নিতির নিয়তি

নিতির নিয়তি

দক্ষিনের জানালাটা খোলাই ছিল। নিতির মনের জানালা যেমন খোলাই থাকে প্রতিনিয়ত তার অজানা অপ্রাপ্ত ভালবাসার জন্য। গত ছয় মাস ধরে সে জানালা পেরিয়ে অজানা এক ভায়োলিনের সুর ভেসে এসে নিতির হৃদয়কে আচ্ছন্য করে যায় এক অজানা শিহরনে।

শান্তিনগরের বিশাল ফ্লাটবাড়ি। রাজধানীর ব্যস্ততম আবাসিক এলাকা। অজস্র মানুসের বাস। কিন্তু কে যে নিতির মনকে রোজ সন্ধায় আলো জাগিয়ে যায় আজো তার জানা নেই। তাই অজস্র লোকের ভিড়ে তার চোঁখ খুঁজে ফিরে সেই মুখটি দেখার আশায় যার ভায়োলিনের সুর তাকে এমন আবেশি করে যায়।

প্রায় চল্লিশটি ফ্লাট। কিন্তু কোথায় থাকে তার সেই মনের মানুষ যাকে সে অজান্তে সঁপে দিয়েছে তার কুমারি মন। নিতি খোঁজে। যতই খোঁজে ততই বাড়ে মনের ব্যাকুলতা।

দিন যায় ব্যাকুলতা বাড়ে। এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা নিতি। আজো রোজকার মত ভেসে আসছে সেই সুর। কিন্তু আজ যেন বড়ই অন্যরকম। বৃষ্টি আর ভায়োলিনের সুর এক হয়ে মধুর সুর হয়ে বাজছে নিতির মনে। নিতিকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সে সুর। আজ নিতি মরিয়া হয়ে ওঠে। তাকে আজ খুঁজে বের করতেই হবে কোথায় থাকে তার সেই অজানা মনের মানুষ। অজান্তেই যাকে করে তুলেছে সে নিজের সপ্নের রাজপুত্র।

পাগল হয়ে ওঠে নিতি ফ্লাট থেকে ফ্লাটে ঘোরে, কান পেতে শোনার চেষ্টা করে, বোঝার চেষ্টা করে কোথায় বাজছে সে সুর, যাতে আটকা পরেছে তার অমোঘ নিয়তি। অনেক খোঁজার পরে পেয়ে যায় সে। তাদের দুই ফ্লোর নিচে ঠিক তাদের বরাবর ফ্লাটটি থেকেই ভেসে আসছে সেই সুর। নিতি উদ্ভ্রান্তের মত বেল বাঁজাতে থাকে।

মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে উঁকি মারে।

ভদ্রমহিলা ঃ কাকে চাইছেন?

নিতি ঃ আসসালামুয়ালাইকুম। আসলে আমি আপনাদের ঠিক দুই ফ্লোর উপরে থাকি। আমার নাম নিতি।

ভদ্রমহিলা ঃ ( স্মিত হাসি দিয়ে ) আচ্ছা তাই। তা কি মনে করে, কোনো কাজ নাকি এমনি পরিচিত হতে?

নিতি ঃ ( আমতা আমতা করে ) না আসলে, আমি আরকি, খালাম্মা, আসলে……

ভদ্রমহিলা ঃ আরে দেখ দেখি কি কাণ্ড তোমাকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। এসো ভেতরে এসো। তুমি বললাম রাগ করলে নাতো। ( স্মিত হাসিটি লেগেই আছে )।

নিতি ঃ ( ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ) না না কি যে বলেন না খালাম্মা??? ( লাজুক হেসে ) আমি তো আপনার মেয়ের মতোই। ( মনে মনে বলছে নিতি ঃ আপনার ছেলে যদি ভায়োলিনটা বাজিয়ে থাকে তবে তো আপনাকে মা ডাকতেই হবে )।

ভদ্রমহিলা নিতিকে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। নিতি চারদিকে তাকিয়ে বসার ঘরটি দেখছে আর ভদ্রমহিলার রুচির প্রসংসা করছে মনে মনে। এদিক ওদিক চকিত চাহ্নি দিয়ে বজার চেষ্টা করছে যে সুরটি এখনো বাজাচ্ছে সে কোন ঘরে??? তাকে কখন সে দেখতে পাবে??? কখন সে তার মনের রাজপুত্রর চোখে চোখ রাখতে পারবে??? কখন সে তাকে বলবে যে ভালবাসার কথা আমি শুধু শুনে এসেছি সে ভালবাসা ভায়োলিনের সুর হয়ে ঢুকে গেছে আমার মনে। নিতি ভাবছে সকল লজ্জা সকল নিয়ম ভেঙ্গে সে আজ জানাবে যে তার অদেখা রাজপুত্রকে সে কতটা ভালবেসে ফেলেছে। তার কতটা জুরে আছে সে ভালবাসার মানুষটি। যার একটু সম্মতির জন্য নিতি যেকোন বন্ধন ছিন্ন করতেও আজ প্রস্তুত। কিন্তু কোথায় সেই মানুষটি সে আসছে না কেন???

ভদ্রমহিলা যার নাম সালেহা তিনি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছেন মগ্ন নিতিকে। আনমনা দাড়িয়ে সোফার কোনটি ধরে এদিক ওদিক দৃষ্টি বোলাচ্ছে। তিনি চমক ভাঙ্গালেন নিতির-

সালেহা বেগম ঃ কি মা? কি দেখছ অমন করে? বসো একটু। কি খাবে বলো হাল্কা না ভারী কিছু?

নিতি ঃ না না খালাম্মা কিছু খাব না আমি…… ( অপ্রস্তুত হয়ে হরবরিয়ে বলে ওঠে নিতি )

সালেহা বেগম ঃ আরে লজ্জা করোনা এম্নিতে নাস্তার সময় এখন, আমিও নাস্তা করবো। কি খাবে বলো?

নিতি ঃ হাল্কা কিছু হলেই হবে। ( না করার আর শক্তি পায় না নিতি )

সালেহা বেগম উঠে গেলেন রান্নাঘরে। ভায়োলিনের সুর হঠাৎ থেমে গেলো। নিতি চমকে উঠলো কিন্তু খুশীও হোল। ভাবলো যাক এবার তবে রাজপুত্রের দেখা মিলবে। কেমন হবে সে??? ভালবাসবেতো আমায়??? আমায় সুন্দর লাগছেতো??? যাহ্‌ একটু সাঁজ করে আসলে কি হতো??? এমনি নানান ভাবনায় রোমাঞ্চিত হয়ে থাকল নিতি।

সালেহা বেগম কিছুক্ষন পরে বসার ঘরে এসে ঢুকলেন পেছন পেছন কাজের ছেলে ট্রলি ঠেলে ঢুকছে। নিতি চেয়ে রইল, কই সে তো এল না??? এখনো আসছে না কেন??? আবার মগ্নতা ভাঙ্গালেন সালেহা বেগম –

সালেহা বেগম ঃ এই মেয়ে কি এত ভাবো সারাক্ষন অমন করে? এই বয়সে মেয়েদের এত চিন্তা করতে হয়না। চেহারার সৌন্দর্য আর লাবণ্য নষ্ট হয়ে যাবে তো, মাসাল্লাহ, কি সুন্দর মেয়েগো তুমি। ( প্রস্রয় মাখা হাসি তার মুখে )

নিতি ঃ ( লজ্জা পেয়ে ) নাহ এমনি, একা বসে ছিলাম তো তাই। ( এদিক ওদিক তাকিয়ে ) আচ্ছা আর কাউকে দেখছি না যে???

সালেহা বেগম ঃ ( কিছুটা কৌতূহলী হয়ে ) কেনো আর কে থাকবে? ( কিছুটা মজা করে ) আর কাউকে আশা করছো, কারো কি আসবার কথা নাকি?

নিতি ঃ ( লজ্জায় মাথা নিচু করে ) ঐযে এতক্ষন যিনি মনকারা সুরে ভায়োলিন বাজাচ্ছিলেন। অসাধারন সুর। তাকেও ডাকুন একসাথে নাস্তা করি। এমন একজন গুনি মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারাটাওতো সৌভাগ্যের ব্যাপার।

নিতির কথা শুনে হঠাৎ করে সালেহা বেগমের চেহারা করুন হয়ে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার সকল জিবনিশক্তি যেনো তাকে ছেড়ে হঠাৎ চলে গেছে। নিতি বিষয়টি খেয়াল করলো। তার মনে অজানা আশঙ্কা উদ্রেক হলো।

নিতি ঃ ( নিতির গলায় অস্থিরতা ) কি হয়েছে খালাম্মা??? অমন করছেন কেনো??? আমি কি আপনার কোথাও না জেনে আঘাত দিয়ে বসলাম??? ( উত্তেজনায় ছটফট করছে নিতি )

সালেহা বেগম ঃ ( দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে ) না মা। তুমি আমাকে কি আঘাত দেবে! যা আঘাত পাবার তা সাত মাস আগেই পেয়েছি। এখন শুধু আঘাতের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা।

নিতি ঃ ( হতবাক হয়ে ) মানে??? কি বলছেন খালাম্মা এসব??? কি হয়েছে বলেন একটু??? ( চরম হতাশা বাজছে নিতির কণ্ঠে )

সালেহা বেগম ঃ ( কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ) ভায়োলিনের যে সুরের কথা বলছ তুমি ওটা আমার ছেলে পিয়েল এর বাজানো। ও ভালো বাজাতো বলে এক রেকর্ড কোম্পানি ওকে অ্যালবাম করার সুযোগ দেয়। যেদিন রেকর্ডিঙের কাজ সম্পূর্ণ শেষ হয়, আমরা একটা সেলিব্রেসন এর পার্টি রাখি। পিয়েল পার্টিতে আসার জন্য খুব দ্রুত গাড়ী চালাতে থাকে। এক পর্যায়ে ওর এক্সিডেন্ট হয়। ঘটনাস্থলেই ওর মৃত্যু ঘটে। কিছুদিন পরে রেকর্ডিং কোম্পানি অ্যালবাম এর কয়েকটা কপি আর রয়্যালিটির টাকা দিয়ে যায়। আগের বাসায় ওর স্মৃতি তাড়া করতো খুব বেশি তাই ছয় মাস হয় এই ফ্লাট কিনে এখানে শিফট করেছি। এখানে আসার পর থেকে পিয়েলের ভায়োলিনের আওয়াজ মিস করতাম তাই ওর অ্যালবামটা প্রতি সন্ধায় শুনতাম। ওর প্রতি আমার ভালবাসার ক্ষুদ্র প্রদর্শন।

নিতির মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পরে। পায়ের তলায় মাটি যেন সরে যেতে চায়। বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে নিতির কাছে সমস্ত বিশ্ব একটি খালি শূন্য স্থান মনে হয়। নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। এ সে কি শুনছে; যে ভায়োলিনের আওয়াজ তার মনে বসন্তের দোলা দিয়ে গেছে, যাকে দেখার জন্য যাকে ভালবাসার জন্য নিতির সকল সত্তা আজ উম্মুখ, সে আজ তবে আর হবার নয়??? যে সুর শুনে সে ভালবাসতে শিখেছিল তা কেবল রেকর্ডকৃত!?! তবে সে শুধুই এক ছেলেহারা মায়ের কষ্ট মেটাতে বাজতো? এ সে কি করলো, কাকে ভালবাসল??? এখন সে এই মৃত পিয়েলকে পাবে কোথায়??? শুধু কারো রেখে যাওয়া স্মৃতিকে সে নিজের ভালবাসা বানিয়েছে??? এমনি অজস্র প্রশ্ন নিয়ে বসে থাকে নিতি। কিছু পাবার আগেই হারিয়ে ফেলার বেদনা তাকে স্থবির করে দিয়ে যায়।

পাবার আগেই সবকিছু হারিয়ে ফেলা এক তরুণী আর স্মৃতি হাতড়ে ফেরা এক রমণীর পাশাপাশি বসে থেকেও নিজেদের সবহারা নিঃসঙ্গ মনে হয়। খাবারগুলো তেমনি পরে থাকে। শূন্য দৃষ্টিতে বসে থাকা দুটি মানুষের হৃদয়ের হাহাকার এক হয়ে মিশে যেতে থাকে বাহিরের বৃষ্টির হুঙ্কারের সাথে। প্রকৃতিও আজ কাঁদতে থাকে তাদের সাথে অঝোর ধারায়।

লিখেছেন – – মুগ্ধ মিশেল |

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত