দুনিয়ার যতসব দেশ আছে চীন হলো আয়তনের দিক থেকে তাদের মধ্যে অন্যতম বড় দেষ। আবার সবচেয়ে বেশি লোক বাস করে এই দেশে। চীনদেশের লোককাহিনী গুলোও খুব সুন্দর। এদেশে রয়েছে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি। প্রায় সব জাতিরই রয়েছে নানারকম লোককাহিনী।
সবসময়ই আকাশে চাঁদ উঠে। হঠাৎ একদিন চাঁদ উঠলো না। অনেকদিন আগের ঘটনা এটি। অথচ সে রাতে আকাশ ভরা তারা ঝিকিমিকি করছিল। আহার জোগার করতে সাতটা নেকড়ে বাঘ নিজেদের আকার বদলে সাতজন যুবকের রূপ ধরে পাহাড়ের নিচে নেমে গেল। অল্প দূরেই একটি বাড়িতে থাকতো সাতটি কুমারী মেয়ে। তারা প্রায় সারা দিনই ঘরে বসে বসে সুতো কাটতো। তাদের বাড়ির দরজার এক ফুটো দিয়ে সাতটি নেকড়ে সাত বোনকে দেখলো। ভেতরে ঢুকে মেয়ে কটাকে খেয়ে ফেলার জন্য নেকড়ে বাঘগুলো দরজায় ঘা দিতে লাগল। দরজার সেই ফুটো দিয়েই সাত বোন বাইরে সাতজন অচেনা যুবককে দেখে অবাক হয়ে গেল, দরজা খোলার সাহস পেল না। মেয়েরা দরজা খুলছে না দেখে নেকড়ে বাঘগুলো বললো, ‘আমাদের ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। আমাদের একটা গরু হারিয়ে গিয়েছে, গরু খুজতে খুজতে অন্ধকারে আমরা নিজেরাই পথ হারিয়েছি। আমরা কি আপনাদের বাড়িতে রাতটা কাটাতে পারি?’
সাতবোন বলল আমাদের বাবা-মা বাইরে। আপনাদের এখানে থাকতে দিলে অনেক অসুবিধা আছে। আপনারা কষ্ট করে আর এক বাড়িতে যান।
নেকড়ে বাঘগুলো বললো, ‘তাহলে আমরা আপনাদের বাড়িতে রাত কাটাতে চাই না, কিন্তু একটু বিশ্রাম না করতে পারলে তো আমাদের চলার সাধ্যি নেই। আমরা এখানে শুধু একটু বিশ্রাম নেবো, কেমন?’
কোনো উপায় না দেখে সাত বোন দরজা খুললো, অতিথিদের বসার জন্য সাত বোন চেয়ার এগিয়ে দিল। অতিথিরা চেয়ারে বসার সময় বড় বোনের চোখে পড়লো অতিথিদের প্রত্যেকেরই পেছন দিকে একতা করে লেজ গুটানো আছে। তা দেখে বড় বোন ভীষণ ভয় পেয়ে কাউকে কিছু না বলে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।
অতিথেয়তা করে অতিথিদের হাতে একটা করে পানির গ্লাস দেওয়ার সময়ে মেজো বোন দেখলো প্রত্যেক অতিথির হাতে কালো কালো ঘন লোম, ভয়ে আর টু শব্দটি না করে সেও পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।
অতিথিরা যাতে পা ধুতে পারে সেজন্যে সেজো বোন একটা গামলায় পানি ঢালতে ঢালতে হঠাৎ দেখলো অতিথিদের পায়ে ঘন কালো কালো লোম, আতঙ্কে শিউরে উঠে সেজো বোনও পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল।
চার নম্বর বোন অতিথিদের কতকগুলো চালের পিঠা খেতে দিল, অতিথিরা পিঠা নেয়ার সময়ে সে দেখলো অতিথিদের হাতের ছুঁচলো নখে পিঠাগুলিতে পাঁচটা করে ছ্যাদা হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে তার শরীর অবশ হয়ে গেল, তার হাতের পিঠাগুলোও মাটিতে পড়ে গেল। তার অবস্থা দেখে নেকড়েগুলো পা ধোয়া, পানি খাওয়া, পিঠা খাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ব্যাপার কী? কী হলো/’ চার নম্বর বোন আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু ভয়ে তার গলা থেকে কোনো স্বর বেরুলো না, তার পা দুটোও যেন শক্ত হয়ে পড়লো।
কোনো উপায় না দেখে সে চুপচাপ পিঠাগুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একপাশে বসে আবার সুতো কাটতে শুরু করে দিল। বাইরে তার চালচলন স্বাভাবিক দেখে সাতটি নেকড়ে আবার বসলো, বসে খেতে শুরু করলো। চার নম্বর বোন তার ছোট তিনটে বোনকে বললো, ‘যারা এসেছে তারা মানুষ নয়, নেকড়ে। মানুষ খাওয়ার জন্যে ওরা মানুষের রূপ ধরেছে। এখন এর একটা কোনো বিহিত করতে না পারলে ওরা আমাদের মেরে খেয়ে ফেলবে’। একথা শুনে ছোট বোন তিনটে নিদারুণ ভয়ে চাপা সুরে কাঁদতে শুরু করলো, পাছে নেকড়েগুলো শোনে এই ভ্যে জোরে কাঁদতেও সাহস পেল না। সবচেয়ে ছোট বোন অর্থাৎ সাত নম্বর বোন ৬ ছয় নম্বর বোনকে বললো, ‘তুমি আমার বড়, তুমি আমাকে বাঁচাবার একটা উপায় ঠাওরাও’।
ছয় নম্বর বোন পাঁচ নম্বর বোনকে বললো, ‘তুমি আমার বড়, আমাকে নেকড়ে বাঘের কবল থেকে বাঁচানো তোমার দায়’।
পাঁচ নম্বর বোন কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত চার নম্বর বোনকে বললো, ‘আমাদের চার বোনের মধ্যে তুমিই বড়, তোমার উচিৎ একটা উপায় বের করে আমাদের সবাইকে বাঁচানো’। কিন্তু চার নম্বর বোন ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল নেকড়ে বাঘদের সামনে থেকে চার বোনের পালানো খুবই কঠিন। সে ছোট বোন তিনটিকে বললো, ‘আমাদের বড় তিন বোন বিপদের সামনে শুধু নিজের নিজের কথা চিন্তা করে চুপ করে পালিয়ে গেল, এখন নেকড়ে বাঘদের কবল থেকে আমাদের বাঁচতে হলে আমাদের নিজেদেরই একটা মতলব বের করতে হবে। নইলে আর রক্ষা নেই’। চার নম্বর বোনের কথায় ছোট তিন বোন সায় দিলো। চার বোনই বসে বসে সুতো কাটবার ছলে ফিসফিস করে পরামর্শ করতে লাগল। চারটী চরকার বনবন শব্দের ধরন ক্রমে ক্রমে বদলে গেল, চাপা কান্নার শব্দ যেন থেমে গেল। মাথা ঘামিয়ে চার বোন একটা চমৎকার মতলব বের করলো।
একটু পরে চার নম্বর বোন উঠে দাঁড়িয়ে নেকড়ে বাঘদের বললো, ‘আমাদের ভীষণ ঘুম পেয়েছে, আপনাদের কি খাওয়া শেষ হয়নি’? নেকড়েগুলো বললো, ‘বেশি রাততো হয়নি! তাছাড়া তোমাদের বড় তিন বোন এখনও ফিরে আসেনি। তোমরা বরং আগুনের কাছে এসে বসো, গা গরম হবে’।
চার নম্বর বোন রাজি হওয়ার ভান করে বললো, ‘তাই ভালো, শুতে যাওয়ার আগে একটু আগুন পুইয়ে নিই। তবে আগুনটাতো আরো চাঙ্গা করা দরকার। আমি বরং উপর তলা থেকে আরো কিছু কাঠ নিয়ে আসি, কেমন’?
এ কথায় নেকড়ে বাঘগুলোর কোনো সন্দেহ্ হলো না।
চার নম্বর বোন ঘর থেকে বেরিয়ে কাঠের সরু সিড়ি বেয়ে উপরে উটলো। একটু পর উপর তলা থেকে সে তার ছোট বোন তিনটিকে ডেকে বললো, ‘আমি একা এতো কাঠ বয়ে আনতে পারছিনা, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো, তোমরাও কিছু কাঠ বয়ে নিয়ে যাবে’।
একথায় ছোট বোন তিনটিও সে ঘর থেকে বেরিয়ে উপর তলায় উঠলো। নিচে সাতটা নেকড়ে বাঘ পিঠা খেয়ে বসে আগুন পোহাতে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন চার বোন কাঠ নিয়ে ফিরবে। বহুক্ষণ কাটলো, তবু চার বোনের উপর থেকে ফেরার নাম নেই। শেষে নেকড়েগুলোর আর ধৈর্য রইলো না। নেকড়েগুলোর মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে লাফ মেরে মেয়েগুলোর খোঁজ নিতে গিয়ে আর ফিরে এলো না। বাকি চারটে নেকড়ে ব্যাপার কিছুওই বুঝে উঠতে পারলো না, তবে তাদের মনে হলো হয়তো কোনো অঘটন ঘটেছে, একা একা আর উপরে যাওয়া ঠিক হবে না। চার নম্বর নেকড়ে বাকি তিনটে নেকড়েকে তার নিজের পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড় করালো, প্রত্যেক নেকড়ে তার সামনের নেকড়ের লেজ শক্ত করে ধরে রইলো, তারপর মজবুত লাইনবন্দী অবস্থায় নেকড়েগুলো কাঠের সরু সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। সবচেয়ে সামনে ছিল চার নম্বর নেকড়ে, আর সিড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সে জায়গা ঘিরে চার বোন অপেক্ষা করছিল চারটে মোটা মোটা রক্তমাখা কোঁতকা হাতে নিয়ে। নেকড়ের সারির প্রথম নেকড়ের মাথাটা উপরতলা বরাবর পৌছতে না পৌছতেই মাথাটা প্রচন্ড ঘায়ে বেরিয়ে এলো, সেইসঙ্গে পড়ে গেল বাকি তিনটে নেকড়েও, বিকট চিৎকার করতে করতে ওরা আগুন থেকে কোনোমতে বেরিয়ে ছুটে বাইরে চলে গেল, বোন চারটেও তাড়াতাড়ি নিচে নেমে দরজায় খিল এটে দিল। ওদের খিল আটতে দেখে নেকড়ে তিনটে বুঝতে পারলো চার বোন ফন্দি করে ওদের এই হাল করেছে আর আগের চারটে নেকড়েকে খতম করেছে। এটা বুঝতে পারা মাত্র নেকড়ে তিনটে ক্ষেপে গেল। প্রচন্ড আক্রোশে ওরা ওদের আসল রূপ ধরে বন্ধ দরজার উপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো, বারবার গর্জন করে, থাবা মেরে মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করলো, কিন্তু দরজাটা ছিল খুব শক্ত, অনেক চেষ্টা করেও ওরা দরজাটা একটুও নড়াতে পারলো না। তারা পিছনের দরজা দিয়ে কোনো কায়দায় বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইল। কিন্তু দেখা গেল পিছনের দরজাও শক্তভাবে বন্ধ।
হঠাৎ পেছনের দরজার কাছে পাঁচ নম্বর নেকড়ে একটা পিপে দেখতে পেল, পিপের ঢাকনাটা যেন পুরোপুরি লাগেনি। পাঁচ নম্বর নেকড়ে উকি মারতেই তার চোখে পড়লো দুল-পরা একটা কান। সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েটা এক কামড়ে পুরো কানটা ছিড়ে নিল।
ওদিকে ৬ নম্বর নেকড়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখতে পেল মাথার উপর একটা গাছের ডাল থেকে কার যেন একটা পা ঝুলছে। নেকড়েটা লাফ দিয়ে উঠে এক কামড়ে সে পায়ের একটা আঙ্গুল ছিড়ে নিল। পা-টা ছিল মেজো বোনের। সে পালিয়ে এসে গাছে উঠে লুকিয়েছিল, কিন্তু একা একা ভয়ে সে স্থির থাকতে পারছিল না। তাতেই নেকড়ে বাঘটা তার পা দেখতে পেয়েছিল, তাড়াতাড়ি পা গুটিয়ে নিতে পারার আগেই নেকড়েটা তার পায়ের আঙ্গুল কামড়ে ছিড়ে নিয়েছিল।
সাত নম্বর নেকড়েও অনবরত গো গো করতে করতে ছুটোছুটি করছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়লো এক ঘন ঝোপের ভেতর থেকে কার যেন পেছনের অংশ বেরিয়ে রয়েছে। অমনি নেকড়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে সে পেছনের অংশ থেকে এক কামড় মাংস ছিড়ে নিল। আসলে সেজো বোনটা একা একা পালিয়ে এসে ঝোঁপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে উবু হয়ে বসেছিল, উটপাখির মতোই সে বুঝতে পারেনি যে তার পেছনের অংশ বেরিয়ে রয়েছে। ফলে নেকড়ে গ্রাসে তার বেশ খানিকটা মাংস চলে গেল বোঝা গেল কোথাও বসার উপায় তার বহু দিন থাকবে না।
স্বার্থপররা সবসমই ধরা পড়ে, ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এখানে তাই ঘটলো। বড় বোন, মেজো বোন, সেজ বোন শুধু তাদের ভীরুতার জন্য নয়, তাদের স্বার্থপরতার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলো। অথচ তাদের ছোট চার বোন জোট বেঁধে খৌশল করে চারটে নেকড়ে বাঘকে জব্দ করে তাড়ালো।