আমি যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম তখনও ছাই বর্ণ আকাশটা ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদেই যাচ্ছিল। বৃষ্টি নিয়ে আমার কোন আদিখ্যেতা নেই, কোনকালে ছিলও না। ‘বৃষ্টি’ শব্দটি দেখলে বা শুনলেই আমার চোখে সবার আগে ভেসে উঠে আমাদের বাড়ির খুঁচ-পাঁচড়ার মত দেখতে উঠানটা। সারা উঠানময় এখানে সেখানে সবুজ কালো কাদামাটি। যেন সারা উঠানটির গায়ে দগদগে ঘা।
আমার শান্ত এবং ধৈর্যশীল মা উঠানের এককোনে ভেজা রান্নাঘরে ভেজা মাটির চুলায়, ভেজা কাঠ দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ধোঁয়া তৈরি করছে। বাবা চৌকাঠে হেলান দিয়ে এক নির্দিষ্ট ছন্দে কেশেই যাচ্ছে। বাবার বুকের হাড়-পাঁজরগুলি হাঁপরের মত উঠছে আর নামছে। রাত নামলে আমার মা তাঁর হেঁজে যাওয়া পা আর হাতের আঙ্গুল গুলিতে ধারে আনা ভেসলিন হাড় কেপ্পনের মত মালিশ করছে। বৃষ্টি হলেই আমার অদম্য রাগ হয়। আকাশের গলা চিপে ধরতে ইচ্ছা করে। বৃষ্টির গায়ে কষে লাথি ছুঁড়তে ইচ্ছা করে।
আমি যখন বাড়ি ছেড়ে আসছিলাম নোনা দেয়াল ঘেঁষা কদম গাছটায় প্রথম ফুল এসেছিল। কাশতে কাশতে এবং হাঁপাতে হাঁপাতে বাবা বলছিল –“গাছটা কেটে ফেলা দরকার। বাড়িতে কদম গাছ থাকা ভালো কথা না।“ কদম আমার প্রিয় ফুল নয়। কদমের গন্ধ আমার কাছে খুবই দূর্গন্ধযুক্ত মনে হয়। তবে বৃষ্টি এবং কদম নিয়ে আমার দু’টো প্রিয় লাইন আছে-“নীল পাড় সাদা শাড়ি, খোঁপায় কুমারী কদম ফুল।“ বৃষ্টি আর কদম বলতেই এই দু’টো লাইনই কেন যেন মাথায় ঘুরপাক খায়!
আমার ট্রেন ছিল ভোর ৪ টায়। বাবা ঘুম থেকে উঠে কাশছে রাত ২ টা থেকে। কাশির ফাঁক ফোঁকরে নিস্তেজ গলায় ডাকে-“ও রুকী, রুকী গো, আর কত ঘুমাও!” আমি যখন বাড়ি চলে যাচ্ছিলাম, আমার বুক পকেটে ছিল একটা চিঠি, মাথার উপরে ভাঙ্গা ছাতা আর হাতে একটি চটের ব্যাগ। বাবা কেঁপে কেঁপে হেঁটে হেঁটে বারান্দা পর্যন্ত এসেছিল। মা দাঁড়িয়েছিল দরজায়, ভাবলেশহীন-নিস্তব্ধ। তাঁর আরও তিনটি সন্তান আছে যারা এক বিছানা ভাগাভাগি করে ঘুমাচ্ছে!
বুক পকেটের চিঠিটি নিয়ে গিয়েছিলাম তার মালিকের কাছে। সে খুব দ্রুত কাগজটির উপর চোখ বুলিয়ে বিছানার একপাশে ফেলে দিয়ে বলেছিল-“দেখছই তো ঘরের অবস্থা। তোমায় কীভাবে জায়গা দিই।“ আমি দেখেছিলাম ঘরটি। বড় একটা জানাল আছে, চমৎকার রোদ উঠেছিল সেদিন। সকালের রোদের গা থেকে হলুদ রঙ কেমন চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছিল সারা ঘরে। মনের সমস্ত ইচ্ছা একসাথে জড় করে বলেছিলাম-“আমি না হয় মেঝেতেই বিছানা পেতে নেব।“ নিরুত্তাপ গলায় উত্তর এসেছিল-“দুঃখিত, নিয়ম নেই”। আমি যখন সেখান থেকে বের হয়ে আসছিলাম, শরীরেরর সমস্ত রক্ত আমার সারা মুখে জমেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে আওড়াচ্ছিলাম-“ ছিঃ! কাঁদতে নেই!”
পাউরুটি আর কলা হয়ে গেল নিত্য সঙ্গী। তবুও তিন বেলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। শেষ তিনদিন চা, সিগারেট আর একটি কলার উপর পাড়ি দিয়ে মোটামুটি আহার এবং একটি বাসস্থানের ব্যাবস্থা করে ফেলেছিলাম অবশেষে। সারাদিন কাজ করি, বেলা শেষে ঘরে ফিরে ভুসভুস ঘুমাই। ছুটির দিনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। খালি দোতলা বাস পেলে সোজা উপরে উঠে যাই। ভাগ্য ভালো থাকলে একদম সামনের সিটটায় গ্যাঁট হয়ে বসি। হুঁস করে কেমন পিঠে দু’টো ডানা গজিয়ে যায়! এমনিতেই মিচিক মিচিক হাসি পায়। শেষ গন্তব্যে গিয়ে আবার ফিরে আসি সেই রোমশ অন্ধকার ঘরে!
আমি আপাদমস্তক কর্মী টাইপের মানুষ। আরও একটু খোলশা করে বললে বলা যায়, আমার সাথে রোবটের খুব একটা পার্থক্য নেই। পাড়ার মোড়ের ছেলেরা দূর থেকে দেখলেই খিক খিক হাসত-“ওই আসছে আমাদের রোবট!” ‘রোবট’ শুনলেই আমাদের মাথায় প্রথম চিন্তাটি আসে একটি আবেগশূন্য যন্ত্র। আবেগের বিষয়টি পরিষ্কার করে বলতে পারছিনা, তবে নিজেকে মাঝে মাঝেই ঐ রোবট নামক যন্ত্র মনে হয়।কী কী করতে হবে ঠিক করে দিয়ে রোবটের সুইচ টিপে দিল, রোবটও সেইমত কাজ শুরু করে দিল। নিজে থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেই, কোন কাজের উদ্যোগও নেই। আমার কাজের জায়গায় সেজন্য আমার সাথে কারো তেমন কোন সখ্যতা গড়ে উঠেনি। সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খায়, চা-সিগারেট খেতে খেতে চারপাশ জমিয়ে তোলে কথার ফুলঝুড়িতে। আমাকে কেউ কখনো ডাকেনা। কেউ বলে না-“কী ভালো তো!”
শুধু একজন ছাড়া! মেয়েটির সামনের দুটো দাঁত আর একটু ছোট হলে, ন্যাকামো ভাবটা আর একটু কমালে, এককথায় নাটালি পোর্টম্যান বলে চালিয়ে দেয়া যেত! তবুও ছোট একটা বাক্য যখন হাসি দিয়ে টেনে টেনে বলে-“কেমন আছেন?” তখন বেশ ভালো লাগে। এবং আমিও আমার একান্ত গোপন শান্ত কোমল হাসিটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলি-“এই তো।“
এ ছাড়াও আরো একজন আছে এই কিম্ভুতকিমাকার শহরে। রাতের টুয়েন্টিনাইন আসরের বেমানান এক সঙ্গী। অপটু খেলোয়াড়। কেউ পার্টনার করতে রাজী নয়। এককোনায় সস্তার মদ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে, মাঝে মাঝে চুক চুক শুধু শব্দ শোনা যায়। বড় মায়া লাগে! হঠাৎ হঠাৎ আসর ছেড়ে বারান্দায় চলে আসতাম। কোন কোন দিন জোছনায় ভেসে যেত চারদিক। কোত্থেকে যেন হাসনাহেনার গন্ধ ভেসে আসত। ছোটবেলায় এমনই কোন রাতে মা হাত ধরে উঠানে হাঁটত। উঠানের কোনে হাসনাহেনার ঝাড়ের কাছে এসে মা গন্ধ শুকত। ছিড়তে চাইলে বলত-“রাতে ফুল-পাতা কিচ্ছু ছিঁড়তে নেই। ওরা ব্যাথা পায়। তুই যদি আমার চুল ছিড়িস,আমি ব্যাথা পাব না? কক্ষনো ছিঁড়বি না! তাহলে মায়েদের শরীর ব্যাথা পায়!” হঠাৎ চুপ করে থেকে মা বলেছিল-“হাসনাহেনা আমার প্রিয় ফুল”। সেদিন কোন এক রেস্টুরেন্টে রাতে খেতে গিয়ে দেখেছিলাম ওদের দরজার সামনে একটা হাসনাহেনা গাছ। ওমা! সেই গাছে আবার ফুলও আছে। অপরিচিত বিদেশিনী রেস্টুরেন্টের মহিলাটিকে অতি উল্লাসে বলেছিলাম-“তোমাদের এ গাছ আছে! এ গাছ তুমি কোথায় পেলে!” খুব বলতে ইচ্ছা করছিল-“তুমি কি জানো, এটি আমার মায়ের প্রিয় ফুল”
তবে সেই বাড়ির ধারে কাছে আমি কোথাও কখনও হাসনাহেনা দেখিনি। কিন্তু সেইসব রাত্রিতে আমি হাসনাহেনার গন্ধ পেতাম! গন্ধ তাড়ানোর জন্য ফস করে সিগারেট জালাতাম। নিকোটিনের গন্ধে আচ্ছন্ন করতে চাইতাম নিজের চারপাশ। এমনই কোন কোন মুহুর্তে সেই বেমানান ভদ্রলোক পিছনে এসে দাঁড়াত নিঃশব্দে। দু’জনে ধোঁয়ার রিং বানাতে বানাতে কোন এক অজানা জগতের কথা বলতাম। যার দিনের আলোয় কোন অস্তিত্ব নেই।
কোন এক ছুটির দিনের দুপুরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। গতরাতে ঘুম হয়নি। সারারাত এপাশ-ওপাশ করে কেটেছে। জ্বর যখন ছেড়ে গিয়েছিল, বিছানা-বালিশ ভিজে গিয়েছিল ঘামে। দুপুরের ঘুম যেন হঠাৎ গিটারের তারের মত টং করে ছিঁড়ে গিয়েছিল। শুধু মনে আছে পিছনে তরল পিচ্ছিল কিছু বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু বেমানান ভদ্রলোকের অবয়ব দেখতে পেয়েছিলাম দরজার পাশে।
যন্ত্র নামক বিষয়টার সাথে আমার আরও কিছু মিল আছে। অপ্রয়োজনীয়, বলা ভালো অপ্রিয় যা কি-না এক অর্থে অপ্রয়োজনীয়, আমি আমার মেমোরিতে জমা করে রাখিনা। রিসাইকেল বিনে ফেলে দিই। তবে একটা মুশকিলের কথা এই যে, আমার রিসাইকেলবিনটা কখনো পরিষ্কার করা হয়ে উঠেনি!
কোন জিনিসই আমার দীর্ঘদিন ভালো লাগে না! সেটা হতে পারে-জায়গা, চারপাশের মানুষজন, চেনা রাস্তাঘাট! কখনো কখনো পড়ন্ত দুপুরে বা গোধুলী লগ্নে অথবা রাত্রি দ্বি-প্রহরে খুব হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আমি হারিয়েও যাই। হেঁটে চলে যাই কোন অচেনা রাস্তায়, যেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ জানা নেই। রিক্সাওয়ালা কখনো ঢুকে যায় কোন কানা-গলিতে। যেখানে চারপাশের দেয়াল দু’পাশ থেকে চেপে ধরতে আসে। আমি কিছুই বলিনা!
সেদিন আমার কাজের জায়গাটিতে সবাই বেশ একটু চুপচাপ ছিল। চায়ের দোকানের আড্ডায় সবাই কেমন ফিসফিস করে কথা বলছিল দেখতে পাচ্ছিলাম। ফিরে এসে আবার যখন সেই থোড়-বড়ি-কলা, কলা-বড়ি-থোড় কাজে যোগ দিলাম, পাশের জন খুব নিচু স্বরে বলল-“শুনেছ ঘটনা?” ঘটনা শুনলাম, নাটালি পোর্টম্যান কেলেংকারী করেছে। তার আর বাঁচতে ইচ্ছা করেনি, তাই সে তাঁর কোন এক শখের ওড়না সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে নিজে ঝুলে গেছে তার নীচে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মেয়েটার মুখ খুব ডিটেইলে মনে করার চেষ্টা করছিলাম। আশ্চর্য! কিছুই মনে পড়ছিলনা। শুধু কানে রিনরিন করে বেজে চলছিল-“অনেকদিন দেখিনি! কোথায় ছিলেন?”
আমি যখন শেষবার বাড়ি যাই, বাবা আরও শুকিয়ে গিয়েছিল। অনেককাল আগে বাবা তাঁর দোকানে খরিদ্দারদের সিগারেট-বিড়ি ধরানোর জন্য একটা কুপি আর তার উপরে একটা দড়ি পাকিয়ে রাখত। সেই দড়িতে সারাক্ষন ছোট্ট করে একটা আগুন থাকত। আমার বাবার শরীরটা সেই পাকানো দড়ির মত লাগছিল দেখতে, পার্থক্য শুধু এই-সেখানে কোন আগুন ছিলোনা, জ্বলবেওনা আর কোনদিন। মা সেই আগের মতই ভাবলেশহীন-প্রাণহীন! সেদিন বাড়ি ছেড়ে আমি আরও অনেক দূরে চলে যাচ্ছিলাম। বুকপকেটে কোন চিঠি ছিলনা তবে ব্যাগে অনেক জরুরী কাগজপত্র! বাবা কোত্থেকে একটা বাঁশের লাঠি জোগাড় করেছিল। সেটাতে ভর দিয়ে খুট খুট শদ তুলে হাঁটছিল। ঘড়ঘড় শব্দে বারবার বলছিল-“ও রুকী, রুকী গো, তাড়াতাড়ি করো!” সদর দরজা পার হয়ে অনেকখানি হেঁটে গিয়ে রিক্সায় উঠতে হয়। বাবা তাঁর নিজহাতের তৈরি বাঁশের লাঠিটা দিয়ে খুট খুট আওয়াজ তুলে পিছনে পিছনে এসেছিল। মা দাঁড়িয়েছিল দরজার চৌকাঠে। রিক্সায় উঠার আগে পিছনে ফিরেছিলাম। বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। মা কী আঁচল দিয়ে চোখ মুছছিল! আমার শরীরের সমস্ত রক্তনালীর রক্তগুলো যেন এক দিকে ছুটে যাচ্ছিল। মুখের উত্তাপ আমি টের পাচ্ছিলাম। চোয়ালে চোয়াল চেপে বলছিলাম-“ছিঃ! কাঁদতে নেই!”
কোথায় যেন হারিয়ে গেছি আমি। হারাতে আমার ভালোই লাগে। তবে আজকাল বড্ড নিজেকে ভুলে যেতে ইচ্ছা করে। কোথায় আমি, কে আমি কিছু মনে করতে ইচ্ছা করে না! কেউ যখন জিজ্ঞেস করে আমি কে, বড্ড বলতে ইচ্ছে করে-“জানিনা তো! ভুলে গেছি!”
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দুই বছর পর বাবা মারা গিয়েছিল। খবর পেয়েছিলাম, ঐবার শীত বেশি পড়েছিল, বাবার শুকিয়ে যাওয়া দড়ির মত শরীর সেবারের শীত আর সহ্য করতে পারেনি। শীতের জন্য বিছানায় পাতা ইলেক্ট্রিক ম্যাট্রেসটা আমার একের পর এক জ্বালানো সিগারেটের আগুনে খুব ছিদ্র করতে ইচ্ছে করছিল। নাহ! আমি তেমন কিছু করিনি। ছেলেমানুষী আমার মধ্যে কোনকালেই ছিলোনা!
আমি যথারীতি কাজে যাই, ফিরে আসি। ছুটির দিনে চুটিয়ে মদ খাই। বন্ধুরা হাসে, আমিও হাসি, বেশ শদ করে!
কোন কোন গভীর রাতে মাথায় একটা ভোঁতা ধরনের যন্ত্রণা হয়। ঘরটা যেন আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে, চারপাশ থেকে ঘরেরে দেয়াল কেমন চেপে আসতে থাকে। আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাই। হাঁটতে থাকি এ মাথায়, ও মাথায়। কখনো কখনো আমার পিছনে কেউ হাঁটে, হাঁটা একটু মন্থর করলে পাশে চলে আসে সে। খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “আমি কি তোমার সাথে হাঁটতে পারি?” আমি গভীর আগ্রহে তার দিকে তাকাই। কোথাও কোন মিল কী আছে? মাঝে মাঝে এমনিতেই জিজ্ঞেস করি-“তুমি কি নাটালি পোর্টম্যানের নাম শুনেছ?” সে দ্বিধান্বিতভাবে ভাবার চেষ্টা করে। আমি তাকে বা তাদেরকে পিছনে ফেলে চলে আসি। পিছন থেকে চীৎকার শোনা যায়-“তোমার জন্য ডিসকাউন্ট আছে!”
বসন্ত এলে বেশ ভালো লাগে। নানা ধরনের ফুল ফোটে। যখন সাদাফুল গুলো ফোটে তখন সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে অনেক সাদা ফুল ছিল। বেলা শেষে সব কাজের পরে মা সেই সাদা ফুলেদের মাঝে আমার হাত ধরে হাঁটতেন। মা হাঁটার সময় কোন কথা বলতেননাহ।ঠাৎ একদিন বলেছিলেন-“তুই কি জানিস, ফুলেদের মধ্যে সাদা ফুল আমার সবচেয়ে প্রিয়!”
অনেকদিনপর মায়ের সাথে সেদিন কথা হয়েছিল। আমার মা খুব একটা কথা বলেন না। জিজ্ঞেস করেছিলাম-“কেমন আছো?” মা বলেছিল-“তুই কি আমাকে তোর কাছে নিয়ে যেতে পারবি?আমার এখানে একটুও ভালো লাগছেনা!”
আবার সেই পুরানো রোগ মাথা চাড়া দিচ্ছে কিছুদিন যাবৎ। এই জায়গা, মানুষজন, চেনা রাস্তা সব কিছুই কেমন অসহ্য লাগছে। সব কেমন দেখা হলেই বলছে, “ভালো লাগছেনা, ভালো লাগছেনা, তোমাকে ভালো লাগছেনা।“ এবার আরও দূরে কোথাও যেতে হবে!
গতরাতে কয়টা পর্যন্ত মদ খেয়েছি, ঠিক মনে করতে পারছিলামনা। পাশে ফোনটা আতংকিতভাবে বেজেই যাচ্ছিল। ফোনের ওপারের খবর শুনেও আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমি কি ঘুমিয়ে ছিলাম, নাকি সজাগই ছিলাম। ফোনের খবরটা শুনে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর বের করেছিলাম ড্রয়ার ঘেঁটে পুরানো একটা ছবি। ওখানে আমার মায়ের ভাবলেশহীন-উত্তেজনাহীন মুখটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে! কী আশ্চর্য! ছবিটাতে আমার মায়ের মুচকি হাসি দেখা যাচ্ছে! মহিলা হাসতেও জানতেন নাকি! জানতাম না তো!
এবার চলে যাওয়ার আগে আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। যেতে ইচ্ছা করলো না! এখানে যখন আসি, জায়গাটা প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়নি। বড্ড বেশি সাদা-সাদা! ইদানীং গাছে গাছে বেশ অনেক ফুল এসেছে। বন্ধু দেখিয়ে বলছিল-“দেখেছ, কেমন সুন্দর সাদা ফুল”! আমার বলতে ইচ্ছা করছিল-“আমার সাদা ফুল পছন্দ নয়, এগুলো কেন, কোন সাদা ফুল পছন্দ নয়!”
আজকাল যখন খুব মন খারাপ হয়, তখন বেশ বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে। ছোট বচ্চাদের মত, গাল-মুখ ফুলিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতে ইচ্ছা করে-“আমি বাড়ি যাব! আমি বাড়ি যাব!” তখন খুব করে আমি একটা বাড়ির ছবি আঁকার চেষ্টা করি! আশচর্য! আমি কিছুই আঁকতে পারিনা! কোন বাড়ির ছবি আমি মনে করতে পারিনা!