মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে গেছে। পাশে দেখি বৌ নেই! হঠাৎ খেয়াল করলাম কইতরী জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে আছে। এক হাতে এক মগ চা, আরেক হাতে সিগারেট টানছে!
তাজ্জিব বনে গেলাম! ও সিগারেটের ধোঁয়া একদম সহ্য করতে পারে না। সেজন্য আমিই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। খুব বেশি বিস্মিত না হওয়ার মতো করলাম। হয়তো মেয়েটা কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে।
নেমে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম— মন খারাপ? বাবার কথা মনে পড়ছে খুব?
কইতরী আমার দিকে কীভাবে যেন তাকালো— তোমার খারাপ লাগছে না? তোমার বৌ যে সিগারেট খাচ্ছে!
আমি স্বাভাবিকভাবে গলা নাড়ালাম— খারাপ লাগার কী আছে? সিগারেট কী মানুষ খায় না?
কইতরী কিছুক্ষণ আমার দিকে অমলিন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। যেন আষাঢ় মাসে অনাবৃষ্টি! ক্ষুধার্ত চোখে জবাব দিলো— আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে রাখবে? তোমার বুকে মাথা রেখে অনেক দিন ঘুমাই না।
বুকটায় চিৎ করে একটা শব্দ হলো! ওর কথাটা একদম মিথ্যে। রোজই আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। কালকে খালামণির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। রাত হয়ে গিয়েছিলো তাই আসতে দেয়নি।
একটা রাত শুধু মাত্র আমাকে ছাড়া ঘুমিয়েছে। কিন্তু কেন যেন আমারো মনে হচ্ছে কোনোভাবে ওর কথাটাই ঠিক! কেন মনে হচ্ছে জানি না। ওর শাড়ির আঁচলটা প্যাঁচিয়ে কোলে নিলাম। মুখ থেকে কফি আর সিগারেট মিশ্রিত একটা ঘ্রাণ আসছে। বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি।
কইতরী কাঁদছে! বাঁকা ঠোঁটে বললো— তুমি খুব পঁচা!
বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো! এমন শক্ত করে কোনোদিন ধরেনি! সারা রাত ঝিরিঝিরি কান্না করেছে। পরনে একটা সেন্ডো গেঞ্জি ছিলো। নাক চোখের পানিতে ওটা পুরো ভিজে কালো হয়ে গেছে!
কতবার জিজ্ঞেস করেছি, কী হয়েছে একবার বলো? ও জবাব দেয় না। কোনো কথা বলে না। শেষ রাতে ঘুম হয়েছে অল্প।
–কইতরীর কাছে পড়তে চারজন বাচ্চা ছেলে আসে। কইতরী স্কুলের শিক্ষিকা। ওরা এসে ফিরে গেছে। ম্যাম আজকে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি!
এক কাপ চা ওর খাটের পাশে রাখলাম। চায়ের ঘ্রাণে ওর ঘুম ভাঙলো। বেশ দাবী দেখিয়েই বললো— তোমার বাইকে চড়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার শখ আমার কী মিটবে না?
আমি আশ্চর্য হলাম! কইতরী কোনোদিন এরকম আবদার করে না! ও ভালো করেই জানে আমার বাইক কেনার অবস্থা নেই! হাসিমুখে বললাম— বাইক না, তোমাকে অটোতে তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিবো, ও ভাই সাবধানে যাবেন কিন্তু। আপনার হাতে আমার জান।
কইতরী উপহাস করলো যেন— মোরদ না থাকলে পুরুষের প্রেম বাড়ে!
মনে হলো কেউ বুকে সুঁই দিয়ে ঘা দিলো! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার সোনা বৌ কীভাবে এই কথাটা বলতে পারলো?
মুচকি হাসি দিলাম।
বলার কিছু নেই।
এ দেশে শিক্ষিত বেকারের এরকম কথা সহ্য করার অভ্যাস আছে। তাঁদের মনে একটুও ব্যথা অনুভব হয় না।
— তুমি তো জানোই, আমার বাবা ঘুষ দিয়ে চাকরী নেওয়ার পক্ষে না।
কইতরী দাঁত কামড়ে বললো— চাকরী করতে হলে কিছু টাকা দিতে হয়৷ সবাই দেয়। আমার বাবাও আমার চাকরীর সময় দিয়েছে। তোমার বাবা এটাকে ঘুষই কেন বলছে?
— যাই হোক। আমি বাবার কথার উপরে নাগ গলাতে পারবো না।
কইতরী খুশি হলো না। মুখটা কালো করে বলেছে— চা নিয়ে যাও। খেতে ইচ্ছে করছে না৷
নিজেকে খুব ছোট মনে হলো।
আচ্ছা বেকার স্বামীর হাতের বানানো চা খেলে কী পাপ হয়? উত্তর জানি না। মা বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম।
–বাবার সাথে বিয়েতে এসেছি। বাবার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। একটু আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাত্রাপথে পাত্রের মৃত্যু হয়েছে! গাড়ি দুর্ঘটনা। খবরটা পেলাম বাবার থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলো।
বাবার বন্ধু কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এমনিতেই মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না। মেয়ে যে সুন্দরী নয় তা না৷ মেয়ের যে কোনো সমস্যা আছে তা-ও নয়। শুধু এই বংশের মেয়েদের অল্প বয়সেই স্বামী মারা যায়। এজন্য কেউ বিয়ে করতে চায় না।
অনেক কষ্ট করে পাত্র জোগাড় হয়েছিলো।
বয়স পঁয়তাল্লিশ!
কালো করে একটা মোটকা লোক। আগে একটা বিয়ে করেছিলো। বৌ মারা গেছে। দুই মেয়ে আছে উনার৷ খুব যে টাকা পয়সা আছে তা-ও না। শুধু বংশের অভিশাপের জন্য এরকমটা হয়েছে। তবুও উনার সাথে বিয়েটা হয়নি। খবর এলো মারা গেছেন।
বাবা হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন। আমাকে ভালো করে দেখে বললেন— তোকে আজকে জামাই জামাই লাগছে। চল তোকে আজকে বিয়ে দিয়ে দিবো।
আমি হাসলাম। বাবা মাঝে মাঝে বেশ কৌতুক করেন। অন্দরমহলে নিয়ে গেলো। দেখলাম বৌ সেজে একটা মেয়ে কাঁদছে। আমার দেখতে খুব ভালো লাগছে। আমার মায়া হওয়ার কথা৷ কিন্তু হচ্ছে না।
তারপর কী হলো তা আমার কাছে আজও রহস্য! ফুল দিয়ে একটা ছোট্ট ঘর সাজানো হয়েছে। গোমটা টেনে সামনে একটা মেয়ে বসে আছে! আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি, মেয়েটার বিয়ে আমার সাথেই হয়েছে!
নিজেকে সামলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম— নামটা কী যেন আপনার?
— কইতরী!
বিয়ের দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে নদীর পাড় পর্যন্ত এসে গেছি সে খেয়াল হয়নি। হাত দিয়ে দেখলাম চোখে কয়েক ফোঁটা পানি এসেছে!
–দ্রুত গতিতে বাস চলছে। হঠাৎ এক বন্ধুর সাথে দেখা। কাকতালীয় ব্যাপার। অনেক বছর পরে পাশাপাশি দুজনের সিট! সাথে ওর বৌ বাচ্চাও আছে৷ পাঁচ বছরের একটা মেয়ে। আমার সাথে এমন ব্যবহার করলো যেন আমি মেয়েটার আপন চাচা।
আমার কোলে বসেই ঘুমিয়ে যায়। মেয়েটাকে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি। সত্যিই বাচ্চারা খুব নিস্পাপ হয়। ফেরশতার মতো। শ্বশুরবাড়িতে গিয়েই কইতরীকে বললাম— আমার একটা বাবু চাই।
কইতরী নাকটা খাঁড়া করে বললো— আমার এখনো বাচ্চা নেওয়ার বয়স হয়নি।
কথাটা আমার কাছে খুব তেতো লাগলো। একজন স্কুল শিক্ষিকার না কী বাবু নেওয়ার বয়স হয়নি!
— তা তোমার বয়স কবে হবে?
আমার চোখে চোখ রাখলো কইতরী— যবে তোমার সরকারি চাকরী হবে৷
কেমন লাগছে বলে বুঝানো দায়। আজকাল কী বাবা হতেও চাকরীর দরকার হয়?
জানি না, মা বেঁচে থাকলে এ-ও জিজ্ঞেও করতাম। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে খুব অকৃতজ্ঞ মনে হয়। ওর বংশের কালো ছায়ার কথা জেনেও যে বাবা ঘরের বৌ করেছে। তা কী ওর জন্য সাত জনমের কপাল নয়?
না কী আমি সত্যিই দুর্বল পুরুষ? অকেজো, অপদার্থ। যে একটা সরকারি চাকরী করতে পারে না। হ্যাঁ সরকারি চাকরীর সুযোগ সুবিধা বেশি। তাই বলে কী মানুষ সরকারি চাকরী ছাড়া বেঁচে আছে না?
জগতের সবাই কী সরকারি চাকরী করে? তাঁরা কী বাবা হচ্ছে না?
প্রশ্ন আছে, জবাব নেই!
কইতরী একটা কালো শাড়ি পড়েছে! নতুন বৌ বাপের বাড়ি আসলে কালো শাড়ি পড়ে? পড়ে হয়তো, সুন্দরই লাগছে। এই কথাটা বলার মুখ আছে আমার?
–কইতরী আমাকে একটা পাঞ্জাবি উপহার দিলো৷ সত্যি কথা বলতে পাঞ্জাবির রং’টা ভালো৷ আমার পছন্দের কালার নীল। কিন্তু তবুও আমার ভালো লাগছে না। আমার মনে হয় ভালো লাগার কথা।
খুশি খুশি লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না৷ কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে পাঞ্জাবি উপহার যদি দেয়। তাহলে অবশ্যই স্বামীর খুশি হওয়া উচিৎ। আঁকা অংকন হাসি দিলাম— সুন্দর তো পাঞ্জাবিটা। নকশাটা খুব ফুটে উঠেছে। কোন জায়গা থেকে কিনলে?
— মানুষ কোন জায়গা থেকে পাঞ্জাবি কেনে?
— তাই তো, দেখো আমি কত বোকা! পাঞ্জাবির দোকান থেকেই তো মানুষ পাঞ্জাবি কেনে!
কথাটা বলার একদম তাড়া পাইনি মন থেকে। ভদ্রতা করলাম। মানুষ হয়ে জন্মালে এই কাজটা অনেক সময় ইচ্ছে না হলেও করতে হয়।
একজনের উপরে খুব রাগ হচ্ছে।
জানোয়ারটাকে পেলে মেরেই ফেলতাম৷ কলেজে থাকাকালীন কথা৷ সবাই সারি বেঁধে হাত দেখাচ্ছে। হাত বাবা। আমরা তিন জনও হাত দেখালাম৷ আমি, বর্ষা, নেয়াজ। তিন জনের হাত দেখে হাত বাবা বলেছিলো— তোমরা তিন জনই খুব ভালো মনের স্বামী-স্ত্রী পাবে।
বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ বর্ষা ভালো মনের জামাই পেলো। নেয়াজ চমৎকার মনের একটা বৌ পেলো। আর আমি পেলাম কী?
আমার বেলাতেই সব সময় ঘড়ির কাঁটা পাল্টে যায়! জীবনে কিছুই মনের মতো পাইনি। বাবা যা দিয়েছে, হাসি মুখে মাথা পেতে নিয়েছি।
বন্ধুবান্ধব যখন সাইকেল দৌড়ায় তখন আমার বাবা বলতো— হাঁটলে শরীর সুস্থ থাকে।
বন্ধুবান্ধব যখন প্রেম করে তখন বাবা বলতো— প্রেম সাস্থের জন্য ক্ষতিকর।
এখন বন্ধুবান্ধব যখন বাবা হয়ে গেলো বৌ বলছে— আমার বয়স হয়নি!
–হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। না, নিজের শরীরে কোনো আঘাত করিনি। কালকে রাতে আচমকা বুকে ব্যথা উঠে৷ কী একটা রোগের নাম বললো যেন। এই রোগটা না কী আমার আগ থেকেই আছে৷ কী আশ্চর্য আমি আজকেই জানলাম!
তারচেয়ে বড় কথা হলো, ডাক্তার বলে দিয়েছে আমি আর এক-দুই দিন বাঁচবো! বাবা আজকে আমাকে শান্তনা দেয়ার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পেলেন না। চোখ বেয়ে পানি পড়া বন্ধ হচ্ছিলো না তাই চলে গেছেন!
একদিনেই আমার জবান বন্ধ হয়ে গেছে! কোনো কথা বলতে পারছি না। একটা চীরকুট লিখলাম কইতরীকে—
প্রিয় কইতরী,
তোমাকে আমার একটা কথাই বলার আছে। সেটা হলো তোমাকে আমার একটা কথাও বলার নেই। ভালো থেকো, সুস্থ থেকো।
কইতরী চীরকুটটা পড়েছে মাত্র৷ আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমার হাতটা ধরে বললো— আমি বিশ্বাস করি না। তুমি আমার, শুধু আমার৷ আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো না।
কান্না করলে কইতরীকে বেশ ভালো লাগে। যেন ঝর্নাধারায় রক্তপাত হচ্ছে। আলোর রক্তপাত। আমি কথা বলছি না দেখে— কথা বলছো না কেনো? খুব অভিমান আমার উপর? তোমার কিচ্ছু হবে না। যত্তসব ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে।
আমাকে মিথ্যে শান্তনা দিয়ে কইতরী কাঁদছে। দুহাত হাওয়ায় তুললো। মনে হচ্ছে কোলে কোনো বাচ্চা আছে। ইশারা করে বললো— শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা? আমাদের অনেক বাচ্চা হবে। তুমি অনেক সন্তানের বাপ হবে। কথা বলো না কেনো?
জবাব দিতে পারছি না। শুনতে পারছি শুধু৷ বলতে পারার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কেড়ে নিয়েছেন। নাক মুখ লাল হয়ে গেছে কইতরীর। কান্না করলে কিছু মেয়ের গাল লাল হয়। কইতরীও তাঁদের মধ্যে একজন।
বললো— বংশের কালো ছায়া বলতে কিছু নেই। তুমি মরতে পারো না। তুমি বেঁচে থাকবে দেখো। আমার মরার পরেও তুমি বেঁচে থাকবে। একবার কথা বলো, বলো না। আমি এসব বিশ্বাস করি না।
আমি বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। বিদায় নেয়ার বেলা হয়ে যাচ্ছে। কইতরী বলছে— অনেক ভালোবাসবো তোমাকে। তোমার সরকারি চাকরী করতে হবে না। যে কোনো কাজ করলেই হবে। তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না জানি। কথা বলো, কথা বলো তুমি।
বুক ওঠানামা করছে। শ্বাস নিতে পারছি না। কইতরী চিৎকার দিয়ে ডাক্তারকে ডাকলো। ডাক্তার এসে আমাকে বললো— আপনার বৌয়ের ভালবাসা পেয়ে গেছেন। এবার বাড়ি যান।
আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে গেলো— আরে আমি দুই দিনের বেড ভাড়া দিয়েছি। এক দিনেই চলে যাবো কেনো?
সঙ্গে সঙ্গে নিজের জিহ্বায় কামড় বসালাম! যাহ একি করলাম? কইতরী মনে হয় আমি কী বলেছি বা ডাক্তার কী বলেছে তা খেয়াল করেনি। কপালে বারবার চুমু খাচ্ছে আর মাফ করে দাও বলছে। হঠাৎ বললো— একটু আগে কী বললে যেন? ডাক্তার সাহেব কী চলছে এখানে?
— আপনার স্বামীর অভিনয় চলছে!
কইতরী তুমুল রাগ করে আমার দিকে তাকালো। যেন কাঁচা খেয়ে ফেলবে৷ এ রাগটা যেন তৃপ্তির। আরো রাগিয়ে দেয়ার জন্য বললাম— এই বুদ্ধিটা কে দিয়েছে জানো? আমার প্রাক্তন প্রেমিকা। সে লেখিকা, মাথায় বুদ্ধি আছে বলতে হবে।
কইতরী ঠোঁট কামড়ে বললো— ডাক্তার সাহেব।
— জ্বী।
— শালারে ইনজেকশন দিয়ে ফেলেন। কিন্তু সাবধান ব্যথা যেন না পায়!