একটি লাশের গল্প

একটি লাশের গল্প

ডিসেম্বরের একদম শুরুতে পহেলা ডিসেম্বর.. . এই সময়টাতে যেহেতু গ্রামে সব ধান কাটা হয়ে যায়। তাই মাঠ গুলোও ফাঁকা থাকে। যারজন্য সবাই এই সময়টাতে মাঠে মজা করে ক্রিকেট খেলতে পারি।সকাল থেকে সন্ধ্যা প্রতিদিন খুব খেলা হয়। শুধু দুপুরে সবাই বাড়িতে খেতে যায়,গোসল করে। প্রতিদিন সকাল 9টা থেকে খেলা শুরু হয়। অার অামি সবসময় একটু লেইট করেই যাই। যেমন 9.15 এ বা 9.30 এ।

এরজন্য অবশ্য বকাও শুনতে হয় খুব। অার অাজকে গেলাম 10:00 টার সময়। স্বাভাবিক ভাবেই অাজ বেশি বকা শুনতে হবে।কিন্তু অাজ যাওয়ার পর দেখি মাঠে কেউ নেই! অামি কিছুটা অবাক হলাম অবশ্য। পরে মাহফুজরে কল দিলাম। ও বলল পাশের গ্রামে (গ্রামের নাম বলল) গেছে।অার এখন অাইসা পড়তেছে। তাই অামি মাঠেই বইসা রইলাম। হালকা রোদ উঠছে।

ভালই লাগছে……. . . অারো 30 মিনিট পর একসাথে সবাই অাসল।
: কই মরতে গেছিলা সবাই?
: অারে মিয়া ইয়ে ( একজনের নাম) মারা গেছে জানো না? (সানজিমুল বলল)
: মানে? কবে মারা গেল? কিভাবে?
: কালকে রাত্রেই মারা গেছে।গলায় ফাশ দিয়া নাকি মরছে।খেলতে অাইসাই সবাই জানলাম।পরে দেখতে গেলাম।
: ওও…….. . সেদিন সকালে অার খেলা হলনা।সবাই কেমন জানি গম্ভির হয়ে গেছে..!!

যাইহোক,বিকালের মাঝেই সবাইকে অাগেরমত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দেখলাম। হয়তো হঠাৎ করে একজন সুইসাইড করা ব্যক্তির লাশ দেখে ওরা থমকে গেছিল। বিকালে অাবার খেলা শুরু করলাম। ওও অাজ অাবার অামাদের এক বন্ধু মাজহারুলের জন্মদিন। তাই সবাই জোর করেই ওর কাছ থেকে ট্রিট নিব।যদিও এ খুব কিপটা…. কিন্তু সবাই ইমোশোনাল কথাবার্তা বলে ওর মনটা নরম করে দিলাম। যেমন,
— ভাই বছরে একটা দিন সবাইকে খাওয়াইলে তোর কম পড়ব নাকি?
— অাচ্ছা তুই না খাওয়াইলে বুঝব অামরা তোর কাছের বন্ধু না ইত্যাদি ইত্যাদি….. . .

রাত 8 টা বাজে। যেহেতু গ্রাম এলাকা তাই এতক্ষণে সব নিরব হয়ে গেছে। গ্রামে রাত হলেই কেমন জানি পরিবেশটা থমথমে হয়ে যায়। যেন, এ গ্রামে কেউ থাকেনা..!! 8.10 এর মাঝেই সবাই একত্রিত হলাম। অামি,সানজিমুল,রায়হান,সাজ্জাদ,মাহফুজ,অার মাজহারুল। এইগুলা তো ওদের ভাল নাম। ডাক নাম গুলা বললাম না ।

অামাদের উদ্দেশ্য হল শহরের একটা রেষ্টুরেন্টে যাব।অবশ্য অামাদের গ্রাম থেকে মাত্র 5কিলোমিটার দূরে। অার সবাই বাড়িতে বলে অাসছে।অাজ অামাদের বাড়িতে থাকবে।অামরা সবাই অাজ একসাথে পড়ব রাত্রে, মানে গ্রুপ ষ্টাডি করব অার কি। . যাইহোক,যখন রেষ্টুরেন্টে গেলাম তখন 9টা বেজে 5মিনিট। সবাই ইচ্ছেমত খাইলাম মজাও করলাম খুব।এই সেই করতে করতে রাত 10.30 বেজে গেছে। অার মজার ব্যাপার হল,মাজহারুল কে এক টাকাও দিতে হয়নি।সব অামরাই দিয়ে দিছি।সাথে গিফটও দিয়েছি।বেচারা,খুব খুশি হইছে মনেহয় ।

এবার তো ফেরার পালা।কিন্তু জানি এখন অার সিএনজি বা অটো পাওয়া যাবেনা। অবশ্য ব্যাপার না।5কিলোমিটার হাইটাই অাসা যাবে।তাই সবাই হাটা ধরলাম…… মাহফুজের রিকোয়েষ্টে সাজ্জাদ একটা গান ধরল।সাথে সবাই শুরু করলাম। জানতাম যদি পাখি দিয়া যাবা ফাঁকি, দেখতাম না তোমার অার ওই মুখ..অামারে কান্দায়া পাও কি সুখ। কিছুক্ষন পর পেছন থেকে একটা এ্যাম্বুলেন্স অাসল। অামরা সাইড দিলাম। কিন্তু অামাদের সাইডেই ড্রাইবার এ্যাম্বুলেন্স টা দাড়া করাইল।
— অাপনারা কোথায় যাবেন ভাই? — (….) অামি গ্রামের নাম বললাম।
— অাচ্ছা অামার সাথে অাসেন অাপনাদের নামিয়ে দিব।
— লাগবেনা..অামরা যেতে পারব। কেউ যখন হঠাৎ করেই ফ্রি কিছু অফার করে…এর মাঝে তো কোন কারণ থাকেই তাইনা?তাই না করে দিছি। কিন্তু লোকটাকে দেখে কেমন মায়া লাগছিল। যেন তিনি অামাদের কাছে সাহায্যপ্রার্থী। তাই বললাম অাচ্ছা চলেন যদিও জেনেছিলাম গাড়িতে লাশ অাছে।কিন্তু একজনের বিপদে তো অারেকজন সাহায্য করবে এটাই নিয়ম। অার অামরা 6জন অাছি তাই ভয়ের কিছু নেই। অার যেহেতু 6 জন একসাথে অাছি নিশ্চয়ই অামাদের নিয়ে ড্রাইভার উধাও হয়ে যাবেনা। সবাই গাড়িতে উঠলাম। কিন্তু গাড়িতে কেমন একটা গন্ধ গাড়িতে। অবশ্য এই গন্ধটা হসপিটালে পাওয়া যায়। গাড়ি ষ্টার্ট দিল.. এক কিলোমিটার যেতে যদি 2মিনিট লাগে।5কিলোমিটার যেতে মাত্র 10-12 মিনিট লাগবে।

অামি এ্যাম্বুলেন্সের সামনে বসছি।ড্রাইভারের সাথে। তো, খানিকটা পথ যাওয়ার পরই মনে হল পিছনে কেউ নাড়াচাড়া করছে। অামি মনে করছি ওরাই দুষ্টমি করছে।কিন্তু হঠাৎ গাড়ির ভিতরে রাখা লুকিং গ্লাস।যেটা দিয়ে পিছনের গাড়ি অাসছে কিনা তা দেখে।সেখানে চোখ পড়ল।অামি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম কেউ,সাদা কাপড় পড়ে বসে অাছে..!! অার অামার সাথে যারা অাসছিল ওদের কেউ সাদা কাপড় পড়ে নাই।তাহলে ও কে? অার লাশ নিশ্চয়ই বসে থাকবেনা। অার যদি সে ড্রাইভারের সাথেই অাসত,তবে নিশ্চয়ই সামনে বসত। অাবার লুকিং গ্লাসে তাকাইলাম।এবার দেখি কেউ নেই।তবে সুয়ে অাছে সাদা কাপড় পড়ে কেউ।কি অদ্ভুত রকমের এ্যাম্বুলেন্স এইটা..!!

কেমন জানি অন্য গুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম। . অাবার একটু পর যখন তাকাইলাম।তখন স্পষ্টই দেখতে পারলাম।ইনি সেই ব্যাক্তি যিনি কাল রাত্রে মারা গেছেন। অার অামি অাজ সকালে উনার লাশ না দেখলেও উনাকে তো চিনি ঠিকই । কিন্তু মুহুর্তেই মনে হল ।যা দেখেছি তা ভুল দেখেছি। কারণ 10 সেকেন্ড পরই অার তিনি ছিলেন না..!! অার ততক্ষণে ভয়ে শরীরের রক্ত যেন পালাতে শুরু করছে। ধুর..!! কি ভুলটাই করেছি।শুধু শুধু সামনে না বসে পিছনে সবার সাথে বসলেই তো পারতাম। কিন্তু এখন অার মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করতে পারছিলাম না যে,সবাইকে অামি ডাক দিব।বা ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলব। অাবার গাড়ি চলছে..কিন্তু এতক্ষণে অামরা তো পৌছে যাওয়ার কথা..!!

যাইহোক,অামি চোখ বন্ধ করে অাছি।কিন্তু পিছনে অাবার শব্দ শুরু হয়েছে। অনেক কষ্ট করে একটা চোখ খুলে ড্রাইভারের দিকে তাকাইলাম ..কিন্তু এবার যা দেখলাম তা দেখার জন্য কোনভাবেই অামি প্রস্তুত ছিলাম না। . . দেখি ড্রাইভারের সিটেই সেই মৃত ব্যক্তিটা বসে অাছে।অামি অাবার চোখ বন্ধ করে বসে অাছি।মনে মনে শুধু ভাবছি।যা দেখেছি তা সবই অামার মনের ভুল।এর বেশি কিছু না। যা দেখেছি কোনটাই সত্য নয়। এবার যাই হোকনা কেন,চোখ অার খুলবনা। কিন্তু একটু পরই অাবার চোখ খুললাম। দেখলাম সব ঠিকঠাক কোন সমস্যা নেই। এবার লুকিং গ্লাসেও তাকিয়ে দেখলাম সব ঠিকঠাক। পিছনে সাদা কাপড় দিয়ে কাউকে ডেকে রাখা হয়েছে। কিন্তু ড্রাইভার কিছুটা অস্বাভাবিক অাচরণ করছিল।তার মুখটাকে শুধু ডান পাশ বাম পাশ করছিল।যেন কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অামি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলাম। ভাইয়া সাবধানে চালান। এবার তিনি অারো স্পিড বাড়িয়ে দিলেন। অামি কিছুটা বিগড়ে গিয়ে বললাম অাস্তে চালান ভাই। এবার তিনি রাগি চোখে অামার দিকে তাকালেন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। যেন দুই চোখে দুইটা মোমবাতি। অামি অাবার ভয় পাওয়া শুরু করলাম। এবার লুকিং গ্লাসে অার তাকাইলাম না। সরাসরি পিছনে তাকাইলাম। দেখি সেই মৃত ব্যক্তিটা বসে অাছে চোখ গুলো বড় বড় করে। অামি শুধু ভাবছি অামি যেন এই মুহুর্তে অজ্ঞান হয়ে যাই। একজন মৃত ব্যক্তিকে এমতাবস্থায় যে কেউ দেখলে স্বাভাবিক থাকতে পারবেনা।অার তার মুখটা ছিল কেমন জানি সেলাই করা। তাকে কি পোষ্টমর্টেম করতে নিয়ে গেছিল? হয়তো নিয়েছিল… . এবার তিনি বসা থেকে অাস্তে অাস্তে উঠলেন। অার অাসতে অাসতে সামনের দিকে অাসছিলেন। একসময় ড্রাইভারকে গলায় চেপে ধরল…অার অামার দিকে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাইল…. অাপনি শুধু কল্পনা করেন? একটা মৃত ব্যক্তি অাপনার দিকে তাকাই রইছে ভয়ঙ্কর ভাবে..কেমন লাগবে??? . . . . . কান্নার শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল… কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম।চারপাশের কিছু মানুষ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। অার অামরা 6জন সবার মাঝখানে বসে অাছি। অাসলে অামাদের এ্যাম্বুলেন্স টা এক্সিডেন্ট করেছিল একটা গাছের সাথে। অার সেই শব্দে নাকি,পাশেরবাড়ির লোকজন যায়া অামাদের উদ্ধার করে অানছে। . .

পরদিন সকালে সবাই বসে অাছি।সবাই অাজ খুবই গম্ভির….. অামিই শুরু করলাম।
: কাল তোমাদের কার সাথে কি হয়েছিল? অামার সাথে যা যা হয়েছিল সব খুলে বললাম। এবার একে একে সবাই বলা শুরু করল.. . মাহফুজ
: অামি হঠাৎ দেখি এ্যাম্বুলেন্সের ভিতর যে লাশটা ছিল। সেটা সকালের দেখে অাসা সুইসাইড করা লোকটাই।অার তিনি যখন হঠাৎ করে অামার দিকে তাকাইলেন….তারপর অার কিছুই মনে নেই।
ও এটা বলার সাথে সাথেই সবাই বলে উঠল..সেইম ঘটনা ওদের সাথেও হয়েছে…!! একটা গাড়িতে সবাই সেন্সলেন্স হয়ে গেছিল..!! অদ্ভুত ব্যাপার। তবে ড্রাইভারের ঘটনাটা অারেকটু অদ্ভুত ছিল। তার ভাষায়…
— অামি যখন গাড়ি চালাচ্ছিলাম।সেই হসপিটালের শুরু থেকেই কেমন জানি অদ্ভুত লাগছিল সবকিছু।অার অামার সহকারির বাড়ি থেকে ফোন অাসার কারণে,অাজ অামি একাই অাসি যেহেতু টাকার পরিমাণটা বেশি ছিল। কিন্তু খানিকটা পথ অাসার পরই বুঝতে পারি..গাড়িতে খুব শব্দ করছে। তখনই, সামনে অাপনাদের পাইলাম। অার খুব ভয় ভয় করছিল..তাই অাপনাদের রিকোয়েষ্টে করে গাড়িতে তুলি।কিন্তু তবুও মনেহচ্ছিল গাড়িতে খুব শব্দ করছে….কিন্তু শেষ মুহুর্তে এক্সিডেন্ট করার অাগ মুহুর্তে দেখি।যাকে,অামি গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছি…অর্থাৎ যে লাশটা নিয়ে যাচ্ছি। সেই লোকটাই রাস্তার মাঝখানে দাড়াই রইছে..!! অামি এরকম অবাক অাগে অার হইনি..!! তাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময় গাছের সাথে এক্সিডেন্ট করি।তবে, এক্সিডেন্ট করার ঠিক অাগ মুহুর্তে মনে হচ্ছিল…গাড়ি থেকে কিছু একটা চলে গেল। অার গাড়িটাও খুব হালকা হয়ে গেল…….!!

সেইদিন সকালেই লাশটাকে দাফন করা হল। লাশের সাথে যারা হসপিটালে গেছিল তারা সবাই নাকি সিএনজি দিয়েই চলে অাসছিল।যারজন্য, এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে লাশের সাথে কেউ অাসেনি। . সেই ঘটনার প্রায় সাত দিন পর্যন্ত অামরা সবাই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।তবে এখন স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর থেকে অার রাত্রে অামরা বের হইনা। কিছু কিছু ঘটনা চাইলেও ভুলা যায়না।এই ঘটনাটাও হয়তো কখনো অামরা ভুলতে পারবনা।
(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত