“এই জীবন আমি আর রাখব না। তুমি ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতে পারি না জয়।” কাগজে কাঁপা কাঁপা হাতে লাইন দুটো লিখে হাতে ঘুমের ওষুধের শিশিটা তুলে নেয় অনামিকা। এই এয়ারকন্ডিশনড ঘর, টেবিলে মায়ের রেখে যাওয়া অমলেট, স্যান্ডুইচ ব্রেকফাস্ট, আলমারি ঠাসা ব্র্যান্ডেড ড্রেসগুলো সবই এই মুহূর্তে বড় বিস্বাদ ঠেকছে তার। কি হবে এত কিছু দিয়ে ! জয় নেই ! তার দু’বছরের চেনা জয় আজ অন্য কারো ! সামনেই ওদের বিয়ে হওয়ার কথা ! কিন্তু একটা সামান্য মেয়ের কাছে হেরে গেল সে ! জয় যে এভাবে মাঝপথে তার হাত ছেড়ে দেবে ভাবতেও পারেনি অনামিকা। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। ওষুধের শিশিটা উপুর করে মুখে ঢেলে নেয় সে। আহঃ শান্তি !
কাল রাতে জানতে পেরেছে অনামিকা যে সে মা হতে চলেছে। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা সে। এদিকে বীরেন তাকে ছেড়ে চলে গেছে দু’মাস আগেই। নতুন প্রেমে মজে আছে সে। দাঁতে দাঁত চেপে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অনামিকা। তার মধ্যবিত্ত সংসারের সেই একা উপার্জনকারী। এক মুহূর্ত ভেবে নেয় সে… জানাজানি হলে আগে হয়ত চাকরিটা যাবে, বাবা মা বার করে দিতে পারে বাড়ি থেকে। আর সমাজের চোখে কলঙ্কিনী হওয়ার তকমা তো আছেই। নাহ ! অনেক বড় লড়াই। তবু হার মানবে না সে। মনে পড়ে যায় কাল রাতে বীরেনের তাকে বলা কথা গুলো,
“আমায় ফোন করেছিস কেন ? কার না কার পাপ, আমার মাথায় চাপাচ্ছিস !” ডুকরে উঠেছিল অনামিকা, “বিশ্বাস করো, এ সন্তান তোমার। আমি এখন কি করব ?”
“বিষ খেয়ে মরে যা…” বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল বীরেন। মুখে চোখে জল দিয়ে বেরিয়ে আসে অনামিকা। ফোনটা নিয়ে রওনা দেয় থানার উদ্দেশ্যে। ওতে কাল রাতের কথোপকথন সবটা রেকর্ড আছে। না, মারবে তবু মরবে না সে।
হসপিটালের বেডে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে অনামিকার শরীরটা। সিডেটিভের প্রভাবে তার সমস্ত সত্তা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কেবিনের বাইরে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বসে আছে অনামিকার মা। পাশে বসে উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ওদের বাড়ির কাজের বউ ঝুলন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যখন দরজা খুলেছিল না অনামিকা, ওরা দু’জন মিলে কোনো ভাবে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে ওকে। দেখে আলুথালু অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে অনামিকার শরীরটা। মুখ দিয়ে ফেনা উঠে শুকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিয়ে হসপিটাল আসে ওরা। অনামিকার বাবা পার্টির কাজে বাইরে আছেন। ওয়াশ করে ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক তার। তবু আজ রাতটা না গেলে বিপদ কাটবে না জানিয়েছেন ডক্টর।
থানায় এসেছে অনামিকা অনেকক্ষন হল। বড়বাবু এখুনি এসে পড়বেন জানিয়েছে একজন কনস্টেবল। কোন এক নেতার মেয়ে নাকি ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করতে গেছিল, হসপিটাল থেকে ফোন পেয়ে তারই তদন্ত করতে গেছেন তিনি।
“রাবিশ, এই সব মেয়েগুলো, একটু কিছু হল কি না হল, আগেই জীবন শেষ করার কথা ভেবে ফেলে। এতটুকু সহ্য শক্তি নেই।” দাঁতে দাঁত চেপে ভাবে অনামিকা। তার ভাবনার মাঝেই দ্রুত গতিতে ঘরে ঢোকেন বড়বাবু। কানে ফোন। কাউকে বলছেন “হ্যাঁ স্যার। মিস অনামিকা সামন্তের জ্ঞান ফিরলেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করব। একজন লেডি কনস্টেবলকে রেখে এসেছি ওখানে স্যার। হ্যাঁ। একটা চিঠি পাওয়া গেছে উনার ঘর থেকে। ট্রেস করার চেষ্টা করছি ছেলেটাকে। হ্যাঁ… সিটি হসপিটালে আছে।”
বড়বাবুর মুখে নিজের নামটা শুনে কেঁপে ওঠে অনামিকা। তবে ওই মেয়েটার নামও তারই নামে !
“আসুন।” চেয়ারে বসেই তাকে ডাকেন উনি। চটকা ভেঙে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় অনামিকা। অনুভব করে হঠাৎ খুব যেন দুর্বল লাগছে নিজেকে। পা দুটো কাঁপছে খুব। কোনোমতে চেয়ারে বসে সে।
“বলুন। কি সমস্যা ?”
“স্যার আমি একটা এফ আই আর করতে চাই।”
“কার বিরুদ্ধে ?”
“আমার প্রাক্তন প্রেমিক বীরেন চৌধুরী।”
“আপনার নাম ?”
“অনামিকা। অনামিকা সেন।”
ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকান ইন্সপেক্টর রায়।
বেডের পাশে একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে অনামিকা। হাতে ধরে রেখেছে মেয়েটার হাত। জ্ঞান ফেরার পর ইন্সপেক্টর রায় এসে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরে গেছেন। চুপ করে শুয়ে আছে অনামিকা।
“তুমি হয়ত ভাবছ আমি হঠাৎ কেন এলাম এখানে। অচেনা অজানা একজন।”
নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে ওঠে অনামিকা সেন।
“আসলে আজ যখন আমি থানায় যাই, তখন ওখানে জানতে পারি, আমারই নামের আমারই বয়সী একটা মেয়ে তার জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল সামান্য কারণে। তাই নিজেকে আর…”
“সামান্য কারণ ! এক ঝটকায় স্যালাইন এর ছুঁচ বেঁধানো হাতটা সরিয়ে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে অনামিকা। তোমার হয়ত সামান্য মনে হতে পারে কিন্তু ভালোবাসার মানুষ যখন স্বার্থপর হয়ে যায়, হাজারটা কথা দিয়ে হাত ছেড়ে দেয় মাঝ পথে তার কষ্ট তুমি বুঝবে না। যার হয়, সেই বোঝে।”
“আমি বুঝেছি।”
“কি বুঝেছ তুমি ? তুমি কে ? কি জান তুমি আমার সম্বন্ধে ?”
“কিছুই জানি না। কিন্তু এটুকু বুঝছি যে এত সুন্দর জীবনটা শেষ করে দেওয়ার মত কিছু হয়নি। বাইরে তোমার মা তোমার জন্য চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন। উনার কষ্টটা বুঝছ তুমি ?”
“আমি কিছু বুঝতে চাই না। কিচ্ছু না। ” চিৎকার করে ওঠে আবার অনামিকা। “আমাদের নাম এক মানেই ভাগ্যও এক নয়।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ তুমি। ভাগ্য যদি বোলো, তাহলে সেটা তোমার থেকে আমার আরো খারাপ।” মৃদু হেসে বলে ওঠে অনামিকা।
“তাতে আমার ভাগ্য বদল হবে না। আমার জয় ফিরবে না তাতে। আমার ঘর ভর্তি জয়ের স্মৃতি। এই দেখ, কানে পরে আছি ওর দেওয়া দুল। পায়ে নুপুর। ঘর ভর্তি ওর দেওয়া পুতুল, কার্ডস, উপহার… উফ ! এসব নিয়ে আমি কি করে বাঁচব ! ও কি করে আমায় এই অবস্থায় ফেলে যেতে পারল ! এতটুকু বুক কাঁপলো না ওর !”
“উপহার ! হ্যাঁ, উপহার তো আমিও পেয়েছি। বীরেনকে ভালোবাসার, ওকে অন্ধের মত বিশ্বাস করার উপহার।”
“কি ? কি পেয়েছ তুমি ?”
উত্তরে নিজের পেটের উপর হাত রেখে অনামিকা। মৃদু স্বরে বলে ওঠে…” সে এখানে। বড় হচ্ছে।”
চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে থাকে দুই অনামিকা একে অন্যের দিকে। অনেকক্ষন পর ওর পেটে নিজের দুর্বল হাতটা রেখে বলে ওঠে অনামিকা , “আর আমার পেটে এরকম কেউ কখনো আসবে না জেনেই আমায় ছেড়ে চলে গেল জয়। ”
আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে আজ খুব শান্তি পাচ্ছে অনামিকা। বীরেন তার যোগ্য শাস্তি পেয়েছে। সব সাক্ষ্য প্রমাণের পর আইন তাকে ক্ষমা করেনি। কারাবন্দী করার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় বীরেনকে দেখে রাগের বদলে করুণা হচ্ছিল ওর। যাক ! সামনে আরেকটা বড় লড়াই। আর কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর আলো দেখবে তার সন্তান। হ্যাঁ, শুধুই তার। আবারো এই বন্ধুহীন সমাজটার বিরুদ্ধে একা দাঁড়াতে হবে তাকে। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে অনামিকা।
বিড়বিড় করে বলে ওঠে পেটে হাত রেখে, “তুই এক নোস। তুই একা নোস।”
“হ্যাঁ, সত্যিই ও একা নয়। আমি আছি।” মেয়েলি কণ্ঠে পিছন ফেরে অনামিকা।
“অনামিকা, তুমি ?”
“হ্যাঁ। আমি। তোমার এই লড়াইয়ে তুমি একা নয়, আমি আছি তোমার সাথে। তোমার সেদিনের দেখা করা, আমার চোখ খুলে দিয়েছে। সত্যি কত অল্পে নিজেকে শেষ করতে যাচ্ছিলাম আমি। বুঝিনি, আমার থেকেও বেশি আঘাত পেয়েও লড়ে জিতে নেওয়া যায় নিজেকে।”
“ভাল লাগল তোমায় এভাবে দেখে। ভাল থেকো।”
“ভাল তো থাকতেই হবে আমাদের। অনামিকা যদি কিছু চাই, দেবে ?”
“আমি ? আমি কি বা দিতে পারি তোমায় বলো ?”
“মাতৃত্ব। তুমি জানো আমি মা হতে পারব না কখনো। জঠরটাই বাদ গেছে আমার। জয়কে ক্ষমা করে দিয়েছি আমি। ওর অধিকার আছে বাবা হওয়ার সুখ পাওয়ার। কিন্তু আমিও অনুভব করতে চাই মা হবার সুখ। তাই তোমার সন্তানকে দেবে আমায় ?”
“না…!” পেটে হাত রেখে চিৎকার করে ওঠে অনামিকা।
“না না আমি একেবারে নেব না ওকে। কিন্তু যদি দুজনেই দায়িত্ব নিই ওর ? আমাকেও ওকে বড় করার অধিকার যদি দাও…” কান্নায় চোখ বুজে আসে অনামিকার।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অনামিকা। “যশোদা আর দেবকী যেমন ? বেশ।”
পুঁচকে ছেলেটা পৃথিবীর মুখ দেখল আজ। হসপিটাল বেডে আজ শুয়ে আরেক অনামিকা। তবে জীবন যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাওয়া নয়, জিতে যাওয়া এক মেয়ে, এক মা। আর ওর শিয়রে বসে আছে সেদিনের সেই ভীরু, দুর্বল অনামিকা। কিন্তু আজ আর সে দুর্বল নয়। বাঁচার জন্য আজ আর কোনো জয়কে প্রয়োজন নেই তার। অনামিকার সন্তানকে নিজের কোলে জড়িয়ে বসে আছে সে। সদ্য মা হওয়ার খুশিতে উপচে পড়ছে তার মুখও। শিশুটাকে দু’দিক থেকে আগলে ধরে দুই অনামিকা। দুই মা।
সমাপ্ত