তোমায় ভেবে ভেবে

তোমায় ভেবে ভেবে

রাত ১:৪৪ মিনিটে শোয়া ছেড়ে উঠে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ১৭৩ তম বারের মত কাঁদল তিতিন। কান্নার এই হিসেবটা তিতিনের অনেক কষ্ট করে রাখতে হয়। যখন তখন চোখে পানি এসে পড়ে, খুব ই যন্ত্রণার ব্যাপার। তিতিনের একটা মলাট বাঁধা রোলটানা খাতা আছে, উপরে লেখা “তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাব।” হেলাল হাফিজের কবিতার নিচে কেন গোটা গোটা অক্ষরে “রাফিয়া নূর তিতিন” লেখা- ব্যাপারটা স্পষ্ট না। এই খাতায় তার সমস্ত কান্নাকাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। আরো বেশ কিছু অদ্ভুত কথাবার্তাও আছে।

তিতিন মেয়েটা নিজেই বেশ অদ্ভুত।

বহুক্ষণ পর যখন চোখ তুলল ফোনের ডিজিটাল সময় তখন দেখাচ্ছে রাত ২:১৪। বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে মাথার পাশে রাখা মলাট বাঁধা খাতা টেনে নিয়ে তিতিন লিখল-
“কান্না: ১৭৩
কারণ: আজ আপনি অনলাইনে। ভাবছিলাম কথা হবে হয়ত! আমি অপেক্ষা করছিলাম, তার মাঝে কোন এক মেয়ে আপনার পাশে দাঁড়ানো ছবি দিল।
শাস্তি: যখন আপনি আমার হবেন, আজকে আমাকে কাঁদানোর জন্য শীতের রাতে আপনাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে- মশারি আর কম্বলের বাইরে।”
খাতাটার সামনের দিকে আরো অনেক লেখা। সব একি নিয়মের। কান্নার নাম্বার, কারণ, শাস্তি। মাঝামাঝি অর্থহীন জাতীয় কিছু কথা……”এভাবে ভালবেসে ফেলার অর্থ কি? আপনি জানেন ও না কিছুই। আমি কখনো বলতে পারবনা।”
“আসাদ, আমার কষ্ট হয় খুব। আপনি যদি আর কাওকে চান! কোনদিন আপনার পড়া হবে এই খাতাটা?”

একদম প্রথম কান্নার বর্ণনায় যাওয়া যাক।
“কান্না:১
কারণ: আপনি। আপনাকে সামনে দেখলে আমার দম বন্ধ লাগে। ছবি দেখলে মনে হয় আমি নিঃশ্বাস পাচ্ছিনা।
শাস্তি: এই লেখাগুলো পড়া।”

আবৃত্তি সভা থেকে অনেকগুলো ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা এক হয়ে বাছাই করা কয়েকজনকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিল। আসাদ তাদের একজন। আবৃত্তি নিয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে স্টেজে উঠেই প্রায় সবাইকে চমকে দেওয়া ভরাট কন্ঠে আসাদ বলেছিল “আমার নীল রঙ পছন্দ। কষ্টের রঙ কি আপনারাও নীল জানেন?”
তিতিন বুঝতে পারছিলনা আসাদ কোন অপ্রকাশিত কবিতা আওড়াচ্ছে কিনা। ঠিক তখন ই খানিকটা হেসে উঠে আসাদ বলল “এটাই হচ্ছে কথা আর আবৃত্তির বেসিক পার্থক্য। কবিতায় আপনাকে তীব্র অনুভূতিদের ছড়িয়ে দিতে হবে, আর কথায় অনুভূতিরা না চাইলেও ছড়িয়ে যাবে। ব্যাস!”

ঠিক ওই মুহূর্তেই কি তিতিনের আসাদ নামক একজন অপরিচিত মানুষকে ভাল লেগে গিয়েছিল, না তার অনেক পরে- যখন তাদের পরিচয় হল আরেক আবৃত্তির সভায়; কেজানে! তিতিনের মনে পড়ে পরিচয়ের পর পর ই খুঁজে বের করে সে আসাদের ফেসবুক আইডি, সেন্ড রিকুয়েস্ট এ চাপ না দিয়ে বসে থাকা হয় আরো কিছুদিন। পরে হুট করে আসাদ ই এক অনুষ্ঠানের কারণে তাকে জানাতে যোগাযোগ করে। ওইবার দেখা হওয়ার পরে তিতিন আবিষ্কার করল আসাদের দিকে সে তাকাতে পারছেনা। বেশ কিছুক্ষণ তাকালেই চোখে পানি এসে পড়ে, আর মনে হয় দম বন্ধ লাগছে।

তাদের কখনো সখনো কথা হয়। খুব অল্প। হয়ত হঠাৎ একটা মেসেজ “কি অবস্থা?” এর বেশি কথাবার্তা কেন যেন তিতির আগাতে পারেনা বা চায়না। তার ভয় হয়। সে জানে আসাদ তাকে চায়না; দুদিন পর আসাদ যদি আর কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, নিজেকে সামলানো কঠিন হবে বলেই হয়ত! তিতিন শুধু এটুকুই খোঁজ নিয়েছে আসাদের কেও আছে কিনা, নেই যেহেতু; একতরফা এই বোকা বোকা অপেক্ষায় তিতিনের আপত্তি নেই।

তিতিন বড় ধরণের ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে আবার তাকালো ছবিটার দিকে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। চোখ পর্যন্ত না ছোঁয়া মিথ্যে হাসি। তিতিন এই বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। আসাদ মন থেকে হাসে খুব কম। হাসতে হয়, তাই হাসে জাতীয় একটা ব্যাপার আছে- কিন্তু তার চোখ বিষণ্ণই থেকে যায়।

ফোন রেখে দিয়ে ঘড়ি দেখল তিতিন। ২:৫৩.. বিছানা ছেড়ে উঠে গেল সে। তার খানিকক্ষণ পরেই তাকে জায়নামাযের সিজদায় ফুলে ফুলে কাঁদতে দেখা গেল।

“যদি সম্ভব হয় তাহলে হেলাল হাফিজের প্রস্থান কবিতাটা আবৃত্তি করে পাঠাবেন তো! ভার্সিটিতে করতে হবে আমার, একটু শোনা থাকলে ভাল হত।”

তিতিনের মেসেজ। মেসেজটা দেখে আসাদ নিজের মধ্যে কিছু যায় আসেনা জাতীয় ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে পড়ল। এই মেয়েটাকে তার প্রচণ্ডরকম ভাল লাগে, হয়ত শুধু ভাল লাগেনা- তার চেয়েও বহু বেশি কিছু। কিন্তু আসাদের আর মাত্র কিছুদিন পর দেশের বাইরে চলে যেতে হবে, এত দূরে কিভাবে পারবে মেয়েটা অপেক্ষা করতে- আজকাল কে কার জন্য অপেক্ষা করে…..এসব ভেবে কখনো বলা হয়ে ওঠেনা। তবে হুম, তিতিনের দিকে তাকালে তার মনে হয় তিতিন অপেক্ষা করবে। অবশ্যই করবে। কিন্তু আসলেই কি করবে? ঈশা অপেক্ষা করেছিল? ঈশাকে তো সে সারাজীবন পাশে রাখতে চেয়েছিল। কই! কিছুই তো হলনা!
আসাদের ক্লান্ত লাগে। ফোন দূরে ফেলে রেখে সে শুয়ে পড়ে। এসব অর্থহীন কথা রাখার মানে নেই।

তিতিন ফায়ারপ্লেসের আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোলের ছ মাসের বাচ্চাটা আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বারবার। বাচ্চার বাবা তিতিনের সামনের ছোট্ট টি টেবিলে দুটো কফির মগ রাখতেই তিতিনের কোল থেকে বাচ্চাটা তার বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ছ মাসের টুকুন আর টুকুনকে নিয়ে খেলায় ব্যস্ত তারিকের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তিতিন আবার আগুনের দিকে মনোযোগ দিল।

ফায়ারপ্লেসের এক কোণে এখনো আধপোড়া টুকরো একটা কাগজ রয়ে গেছে। লেখা:
“কান্না: ৯৫৬
কারণ: আপনি আমার হলেন না।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত