আব্বু, ১০০ টাকা দাও তো ?” বাবার কাছে ছেলের খুবই স্বাভাবিক আবদার। কিন্তু আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগল অন্তুর কণ্ঠটা , কেমন যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা আর পুরুষালি! খেয়াল করে দেখলাম ওর নাকের নিচে নতুন গজানো গোঁফের রেখা। কি আশ্চর্য ! আমার অন্তুটা বড় হয়ে গেল ? এই কয়েকদিন আগেও ওকে কোলে নিয়ে হিস হিস শব্দ করে হিসু করালাম, হাত ধরে ধরে হাঁটালাম আমার সেই অন্তু বড় হয়ে গেল? হয়ত কয়েকদিন পরে আমার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে কোন মেয়েকে বাদাম কিনে খাওয়াবে , আরও কয়েকদিন পরে হয়তবা একটা টুকটুকে মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে। কি অদ্ভুত ! কি অদ্ভুত ! ছোট বেলা থেকে ওর সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছি তবুও আজকে কোথায় যেন একটা ছোট্ট দূরত্ব অনুভব করছি । কে জানে হয়ত পিতা পুত্রের মধ্যে সামান্য এই দূরত্বটারও আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে ।
“আব্বু, কি হল টাকা দাও না তাড়াতাড়ি ?” অন্তুর তাড়া খেয়ে সৎবিত ফিরে পেলাম, বললাম
“কি করবি টাকা দিয়ে ?”
“লাগবে, দাও না, বন্ধুরা মিলে একটু ঘুরতে যাব”
“খালি বাইরের বন্ধুদের সাথে সময় কাটালে হবে? বাসায় যে তোমার দুইজন বয়স্ক বন্ধু আছে তাদের কথাও তো ভাবতে হবে নাকি ?”
“ঠিক আছে আব্বু, কালকে স্কুল ছুটি আছে ,আমি তাড়াতাড়ি ফিরব আর তারপর তুমি ,মামনি আর আমি চুটিয়ে আড্ডা দিব। ”
“আচ্ছা সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরবা।”
রাতের খাবার দাবার শেষ করে একটা পারিবারিক আড্ডা জমে উঠল । আড্ডার এক পর্যায়ে অন্তু জিজ্ঞাসা করল “আব্বু, তোমাদের কি ভালবাসার বিয়ে ?” ছেলের মুখ থেকে প্রশ্নটা শুনে সত্যিকার অর্থে একটু লজ্জাই লাগল। অন্তুর মাও দেখি মিটিমিটি হাসছে । অন্তুর সাথে যেহেতু আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ তাই আর সংকোচ না করে বললাম “হ্যাঁ বাবা তোমার আম্মুকে আমি ভালবেসেই বিয়ে করেছি।” অন্তু বলল “আব্বু , তাহলে তোমাদের গল্পটা বল না ?” শেলি মানে অন্তুর মা বলল “বল না , সমস্যা কি ?”
“আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তবে আলাদা সাবজেক্টে। তোর মাকে আমি প্রথম যখন দেখি তখন আমি রাস্তার একপাশে আর তোর মা অন্য পাশে । দেখলাম ২ টাকা ভাড়া বেশী চাওয়াতে রিকশাওয়ালার সাথে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। এমন কৃপণের কৃপণ ছিল ,বুঝলি ? ” শেলি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল “শোন ঐটা কৃপণতা ছিল না , যে ভাড়া ঠিক করেছিলাম উনি অন্যায় ভাবে তার চেয়ে বেশী দাবী করতেছিল, এইটা তো মানা যায় না, তাই না? ” আমি বললাম “আচ্ছা আচ্ছা হইছে গল্পটা শেষ করতে দাও। তো এই রণরঙ্গিণী রূপ দেখে প্রথম দেখায় ভালবাসা তো দূরে থাক ভালও লাগেনি তোর আম্মাকে । এরপর একদিন দেখলাম ক্যাম্পাসে তোর আম্মা গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে একজন দুস্থ মানুষের জন্য টাকা তুলছে। ওর এক সহপাঠীর কাছ থেকে তো প্রায় মারধর দিয়েই টাকা আদায় করল। সেদিন কেন যেন খুব ভাল লাগল তোর আম্মাকে, তো দুস্থ লোকটাকে সাহায্য করার উ-ছিলায় তোর আম্মার সাথে পরিচিত হয়ে আসলাম। ” অন্তু বলল “আব্বু, তুমি তো বিশাল ভণ্ড ছিলা !” আমি বললাম “এই জন্যই বাঙ্গালি জাতির কোন উন্নতি হয় না। সব কিছুকে নেতিবাচক ভাবে দেখে। আরে এইভাবে চিন্তা কর যে, তোর বাবা কত প্রত্যুৎপন্নমতি আর স্মার্ট ছিল।” শেলি হাসতে হাসতে বলল “স্মার্ট আর তুমি? ঐ জিনিসটার সাথে তো তোমার ব্রিটিশ আমল থেকে শত্রুতা! জানিস তোর বাবা বিয়ের পর প্রথম যেবার শ্বশুরবাড়িতে এল সেবার একটা কটকটে লাল রঙের টি-শার্ট পরে আসছিল। আমি লজ্জায় মরে যাই অথচ তার কোন বিকারই নাই।এরপর আমিই আস্তে আস্তে তোর বাবাকে মানুষ বানাইছি, আমি না থাকলে তোর বাবার খবর ছিল। ” আমি একটু কপট রাগত স্বরে বললাম “ধন্যবাদ, আমাকে মানুষ বানানোর জন্য , এবার কি গল্পটা শেষ করতে পারি ?” শেলি বলল “হুম বলো।”
“এরপর কারণে অকারণে তোর আম্মার সাথে অল্পবিস্তর কথা বলতে লাগলাম। একই ক্যাম্পাসের হওয়াতে সুযোগের কোন অভাব ছিল না। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, বুঝলাম তোর আম্মাকে ভালবেসে ফেলেছি, তারপর এক শুভক্ষণ দেখে তোর আম্মাকে মনের কথাটা বললাম আর তোর আম্মাও এরকম হীরার টুকরা ছেলের সাথে জীবন কাটানোর লোভ সামলাতে পারল না। তারপর আর কি, অন্য সব কাহিনীর মতোই রাজা রানী সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল আর তাদের মাঝে অন্তু নামের একটা রাজপুত্র আসল।” অন্তু বলল “খুব মজা লাগল আব্বু আর তোমার সম্বন্ধে অনেক নতুন নতুন তথ্য পেলাম!” আমি বললাম “আচ্ছা অনেক গল্প হল এখন ঘুমাতে যাও।” অন্তু আমার আর শেলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
অন্তু যাওয়ার পর শেলি আমার কাছে এসে বসল। খুব নিচু স্বরে বলল “তুমি অন্তুকে পুরো ঘটনা বললে না কেন?” আমি বললাম “কিসের পুরো ঘটনা?” শেলি বলল “আমাদের সম্পর্ক হওয়ার পর আমি যে তারেকের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম এবং পরে ভুল বুঝতে পেরে তোমার কাছে ফিরে এসেছিলাম।” আমি একটু সময় নিয়ে বললাম “দেখ জীবনটা সহজ করার জন্য অনেক সময় আমাদের কিছু সত্য ভুলে যাওয়া শিখতে হয়। তুমি তারেকের কাছে ফিরে গেছিলা এইটা সত্য তবে তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে এই মুহূর্তে তুমি আমার পাশে বসে আছ, আমাদের একটা রাজপুত্র আছে আর সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আজ ২০ বছর পরে এসে এই চুলে পাক ধরা শেলিকেও আমি ভালবাসি ঠিক আগের মতোই। ” দেখলাম শেলির চোখ টলমল করছে। জীবনে অনেক কিছুই সহ্য করা শিখেছি শুধু শেলির চোখে পানি ছাড়া। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য শেলিকে বললাম “আচ্ছা , তোমার ঐ দিনটার কথা মনে আছে যেদিন তুমি আমার জন্য প্রথম রুটি বানাতে গেছিলা ,তোমার ঠোঁটের পাশে একটু আটা লেগেছিল তারপর আমি ঐটা মুছতে যেয়ে …………” শেলি বলল “এই চুপ কর তো, অসভ্য একটা !
লিখেছেন – হিল্লোল |