অন্তর

অন্তর

অন্তর ছেলেটিকে যত দেখছি ততই আমি অবাক হচ্ছি। শুধু আমি-ই না আমাদের এই নিশ্চিন্তপুর বাসীর সবাইকেই অবাক করে চলেছে অন্তর। আমাদের এখানে যে শিশুটি কথা বলতে শিখেছে মাত্র তার কাছ থেকেও আপনি অন্তর সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। আমাদের নিশ্চিন্তপুর স্কুলে ক্লাশ সিক্সে পড়ুয়া দশ বছর বয়সী এই ছেলেটি সার্কাসের আদুলে নানা রকমের সব ভয়ংকর খেলা দেখিয়ে সবাইকে অবাক করে চলেছে। প্রথম দর্শনে ছিপ ছিপে গঠনের শ্যাম বর্ণের এই ছেলেটিকে দেখে আপনার কখনই বিশ্বাস হবে না যে এই ছেলেটি এত কিছু দেখাতে পারে। অবশ্য এই খেলা দেখানোর বিনিময়ে কিছু টাকা পায় যা দিয়ে তাদের সংসার চলে। বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনেছি আর বইয়ের পাতায় মুদ্রিত লেখাতে পড়েছি আমাদের দেশে নাকি মসলিন শাড়ি তৈরি হত। যার কদর ছিল বিশ্বময়। এই মসলিন শাড়ি নাকি একটা ছোট্ট আংটির ভিতর দিয়ে নাকি অনায়াসে আনা-নেয়া যেত। এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে সত্যিই কেমন জানি কষ্ট হতো (বেইজঃ লোকমুখে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই)।

কিন্তু যেদিন ছোট্ট একটা রিংয়ের ভিতর দিয়ে অন্তরকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম আমার সবকিছু কেমন জানি ওলটপালট হয়ে গেল। এর আগেও আমি দেখেছি সার্কাসে আর টিভির পর্দায় এক রিংয়ের ভিতর দিয়ে দুজনকে বেরিয়ে যেতে। তবেরএমন অনুভুতি হয় নি। কারন আমার বিশ্বাস ওরা কালো জাদু জানে আর অনেক ছোট থেকে তাদের ট্রেইনআপ করা হয় বলে তারা তা অনায়াসে করতে পারে। কিন্তু অন্তরের ক্ষেত্রে তো সম্পুর্ণ আলাদা। ও কোন কালো জাদুও শিখেনি বা কারো কাছে দীক্ষাও নেয় নি। যে মেয়েটি আরশোলা দেখে ভয় পায় তার গায়ে যদি একটি আরশোলা উঠে যায় তখন ঐ মেয়েটির যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয় ঠিক একই কায়দায় কিছু অঙ্গ ভঙ্গী দেখিয়ে আমাদের চোখে ধোয়াশা ধরিয়ে নিজেকে রিংয়ের ভিতর দিয়ে বের করে নিল অন্তর। আমি নিশ্চিত এটা রাবারের রিং। না হলে যে রিংয়ে শুধুমাত্র কোনভাবে মাথাটা ঢুকানো যায় তা দিয়ে কিভাবে সে নিজেকে বের করে নেয়। কৌতুহলি আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। রিংটিকে নিজ হাতে স্পর্শ করে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। রিংটি হাতে নিতেই আমার সব অবিশ্বাস নিমিষেই হারিয়ে গেল। তারপর একে একে উপভোগ করলাম তার দেখানো সব খেলা। ছোট্ট একটা লাঠি হাতে শুন্যে রশির উপর দিয়ে হেটে যাওয়া, বৈদ্যুতিক থামকে সোজা রাখার জন্য যেভাবে টানা দেয়া হয় ঠিক ঐ ভাবেই বাধা তারে দু পায়ের আঙ্গুলের মাঝে ভর দিয়ে ছোট্ট এক লাঠি হাতে হেটে উপরে উঠে যাওয়া আবার ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসা, কোমর সহ পায়ে বেল্ট লাগিয়ে হাতে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচে রেখে শুন্যে বাধা লাঠিতে চরকির মত ঘোরা, সাইকেলের কিছু কারুকাজ। তবে তার দেখানো শেষ খেলাটা আমার মনে সবচেয়ে বেশী আতংক ছড়িয়ে গেল। কালো কাপড়ে মাথাসহ মুখ বেধে পা উপরের দিকে দিয়ে গাড় অব্দি মাটিতে পুঁতে দিয়ে ঠিক পাঁচ মিনিট পর উঠে আসা। চারদিক করতালিতে মুখর। এরই মাঝে অন্তরের বাবার মুখে গানের সুরে কিছু কথায় আমার মন কম্পিত হলো…..

“এখানে আগত সুধী জনতা ওগো প্রিয়..

তোমরা তোমাদের মন খোলে জেনে নিও..

ভিক্ষা বৃত্তির চেয়ে আমাদের কাছে..

সংগ্রাম করে বেচে থাকাটায় বেশী শ্রেয়..

জীবনের সংশয় নিয়ে দেখানো খেলায়..

যদি তোমাদের মন রাঙ্গাতে পারি..

তবে মোদের মুঠো ভরে দিও..

মোর জন্য দোয়া রেখ যেন….

অচল এই আমি বিধির দোয়ায় আর…

আমার ছোট্ট অন্তরের কল্যাণে…

যতদিন আছি বেচে, থাকতে পারি…

নিজ মাথা উচু করে, সম্মানে”।

আজ থেকে তিন বছর আগেও কল্পনায় ছিল না যে ছোট্ট এই বয়সেই সংসারের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে অন্তরকে। বাবা মা আর ছোট বোন তিতলিকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। দুরন্তপনায় কেটে যেত অন্তরের সারাটা দিন। পুকুরের পানিতে ছোয়াছোয়ির খেলায় দিনভরও কেউ তার নাগাল পেত না। পুকুরের উপরে কড়ই গাছের ডালে ওঠে অলিম্পকে দেখা পুলে ড্রাইভ দেয়ার মত কর ড্রাইভ দিত। তা দেখে সবার হাততালি পেত। এটা দিতে গিয়ে কখনো সে সফল আবার কখনো বিফল হতো। পা থেকে আরও আধা হাত দুরে বিস্কুট রাখা হতো পিছন দিকে ঘুরে এসে মুখ সে তা তুলে নিত। কখনো কখনো দুরত্ব বেড়ে এক হাতও হত। আর দিগবাজি দেয়ায়ও সে ওস্তাত ছিল। প্রথম প্রথম অন্তর অনেক ব্যাথা পেত এসব করতে গিয়ে। বাবা মার কাছে বকাও খেত অনেক। তবুও তার দুরন্তপনা এতটুকুও কমেনি। আশেপাশে যেকোন জায়গায় কোন অনুষ্ঠান হলেই ডাক পড়ত অন্তরের। সেও তার কারিশামা দেখিয়ে সবাইকে বিনোদিত করত। তাদের সুন্দরভাবে চলা জীবনে হঠাৎ-ই কাল বৈশাখীর ঝড়। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা পঙ্গুত্ব বরন করে। নিমিষেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রায় তারা নিঃশ্ব হয়ে যায়।

প্রতিবেশী এক দাদার উৎসাহ আর সহায়তায় অন্তর এ খেলা দেখানো শুরু করে। অসহায় হলেও অন্তর তার বাবাকে ছোট হতে দেয়নি। দেয়নি কারো কাছে গিয়ে হাত পেতে সাহায্য নিতে। যা আমরা সুস্থ মানুষ হয়েও হর হামেশাই করে বেড়ায়। অসহায় কারোর ফাইল আটকে দিয়ে নির্লজ্জের মত ভিক্ষার হাত বাড়াই। কলমের নিপুন দক্ষতায় গরীবের মুখের খাবার কেড়ে নেয় অনায়াসে। বিবেকের জুতো আমাদের কখনই পস্তাগাত করে না। কারন আমরা নির্লজ্জতার স্বর্ণ শিখরে চড়ে বসে আছি। স্যালুট এই অন্তরদের যারা অসহায় হয়েও কখনো অন্যায় কাজ করেনা। স্যালুট তাদের যারা কখনও কারো সাথে অন্যায় করে না। অন্যায়কে কখনই প্রশ্রয় দেয় না। কোন গরীবের মুখের খাবার কেড়ে নেয় না।

“বেচে থাকুক তারা যুগযুগ ধরে…

অসহায় মানুষদের সেবার তরে”।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত