শঙ্খমোচড়

শঙ্খমোচড়

এক,

শাকুর আলী আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছে মনে করতে পারলো না। তার বিশ বছরের ঠিকাদারি জীবনে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটে নাই। কোথাকার কোন পুঁচকে ইঞ্জিনিয়ার তাকে সাপের পাঁচ পা দেখায়! বলে কিনা কীসের কী স্লাম্প না মাম্প টেস্ট করতে হবে! হুম, এমন কতো ইঞ্জিনিয়ার সে চরিয়ে খেলো! আজ এসেছে তার কাছে জ্ঞান জাহির করতে। পকেটে বাণ্ডিল মনে হয় কিছু কম পড়েছে তাই এতো ফপর দালালি। মুখ ভর্তি করে একদলা থু থু ফেলে বিড়বিড় করে গালি দেয় অদৃশ্য কাউকে লক্ষ্য করে। ভাদ্রের চিড়বিড়ানি রোদে মেজাজের পারদও চরচর করে উপরে উঠতে থাকে।
তিরিক্ষি মেজাজে কুদ্দুসকে ডেকে পাঠায় শাকুর আলী। কুদ্দুস তার নির্মাণ গ্রুপের প্রধান রাজমিস্ত্রী। এই দীর্ঘ সময়ের পথচলায় কুদ্দুস ছিল বলেই সে সব যাত্রা উতরে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার বেশি দরের সিমেণ্ট বা রড কিনতে বলেছে কিংবা কাঁচামালের বাজার দর বেড়ে গেছে, শাকুর আলীর মাথায় হাত। কুদ্দুস কেমন কেমন করে যেনো সব ঠিক করে ফেলে। কীভাবে ইঞ্জিনিয়ারকে ঠাণ্ডা করতে হবে বা কোন মিশ্রণে কতটুকু সিমেন্ট আর খোয়া মেশালে বাজার দর নিয়ে ভাবতে হবে না, এটা ঠিক করা কুদ্দুসের দু’মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু এই যাত্রায় মনে হয় পার পাওয়া যাবে না। এই নতুন ইঞ্জিনিয়ার মহা ঘোঁড়েল। ব্যাটা সততার লেবেল এঁটেছে গায়ে। কুদ্দুসও এর সাথে বিশেষ সুবিধা করতে পারছে না। এখন এই স্লাম্প টেস্টের জিনিসপাতি আছে না বানাতে হবে কে জানে!
‘সাব, কুদ্দুস ভাই নাই। হ্যার মার অসুক। বাড়িত গ্যাছে।’
বিরক্ত মুখে উত্তরদাত্রীর মুখের দিকে চাইতেই মেজাজটা প্রসন্ন হয়ে গেল শাকুর আলীর। আহ্‌, কী কচি মুখটা! বড় বড় চোখ দুটিতে এখনো বিস্মিত হওয়ার অভ্যেসটা যায়নি। পরনে আধাময়লা এক ছেঁড়া শাড়ি। কাজ করার সুবিধার জন্য শাড়িটা আটোসাঁটো করে শরীরের সাথে বেঁধে নিয়েছে। তাতে শরীরের জোয়ার যেন বাঁধ মানছে না। চটচটে গরমে সেটা আবার ঘামে মাখামাখি হয়ে একেবারে লেপ্টে আছে শরীরে। সিমেন্ট খোয়ার মশলা বইবার কাজ তো আর আরামের কাজ না। পুরুষলোকের সাথে হাত মিলিয়ে সমান তালে করতে হয়। এরা অস্থায়ী শ্রমিক। টুকরি গুনে দিনশেষে টাকা পায়। লোলুপ চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেয়েটাকে খানিকক্ষণ গিলে খেলো শাকুর আলী। চোখের চাউনিতে দিশেহারা হয়ে মেয়েটা কিছু সময় ছেঁড়া শাড়িটাকে অসহায় ভাবে টানাটানি করলো। তাতে লাভের লাভ এই হলো, শাড়িটা আরো খানিকটা স্থানচ্যুত হয়ে গেলো আর শাকুর আলীর চোখ একেবারে কোটর খুলে বের হয়ে আসতে চাইলো।
‘ঐ সালমা, অনে খাড়াইয়া থাগলে অইবো? টুগরি ভর তাড়াতাড়ি।’
‘আইতাছি।’ মেয়েটা আর দাঁড়ায় না। পালিয়ে বাঁচে।
নতুন কাজে যোগ দিয়েছে মেয়েটা। কুদ্দুসই মাস তিনেক আগে কোত্থেকে যেন নিয়ে এসেছে। সাথে একটা দেড় দুই বছরের বাচ্চাও ছিল। বাচ্চাসহ কাউকে কাজে রাখবে না আগেই বলেছিল শাকুর আলী। তবু কুদ্দুসের জোরাজুরিতে মেয়েটাকে দেখতে চেয়েছিল। দেখার পরে আর না করেনি। সেইদিন থেকেই মেয়েটার দিকে চোখ দিয়ে রেখেছে সে। সদ্য গ্রাম থেকে আসা মেয়ে। হয়তো স্বামী ছেড়েছুড়ে দিয়েছে, পেটের দায়ে ঢাকা শহরে চলে এসেছে। এদের পটানো কঠিন কিছু নয়। সুযোগমতো একটু মিষ্টি কথা বললেই মোমের মতো গলে যাবে।
শাকুর আলীর চরিত্র দোষ আগে ছিল না। তিন সন্তানের জনক সে। বড়টার বয়স পনেরো বছর। বছর পাঁচেক আগে স্ত্রী হঠাৎ পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে একেবারে শয্যাশায়ী। তার দেখাশোনার জন্য একজন নার্স রাখতে হয়েছে। সেই নার্সকে দিয়েই চরিত্র সমস্যা শুরু হয়েছে শাকুর আলীর। পুরুষ মানুষের কী আর বউ ছাড়া এতদিন চলে!
কিন্তু তিনমাস হয়ে গেলো, এই মেয়েটাকে এখনো বাগে আনতে পারছে না সে। যখনই একটু একা হওয়ার সুযোগ পায়, কোত্থেকে যেনো কেউ না কেউ এসে বাগড়া দেয়। এই কুদ্দুস ব্যাটার মতলবও বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটাকে সে এনে দিয়েছে বলে যেনো একেবারে তার গার্জিয়ান বনে গেছে! শাকুর আলীর আশেপাশে ভিড়তে দেয় না। এতোদিনের ডান হাত তার, আজ কিনা তারই শত্রু হয়ে গেলো!
খিঁচড়ে থাকা মেজাজে পুরোনো ছাই চাপা আগুন আরো জ্বালা ধরিয়ে দেয়।

দুই,

‘ঐ ছেমড়ি! তরে না কইছি ঠিগাদার ব্যাডার সামনে দিয়া ঘুরঘুর করবি না!’
‘আমি কী ঘুরঘুর করছি নি? কুদ্দুস ভাইরে খুঁজতাছে। কমু না?’
‘এ্যা! কমু না! তরে জিগাইছেনি যে তর ড্যাং ড্যাং কইরা কইবার যাওন লাগবো? ওহোনো তুমি কিছুই বুঝোনা। আরেকবার প্যাট বানানের পর বুঝবা, তাই না?’
চুপ করে যায় সালমা। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি উঠাতে থাকে। কথায় কথায় পেটের খোঁটা সবাই দেয়। তা সে ক্ষুন্নিবৃত্তিই হোক কিংবা অন্য কোনো বাজে ইঙ্গিত। যারা ভালো চায় তারাও দেয় আর যারা ভালোর ভান ধরে থাকে তারাও। এই পেটটার জন্যই বুঝি সব জ্বালা!
শেফালী চাচী মনে হয় তার ভালোই চায়। দেড় বছরের শিশু সন্তানকে বুকে নিয়ে এক কুদ্দুস ভাই এর ভরসাতেই গ্রাম ছেড়েছিলো সালমা। কুদ্দুস আর সে একই গ্রামের। উঠতে বসতে গ্রামের লোকের মুখ ঝাংটানিতে যখন আর পারছিলো না সে, কুদ্দুসই তাকে শহরে আসতে বলে। নিজের ভাই না হলে কী হবে, কুদ্দুস ভাই তার মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়ে কিছু কম করেনি সেদিন। তার নিজের বাবা-মাও তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তার কাছ থেকে। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো যে, তার বাচ্চার ভরণপোষণ তারা করতে পারবে না। সেদিন কুদ্দুস ভাই তাকে ঢাকার ঠিকানা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, ঢাকায় গিয়ে দেখা করতে। কিছু করার ছিলো না সালমার। গ্রামে বসে মানুষের শাপ-শাপান্তে তিলে তিলে শেষ হওয়ার চেয়ে ঢাকায় গিয়ে একেবারে শেষ হওয়াও সহজ মনে হয়েছিলো ওর কাছে। ইট পাথরের এই শহরে সে হয়তো কীট হয়েই বেঁচে থাকতো। কুদ্দুস ভাই তাকে আশ্রয় দিয়েছে, একটা কাজও জোগাড় করে দিয়েছে।
কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেনি তার বাসায়। দু’মাস যেতে না যেতেই কুদ্দুস ভাইএর বউ এটা ওটা বলে তার খুঁত ধরতে শুরু করলো। সালমা ঠিক করেছিলো, একটাও রা করবে না। মুখ গুঁজে পড়ে থাকবে। কাজ করে যেটুকু টাকা পেতো, পুরোটাই তুলে দিতো কুদ্দুস ভাইএর বউএর হাতে। এমন একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই সে যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু কী হলো কে জানে! একদিন চক্ষুলজ্জা টুকুর বাহানাও চুকে গেলো। ভাবী তাকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, সেখানে তার থাকা চলবে না।
‘তুমি অন্য হানে যাও মাইয়া। আমি তোমারে রাখবার পারুম না।’
অসহায় চোখে কুদ্দুস ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় সালমা। সেই চোখের দিকে তাকাতে পারে না কুদ্দুস । মুখ নামিয়ে নেয়।
সালমা বুঝতে পারেনি তার অপরাধটা কী! একদিন শুধু এক প্রতিবেশিনীকে কুদ্দুস ভাইয়ের বউএর কাছে বলতে শুনেছিলো,
‘মরদ নিয়া ঘর করো বুইন। চোখ কান খুলা রাইখো। পুরুষ মাইনষ্যেরে বেশি বিশ্বাস করলে কইলাম ঠগবা!’
আশ্রয়হীনা সালমা আবারো আশ্রয় খুঁজে পায় এই শেফালী চাচীর কাছে। নির্মাণ কাজের সেও একজন শ্রমিক। কাজের সূত্রেই চাচীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে সালমার। চাচীর তিনকূলে কেউ নেই। এক ভাস্তে আছে, সে কই থাকে কী করে চাচী জানে না। মাঝে মাঝে হাতে টান পড়লে চাচী’র খোঁজ নিতে আসে। বস্তির একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে চাচী। সালমা গিয়ে ওঠে তার কাছে। তার ছেলেটি এতোদিনে বেশ বুঝে গেছে, তারা মাঝে মাঝে বাক্স পেঁটরা নিয়ে জায়গা বদল করে। বিষয়টাতে তার একরকম অভ্যস্ততাও চলে এসেছে। যেখানেই যায় সে বেশ মানিয়ে নেয়। কিছু খেতে দিলে খায়, না দিলে কান্নাকাটিও করে না। তার কাছে এটাই জীবনের স্বরূপ। অন্যরকম হলেই বুঝি ঝামেলা বাঁধতো।
সালমা আজো ভেবে পায় না, তার পাপের বোঝা কেন তার নিষ্পাপ সন্তানকে বইতে হবে? সতেরো বছর বয়স অব্দি সে তো অন্ততঃ এটুকু জানতো, ঘর মানে কী…পরিবার কাকে বলে। তার সন্তান কেন এই প্রাপ্তি টুকু থেকেও বঞ্চিত হবে?

তিন,

‘সালমা, তুমি শুধু শুধুই ভয় পাও। আমি থাকতে তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই।’
ভয়! ভয় কীসের? আনমনা চোখে সেদিন ভয়ের কী কোনো লেশমাত্র ছিলো? মেঘের অপার ডানায় নির্ভার চোখ মেলে রাখা সালমার দু’চোখ জুড়ে তখন তো কেবলই ওড়ার আকুতি। নীল আকাশটা কী বিশাল! অল্প কিছু সাহসী পাখীর দল আকাশের সীমানা ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, জোড়া বেঁধে। সঙ্গীর প্রতি কী অগাধ আস্থা তাদের!
পাশ ফিরে তারিকের দিকে চেয়েই ফিক করে হেসে ফেলে সালমা। তারিক কেমন ব্যাকুল চোখে চেয়ে আছে তার দিকে! যেনো সালমাকে ভয়মুক্ত করা না করার পিছনে তার জীবন মরণ সমস্যা লুকিয়ে আছে।
তারিক এই গ্রামের ছেলে না। পাশের গ্রামের কদম আলীর দূরসম্পর্কের ভাগ্নে, একটা এনজিওতে চাকরি করে। সালমাদের গ্রামে এসে গ্রামের যুবক ছেলেদের আধুনিক কৃষিকাজের পদ্ধতি সম্পর্কে শেখায়। সালমার ভাইও শিখতে যায় তার কাছে। একদিন ঘটনাচক্রেই পরিচয় হয়ে গেলো সালমার সাথে। গ্রামের বোকাসোকা অল্প পড়ালেখা জানা মেয়ে সালমা। কিন্তু তার সৌন্দর্যে ছিল বেজায় চটক। ষোড়শী সুন্দরী সালমার রূপে আকৃষ্ট হতে তারিকের বেশি সময় লাগলো না। এদিকে সালমা তো চৌকষ তারিকের বাকচাতুর্যে প্রথম দিন থেকেই কাত। তারা দেখা করতে শুরু করলো দশ জনের নজর এড়িয়ে। পুকুর ঘাটে, ক্ষেতের আলে, গাছের ছায়ায়… নিয়মিত কথা না হলে কারোরই চলে না। তারিক সালমাকে শহরের কথা শোনায়। এনজিওর কাজে কিছুদিনের জন্য সে গ্রামে এসেছে। এই কাজটা শেষ হলেই আবার ঢাকায় চলে যাবে। কিন্তু এবার সে একা যাবে না। আর কিছুদিনের মধ্যেই মামাকে দিয়ে সালমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাবে। স্বপ্নালু চোখে সালমা শোনে তারিকের কথা। ঢাকায় সংসার হবে তার? কতোদিন ভেবেছে এই গ্রামের বাইরে অন্য কোথাও তার বিয়ে হবে। দূর কোনো গ্রামে। একেবারে ঢাকা শহরে সংসার হবে তার, এ তো সে কল্পনাও করতে পারেনি। বেপরোয়া স্বপ্ন আর রাত নামার অপেক্ষায় থাকে না, দিনে দুপুরেই হানা দিতে শুরু করে।
কিন্তু গ্রাম বলে কথা! এসব সিনেমার রঙ্গ তো আর গ্রামে প্রকাশ্যে চলে না। মুরুব্বিরা সভা বসালেন। সালমার বাবা-মা, ভাইএর লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়। তলে তলে পানি বহুদূর গড়িয়েছে। তাই খোঁজ পড়লো তারিকের। কিন্তু কোথায় সে? সে তো প্রায় সপ্তাহ খানেক যাবত গ্রামেই আসছে না। পাশের গ্রামে খবর গেলো। তারিকের মামা জানালেন, সে দিন দশেক আগে ব্যাগ গুছিয়ে ঢাকা চলে গেছে। তার গ্রামের কাজ শেষ হয়ে গেছে।
নিজের কানকেও বিশ্বাস হয় না সালমার। এটা কীভাবে সম্ভব? তারিক তাকে ঠকাবে! কীসের জন্য?
কথার গণধোলাই এ ততোক্ষণে হুঁশ ফিরেছে সালমার। শোকতাপ কাটিয়ে স্বপ্নের জগত থেকে আস্তে আস্তে আবার ফিরে আসে বাস্তবের জগতে।
কিন্তু তখনো আসল বাস্তবতা সামনে আসেনি। মিষ্টি কথার জাল বিছিয়ে তারিক হাতিয়ে নিয়েছিলো অনেক বড় কিছু। একদিন ঝুম বৃষ্টির দিনে, আবছায়া গোধুলী বেলায়… অন্ধকার হয়ে এসেছিলো চারদিকে। তারিকের সাথে কথা শেষ করে বাড়ির পথ ধরেছিলো সালমা, জোর কদমে। অকস্মাৎ পেছন থেকে তারিক জাপ্টে ধরেছিলো তাকে, দস্যুর মতো। জোর হাতে নিয়ে গিয়েছিলো ক্ষেতের আড়ালে, অন্ধকারের গহ্বরে।
বোকা সালমা সেদিন এটাও ঠিকমতো বুঝতে পারেনি কী হারালো সে! অগাধ আস্থায় সে বিশ্বাস করেছিলো, তারিক ঠকাবে না তাকে। বাড়ি ফিরে আসার পর মা খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো তার বিধবস্ত বেশবাসের দিকে। কেন যেনো মার দিকে সেদিন তাকাতে পারেনি সালমা।
সেদিনের সেই অন্ধকারের হাতছানি ঘোর অমানিশা হয়ে ফিরে আসে সালমার জীবনে। গ্রামের লোক যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের বাড়িতে। বাবা-মা’র অপমানিত মুখ আর ভাইয়ের আগ্রাসী বাক্যবাণেও সেদিন সে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারেনি।
একটা ঘরের স্বপ্ন দেখেছিলো সালমা। চোখের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে কোথাও, নিজের একান্ত কোনো প্রিয় মানুষের সাথে ছোট্ট একটা ঘর, একচিলতে আশা। সেদিন খুব দূরের মনে হয়নি সেই স্বপ্নটাকে। অথচ আজ!
হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারা সেই স্বপ্ন যা একদিন দিনের আলোতেও তার কাছে আসতে দ্বিধা করতো না, আজ মাঝরাতের অঘোর নিদ্রাতেও আর তার কাছে ধরা দেয় না।

চার,

শাকুর আলী আঁটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছে এবার। সামান্য এক দুইদিনের পুঁচকি ছুড়ি যে কিনা তারই শ্রমিক দলে দিন চুক্তিতে কাজ করে, তাকে সে কাবু করতে পারবে না তাও কী হয়!
একদিন সে পেয়ে যায় অপ্রত্যাশিত সুযোগ। বাচ্চার জ্বরের জন্য দু’দিন কাজে যেতে পারে না সালমা। এদিকে টাকা আসে দিন হিসেবে। এভাবে কামাই করলে তো আর পেট চলবে না। তাই অসুস্থ বাচ্চাকে বাসায় একা রেখে সালমা দেখা করে শাকুর আলীর সাথে। শেফালী চাচী জানলে তাকে শাকুর আলীর কাছে যেতে দেবে না, তাই সে গোপনেই দেখা করে তার সাথে। সুযোগসন্ধানী শাকুর আলী সালমার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। অনুপস্থিতির সময়টা সে সালমাকে পুরো টাকা দিয়ে দেবে বলে আশ্বস্ত করে।
নিশ্চিন্ত মনে ফিরে আসে সালমা। শেফালী চাচী বেশিই সন্দেহ করে! কতো ভালো মানুষটা! এক কথায় তাকে কতো বড় চিন্তা থেকে মুক্ত করলো।
বাচ্চার জ্বরটা একটু নেমেছে। শরীরে ঘাম দিচ্ছে। সারারাত নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ক্লান্ত সালমা বাচ্চার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে।
শরীরে কিছু একটার উপস্থিতিতে ঘুম ভেঙে যায় সালমার। ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারে না সে। বিপর্যস্ত শরীরে ঘরের দোর লাগানোর কথা মনে ছিল না তার। এই সুযোগে লম্পট শাকুর আলী ঢুকে পড়ে ঘরে। চড়াও হয় তার শরীরে।
হঠাৎ যেনো জ্ঞান ফিরে আসে সালমার। এমনি এক দস্যু একদিন তাকে পথে বসিয়েছিল। আদরের দুলালী থেকে আজ সে একজন দিনমজুর। আরেক দস্যু বুঝি তাকে এই সম্মান টুকু নিয়েও বাঁচতে দেবে না। ছুঁড়ে দেবে তাকে অন্ধকার এঁটো গলিতে।
এদিক ওদিক চেয়ে হাতের কাছে একটা বটি খুঁজে পায় সালমা। ততক্ষণে শরীরে চেপে বসেছে দস্যু। বহুকষ্টে বটিটার নাগাল পেয়ে সুযোগ মতো এক কোপ বসিয়ে দেয় ঘাড় বরাবর।
রক্তের স্রোতে ভেসে যায় মাটির মেঝে। ছেলেটা ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করে। বুকে জড়িয়ে ধরে তার কান্না থামায় সালমা।
সামান্য যেটুকু সম্বল ছিল দ্রুত হাতে গুছিয়ে নেয়। আবার ঠিকানা পাল্টাতে হবে।
এবারের গন্তব্যের জন্য সে আরো বেশি প্রস্তুত, পরিণত। জীবনযুদ্ধের পরিপক্ব একজন যোদ্ধা এখন সে।
শেষপর্যন্ত সে তার স্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। ছোট্ট একটা নিটোল ঘরের স্বপ্নকে আজ এতোদিন বাদে সে পিছে ফেলে আসতে পেরেছে।
একসময় তা মিলিয়ে যায় জমাট বাঁধা কুয়াশায়…পরিণত হয় বৃত্ত থেকে বিন্দুতে।

লেখক, ফাহমিদা বারী

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত