতরাং সঙ্গত কারণেই এমন আহামরি ভাল ছাত্র সে ছিল না। সহপাঠীদের মাঝে সে যতটা জনপ্রিয় ছিল শিক্ষকদের কাছে ছিল ঠিক ততটাই অবাঞ্ছিত। এইতো এতোটুকুই জানতাম।

সেদিন ক্লাসের বিরতিতে মন খারাপ করে বসে ছিলাম। মন তো খারাপ থাকবেই , সেজানের সাথে ব্রেক আপ হয়েছে কয়েক দিন আগেই। তখন আমার আকাশ মেঘলা লাগে, বাতাস ভারী মনে হয়, অন্যদের হাসাহাসি অসহ্য লাগে, যুগল দেখলে মনে হয় এরা ভণ্ডামি করছে। এবং এর সাথে অতি অবশ্যই ব্রেক-আপের পরপর মেয়েদের মনে যে দর্শন উদয় হয় অর্থাৎ “সব ছেলেই খারাপ আর কিছু কিছু ছেলে বেশী খারাপ” সেটিও পাকাপোক্ত হয়ে বসে গেছে। তো দুম করে রাতুল আমার পাশে এসে বলল “ মন খারাপ করে থাকলে তোকে যে বাংলা ছিঃনেমার সাইড নায়িকাদের চেয়েও বাজে দেখায় সেটা কি জানিস?” নম্র ভদ্র মেয়ে হিসেবে আমার একটা সুনাম ছিল নাহলে ঐখানেই রাতুলের গালে জোরেশোরে একটা বসিয়ে দিতাম । তবে বাস্তবে রাতুলের দিকে একটা শুকনো হাসি দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম।

এরপর কয়েকদিন ক্লাসে টুকটাক কুশল বিনিময় চলল, আমি এক দুই শব্দে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। একদিন সন্ধ্যায় ও আমার মোবাইল এ ফোন দিল, আমি একটু বিরক্তির সাথেই রিসিভ করলাম। ও কোন হ্যালো ট্যালোর ধার না ধেরে রিসিভ করার সাথে সাথেই বলল “একটা কৌতুক শুনবি?” আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বলা শুরু করে দিল। এতদিন পর আর কৌতুকটা মনে নেই তবে এতটুকু মনে আছে যে সেটা শুনে আমি হেসেছিলাম এবং হাসিটা বোধ হয় একটু প্রশ্রয় মেশানোই ছিল কারণ সেদিন প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেছিলাম। এরপর থেকে কিছুদিন ধরে প্রায় নিয়মিত বিরতিতে এবং পরবর্তীতে বিরতিহীন ভাবে আমাদের কথা হতে লাগল। আমি খেয়াল করলাম দিনের অনেকটা সময় আমি রাতুলকে নিয়ে ভাবছি আর মাঝে মাঝেই ওর মজার মজার কথা গুলো চিন্তা করে আনমনে হেসে উঠছি। বুঝতে পারলাম ওকে বাদ দিয়ে হয়ত আমার জীবন চলবে তবে সে জীবনটা হবে শুধুই যাপনের জন্য, এর বেশী কিছু না। নারীসুলভ অহমিকার কারণে আমি চাচ্ছিলাম ওর কাছ থেকেই কোনও সিদ্ধান্ত আসুক । জীবনে করা কোনও ভাল কাজের ফসল হিসেবে দিনটা আসল এবং যেহেতু মানুষটা রাতুল তাই একটু চমক হয়েই আসল। সেদিন আমরা হেঁটে হেঁটে টিএসসির দিকে যাচ্ছিলাম হঠাৎ করে একজন বয়স্ক মহিলা ভিক্ষুক দেখে রাতুল দাঁড়িয়ে গেল। তারপর উনাকে বলল “চাচী ভিক্ষা কর কেন? কাজ করতে পার না?” উনি বলল “বাবা এই বয়সে কাজ দিব কেডা?” রাতুল বলল “আচ্ছা তোমারে আমিই এখন একটা কাজ দিচ্ছি, করতে পারলে নগদ একশ টাকা পাবা, কি করবা? ” উনি বলল “ কি কাজ বাপ?” রাতুল বলল “এই যে মেয়েটারে দেখতেস না, ওকে জিজ্ঞাসা কর তো আমার বউ হইতে রাজী আছে কিনা?” মহিলা ভিক্ষুকটা কিছুক্ষণ বিব্রত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল আর আমি উনার চেয়েও বিব্রত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলাম তারপর একশো টাকার লোভেই কিনা জানি না উনি আমাকে বলল “মা, তুমি এই বাজানরে বিয়া করবা?” আমি এই কথা গুলো শোনার জন্য কতদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম কিন্তু আমার সকল প্রস্তুতি আমাকে ধোঁকা দিল আর আমি কাঁদতে শুরু করলাম , কাঁদতে কাঁদতেই ওর হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে বললাম “যদি তুমি কথা দাও আজকেই তুমি আমাকে শেষ বারের মতো কাঁদালে তবেই আমি তোমার হব ।” রাতুল বলল “ও আল্লাহ, আমি তোমাকে কাঁদাব না তো কি রাস্তার লোকজন তোমাকে কাঁদাবে ? আমি অবশ্যই তোমাকে কাঁদাব তবে কথা দিচ্ছি সে কান্না হবে আনন্দের।”

যতটুকু ঝগড়া না করলে ভালবাসার অপমান হয় ওর সাথে আমার তার চেয়ে বেশী ঝগড়া কক্ষনই হয় নি। আমরা দুজন কেউই কাউকে বদলাতে চাই নি। তাই ওর সারাক্ষণ হইচই করার অভ্যাসটাও অটুট ছিল। এমনকি আমাদের বিয়ের দিনেও সে ছিল অপরিবর্তিত। ভেবেছিলাম এই প্রথম লজ্জা লজ্জা চেহারার রাতুলকে দেখব রুমাল মুখ চাপা দিয়ে বসে আছে। কিন্তু কিসের কি বিয়ের আসরে ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর কাছে কোন রুমালই নেই। বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করছে, ইয়ার্কি করছে কি আর বলব। ইচ্ছা করছিল ওর গালে একটা বসায় দেই আর বলি “ছাগল, একটু তো লজ্জা শরম রাখ আজকে তোর বিয়ে !” কিন্তু ঐ যে আগেই বলছিলাম নম্র ভদ্র মেয়ে হিসেবে আমার যে সুনাম ছিল সেটা নষ্ট করতে ইচ্ছা হয় নি।

আমি হয়ত রান্নাবান্না সেরে ওর জন্য অপেক্ষা করছি ও এসে বলবে চল আজ বাইরে খেতে যাই। আমি হয়ত বললাম যেগুলো রান্না করেছি সেগুলো তো নষ্ট হবে তখন ও বলে একদিনের জন্য না হয় আমি শয়তানের ভাই আর তুমি শয়তানের বোন হলে, সমস্যা নাই তো! প্রতি মাসেই দূরে বা কাছে কোথাও না কোথাও আমরা বেড়াতে যেতাম। স্বপ্নের মতোই কাটছিল ওর সাথে দিনগুলো । নাহ মিথ্যা বললাম আমার স্বপ্নও তো এতো সুন্দর ছিল না কখনো।

কিন্তু আজ যে রাতুলকে দেখছি তাকে আমার বড় অচেনা মনে হচ্ছে ।অফিস থেকে এতো সকালে ও কখনই ফেরে না । আশ্চর্য রকম বিষণ্ণ লাগছে ওকে । কোনও কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে আছে। কি হয়েছে ওর? এরকম তো হওয়ার কথা না । আর এতগুলো মানুষ আশেপাশে থাকলে ওর তো আসর জমিয়ে রাখার কথা আর মানুষগুলোর হাসতে হাসতে হেঁচকি ওঠার কথা । কিন্তু মানুষগুলো উল্টো কাঁদছে কেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে আর মনে হচ্ছে রাতুলের মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে চিৎকার করে বলি “তুমি না বলেছিল তুমি যদি কখনো আমাকে কাঁদাও সে কান্নাটা হবে আনন্দের , তুমি এতো বড় মিথ্যুক ? ”

লিখেছেন – হিল্লোল |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত