ভোরের প্রথম আলোক রেখা যখন জানালা গলে ভেতরে এসে পড়ে, সেই সময় আমি ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা ছোটখাট বিল ছিলো। বিলটার নাম ছিল দরিয়ার বিল। দরিয়ার বিলের ইতিহাস অনেক পুরোনো। জ্বিন-পরীদের যুগে সমুদ্র ভেঙে আলাদা হয়ে যাবার সময় এই বিলের সৃষ্টি। আমি ঘুমমাখা চোখে বিলের পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। বিলের পাড়ে বসে সোনালি সূর্যের উদয় দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। আমি স্বপ্নাতুর চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম।
সত্যিকার অর্থে স্বপ্ন বলতে যা বোঝায় সেটা আমার জীবনে থাকার কথা ছিল না। আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে বাবারও মানসিক মৃত্যু ঘটে। বাবা আমাকে কখনোই দু’চোখে দেখতে পারতেন না। ছোট ছিলাম বলে ব্যাপারগুলো আমি ভালো বুঝতাম না। আমার মেজ ফুপুর স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় ফুপু আমাদের বাড়িতে এসে থাকতেন। তার নিজের ছেলেমেয়ে ছিলো বিধায় আমার দিকে লক্ষ্য করার মতো সময় তার ছিলো না। মোদ্দা কথা আমি সম্পূর্ণই বাবা-মায়ের ভালবাসা ছাড়া শৈশব পার করেছি। মানুষের ভালবাসা পাই নি বলেই হয়তো প্রকৃতিকে আমি এতো বেশি ভালবাসতাম। দরিয়ার বিলের জলে সূর্যের প্রতিফলনে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিয়ে সব দু:খ কষ্ট ভুলে যেতাম। বিলে অনেক অনেক পাখি এসে বসত। নিজেকে তাদের সাথে তুলনা করার চেষ্টা করতাম। আমার জীবনও যেন তাদের মতই স্বাধীন- প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি। বিলের জলে পদ্মফুল ভেসে বেড়াত। আমি সেই পদ্মরেখায় নিজের ছবি এঁকে নিতে চাইতাম। বিলের জল আর পদ্মফুলের সাথে আমি অদ্ভূত এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। প্রতিদিন সকালে তাই বিলের ধারে ছুটে না গিয়ে থাকতে পারতাম না।
আমার বয়স যখন নয়, তখন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। আমার সবচেয়ে ছোট খালার নাম রওশন আরা। তিনি আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। খালার খুবই কম বয়সে বিয়ে হয়েছিলো। শুনেছিলাম, তার প্রথম সন্তান বেশিদিন বাঁচেনি। নিউমোনিয়া হয়ে মারা গিয়েছিলো। এর আগে খালা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আমাকে খুবই আদর করতেন।
এবার বেড়াতে এসে খালা অদ্ভূত এক কাহিনী করল। সে আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে চাইল। বাবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আর আমি চলে যাওয়া মানে ফুপুর ছেলেমেয়েদের আরেকটু স্বাধীনতা। কেউ তাই না করল না। আমি মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাই। গম্ভীর-থমথমে আকাশটার ওপর বড্ড অভিমান হয় তখন। এতবড় আকাশ, তবু ভালবাসতে জানে না।
আমার নিজস্ব কোনও মতামত ছিল না। খালা সবকিছু ঠিকঠাক করেই এসেছিলো। গাড়িতে ওঠার সময় খালা আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে বলল, “যেতে হলে একটা শর্ত আছে।” খালা মিষ্টি করে হাসি দেয়। “আমাকে মা বলে ডাকতে হবে।” খালার চোখ ছলছল করে ওঠে। সেই সাথে আমারও। আমি বললাম, “মা কেমন হয় আমি জানি না। তোমাকে মা বলে ডাকতে পারি, কিন্তু মায়ের মতো করে ভালবাসতে পারব কি না জানি না।” খালা হাসল, কিছু বলল না। তার চোখে তখন রাজ্যের বিস্ময়।
ডিসেম্বরের সেই দিনটিতে আমি আমার খালাকে মা বলে ডাকতে শুরু করলাম। গ্রাম ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি থামিয়ে আমি বিলের ধারে নামলাম। বোবা বিল আর প্রাণীগুলো আমার দিকে অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। তাদের সাথে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, যে বন্ধুত্বে কোন খাদ নেই- কোনও আশা-নিরাশার বালাই নেই। আমি একটা পদ্মফুল ছুয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।
খালার বিয়ে যে ভদ্রলোকের সাথে হয়েছিল, তার নাম হারুন তালুকদার। নির্ঝঞ্ঝাট ভালো মনের মানুষ। আমাকে দেখে বললেন, “তাহলে আমাকে বাবা বলে ডাকতে আপত্তি কোথায়।” তারপর যেন মস্ত রসিকতা করেছেন, সেরকম করে হাসতে লাগলেন। তারা ঢাকা শহরের মিরপুর এলাকায় ঘুপচির মধ্যে ছোট দুই রুমের একটা বাসায় থাকতেন। আমার ধারণা ছিল খালা আমাকে অন্য রুমটা দিয়ে দেবেন থাকার জন্য। তিনি তা করলেন না। আমি খালা-খালুর সাথে একই বিছানায় ঘুমোতাম। খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতেন। তার চোখে মুখে অপার শান্তি ছড়িয়ে পড়ত। যেন তার হারানো ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন।
আমি আসার পর থেকে বাসার অবস্থা বদলে যেতে থাকে। সব আয়োজন যেন আমাকে ঘিরেই। আমাকে স্কুলে ভর্তি করা থেকে শুরু করে আমার জামা-কাপড় তৈরী, পড়ার টেবিল তৈরী, নতুন বিছানা তৈরী আরও কত কি। আশপাশের বিভিন্ন বাসা-বাড়ি আর খালুর অফিস থেকে লোকজন আমাকে দেখতে আসত। আমি সারাজীবন গ্রামে কাটিয়ে আসা নয় বছরের বালক। সৌজন্যতার সাধারণ নিয়মকানুনগুলোও জানি না। তাই বেশিরভাগ সময়ই চুপ করে থাকতাম আর হাসতাম। আমার জন্য আলাদা বিছানা করা হলেও, আমি না ঘুমানো পর্যন্ত খালা আমার মাথার কাছে বসে থাকত আর আমাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাত। আমি ঘুমিয়ে গেলে আমার শরীরে চাদর টেনে দিয়ে তারপর ঘুমোতে যেত। একেই বুঝি বলে মায়ের ভালবাসা? আমি অবাক হয়ে যেতাম। ছোটকাল থেকে নোংরা মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বড় হয়েছি। ব্যাপারগুলোতে তাই কেন জানি অভ্যস্ত হতে পারতাম না।
এত কিছুর পরও কেউ একজন যদি বিন্দুমাত্র অসুখী হয়ে থাকে, সেটা ছিলাম আমি। বাবা-মায়ের অপরিসীম বা তার চেয়েও বেশি ভালবাসা আমার মন-প্রাণ ভরে দিতো ঠিকই, কিন্তু তবুও দরিয়ার বিলের ধারে ফিরে যেতে খুব বেশি মন টানত। বিলের পানি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে হতো, পদ্মপাতায় ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হতো। পদ্মরেখায় সূর্য্যের প্রতিফলন দেখতে ইচ্ছে হতো। আমি খালাকে গিয়ে বলি, “মা, আমরা গ্রামে গিয়ে থাকতে পারি না?” খালা হেসে জবাব দেয়, “আমার লক্ষী বাবাকে যে অ-নেক বড় হতে হবে? অনেক পড়াশোনা শিখতে হবে।” তার কথায় যুক্তি ছিল। তবুও গ্রামের জন্য আমার মন কেমন করতে থাকে। আমি বলি, “তাহলে চলো না কিছুদিনের জন্য বেড়িয়ে আসি। অনেকদিন ধরে বিলটার কথা মনে পড়ছে।” খালা কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর বলে, “ঠিকআছে, আমরা সামনের সপ্তাহে যাবো।”
আমাদের সেই গ্রামে যাওয়া আর হলো না। যাবার সময় আমাদের লঞ্চটা ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়। তার মধ্যে একজন ছিলো আমার মা, রওশন আরা। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, আমি ডুবে যাবার আগেই আমাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ঝড়ের কবলে পরার পর মায়ের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। সে আল্লাহর নাম জপতে থাকে আর আমার শরীরে ফু দিতে থাকে। আমি জানতাম, তার ভয় মৃত্যুকে নয়। এত বছর পর ফিরে পাওয়া সন্তান আবার হারিয়ে যাওয়ার ভয়। মা আমাকে কাছে ডেকে বললেন, “আজ যদি আমি মরে যাই, তাহলে তুই একটুও মন খারাপ করবি না কিন্তু। অনেক পড়াশোনা করে অনেক বড় হবি।” আমি মাথা ঝাকালাম। হঠাৎ করেই আমি এই মানুষটার প্রতি অসম্ভব ভালবাসা অনুভব করি, মনের ভেতর থেকে। আমি আকুল হয়ে বললাম, “মা, আমার ভয় করছে।” মা হেসে বলে, “কিসের ভয়? আমি আছি না?”
ছোটকাল থেকে অনেক দু:খ দুর্দশার মাঝে বড় হলেও আমি কখনো কাঁদতে পারিনি। কিন্তু সেদিন আমি কেঁদেছিলাম। চিৎকার করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদেছিলাম। আমার মায়ের জন্য। বিধাতার এই প্রহসন আর সহ্য হতে চাইছিল না। আমি সত্যি সত্যিই অনেক পড়াশোনা করেছি, আমার মায়ের জন্য। অনেক বড় হয়েছি- তাও আমার মায়ের জন্য। জন্মদাত্রী মাকে কখনো দেখিনি, তাই তাকে ভেতর থেকে কখনো অনুভব করতে পারিনি। আমার তাই একটাই মা। আমার মা রওশন আরা।
আমি কথা সম্পূর্ণ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি। এই মুহূর্তে মিলির দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস আমার নেই। তাকালে আমি ধরা পড়ে যাবো। আমার চোখে যে চিকচিকে অশ্রু।
মিলি আমার হাত ধরে বলল, “এই কান্না লুকানোর কিছু নাই। তোমার মা বেঁচে থাকলে তোমাকে নিয়ে অনেক অহংকার করত।” তার কথা শুনে আমি হাসলাম।
“আমি অহংকার করার মতো কিছু হতে চাই নাই। শুধু ভালবাসা চাইছিলাম।” আমি দম বন্ধ করে অন্য কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করি। আমরা কতক্ষণ ওভাবে বসে থাকি বলতে পারব না।
মিলি জিজ্ঞেস করল, “তোমার গ্রামে একবার নিয়ে যাবা আমাকে? বিলটা দেখতে ইচ্ছা করতেছে।”
এবার আমি মুখ তুলে তাকাই। তারপর হেসে বলি, “আমি আর কোনদিন গ্রামে যাই নাই। যাইতেও ইচ্ছা করে না।” মিলি কিছু বলে না। আমার কষ্ট দেখে তার চোখেও পানি চলে আসে।
মিলিকে আমি গ্রামে নিয়ে গেলাম। সবকিছু বদলে গেছে। বাড়িঘর-দোকানপাট সব। আমাদের পুরোনো বাড়িটা ভেঙে নতুন করে করা হয়েছে। বাবা কয়েকবছর আগে মারা গিয়েছেন। আমাকে সময়মতো খবর দেয়া হয়নি দেখে তার জানাযায় আমি আসতে পারিনি। নতুন করা বাড়িটাতে ফুপু তার তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার পেতে বসে আছে। আমাকে দেখে ফুপু খানিকটা ঘাবড়ে যায়, এই বুঝি আমি সম্পত্তির ভাগ চাইব। আমি সেরকম কিছু চাইলাম না। শুধু বাবা-মায়ের কবর ঘুরে আসলাম। বাবা মানুষটা আমার প্রতি অনেক অন্যায় করেছে সত্য, কিন্তু তারপরও কেন জানি তাকে আমি ঘৃণা করতে পারলাম না। কেন জানি মনে হয়, ভেতরে ভেতরে হয়তো সে সত্যিই আমাকে ভালবাসত।
মিলিকে আমি বিল দেখাতে নিয়ে যাই। দরিয়ার বিল। জ্বিন-পরীদের যুগে যে বিলের সৃষ্টি। কত আবেগ-কত অনুভূতি-কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বিলের সাথে! সব বদলে গেলেও, বিলটা সেই আগের মতই আছে। আমি বিলের পানি ছুঁয়ে দেখি। মিলির হাতে হাত রেখে সেই পানি দিয়ে পদ্মরেখায় প্রতিফলন আঁকতে চেষ্টা করি। সোনালি সূর্যটাকে রুপালি জলের সাথে মিশে যেতে দেখি। এই ভালবাসা, এই মানুষগুলোও একদিন চলে যাবে। তখনও হয়তো একই ভাবে বিলের জলে খেলা করবে সাদা বক আর মাছরাঙারা।
এক বুক ভালবাসা নিয়ে আমি আর মিলি সেই জলখেলা দেখতে থাকি।