নীল কাচের নুপুর

নীল কাচের নুপুর

কয়েকদিন থেকে একটু শান্তি করে বেড়াতে পাড়ছি না। আবার এদিকে অধরাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। এই মেয়েটা কখন যে কি করে আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মেজাজ হচ্ছে মালদ্বীপ এর আবহাওয়ারর মতো এই আছে এই নেই। তাই কিছুতেই অধরার উপর আমি রাগ করে থাকতে পারবো না। আর এই জন্যে আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে সে খুব মজা পায়। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে গত দুদিন থেকে তাকে ফোনেও পাচ্ছি না এস এম এস এও না, না ফেসবুকে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না এই মেয়ে কি সেই অধরা যে আমার সঙ্গে একটিবার কথা বলতে না পারলে কেঁদে অস্থির হয়ে যায়। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে আবার ফোন দিলাম, অনেকক্ষণ বাজার পর এবার ফোন উঠাল সে।

” অধরা, কি হয়েছে তোমার ফোন দিলে ধরো না। আবার এস এম এস এর কোনো উত্তর নেই!”

” কিছু হয়নি মেঘ, আমার ইচ্ছা করছে না তাই দিচ্ছি না। আর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো কারো কিছু করার নেই? ”

আমি চুপ হয়ে গেলাম। এই মেয়ে খুব জেদি। সবসময় একটা ফ্যাকরা বাঁধাবে কি বাঁধাবে। আমি আবার বললাম,

” আচ্ছা তুমি যেটা চাচ্ছ, সেটা কি আদৌ সম্ভব তুমি বল?”

” কেন সম্ভব নয়! দেখো খুঁজলে কত কিছু পাওয়া যায়। আর এ তো সামান্য নুপুর তাও তুমি পাচ্ছ না খুজে।”

” আচ্ছা তুমি কি ছেলেখেলা পেয়েছ নাকি এটাকে। খুঁজছি তো কিন্তু পাচ্ছি না। আর তুমি বাচ্চাদের মতো জেদ ধরছ ভালো কথা কিন্তু ফোন দিলে ধরো না এটা কেমন কথা বল তো।”

” শোন, ছেলে খেলা আর মেয়েখেলা যাই হোক না কেন আমাকে তুমি নুপুর এনে দিবে এটাই লাস্ট কথা। আর হ্যা, যদি নুপুর খুঁজে পাও তাহলে আমাকে ফোন দিবে তার আগে না। ”

আমি হ্যালো হ্যালো করছি আর ওইদিকে ফোন রেখে দিছে। আসলেই এই ফাজিলের ফাজিল। এরকমভাবে কেউ জেদ করে বসে থাকে নাকি! কোন কুক্ষণে যে এই মেয়েকে আমি ভালোবাসছি আল্লাহ্‌ জানে। দেখতে খুব ভোলাভালা সাদা টাইপের মেয়ে কিন্তু একবার জেদ ধরে বসলে কে আর থামায় ওকে। কাচের নুপুরের ভুত যে কবে থেকে অধরার মাথায় চাপলো কে জানে! নুপুর লাগবে ভালো কথা সুপারমার্কেট থেকে কিনে দিবো এক জোড়া। কিন্তু এমন নুপুর হলে চলবে না। লাগবে কাচের নুপুর, তাও আবার নীল রং এর হতে হবে। আমি অধরাকে বললাম,

” আচ্ছা, আমি নীল কাচের চুড়ি কিনে দিবো।”

কিন্তু তার এক কথা কাচের নীল নুপুর লাগবে। যদি দিতে পার তাহলে যোগাযোগ করিও। আর না পারলে আমাকে কক্ষনো ফোন দিবে না। আমিও মুশকিলে পরে গেলাম। এ যে একগাদা খড়ের মাঝে সুই খোজার মতো। তবুও একমাত্র প্রেমিকা বলে কথা। কয়েকদিন অফিসের কাজ বাদ দিয়ে লেগে পরলাম কাজে। কিন্তু কিছুতে খঁজে পেলাম না। সারা ঢাকা চষে বেড়িয়েছি কিন্তু খুঁজে আর পাই না। যাকে বলি হয় বলে এ জিনিশ পাবেন না, কেউ বলে পাগল নাকি মানসিক ডাক্তার দেখান ভালো দেখে। কেউ কেউ আবার চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে। আমিও আর বেশি কথা বাড়াই না। চলে আসি সেখান থেকে।

এসব অদ্ভুত চিন্তা যে কেবল অধরার মাথা থেকে আসতে পারে আমি তা ভালো করেই জানি। পাগলি মেয়ে,একবার আমকে বলল, ওর কচুরিপানার ফুল চাই। আরে বাবা কত দামি দামি ফুল পাওয়া যায়। এসব বাদ দিয়ে কিসের কচুরিপানার ফুল নিবে। কত বুঝালাম। কিন্তু গো ধরে আছে ওইটাই লাগবে। সমস্যা হচ্ছে আমি নিজেও জানি না কচুরিপানার ফুল কেমন দেখতে। নেট নুটে সার্চ দিয়ে দেখলাম, একগুচ্ছ সাদা ফুল। আর তার পাপড়িতে গাঢ় বেগুনি আবার হালকাও থাকে। দেখতে বেশ ভালই ফুলটা একদম শুভ্র দেখতে। কিন্তু কোথায় পাবো খুঁজে! অনেক কষ্ট করে একজন রিক্সাওয়ালার কাছে খোজ পেলাম। শেষমেশ পচা পানির খালে নেমে ফুল এনে দিলাম। কত যে খুশি হল বলে বোঝাতে পারবো না। আমার সামনে লাফালাফি শুরু করা বাকি ছিল আর কি। অবশ্য সেদিন একটা পাপ্পিও পেয়েছিলাম। তবে আমি ব্লাকমেল করে নিয়েছি। বলে কিনা এখন এসব না বিয়ের পর হবে। তবে যাই হোক, ফুল গুলো কাচের জারে ঢুকিয়ে রাখলো। কিন্তু সব ফুল কি আর বেচে থাকে নাকি, কয়েকদিন পর আবার ফুলের পাপড়ি নেতিয়ে পরে গেলো। তাই দেখে অধরার সেকি কান্নাকাটি আর মন খারাপ। আমি আর আন্টি তো হেসেই বাচি না। আমি বললাম, ” আচ্ছা, গাছ কি কখনো শিকড় ছাড়া বাচে। আর ফুল কি কখনো হাতে মানায়। তুমি যদি কচুরিপানা সহ নিয়ে আসো তাহলে ভালো হবে। আই মিন ফুলের গাছের মতো চাষ করতে হবে ওগুলোকেও তাহলে টাটকা থাকবে।” কিন্তু এই মেয়ে যে আমাকে এভাবে বোকা বানাবে আমি জানতাম না। বলে কি তাহলে আমি এখন কচুরিপানা লাগাবো। আর তুমি তার সব ব্যবস্থা করে দিবা। আমি যেন নিশ্বাস নেওয়া ভুলে গেলাম। আমি কি বললাম ওকে। নিজেই নিজের পায়ে কুরোল মারলাম শেষে। কত কষ্ট করে বুঝালাম। না হলে আমাকে এবার খুঁজে পাওয়া সম্ভব হত না। প্রথমবারই গায়ে পায়ে অনেক চুলকানি ছিল। এবার নামলে খবর হয়ে যেত।

আর একবার, মধ্যরাতে ফোন দিয়ে ওদের বাসায় যেতে বলল। আমিও খুশি মনে গেলাম যাক এবার হয়ত কিছু ইয়ে পাবো। কারণ আগের দিন আমি এই নিয়ে ওকে অনেক কিছু বলছি। অধরা নিচে নেমে আমায় বলল,

” এই আমার না খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে, এনে দাও না।”

” মানে কি! তোমার না আইসক্রিম খাওয়া যাবে না। আর এত রাতে তুমি আমাকে এই জন্যে উঠিয়ে নিয়ে আসলে।”

” কি করব বলো, বাসায় আইসক্রিম নেই। মা ফ্রিজে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আর তুমি তো জানো আমার আইসক্রিম না হলে ঘুম আসে না। ”

” আমি পারবো না। তুমি গিয়ে ঘুমাও যাও। পাগল নাকি এত রাতে আইসক্রিম কোথায় পাবো আমি!”

” আমি কিচ্ছু জানি না। তুমি এনে দিবা কিনা বল। আর তুমি যদি আমার হবু বর আর বয়ফ্রেন্ড হয়ে থাকো তাহলে এনে দিবা ওকে।”

আমার আত্নসম্মানে বিরাট আঘাত পরল। বয়ফ্রেন্ড হওয়ার এই এক ঝামেলা। কিছু করতে না পারলে খোটা মারবে। শালার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেলো দেখছি। সেই রাতে অনেক ঘুরে একটা মাত্র আইসক্রিম এর দোকান পেয়েছিলাম। সেটাও আবার বন্ধ হবে হবে করছে। জরুরি কাস্টমার বুঝে বেটা দ্বিগুণ দাম নিয়ে নিলো আমার কাছে। ভাগ্য খুভ ভালো যে কোনো পুলিশ সেদিন আমাকে দেখেনি। না হলে মদখোর বা আদম ব্যবসায়ী যাই হোক একটা কিছু ভেবে কোর্টে চালান করে দিতো। পাপ করেছি তার সাজা তো পেতেই হবে।

কিন্তু এবার যে জিনিশ চেয়েছে আমার সাধ্য নেই দেওয়ার। রাগে দুঃখে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলালাম। না হলে আবার পাগল ভেবে অফিসের সবাই বসের কাছে গিয়ে চাকরিটাই খেয়ে ফেলল। তখন আবার মরণ দশা শুরু হয়ে যাবে। অফিস ছুটির পর বেরিয়ে পরলাম। উদ্দ্যেশ্য নুপুর। আমার অবশ্য ভালই লাগে এর ফাকে বেড়িয়ে নেওয়া যায়। আজকেও তেমনি বেড়িয়ে পরলাম। সাভার থেকে রিক্সা নিয়ে কিছুটা গ্রাম এলাকায় আসলাম। অনেক সুন্দর জায়গা। সাথে অধরা থাকলে খুশি হয়ে যেত। সাথে সাথে মনে পরল আজকে সারাদিন তো অধরাকে ফোন দেওয়া হয়নি। যা মেয়েটা মনে হয় রেগে গেছে আরো। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, একটা বড় পাকুর গাছের নিছে একটা ছোট্ট খুপরির মতো দোকান। খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। পানি পাওয়া যায় কিনা তাই গেলাম। একজন বয়স্ক মতো মানুষ এর সাথে একটা সাত আট বছর বয়সী মেয়ে বসে আছে।

” চাচা পানি পাওয়া যাবে একটু, খুব পিপাসা পেয়েছে।”

” হ পাওয়া যাইব ছার “, মেয়েটি জবাব দিয়ে এক মগ পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেতে খেতে চোখে পরল ঝুরির ভিতরে অনেক কিছু জিনিশ। তার মধ্যে একটা কিছু নীল মতো দেখা যাচ্ছে। আমি পানি খাওয়া শেষ করে মেয়েটিকে বললাম,

” আচ্ছ, ঐ যে নীল মতো কিছু দেখা যাচ্ছে ওইটা একটু দেখাবে। ”

মেয়েটি জিনিশটি বের করে হাতে নিলো। আমি অবাক হয়ে হাতে থাকা জিনিশ টির দিকে তাকিয়ে আছি। একেবারে তাজ্জব বেপার। তা না হলে এই এরকম একটা খুপরি ঘরে আমার কাঙ্ক্ষিত নুপুর পেতে পারি। তড়িঘড়ি করে নুপুরটি হাতে নিলাম। মেয়েটিকে বললাম,

” আচ্ছা, এর আর এক পাটি আছে কি?”

অনেক খুজার পর মেয়েটি বলল,

” না ছার হইব না মনে হয়। হারাই গেছে। ”

আমি মেয়েটিকে এক পাটির দাম সহ একটু বেশি দিয়ে দিলাম। মেয়েটি খুশি হল একটু। ভাবছে পাগল নাকি এই রকম একটা নুপুর এর জন্যে বেশি টাকা দেয়। আমি মনে মনে অনেক পুলকিত অনুভব করছি। অবাক হয়ে নুপুরটার দিকে তাকাচ্ছি। কেমম নীল দ্যুতি ছাড়াচ্ছে কাচের নুপুরটা।

অধরাকে ফোন দেওয়ার জন্যে ফোন বের করব। তার আগেই দেখি অধরার মা আমাকে ফোন দিয়েছে। ফোন ধরে বললাম,

” আন্টি বলুন?”

” বাবা তুমি কোথায় এখন?”

” এইতো আন্টি অফিস ছুটি। আমি একটু বাইরে আছি। কিন্তু কেন?”

” বাবা তুমি একটা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আসো। অধরা হাসপাতালে এক্সিডেন্ট করেছে।”

” আচ্ছ আমি এখুনি আসছি।”

অনেক তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে গেলাম। করিডোর এ অধরার মা দাঁড়িয়ে আছে। ওর বাবাকেও দেখছি।।আমাকে দেখে উনি কেবিনে ঢুকতে বললেন। আমি ঢুকে দেখি অধরা একটা সাধা বিছানায় শুয়ে আছে। পায়ের কাছে সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। আমার পায়ের আওয়াজ শুনে অধরা চোখ খুলে দেখলো। ওর চোখ দিয়ে পানি পরছে। আমি কৌতুকের সুরে বললাম,
” অধরা এবার তো আমার উপরে আর রাগ করতে পারবে না। ”

অধরা চুপ করে আছে। আমি আবার বললাম, ” চুপ করে আছো কেন? তোমার নীল কাচের নুপুর পেয়েছি আমি। ” অধরা চোখ দিয়ে ওর পায়ের দিকে দেখলে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চট করে ওর পায়ের দিকে গেলাম। ও হাত দিয়ে চাদর শক্ত করে ধরে রাখলো। আমি ওর এমন আচরণ এ আরো অবাক হয়ে গেলাম। হাত দিয়ে চাদরটা টানতে গেলে, অধরা কান্না স্বরে না না করতে লাগলো। আমি টান দিয়ে চাদর সরিয়ে দিলাম। আমার পুরো পৃথিবী আন্ধার হয়ে গেলো। আমার সামনে লাল নীল আলো খেলা করতে লাগলো। ধপ করে বসে পরলাম। অধরার কোমল শুভ্র পায়ের বদলে ব্যান্ডেজে মোড়া দেখতে পেলাম। আমার হাত থেকে কাচের নুপুরটি পরে গেলো। অধরাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অধরা কেঁপে কেঁপে কান্না করছে। আমার অধরার পায়ে আর কখনো নুপুর বাজবে না। ও আর কখনো নুপুরের জন্যে বায়না করবে না। আমার গলা কান্নায় গুঁজে আসছে। নুপুরের নীল কাচের পুথি গুলো নুপুর এর সুতো থেকে ছিরে গিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে চারদিকে ছড়িয়ে পরছে। টুংটাং আওয়াজে কেমন বিষাদময় সুর ভেসে আসছে। আমি অধরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছি।

লিখেছেন : মেঘের পরে মেঘ

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত