রুমকি বলল, ‘তুমি একটা আস্ত গাঁইয়া।’
কথাটা সে আগেও বলেছে, প্রায়ই বলে, আমি কিছু মনে করি না। কিন্তু সেদিন মেজাজটা সত্যি চড়ে গিয়েছিল। বললাম, ‘কেন? গাঁইয়া কেন? তোমার উপকার করলাম, সেটা অন্যায় হয়ে গেল?’
‘উপকার তো করেছ, কিন্তু শেষে ওই যে কথাটা বললে, সেটা বাংলা সিনেমার ডায়ালগের মতো হয়ে গেল না?’
‘হ্যাঁ, তা একটু হয়েছে, তবে এ ছাড়া আর কী উপায় ছিল?’
ঘটনাটা খুলে বলি—কয়েক দিন ধরে রুমকিকে একটা ছেলে উত্ত্যক্ত করছিল। কলেজগেটে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, গাড়ি থেকে নামলেই কেমন ইশারা করে, ফোন নম্বর জানতে চায় ইত্যাদি। রুমকিই আমাকে জানিয়েছিল এসব কথা। বলেছিল, ‘একদিন তুমি আমার সঙ্গে যাবে?’
আমি রাজি। গেলাম। মোটরসাইকেলে বসা রোদচশমাপরা ছেলেটাকে ভিলেনের মতো মনে হয়েছিল দেখতে। সোজা সামনে গিয়ে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে বললাম, ‘মেয়েদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে মাস্তানি করা ছাড়ো, নইলে…।’
ছেলেটা অবাক, আমার পেছনে দাঁড়ানো রুমকিকে দেখে বলল, ‘আপনি কেন…ও আপনার কী?’
তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আমি বলেছি, ‘ও আমার প্রিয়তমা।’
সংঘর্ষের একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কী বুঝে ছেলেটি কথা বাড়াল না। হঠাৎ মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে হুশ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বিজয়ীর দৃঢ়তায় রুমকিকে বললাম, ‘দেখো, ও আর কোনো দিন আসবে না।’
তখনই রুমকি বলল কথাটি, ‘গাঁইয়া’। উপকারের এই প্রতিদান!
আমি গ্রাম থেকে এসেছি। উচ্চমাধ্যমিকে রীতিমতো ভালো রেজাল্ট করে সুযোগ পেয়েছি মেডিকেল কলেজে পড়ার। হোস্টেলে সিট না পাওয়া পর্যন্ত মেসে থাকব ঠিক করেছিলাম। এমনকি হোটেলের একটি রুম নিয়েও থাকতে পারতাম। ছেলের জন্য খরচ করার মতো যথেষ্ট টাকা-কড়ি আছে বাবার। কিন্তু রহমান সাহেব, আমার দূরসম্পর্কের চাচা বাবাকে বলেছিলেন, ‘আমার এত বড় বাড়ি, বউ-বাচ্চা নিয়ে মোটে তিনজনের সংসার, ছেলেটা এখানেই থাকুক।’
সেই থেকে থাকা। আমি নরম মনের মানুষ। রুমকিকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। ‘এ’ লেভেলের ছাত্রীটি ঘরে স্কার্ট-টপ্স অথবা হাঁটু দৈর্ঘ্যের জিনসের ট্রাউজার আর স্লিভলেস টি-শার্ট পরে থাকে। বাদামি কটা চোখ, গোলগাল ফরসা মুখ আর পিঠ পর্যন্ত সোজা ঝরঝরে চুল—সব মিলিয়ে একটা আদুরে বেড়ালের মতো।
রুমকি কিন্তু শুরুতে একেবারেই পাত্তা দিত না আমাকে। কেমন একটু অবজ্ঞার ভাব ছিল চেহারায়। ওর এমন আচরণের কারণে এ বাড়ি ছাড়ার কথা ভেবেছি অনেকবার। ও কি আমাকে আশ্রিত ভেবেছে!
কিন্তু এর মধ্যে কয়েকবার আমার কাছে অঙ্ক বুঝতে এসে একটু সমীহের ভাব তৈরি হয়েছে। আমি ইংরেজিতে ভালো, কিন্তু রুমকির মতো ইংরেজিতে ফুটফাট কথা বলতে পারি না। এখন ওকে আমি অঙ্ক করাই, ও আমাকে কম্পিউটার শেখায়। আমি দ্রুত কম্পিউটার শিখি, কিন্তু রুমকির মাথা মোটা, সহজে অঙ্ক বোঝে না। বোঝে না যে তা নিয়ে কোনো সংকোচ আছে বলেও মনে হয় না, উল্টো কথায় কথায় আমাকে ডাকে গাঁইয়া। আসলে বাবা-মায়ের প্রশ্রয়ে মেয়েটার এ অবস্থা। তাঁরা আমাকে বলেন, ‘ওর কথায় কিছু মনে কোরো না, বাবা। ছেলেমানুষ…।’ এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে ছেলেমানুষ! শুনে আমার গা জ্বলে, আবার হাসিও পায়।
দিনের অর্ধেক সময় ইংরেজি ছবি দেখে রুমকি। আমাকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, লেওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর কথা বলে। এসব ছবি আমি দেখি না। আমি বাংলা ছবির ভক্ত। গ্রামে পূবালী সিনেমা হলে নতুন ছবি এলেই বন্ধুদের নিয়ে দেখতে যেতাম। আমি রুমকিকে অপু-শাকিব খান, পূর্ণিমা-রিয়াজের কথা বলি। ও শুনে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে। করে বটে, আবার আমার কাছে বাংলা ছবির গল্প শুনতে আসে। আমি শহুরে ধনীর দুলালি অপুর সঙ্গে গ্রামের সহজ-সরল শাকিব খানের প্রেমের গল্প বলি। শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে রুমকি। বলে, ‘ফানি, অ্যাবসার্ড!’ আমি মিইয়ে যাই।
কয়েক দিন ধরে রুমকিকে কেমন উসখুস দেখাচ্ছে। কেমন জানি আনমনা। আমার বাংলা ছবির অভিজ্ঞতা বলে, মেয়েটা প্রেমে পড়েছে। আমার খুব ভয় হয়। এখন তো ওর ভুলের বয়স, ভুল করে রাংতাকে রুপো ভাবছে না তো মেয়েটা! খুব জানতে ইচ্ছে করে ছেলেটা কে। কিন্তু গেঁয়ো ভাববে বলে সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারি না।
সেদিন ছুটির দিন ছিল। রুমকি পিকনিকে গেছে কলেজ থেকে। আমি একা কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে আমার রুমে ফেলে যাওয়া ওর ল্যাপটপটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছি। এত বেখেয়ালি মেয়ে, পাসওয়ার্ড দিয়ে যায়নি। কী এক কৌতূহলে (এটা সত্যিকারের গ্রাম্যতা) রুমকির ‘মাই কম্পিউটারে’ ঢুকে পড়লাম। চোখ বুলোতে গিয়ে হঠাৎ ডি-ড্রাইভে ‘মাই লাভ’ নামের একটি ফাইল দেখে কৌতূহল পৌঁছাল চরমে। যা ভেবেছিলাম তা-ই। রুমকি এখানে লিখে রেখেছে অনেক আবেগ-অনুভূতির কথা। কার উদ্দেশে যেন লিখেছে গভীর প্রেমের আকুতি। ভাবছি, ছেলেটা কে? আরও একটু এগিয়ে চমকে উঠলাম হঠাৎ। রুমকি লিখেছে, ‘অল আর হিপোক্রিট অ্যারাউন্ড মি, ইউ আর ওনলি দ্য একসেপশন। দ্যাট ডে ইউ কল্ড মি প্রিয়তমা। ডিড ইউ মিন ইট? আই লাভ ইউ, গাঁইয়া…।’
মেয়েটা প্রেমে পড়েছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী বোকা আমি! অ্যাঞ্জেলিনা জোলি যে শাকিব খানের প্রেমে পড়েছে বুঝতে পারিনি।
লেখাপড়া মাথায় উঠল। রাতে ঘুম হয় না। এর মধ্যে হলে সিট বরাদ্দ হয়েছে আমার নামে। এখান থেকে আপাতত না পালালে পরীক্ষা পাসের যে কোনো আশা নেই, তা তো নিশ্চিত। চাচা-চাচিকে বললাম। তাঁরা রাজি হলেন দোনামনা করে। রুমকিকে বলতেই দেখলাম তার চোখে পানি। নায়িকার সেই অশ্রুবিন্দু দেখে আবার শাকিব খান জেগে উঠল আমার ভেতর। বললাম, ‘যত দূরেই যাই, তুমি আমার মনের কাছেই থাকবে, প্রিয়তমা।’
আমার হাত চেপে ধরে ভেজা চোখ তুলে রুমকি বলল,‘গাঁইয়া।’
লিখেছেন – বিশ্বজিৎ চৌধুরী |