আশ্বিনের ঘন নীল আকাশে তুলো তুলো মেঘের দিন শেষে কার্তিক পড়লো এই ক’দিন হয়। আজ মোটে কার্তিকের নয় তারিখ, অথচ কী ভীষণ শীতল বাতাস চারদিকে। এবার খুব কনকনে শীত পড়বে বোঝা যাচ্ছে। গত কয়েরক বছরের মতো অল্প দিনেই এবারের শীত বিদায় নেবে না, উত্তুরে হাওয়া যেন আগাম সে খবরটাই পৌঁছে দিতে এসেছে। উঠোনের নাইলনের দড়ি থেকে তুলে আনা ঠাণ্ডা হিম হয়ে যাওয়া কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে শেফালির মনে হয় এবার সত্যি সত্যি মানুষের ‘হাড্ডি ঠকঠক করা’ শীত পড়বে। উঠোনের দড়িতেই মেলে দেয়া ছিল কাপড়গুলো সারাদিন, অবশ্য উঠোন থেকে রোদ চলে গেছে অনেক আগেই, তার উপর শেষ বিকেল থেকেই এই ক’দিনের চেয়েও বেশি করে যেন পৌষের হাওয়া দিচ্ছে আজ। তাতেই কাপড়গুলো নেতিয়ে একসা, কাল আরেকবার রোদে মেলে দিতে হবে সকালবেলায়, না হলে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ হয়ে যাবে নিশ্চিত।
এ বাড়ির উঠোন থেকে রোদ চলে যায় দুপুর থাকতেই। শেফালির মাঝেমাঝে মনে হয় বাড়িটা যেন ছায়ায় ঢেকে থাকার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। উত্তরে-দক্ষিণে দু’সারি লম্বালম্বি ঘর আর তার সামনে টানা বারান্দার এ বাড়ির চৌকো উঠোনটার মাঝ বরাবর একসারি সুপারি গাছ। আর বাড়িটার বাইরেও দু’পাশের ঘরের পেছনে আম-কাঁঠাল আর সুপারি গাছের ঘন ছায়া এ বাড়িতে রোদ টিকতে দেয় না দুপুরের শেষ অবধি। এ বাড়িতে তাই সবসময়েই কেমন একটা ঝিম ধরা শীতল আর স্যঁতসেঁতে ভাব থেকে যায়। এখন, এই ঝিরঝির করা বাতাসে ঘরের একমাত্র জানালাটার সোজাসুজি বসে পুরনো নেতানো কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতে শেফালীর মনে হয় এই শীতে একটা মোটা সোয়েটার না নিলে আর হবে না। ‘হাড্ডি ঠকঠক করা’ শীতে পুরনো পাতলা সোয়েটার আর ছোট চাদরে টিকে থাকা যাবে বলে মনে হয় না। দিদির কাছে চাইবে নাকি একটা মোটা সোয়েটার এবার? থাকলে দিদি দিয়েও দেবে অবশ্য, সে নিয়ে ওর চিন্তা নেই, কোনোরকমে একবার মুখ ফুটে চেয়ে ফেলতে পারলেই হলো।
দিদি মানে মহুয়া, যার বাসায় এই বছরখানেক থেকে শেফালি রোজ সকালে ঘণ্টাদুয়েক ঘরের কাজকর্ম করে দেয়। দিদি নাকি মস্ত অফিসার, সবার কাছ থেকে শোনে ও। অবশ্য দিদি ঠিক কী অফিসার তা জানে না শেফালি। সে শুধু নিয়মমতো দিদির অফিসে যাবার আগে সকাল সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত কাজকর্ম সেরে নিজের চাকরিতে যায়। সকালবেলাটা ওর খুব তাড়াহুড়োয় কাটে সেটা ঠিক তবু হাসপাতালের আয়ার চাকুরিটা ও নিজেও ছাড়তে চায় না। এই চাকুরিই ওকে দুর্দিনে বেঁচে থাকতে দিয়েছে, নাহলে…
আর দিদির বাসার কাজ সেরে হাসপাতালের ডিউটিতে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না- সকালবেলাটা বড্ড ঝক্কির হলেও শেফালি তাই দু’টো কাজই হাতে রেখেছে। তা মহুয়াদিদি অবশ্য লোক খুব ভালো। মেয়ে নিয়ে একলা থাকে শেফালি এই ভাড়ার বস্তিমতো জায়গাটায়, দিদি না থাকলে এতটা স্বস্তিতে থাকা যেত এখানে? আর তাছাড়া ওর প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নিজেই সেধে সেধে টাকাটা, পয়সাটা, আলুটা, মুলোটা থেকে শুরু করে ওর থাকা খাওয়ার অনেক বিষয়ই দেখে দিদি, এজন্য মনে মনে দিদির প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ বোধ করে শেফালি। দিদির কথায় আবারও সোয়েটারের কথাটা মনে পড়ে ওর, নাহ্, মোটা একটা সোয়েটার তার কাছে চাইতেই হবে, নাহলে শীতটা বড় কষ্টে যাবে সত্যি সত্যি।
শেফালির সোয়েটার বিষয়ক ভাবনাটা বেশি এগোতে পারে না কারণ এর মধ্যেই ঘরের পুরনো রঙজ্বলা কাঠের দরজাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে জানিয়ে দিয়েছেু কেউ আসছে ঘরের ভেতর। এ বাড়িটা বাড়িওয়ালা কত আগে বানিয়েছে কে জানে! দরজা-জানালাগুলো কেমন লড়ঝরে হয়ে গেছে, খুলতে গেলেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা বিনে পয়সার বাঁশির মতো বাজবেই। ঘরের সিমেন্টও খসে গেছে জায়গায় জায়গায়। স্যাঁতসেঁতে ভাবটা একারণে আরও বেশি মনে হয়।
দরজার শব্দে শেষ জামাটা ভাঁজ করে উঠে পড়ে ও। হ্যাঁ, কাকলীই এসেছে পিউকে সাথে নিয়ে। কাকলী ওর ছোট বোন। এ সময়ে পিউকে সাথে করে এ বাড়িতে আসাটা কাকলীর প্রাত্যহিক কাজ হয়ে গেছে। ওর কাছেই সকালবেলা পিউকে রেখে যায় শেফালি, সারাদিনের জন্য, সাথে প্লাস্টিকের বক্সে ভরে দেয় খাবারদাবার। কাকলীর কাছে পিউকে রাখা মানে আসলে মা’র কাছেই রাখা। কথাটা যতবার মনে পড়ে, ততবারই নিজের কুণ্ঠা দূর করতে নিজেকেই বেশি করে বিশ্বাস করাতে চায় ও, সরাসরি মা’র কাছে তো আর রাখতে যাচ্ছে না পিউকে। অবশ্য কাকলী হোক বা মা’ই, ও বাড়িতে না পাঠালে পিউকে কোথায়ই বা রাখতে পারে ও সারাদিনের জন্য? আর কোথায় রেখে নিশ্চিন্তে কাজে যাওয়া যায়? নিজে আট-দশ মাস ও বাড়ির পথ না মাড়ালেও তাই সকাল বিকেল কাকলীর কাছে পিউকে বুঝিয়ে দেয়া আর ওর কাছ থেকে বুঝিয়ে নেয়া ছাড়া ওর আর গত্যন্তর নেই।
শেফালি উঠে ঘরের একমাত্র বাতিটা জ্বালে সুইচ টিপে, পিউ ততক্ষণে পায়ের স্যান্ডেল খুলে উঠে পড়েছে চৌকিতে। কাকলীও বসেছে, রোজই বসে, তারপর দু’চারটা কথাবার্তা বলেই চলে যায় ও। আর ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যেটাও রাতের দিকে গুটিগুটি পা বাড়াতে শুরু করে- একান্ত দরকার না হলে শেফালি নিজেও ওকে বসতে বলে না। যা দিনকাল পড়েছে এমনিতে আজকাল! মাঝেমধ্যে খুব গল্প করতে ইচ্ছে করলেও তাই কাকলীকে বেশিক্ষণ থাকতে বলে না ও।
“মা, মা, দিদিমা আইজ মাংস আন্দিছিলো!”- পিউয়ের কথায় দিদিমার রান্না মাংস খেতে পাওয়ার আনন্দ ঝরে পড়ে। তা পড়বারই কথা বটে, শেফালি আর পিউয়ের ক’দিনই বা মাংস খাওয়া হয় আর? কোনো কোনো সময় পুরো মাস মিলেও একবার একটু মাংস খেতে পারা যায় না। বাসা ভাড়া, খাওয়া-পরা, নিজের এটা ওটা খরচ বাদ দিলে যা থাকে, শেফালি তার থেকেই যক্ষের ধনের মতো একটু করে আগলে রাখে সঞ্চয়। তবু আজ পিউয়ের মুখে দিদিমার মাংস রান্নার ঘটনা ওকে তেমন একটা আনন্দ দেয় না। বরং আজ দিদিমার হাতে মাংস খেয়ে মেয়েটা যে হাভাতের মতো খুশি হয়ে গেছে, বিষয়টা ওকে বুঝি একটু বিব্রত করে তোলে কাকলীর সামনে।
“তোর জইন্য যে ডিম ভাজি করি দিলাম তকন”- শেফালির এই ভাষাগত মিশ্রণ আজকাল সহজাত হয়ে গেছে ওর কাছে। ঘরের বিশুদ্ধ আঞ্চলিক ভাষার সাথে বাইরে কাজ করতে গেলে এমন একটা ভাষা তৈরি হয়ে যায় বটে নিজের অজান্তেই। সেই ভাষায় শেফালি পিউকে তিরস্কার করে হঠাৎ, রুক্ষ শুকনো কণ্ঠে।
“আরে ধুর, বাদ দে। ডিম খাইলে কি মাংস খাওয়া যাবার নায় নাকি? এইটা নিয়া ফির কী হইল তোর?”- শেফালির তিরস্কারে কাকলী একটু ক্ষুব্ধ হয়েছে বোঝা যায়। আপাতত ওর কণ্ঠের তাচ্ছিল্য আর বিরক্তিই চুপ করিয়ে দেয় শেফালিকে। শেফালি চুপ মেরে যায়, সামান্য মাংসের ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না ওর। আর তাছাড়া সকাল থেকে সারাদিন এইসব কাজকর্ম করে এসে আর এইসব ছোটখাট দেনদরবার করতে ভালোও লাগে না এখন এই অবেলায়। আরও একটা ব্যাপার আছে, শেফালির হয়ত মনেও হয় দিদিমার রান্না মাংসে পিউয়ের অধিকার এই সাত-আট মাসেই একেবারে নেই হয়ে যায়নি। ও বাড়িতে রোজ যাওয়া যাবে, সারাদিন থাকা যাবে আর দু’টো ভালোমন্দ একেবারেই মুখে তোলা যাবে না, এই বা কেমন কথা?
পিউ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছে, ওর সাড়ে তিন বছরের পিচ্চি শরীরটা এলোমেলোভাবে বিছানার মাঝখানে পড়ে থাকে। মেয়েটার শোয়াটা কেমন যেন, শুয়ে পড়লে একেবারে নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে এমন করেই। কাকলী বসা থেকে উঠে পড়ে এবার, চলে যাবে। কাঠের ঘুণে খাওয়া পুরনো টেবিলের উপর বিছানো কালো-নীল ফুলকাটা টেবিলক্লথ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শেফালির দিকে তাকিয়ে বলে- “শনিবারে মোক দেকির মানুষ আইসপে অমপুর থাকি। পাইরলে আসিস একবার।”
শেফালি উত্তর দেয় না। শনিবার আসতে এখনও বেশ ক’দিন বাকি, আজ মোটে মঙ্গলবার। যে বাড়ি থেকে শেফালি একেবারে বেরিয়ে এসেছে এতদিন হয়, সে বাড়িতে কেবল কাকলীর বিয়ের সম্বন্ধ উপলক্ষ্যে ফেরা যায় কিনা তার উত্তর শেফালির কাছে এই মুহূর্তে নেই। বাইরের ঘনায়মান অন্ধকার আর কুয়াশার পাতলা চাদরের ফাঁক দিয়ে শেফালি কেবল কাকলীর অপসৃয়মান শরীরটার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে।
২
সেদিন ছিল শুক্রবার- শেফালি বেঁচে থাকতে সেই দিনের কথা জীবনেও ভুলবে না। হারামজাদা বদমাশটা সেদিন সাতসকালেই কোথা থেকে এসে হাজির হয়েছিল বাড়িতে। শুক্রবারের ঘুমের আরামটা শেফালি উপভোগ করে খুব- ওইদিন হাসপাতালে ওর ডিউটি নেই, দিদির বাসায় যায় দুপুরে, ওইদিন কেউ ডাকে না শেফালিকে যতক্ষণ ও না ওঠে নিজে থেকে। কাকলী আর শেফালি ও বাড়িতে এক চৌকিতে শুতো, পাশের চিকন চৌকিটায় থাকতো সোহাগ। ওরা অবশ্য শুক্রবারেও উঠে পড়তো সকাল সকাল- উঠবে নাই বা কেন? ওদের তো আর রোজ রোজ সকাল সাতটা থেকেই শরীরের ঘাম ফেলা শুরু হয় না! সেদিনের সেই শুক্রবারের সকালে, পিউয়ের তখনও তিন বছর হয়নি, বুকের কাছে ওর গুটিসুটি করা ছোট্ট শরীরটা আলতো করে জড়িয়ে ঘুমুচ্ছিল শেফালি। জীবনে তখনও আর ছিলই বা কী যা এভাবে উপভোগ করা যেত!
শেফালির বহু আরাধ্য আরামের সেই ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল এক নোংরা স্পর্শে। শরীরের উপর আচমকা হাত পড়ায় ঘুম ভেঙ্গে তড়াক করে উঠে পড়েছিল শেফালি তখন। বদমাশ লোকটার কী সাহস! হারামজাদার বাচ্চাটা কোন সাহসে ঘরে ঢুকেছিল শেফালি ভেবে পায়নি, কোত্থেকে পৌঁছেছিল ও বাড়িতে অত সকালে তা নিয়েও তার মাথায় প্রশ্ন জাগেনি। শুধু সেই স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে রাগে ক্ষোভে ঘেন্নায় চেঁচিয়ে উঠেছিল সকালবেলার পবিত্র নীরবতা ভেদ করে- “শালা হারামখোর, ক্যান ঢুকছিস ঘরে? এক্ষণ বাইর হ!”
বদমাশটাও শেফালির আচরণে ভয় পেয়েছিল মনে হয়, কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল। হাত সরিয়ে নিয়ে ছিটকে সরে গিয়েছিল কয়েক হাত; তবু শুকিয়ে যাওয়া মুখে কোনোরকম শক্তি এনে একটু পরে বলেছিল-“রাগ হচিস, শ্যাপা? রাগ হচিস ক্যানে অত?”
কী দুঃসাহস! শালা কোন মুখে আবার জিজ্ঞেস করে শেফালি রাগ করেছে নাকি তার উপর? ঘেন্নায় এক দলা থুথু ছুঁড়ে দিয়েছিল শেফালি হতবাকে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া রোগা লিকলিকে শরীরটার উপর, লোকটা মনে হয় তখনও ভাবতে পারেনি পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতে পারে। হতভম্ব লোকটার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি শেফালি। গায়ের জোরে থুথু দিতে পেরে কেমন যেন আশ্চর্য শান্ত হয়ে গিয়েছিল ও। তারপর মনোযোগ দিয়েছিল বিছানায় উঠে বসা পিউয়ের উপর, বেচারা সাত সকালেই ঘুম ভেঙ্গে এই পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে একেবারে চুপ তখন। ওকে কোলে নিয়ে খোলা জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে চৌকির উপর বসে পড়েছিল শেফালি, ঘৃণিত লোকটা কখন চলে গিয়েছিল তাও টের পায়নি ও, বোধ ফিরেছিল একেবারে মা’র গলায়। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে কাঠ হয়ে বসে থাকা শেফালির উদ্দেশে উঠোন থেকেই সেদিন চেঁচিয়ে উঠেছিল মা- “হারামজাদী! এত মানুষ মরে, তুই মরিস না! মানুষটাক খ্যাদে দিলু তুই? এত দ্যামাক কীসের তোর, মাগি!”
বিস্ময়ে আরও কাঠ হয়ে গিয়েছিল শেফালি! মা এইসব কথা বলতে পারলো ওকে? যে বদমাশ তার কথা না ভেবে, পিউয়ের কথা না ভেবে আরেকটা বিয়ে করে ঘরে আনতে পেরেছে, যে মানুষটার ঘর সেই ঘটনার পর এক কাপড়ে মেয়েকে নিয়ে ছেড়ে চলে এসেছে শেফালি- সেই মানুষটাকে রাগে, ঘেন্নায় তাড়িয়ে দিয়েছে বলে মা ওকে এইসব বললো? অথচ এই মা-ই তো ওকে থাকতে দিয়েছিল যেদিন এরকমই এক সকালে এক কাপড়ে পিউকে কোলে করে ও ফিরে এসেছিল এ বাড়িতে? সেই মা?
সেই সকালটাই ও বাড়িতে শেষ সকাল ছিল শেফালির, ও বাড়িতে এরপর কোনোদিন সোনারঙ ছড়ানো দুপুর আসেনি ওর জীবনে, মিঠে বাতাসের ঝিরঝিরে বিকেল পেরিয়ে লালের ছোঁয়াচে সন্ধ্যে নামেনি আর। মা’র একটাও কথার উত্তর না দিয়ে নিজের আর পিউয়ের কাপড়চোপড় সস্তার ফুলকাটা ব্যাগে গুছিয়ে বের হয়ে এসেছিল শেফালি, তখনই, পিউকে কোলে করে। মা ডেকেছিল পেছনে অনেক তখন, হয়তো ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিল কী হতে চলেছে- কাকলী, সোহাগ অনেকটা দূর এসেছিল পেছন পেছন; শেফালি ফেরেনি সেদিন, সেদিনের পর ফেরেনি আর কোনোদিনই। পিউকে কোলে করে এক হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে গিয়েছিল দিদির বাসা পর্যন্ত। না, দিদি ওকে ফিরিয়ে দেয়নি সেদিন- পিউকে নিয়েই থাকতে দিয়েছিল সব শুনে। নিজেই কার কার সাথে যেন কথাবার্তা বলে এই বাড়িটা ঠিক করে দিয়েছিল ক’দিন পর।
সে আজ কতদিনের কথা! এখন কার্তিকের শুরু, মানে এ বাড়িতে এসে ওঠারও আট মাস হয়ে এলো প্রায়। ঘুমন্ত পিউকে জড়িয়ে ধরে পাতলা কাঁথাটা ওর গায়ের উপর ভালো করে ছড়িয়ে দেয় শেফালি। আজ কাকলী যেতে বলেছে ও বাড়ি। যাওয়া যায়? মা’র উপর আজকাল অতটা ক্ষোভ নেই আর, বেচারা ওর কষ্ট নিয়েই ভাবতো বেশি আর তাছাড়া তাদের কাছে পুরুষ মানুষের দ্বিতীয় বিয়ে করাটা অতটা দোষেরও নয় হয়তো। না, তবু যাবে না শেফালি। এত দিন হলো কই মা তো একবারও নিতে আসেনি ওকে! জীবন থাকতে আর ও বাড়ি যাবে না কিছুতেই। পিউকে জড়িয়ে ধরে ভালো করে শুয়ে পড়ে শেফালি, শক্ত কাঁথার বিছানাটা কেমন কটকট করে পিঠের নিচে, শেফালি যেন এতদিন পরে অনুভব করে, এবার একটা তোশক না বানালে আর চলছে না কিছুতেই।
৩
অপরিচিত নম্বরটা থেকে শেফালির ফোনে যখন কলটা এলো, তখন ও হাসপাতালের সব টুকটাক কাজ গুছিয়ে ফেলেছে প্রায়। আজ পাঁচটা পার হয়ে গেছে কাজ শেষ করতে করতে। মাঝেমাঝেই যায়, মফস্বল শহরের এই হাসপাতালের ডিউটি এমনিতেও সবসময় ঘড়ির কাঁটার মিনিট, সেকেন্ডের হিসেব অনুযায়ী চলে না অবশ্য। সকালে যেমন আধাঘণ্টা-মিনিট কুড়ি দেরিতে এলেও চলে কোনো কোনো দিন, তেমনি দিনের শেষে কোনো কোনোদিন এরকম দেরি হয়েই যায় বের হতে হতে। অপারেশন রুমের জিনিসপত্রগুলো সব ঠিকঠাক জায়গায় আছে কি না তা শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিলো শেফালি, তখনই কলটা এলো।
অপরিচিত নম্বর দেখে কলটা রিসিভ করবে কি করবে না সে বিষয়ে একটু ভেবে রিসিভ করেই ফেলে ও। ওপাশের চিনতে না পারা কণ্ঠ জিজ্ঞেস করে- “শেপালি বৌদি,দাদা আইজ দুপরোত মরি গেইচে অ্যাকসিডেন করি…”
হড়বড় করে সেই অপরিচিত কণ্ঠ আরও কী কী বলে যায় তারপর শেফালি সব শুনতে পায় না, শোনার মতো কোনো আগ্রহও বোধ করে না। সেই কণ্ঠটা কার, কে আজ এতদিন পর ওকে ‘বৌদি’ ডেকে দাদার মৃত্যুসংবাদ দেয়ার জন্য কল করেছে তাও জানার কোনো আগ্রহ আসে না ভেতর থেকে। ওপাশের কণ্ঠটার শেষ না হওয়া কথার মাঝখানেই শেফালি লাইনটা কেটে দেয় ওর মোবাইল ফোনটার বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া লাল বাটন চেপে, রঙ ওঠা শ্যাওলামতো রেক্সিনের ভ্যানিটি ব্যাগটায় রেখে দেয়। কী অ্যাকসিডেন্টে অপরিচিত কণ্ঠস্বরের ‘দাদা’ মরেছে তাও জানতে ইচ্ছে হয় না ওর। আর তারপরই অবাক বিস্ময়ে ও খেয়াল করে এই মৃত্যুসংবাদ ওর মনে কোনো ভাবান্তরই ঘটায়নি। যে মানুষটার ঘর ও ঘেন্নায় ছেড়ে এসেছে অনেকদিন হয়, সে মানুষটার সমস্ত সত্ত্বারই মৃত্যু ঘটে গেছে ওর কাছে চুপিসারে কবে কখন, তার খোঁজও ও রাখেনি কোনোদিন। আজ হঠাৎ আসা এই ফোনকলে সেই অমোঘ সত্যটা যেন একেবারে মূর্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আজ, এই শেষ বিকেলের ঠাণ্ডা কংক্রিট ঘরে দাঁড়িয়ে শেফালি বুঝে যায়, সেই মানুষটা ওর কাছে মরে গেছে কোনো একদিন, নিজের অজান্তেই। এমনকী সেই লিকলিকে রোগা চেহারার ঘৃণিত মৃত মানুষটার জন্য আজ সামান্য পরিচিতের অনুকম্পাও বোধ করে না শেফালি। অপারেশন রুমের চারপাশে আরেকবার চোখ বুলিয়ে ও বের হয়ে আসে বাইরে।
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শেফালির মনে হয় ও আজ জন্মের মতো নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে। নিজেকে অনেক নির্ভার লাগে ওর, অনেক বেশি হালকা মনে হয়; পাখির মতো কিংবা না, না, আরও হালকা, গরমের দিনে ঘাসের উপর, পাতার উপর উড়ে বেড়ানো লাল-নীল ফড়িংয়ের মতো হালকা। অসহ্য প্রতারণা করা একটা মানুষের নোংরা হাত আর কোনোদিন কোনোখানে দুঃস্বপ্নেও ওকে ছুঁতে পারবে না, এই ভাবনাটাই ওকে এই ফড়িং-অনুভূতি এনে দেয়।
প্রায় সময়েই বাড়ি ফেরার পথে ভ্যানে করে ফেরে শেফালি, ওদের এই ছোট্ট গ্রাম-গ্রাম শহরটায় রিকশা কম, ভ্যানেই চলাচল বেশি সবার। আজ এই পরিচিত পথে ওর হাঁটতে ইচ্ছে করে খুব। বাসরাস্তাটার পাশ দিয়ে সবুজ ঘাস আর মাটির রাস্তা ধরে শেফালির হাঁটতে খুব ভালো লাগে আজ। বাস-ট্রাক-মোটরবাইক-রিকশা-ভ্যানের শব্দ ছাপিয়ে শেফালির হাঁটাপথে কোথাও যেন খুব মিহিসুরে কোনো গান বেজে ওঠে, পথচলতি মানুষের কথাবার্তার টুকরোটাকরা শব্দও আজ ওর পাশ কাটিয়ে চলে যায়। শেফালির মনে হয়, এমন করে স্বস্তির শ্বাস ও এই জীবনে কোনোদিন নিতে পারেনি।
বাসরাস্তার পর ছোট গলিপথ পেরিয়ে বাড়ির উঠোনে এসে থমকে দাঁড়ায় শেফালি। ওর ঘরের সামনের টানা বারান্দাটায় পিউ আর কাকলী দাঁড়িয়ে আছে, আজ বেশ আগেই এসে পৌঁছেছে ওরা; কিন্তু না, ওদের দেখে থমকায়নি ও। কাকলীর পেছনে শেফালি এখান থেকেই দেখতে পেয়েছে মাকে। কতদিন পর! মা? সত্যি সত্যি? শেফালির ধন্ধ কেটে গেলে মা’র চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মা কত শুকিয়ে গেছে না আগের চেয়েও? কালচে খয়েরি রঙের উপর নীল ছাপার শাড়িতে মাকে কি আরও বেশি বিষন্ন দেখায়?
আস্তে-ধীরে শেফালি উঠোনটুকু পার হয়। এইটুকু উঠোন পেরোতেই ওর যেন কেটে যায় আলোকবর্ষ সময়। মা এবার এগিয়ে আসে ওর দিকে, আগের মতোই। কে জানে, মাঝখানে এতদিনের অদর্শন মা ভুলেই গেছে হয়তো, আস্তে-ধীরেই মা ওকে বলে- “আইতোত কাকলীক দেকির আইসপে মানুষ। বাড়ি চল।”
শেফালির মনে হয়, মা’র সাথে ওর এই মুখ না দেখাদেখি কোনোকালেই ছিল না। মা’র কণ্ঠ তো সেই আগের মতোই আছে এখনও, ওরকমই ধীর, শান্ত আর শুকনো; বদলায়নি একটুও। কুয়াশা ঘিরে আসতে থাকা সন্ধ্যেটায় মা’র মুখোমুখি দাঁড়িয়েও শেফালির মনে হয়, মাঝখানে এতগুলো মাস পেরিয়ে কার্তিক আসেইনি পৃথিবীতে।
বাইরে তখন প্রথম কার্তিকের অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে, আগাম শীতের কুয়াশার পাতলা চাদরেও ঘন বুনোটের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। ক্ষীণ হয়ে যাওয়া আলোতে মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে শেফালির মনে হয়, পৃথিবীর কোনো মা’ই বোধহয় শেষপর্যন্ত অত খারাপ হয় না…