কিছুটা আবেগ আর বাকিটা শুধুই ভালবাসা

কিছুটা আবেগ আর বাকিটা শুধুই ভালবাসা

“This was just meant to be,
You are coming back to me,
Cause, this is pure Love,
Cause, this is pure Love….”

প্রায় আধঘন্টা যাবত্‍ মোবাইলটা বেঁজেই চলেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ফোনদাতা নিজেই বিরক্ত হয়ে ফোন দেয়া বন্ধ করে দিবে। তাই এতোক্ষণ সেদিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ না করে সাত সকালের আরামের ঘুমটাকে হারাম করতে চাই নি। কিন্তু হয়তো আজ বিরক্ত হওয়ার দায়িত্বটা আমারই উপর ন্যস্ত। এমনিতেই রাত সারে ৩ টায় ঘুমিয়েছি তার উপরে সকাল ৭ টায় এই অনাকাঙ্খিত ফোন।

বালিশের নিচে এক চোখ বন্ধ রেখে আরেকটা চোখ মিটমিট করে খোললাম। কিছুক্ষণ এলোপাথারি হাতড়িয়ে মোবাইলটা খুঁজে তার স্ক্রিনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অবাক না হয়ে পারলাম না।

‘Nodi Calling. . .’

এই মেয়ের তো আমাকে জীবনেও আর ফোন করার কথা না। কারণ গতকাল সে নিজেই আমার সাথে ঝগড়া করে এই উক্তি প্রদান করেছে। অবশ্য তার কথার মর্যাদা সে কখনোই রাখতে পারে নি। বিশেষ করে আমার সাথে দৈনিক ঝগড়ার পর যেগুলা ব্যাক্ত করে সেগুলা তো কখনোই না।

ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে,

– কিরে গাধা! ফোন ধরিস না কেন? মোবাইলটা কি স্যুকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য কিনেছিস নাকি! গাধা কোথাকার…
– না মানে আমি….
– আরে রাখ তোর আমি! আচ্ছা ঈষাম তুই কই রে? এক্ষণি শাহবাগে আয় তো একটু। ১৫ মিনিটের ভেতর।
– ধুর! আমি পারবো না। আমি এখন ঘুমাইতেছি। তুই ফোন রাখ তো। ডিস্টার্ব করিস না।

– কি বললি? তুই যদি এক্ষণই না আসিস তাহলে তোর সামিয়ার কাছে বলে দিব যে তার আগে তোর কয়টা প্রেমিকা ছিল। তখন বুঝবি ঠ্যালা!

টুট টুট! টুট টুট!

আমি আর কিছু বলার আগেই নদী ফোনটা কেঁটে দিল। তার শেষ হুমকির কথা শুনেই আমার ঘুম কোথায় যে পালালো তা নিজেও বুঝতে পারি নি। নদীকে আমি প্রায় ৩ বছর ধরে চিনি। আমরা একই ভার্সিটিতে একই ক্লাসে পড়ি। কয়েকদিন আগে এক ছেলে তাকে প্রপোজ করেছিল বলে ঐ ছেলেকে ডাইরেক্ট কানেগালে থাপ্পড় মেরে বসেছিল। এই বিদঘুটে স্বভাবের জন্যে তার কোন বন্ধুও নেই। কিন্তু আমি কিভাবে যে তার এতো ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। এই মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। নিজেও প্রেম করবে না আবার আমাকেও করতে দিবে না। যা ও বহুদিন পরে একটা প্রেমিকা কপালে জুটেছে সেটাও হাড়াতে হবে যদি তার কথা মত এখনি শাহবাগে না যাই। অগত্য আর কোন পথ না দেখে প্রিয় বিছানাটা ছাড়তেই হলো আমাকে।

শাহবাগের ফুল দোকান গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় ২০ মিনিটের মতো হতে চললো। কিন্তু মহারাণীর আসবার কোন নাম গন্ধই নেই। এমন জানলে আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আসা যেতো। ক্ষানিকটা হতাশা এবং অনেক গুলো বিরক্তি নিয়ে নিজেই নিজের কপাল কুঁচকাতে লাগলাম। ঠিক এই মুহূর্তে একটা রিকশা এসে থামলো ডান পাশে। চোখ উঠিয়ে নদীকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই বিরক্তির হার বেড়ে গেল আরো কয়েক গুণ। কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছু বলার আগেই সে বলে উঠলো,

– কিরে! এভাবে রোদে দাড়িয়ে আছিস কেন? একটু ছায়ায় দাড়ানো যায় না? রোদে পুড়ে কাল হয়ে গেলে তো তোর প্রেমিকা তোকে ছেড়ে চলে যাবে।

– ছেড়ে গেলে সমস্যা কি? তুই তো আছিস ই! তোকেই না হয় প্রেমিকা বানিয়ে নিবো।
– এহ! আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নাই তো যে একটা বান্দরকে ঘাড়ে চড়িয়ে বাকি জীবনটা বরবাদ করবো!
– থাক আমার আম্মা! তোকে আমার প্রেমিকা হতে হবে না। মাফ কর আমাকে।
– আগে দুই পায়ে ধরে মাফ চাও বাছা। তারপর দেখি মাফ করা যায় কিনা!

এই বলে নদী তার দুই পা সত্যি সত্যি বাড়িয়ে দিল। তার চোখে মুখে শয়তানি হাসির স্পষ্ট ছাপ এবং আমার মুখে আবার বিরক্তি রেখা।

কিছুক্ষণ পরে নদীই আবার নিরবতা ভাঙ্গলো,

– আচ্ছা বাদ দে। চল আমার সাথে। অনেক গুলা ফুল কিনতে হবে।
– হঠাত্‍ ফুল দিয়ে কি করবি? তোর বাসর ঘর সাজাবি নাকি? তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে এইটা আমাকে বললি ও না?
– ধুর! ফাজলামো রাখ তো। ভার্সিটির একটা অনুষ্ঠানের স্ট্যাজ সাজাতে হবে। তাই ফুল দরকার।

আর কোন কথা না বাড়িয়ে হাঁটা ধরলাম নদীর পিছে পিছে ফুল দোকানের দিকে। প্রায় দুই ঘন্টা লাগিয়ে তাকে ফুল কেনায় সাহায্য করে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরলাম সেদিনের মতো।

প্রায় দুইদিনের মতো হয়ে গেলো সামিয়ার মোবাইল বন্ধ। সব সময় ঝগড়া হলেই এই মেয়েটা তার মোবাইল বন্ধ করে রাখে। হয়তো এইটা তার একটা জন্মগত বদ অভ্যাস। মেয়েটাকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই ভাল লেগে গিয়েছিল। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তাকে প্রেম নিবেদন করে ফেলি। বলতে গেলে সাথে সাথেই মিশন সাকসেসফুল। অন্যান্য মেয়েদের মতো আমার সাথে কোন প্রকার ভাব নেয়ার অভিনয় করেনি সে।

মেয়ে হিসেবে একটু পিছিয়ে পরলেও প্রেমিকা হিসেবে সামিয়া ১১০% পারফেক্ট। কারণ নিজের প্রেমিকের পকেট কতো পর্যায়ে ফাঁকা করা যায় সেটা হয়তো তার থেকে ভাল আর কারো জানা নেই। বলাই বাহুল্য যে আমাদের সর্বশেষ ঝগড়াটা এই বিষয়টা নিয়েই হয়েছিল।

বিকাল গড়িয়ে অস্তমিত সূর্যাস্থ সন্ধ্যা আগমনের বার্তা পৌছিয়ে দিচ্ছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। লাল গোলাকার সূর্য্যটাকে এই সময়ে ডিমের কুসুমের মতো লাগে আমার কাছে। হয়তো ডিম খেতে ভাল লাগে বলেই এমনটা মনে হয়।

‘অস্তমিত সূর্য্য তুমি নিচ্ছ কেন ডিমের মতো সাজ…

তোমায় দেখে ক্ষিদের রাজ্যে খুব একলা আমি আজ…’

নাহ! এই কবিতা আর বেশি দূর আগানো ঠিক হবে না। নাহলে এইটা পড়ে কোন সময় কোন দিক দিয়ে কবি সমাজ আমাকে আক্রমণ করে বসে তার ঠিক ঠিকানা নেই।

ভাবনার রাজ্যে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। হঠাত্‍ মোবাইলে রিংটোনে সেই চিরচেনা প্রিয় গানটা বেঁজে উঠলো।

নদী কল করেছে। সবুজ বোতামে চাপ দিয়ে ‘হ্যালো’ বলার পর আর একটা কথাও মুখ দিয়ে বেড় হয়নি। কারণ নদী যা বলেছে তাতে নিজের কানটাকেই অবিশ্বাস্য লাগছিল।

কাল বিলম্ব না করে সরাসরি ঘর থেকে বেড়িয়ে পরলাম। উদ্দেশ্য কেএফসি,ধানমন্ডি। প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় পৌছে গেলাম গন্তব্যে। বাইরে নদী দাড়িয়ে। তাকে সাথে নিয়ে ঢুকে পরলাম ভেতরে। কিন্তু যা দেখলাম তাতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। নদী যা বলেছিল সব সত্য।

সামিয়া একদিকে আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কথা বলে না আর অন্যদিকে এখানে আরেক ছেলের সাথে ডেটিং মারছে। মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল।একটা পুরুনো কথা মনে পরে গেল হঠাত্‍। সামিয়া একদিন কথার ছলে বলেছিল যে তার পিঠে ঠিক মাঝ বরাবর একটা তিল রয়েছে। নিজের মেজাজ ঠান্ডা করার বুদ্ধিটা বেড় করতে খুব একটা দেড়ি হলো না আমার।

হনহন করে হেঁটে বিদ্যুত্‍ বেগে চলে গেলাম তাদের টেবিলের সামনে। আমার দিকে তাকাতেই সামিয়ার চোখ গুলি বড় বড় হয়ে গেল। তার এই অবাক দৃষ্টিতে তাকে খুব অদ্ভুত লাগছিলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি বলে উঠলাম,

‘আরে সামিয়া। তুমি এখানে! আর তোমার সাথে এইটা কে? নতুন প্রেমিক বুঝি? এতো জলদি আমাকে ভুলে গেলে? আমিতো তোমাকে এখনো ভুলতেই পারি নি। তোমার পিঠের মাঝ বরাবর যে তিলটা আছে নাহ! ঐটা আমাকে এখনো তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়।’

বলেই তার পাশের ছেলেটার দিকে একটা কপট হাসি প্রদান করে নদীকে নিয়ে বেড় হয়ে গেলাম সেখান থেকে।

ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে আছি আমি আর নদী। চাঁদের আলোটা ঠিক মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে। এই চাঁদকে নিয়ে কতো কবি কতো কবিতা লেখে। মাঝে মাঝে আমারও লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন জানি এই চাঁদটাকে একটা মস্ত বড় গোল বাংলা সাবান ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না আমার কাছে।

পকেট থেকে সদ্য কেনা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিতেই বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।

প্রায় ৩ মাস পর সিগারেট টানছি। কারণ এতোদিন সামিয়ার বারন ছিল সিগারেট খাওয়াতে। সামিয়ার কথা মনে হতেই মেজাজটা আবার খিট খিটে হয়ে গেলে। সিগারেটে আরেকটা টান দিতেই নদী নিরবতা ভাঙ্গলো।

– আচ্ছা ঈষাম,এইটা তোর কয় নাম্বার রে?

নদীর দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

– কিসের কয় নাম্বার?
– মানে এইটা তোর কয় নাম্বার ছ্যাকা?

বলেই নদী মুচকি হাসা শুরু করলো। এমনিতেই মেজাজ খারাপ তার উপরে সে আমার সাথে ফাজলামো করছে। অগ্নিচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তাতে কোন কাজ হলো বলে মনে হলো না। তার মুচকি হাসা এবার অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হলো।

নদীর হাসি মুখ দেখে আমার সব রাগ নিমিষেই বিলীন। আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। জ্যোত্‍স্নার আবছা আলো গাছের পাতার ফাঁক ডিঙ্গিয়ে তার চোখে মুখে এসে পরছে। তাতেই নদীকে এক অচীনপুরের পরীর মতো স্নিগ্ধ লাগছে। এই স্নিগ্ধতা তার চারপাশে সৃষ্টি করে এক মায়া। আর এই মায়া থেকেই জন্ম নেয় সুদ্ধ ভালবাসার অনুভূতি। যে অনুভূতি শুধুই কাছে টানে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুটি হৃদয়কে অচেনা এবং অজানাতে।

হঠাত্‍ করে সবচেয়ে চেনা মানুষটাকে খুব অচেনা লাগছে আজ। এতো বছরের পরিচয়টা কি তাহলে কপটতায় ছিল ভরা! নতুন করে নতুন আবেগে আজ নদীকে আবার জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে কি মেনে নিবে আমার এই নতুনত্বকে!

মনের ভেতর যখন এই সংশয়ের পেন্ডুলাম এদিক উদিক দুলছিল তখনি নদীর কথায় সম্ভিত ফিরে পাই।

– কিরে এভাবে কি দেখছিস?
– তোকে দেখছি।
– আমাকে দেখার কি আছে? আমাকে তো প্রতিদিনই দেখিস!
– আজ অন্যভাবে দেখছি। অন্য এক মায়ায়।

তারপর ক্ষাণিকের নিরবতা। চাঁদের নিয়ন আলো লেকের জলে পরছে। সেই আলো জলের উপর এক রূপালী প্রলেপ সৃষ্টি করেছে। নদী এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকে আর আমি তার দিকে। হঠাত্‍ নিরবতা ভাঙ্গি আমি নিজেই।

– তুই আমাকে অনেক ভালবাসিস। তাই না?

সাথে সাথেই নদীর ভেতর এক ধরণের পরিবর্তন লক্ষ করি। সে ক্ষাণিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে।

– কে বলেছে তোকে?

– আমি জানি। তুই আমাকে ভাল না বাসলে আমার আগের সব প্রেমিকাদের ব্যাপারে এতো তথ্য যোগার করতি না। তারা খারাপ কি ভাল তাতে তোর কোন বিকার থাকতো না।

– ফালতু কথা বাদ দিয়ে চল যাই। অনেক রাত হয়েছে।

সে উঠার চেষ্টা করতেই আমি তার হাত ধরে আবার বসিয়ে দেই।

– আগে বলে যা তুই আমাকে ভালবাসিস কি না।
– আমি জানি না।
– বল না প্লিজ। তোকে আমার দোহাই লাগে।

নদী এবার নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পরেই তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল নেমে আসে। জীবনে এই প্রথম আমি তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমার প্রশ্নের জবাব সে চোখের জলে দিয়ে দিয়েছে।

আমি ডান হাত বাড়িয়ে নদীর বাম হাতটা ধরি আলতো করে। এক অজানা ভাল লাগা ছুঁয়ে যায় আমাকে। নদী আমার কাঁধে মাথা রাখে পরম ভালবাসায়। এই জ্যোত্‍স্না স্নাত রাতে শুরু হয় একটি ভালবাসার নতুন অধ্যায়। যাতে আছে কিছুটা আবেগ আর বাকিটা শুধুই ভালবাসা……

লেখক, ঈষাম আরমান

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত