অবশেষে সুযোগটা এসেই গেল। শান্তনুর বাড়ি যাবার। হ্যাঁ, সুযোগই বলা যায় কারণ ওর সাথে একসময় ভালবাসার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ওর বাড়ি কখনোই যাওয়া হয়নি দয়িতার। শান্তনুও যে ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছে খুব করে, এমনটা নয়। আসলে শান্তনুর আর দয়িতার সম্পর্কের মধ্যে অর্থনৈতিক ফারাকটা ছিল বিস্তর। দয়িতা আজ থেকে বারো বছর আগে গাড়ি করে কলেজ যেত আর শান্তনু দিনের পর দিন পকেটে পাঁচ টাকা নিয়ে একটাই শার্ট পরে কলেজ আসতো। তবে ওই যে বলে প্রেমে যদি মজে মন… ছোটবেলা থেকেই অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ হওয়ায় দয়িতা কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। বাড়িতে সব ছিল। টাকা পয়সা, শখ পূরণের সামগ্রী, এমনকি তার মুখের কথা খসানো মাত্র সব এনে হাজির করবে এমন একটা মেয়েও ছিল। তার নাম ছিল সুপর্ণা। দয়িতারই বয়সী। ভাল ঘরের মেয়ে। অভাবের দায়ে ওর মা ওকে দয়িতাদের বাড়ি রেখে গেছিল। থাকত, খেতো ওর সাথেই আর পড়াশোনা করত বাড়িতেই। আসলে দয়িতার মা বাবা দুজনেই চাকুরীজীবি হওয়ায় ছোট থেকেই কাজের মাসি আর বড় হয়ে তার মেয়ে সুপর্ণার সান্নিধ্যেই বেশির ভাগ থাকত সে।
শান্তনুর বাড়ি যাওয়ার সুযোগটা এসে গেল হঠাৎই। যদিও জানতে পেরেছে দয়িতা যে এখন ও ওর নিজের বাড়িতে থাকে না। চাকুরী সূত্রে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া করে থাকে কিন্তু সেও তো ওরই বাড়ি, ওরই সংসার। আসলে সামনের মাসে দয়িতার বিয়ে। হ্যাঁ, একটু বেশি বয়সেই হচ্ছে। তবে ত্রিশ বত্রিশটা এখনকার দিনে কোনো বয়স নয় মেয়েদের বিয়ের। ওই কম বয়সে বিয়ে করে মাথায় ধ্যাবরা করে সিঁদুর পরে চওড়া পাড় তাঁতের শাড়িতে নিজেকে লেপ্টে স্বামীর পাশে হাসি হাসি মুখ করে আত্মীয়ের বিয়ে বাড়ি যাওয়া, ওসব দয়িতার দ্বারা হবে না জাস্ট। এ ছাড়াও জীবনে অনেক কিছু আছে।
শান্তনুর সাথে দয়িতার ব্রেক আপটা হওয়ারই ছিল। কলেজের তিনটে বছর হু হু করে কেটে গেছিল। ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হওয়ার পর ওই সদ্য যৌবনে শান্তনুর মত একজন অভিভাবকসুলভ কাউকে প্রেমিক হিসেবে পাওয়াটা একটা অন্যরকম স্বাদ এনে দিয়েছিল দয়িতার জীবনে। শান্তনু তিন বছরের বড় ছিল ওর থেকে যদিও এক বছরেই ভর্তি হয় তারা কলেজে। সেম ডিপার্টমেন্ট। দয়িতার কারণ অকারণ অভিমানে ওর পাশে থাকা, মেঘলা দিনে দরাজ গলায় ওর গান, কলেজ কেটে ওদের বাড়িতে সারা দিন ওর আড্ডা, পরীক্ষার আগে রাতের পর রাত জেগে ফোনে পড়াশোনা করা, এসব তখন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। শান্তনু তখন দয়িতার একাকী জীবনে এক অপরিহার্য অস্তিত্ব। ওর দিন রাত্রির কাব্য। ওর গদ্যময় চেহারা, পকেটের কাঙাল অবস্থা, ফাটা চটা জামাকাপড় কোনো কিছুই চোখে পড়েনি তখন। কিন্তু সত্যিটা একদিন না একদিন তো চোখে পড়তই। পড়লোও। কলেজ শেষ হওয়ার পর এক মাস কেটে গেছে। শান্তনু একদিন দয়িতাকে বলল দেখা করতে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন করল , “এবার ?”
শান্তনু একটু হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল , “মানে ?”
মানেটা দয়িতাও জানত না ঠিকঠাক। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছিল সে, এই এক মাসে কোথায় কি যেন একটা সূক্ষ্ম ভাবে বদলে গেছে। কলেজে একদল বন্ধুর মাঝে যেটা চোখে লাগেনি কখনো, সেই বৈষম্যটাতেই আজ খুব করে যেন চোখ পড়ছিল। লক্ষ্য করছিল সে শান্তনুর পা থেকে মাথা অবধি। ওর ওই রংচটা সবজে জামা, মলিন প্যান্ট, উস্কো খুস্কো চুল, সস্তার চটি, হাতে ডাটি ভাঙা কালো ছাতা, সব মিলিয়ে ওকে বড় বেমানান লাগছিল। ছোটবেলা থেকেই দয়িতা এক রাজকুমারের স্বপ্ন দেখেছে। কই ! মিলছে না তো ! এই দীন দরিদ্র মানুষটা আর যাই হোক, তার সেই রাজকুমার নয়। হ্যাঁ, সাময়িকভাবে রাজকুমারীকে আগলে রাখা কোনো প্রহরী হতে পারে। তিন তিনটে বছরে কলেজ ক্যান্টিন রাস্তা ঘাট বকুলতলায় যা চোখে পড়েনি, সেই দিন ওর বাড়ি যাওয়ার স্টেশনে ভিড়ের মধ্যে বসে দয়িতা সব আবিষ্কার করে ফেলছিল। দেখা করতে আসার সময় শান্তনু ফোনে বলেছিল ওকে ওর বাড়ি নিয়ে যাবে। বলেছিল এতদিন সংকোচে পারেনি সেই টালির ঘরে দয়িতাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে কিন্তু সেদিন সে নিজেই এক সমুদ্র সংকোচে বিহ্বল হয়ে গেছিল। কোনো মতে শান্তনুকে পাশ কাটিয়ে একছুটে উঠে পড়েছিল চেনা গন্তব্যে ফেরত যাওয়ার ট্রেনে। তবে পিছন ফিরে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছিল সে শান্তনুর হতভম্ব হয়ে যাওয়া মুখটা। বিনা নোটিশে ওরা পরস্পরের অচেনা হয়ে গেছিল সেদিন থেকে। একবার , পরে মাত্র একবার ফোন করেছিল শান্তনু ওকে। দয়িতা তুলতে পারেনি। কিই বা বলত সে! নিজেই নিজের কাছে অচেনা হয়ে গেছিল দয়িতা ভীষণ রকম। বা হয়ত তিন বছর অচেনা থাকার পর আবার চেনা নিজের কাছে ফেরত এসেছিল সে।
শান্তনুর সাথে এরপর কোনো যোগাযোগ ছিল না মাঝের এই দীর্ঘ বার বছর। কিন্তু কি জানি কি করে দয়িতার স্মৃতিতে রয়ে গেছিল ওর মোবাইল নম্বর। ভেবেছিল সে নম্বর হয়ত ওর কাছে আর নেই। নেহাতই কৌতুহলবশত ডায়াল করেই কেটে দিয়েছিল। আসলে প্রথম রিংটা হওয়ার সাথে সাথেই কেন জানিনা বুকের মধ্যেটা ধক করে উঠেছিল। এতই জোরে হয়েছিল সেটা যে নিজেকে সামলাতে পারেনি দয়িতা। খানিকখন পর নিজেকে সামলে আবার রিং করেছিল। মনে মনে হেসে উঠেছিল নিজের বোকামিতে। ফোন প্রায় কেটে যাওয়ার মুহূর্তে ওর কানে আছড়ে পড়েছিল চেনা এক ঘূর্ণির মত শান্তনুর স্বর।
” হ্যালো।”
“আমি… দয়িতা বলছি।”
“হ্যাঁ, বল।”
এমন স্বাভাবিক গলায় কথা বলছিল শান্তনু যেন ও জানতই যে একদিন না একদিন দয়িতার ফোন আসবেই। কেন জানিনা নিজের উপরই খুব রাগ হয়েছিল ওর। যাইহোক কথা খুঁজে ওকে বলেছিল দয়িতা,
“আমার বিয়ে, সামনের মাসে।”
শুনে শান্তনু নীরবে একটু হেসেছিল কি ? বলেছিল
“বাহঃ ! খুব ভাল।” খুব নিস্তরঙ্গ লাগছিল কি ওর গলা ?
দয়িতা আবার বলেছিল
“তুই বিয়ে করেছিস ?”
“হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত উত্তর এসেছিল।
“কবে ?”
“অনেক বছর আগে। কলেজ পাশ করার পর চাকরি পাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যে।”
উত্তরটা শুনে তাজ্জব বনে গেছিল দয়িতা। ওদের সম্পর্কটা শেষ হওয়ার পর এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিয়েছিল শান্তনু !
“আমি নিমন্ত্রণ করতে চাই তোকে, আই মিন, তোদের দুজনকে।”
“তিনজন।”
“তিনজন মানে !”
দয়িতা কেমন যেন ভ্যাবাচাকা মেরে যাচ্ছিল। তেত্রিশ বর্ষীয় দয়িতা রায় একজন সব দিক থেকে সাকসেসফুল মহিলা কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিল তার একদা ত্যাগ করা ছাপোষা প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে। শান্তনু মনে মনে খুব তাচ্ছিল্য করছিল কি ! নাকি সবই তার মনের ভুল !
“তিনজন মানে আমাদের এক সন্তানও আছে। এক মেয়ে।”
“ওহ ! বাহঃ ! কংগ্রাচুলেসন।” নিজের করা উইশটা নিজের কানেই কেঠো কেঠো ঠেকেছিল ওর।
“তবে তো সবাইকেই আসতে হবে ! আমি নিজে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসব। ” অতিরিক্ত উচ্ছাস দেখিয়ে ফেলছিল কি দয়িতা ! শান্তনু তো নিজে থেকে যেতে বলেনি। আর শেষবার তো সে নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছিল ওর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ। তবে কি মনের
গোপনে কোথাও উঁকি দিয়েছিল শান্তনুকে দেখার ইচ্ছে ! নাকি আরো কিছু দেখতে কৌতুহল হয়ে উঠেছিল তার মন ! খুব স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিয়েছিল ও , “আসিস। তবে আমি এখন অন্য জায়গায় থাকি। ঠিকানাটা লিখে নে।”
কলিংবেলটা বাজিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে দয়িতা। একটু পর দরজাটা খুলে গেল। বছর সাত আটের একটা ফুটফুটে মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। অবিকল শান্তনুর মুখ।
“কাকে চাই ?” ছোট্ট মেয়ের প্রশ্ন।
“শান্তনু মৈত্র ?”
“বাবা তো নেই ! কিন্তু এক্ষুনি চলে আসবে।”
“ওহ ! আর তোমার মা ?”
“মা আছে। গা ধুতে বাথরুমে গেছে। তুমি কে আন্টি ?”
“আমি ? আমি তোমার বাবার বন্ধু হই।”
“কি নাম বলো !”
“আমার নাম দয়িতা।”
মেয়েটা আর কিছু না বলে এক ছুটে ঘরের ভিতর চলে গেল।
দয়িতা ভাবে সত্যি তো বড় ভুল হয়ে গেছে। কখন গেলে শান্তনুকে পাওয়া যাবে না জিজ্ঞাসা করেই ও চলে এসেছে। ভেবেছিল বিকেলের দিকে নিশ্চয়ই থাকবে সে বাড়িতে।
একটু পরেই মেয়েটা আবার ফিরে এলো। “আন্টি, মা তোমায় ভিতরে আসতে বলল। এসো। মা আসছে।”
মৃদু পায়ে ভিতরে এসে বসল দয়িতা। এটা ড্রয়িং রুম, বোঝাই যাচ্ছে। খুব সুন্দর করে সাজানো, ছিমছাম। ঘরের পেস্তা গ্রিন রং, দেওয়ালের টেরাকোটা শোপিস, মধুবনী পেইন্টিং, হাতে তৈরি ফুলদানি সব কিছুই খুব যত্ন করে সুচারু ভাবে সাজানো রয়েছে। পাশের ঘরে যাওয়ার দরজায় ভারী বেগুনি রঙের পর্দা। কিরকম যেন অস্বস্তি হতে থাকে দয়িতার। মেয়েটা আবার ভিতরে চলে গেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ রান্না ঘর থেকে কুকারে সিটি পড়ার আওয়াজ আসে আর তার সাথে ভেসে আসে সুগন্ধি বাসমতি চালের গন্ধ। কিছু রান্না হচ্ছে। উসখুস করতে থাকে দয়িতা। বার বার ঘড়ি দেখতে থাকে। কি যেন অস্বস্তি ! যেন দাঁতের ফাঁকে সূক্ষ্ম কোনো খাবারের কণা আটকে গেছে। যতক্ষণ না তুলে ফেলবে শান্তি নেই। অবশ্য এখানে যে সে নিজেই সেই ফরেন পার্টিকেল তা বুঝতে অসুবিধা হয়না দয়িতার। হঠাৎ ডোরবেলটা বেজে ওঠে। চমকে ওঠে সে। নিশ্চয়ই শান্তনু। তড়িঘড়ি সে নিজেই উঠে যায়। দরজাটা খুলে দাঁড়ায় সামনে। হ্যাঁ, শান্তনু দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে বাজারের আর আরেক কাঁধে অফিসের ব্যাগ।
“ইয়ে মানে আমি মনে হয় ভুল সময়ে এসে পড়েছি।” একপাশে সরে এসে বলে দয়িতা।
“একেবারেই না। ঠিক সময়েই এসেছিস তুই। আয়।” বলে ভিতরে আসে শান্তনু। পিছু পিছু দয়িতাও। ব্যাগগুলো ভিতরের ঘরে রেখে আবার ড্রয়িং রুমে আসে সে। ইতিমধ্যে ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে শান্তনুর স্ত্রীও।
“সুপর্ণা ! ” নিজের অজান্তেই ঘড়ঘড়ে একটা স্বর বেরিয়ে আসে দয়িতার গলা দিয়ে। ঘরে কিছুক্ষন নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা। শুধু দেওয়াল ঘড়িটা টিক টিক করে যেন জানান দিচ্ছে কিছুই থেমে থাকে না।
“তার মানে….” নীরবতা ভেঙে আবার দয়িতাই বলে ওঠে।
“না , তুই কিছু মানে করার আগেই আমি বলতে চাই কিছু।” শান্তনু হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় দয়িতাকে।
“সুপর্ণাকে কোনো কিছুর মাঝে আনিস না। ও নেই, কখনো ছিল না কিছুতেই।”
“মানে ?”
“শেষ দেখা হওয়ার পর শেষ একদিন তোর বাড়ি গেছিলাম। তুই ছিলিস না। তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম অনেকক্ষন। ফোনও করেছিলাম। তুই তুলিসনি।”
“তো ? তাই তুই সুপর্ণার সাথে …” কিরকম যেন অসহায় লাগছে নিজেকে দয়িতার। ওর কোনো হিসেবে যে মিলছে না। কোথায় সেই সেদিনের ছাপোষা ছেলেটা ! সে বিয়ে সংসার সবই করেছে, সুখে আছে, এত অবধি তাও মেনে নিতে খুব কিছু কষ্ট হচ্ছিল না দয়িতার। কিন্তু তার স্ত্রীর ভূমিকায় সামনে চওড়া করে সিঁদুর ল্যাপটানো তাঁতের শাড়ি পরা এই সুপর্ণা, তার ফাইফর্মাস খাটা মেয়েটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে ! কেন মনে হচ্ছে সে ডুবে যাচ্ছে কোনো চোরাবালিতে, কিসের ভাঙচুর চলছে ভিতরে তার ! এতগুলো বছর যে সে নিজের সিদ্ধান্তের ঠিক ভুল নিয়ে হিসেবে কষেছিল সব ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে কেন !
“সুপর্ণার সাথে কিছু নয় দয়ি। সেদিন তোর বাড়িতে ওর সাথে বসে অনেকক্ষন কথা হয়েছিল। ওর অভাব, ওর দুঃখের কথা ভাগ করে নিয়েছিল ও আমার সাথে। ব্যাস, এই টুকুই। ”
“এই টুকু হলে কি আর আজ ও এখানে থাকত ?” হেসে ওঠে দয়িতা।
“এইটুকুই বলতে, এইটুকুই ওর ভূমিকা, যতদিন তুই ছিলিস আমার জীবনে। অবশ্য আমরা দু’জন কি আর সত্যিই কোনোদিন ছিলাম একে অন্যের জীবনে !”
“আমি বরং একটু চা করে আনি। তোমরা কথা বলো।” এতক্ষনে এই প্রথম কথা বলে ওঠে সুপর্ণা এবং আর কিচ্ছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভিতরে চলে যায় সে।
ঘরের মধ্যে শুধু ওরা দু’জন।
“শোন দয়ি…”
“আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এটা করেছিস তুই, তাই না ?”
“প্রতিশোধ !” ঈষৎ হেসে ওঠে শান্তনু। “তুই তো আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলিস দয়ি, বা হয়ত কখনো গ্রহণই করিসনি। সেদিন তোর বাড়ি থেকে ফেরার সময় “দয়িকে কিছু বলার দরকার নেই যে আমি এসেছিলাম।” শুধু এটুকুই বলেছিলাম আমি।”
“কেন গেছিলিস সেদিন তুই ?”
“কি জানি ! বোকার মত… আসলে ওইদিন আমার জন্মদিন ছিল… তার আগের দুটো বছর ওই দিনটা তোর বাড়িতেই তো কেটেছিল… তাই বোকা বোকা টাইপ.. হাহা… তারপর আর কখনো তোকে বিরক্ত করিনি। সুপর্ণাকে আমার নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটাকে খুব অসহায় লেগেছিল সেদিন। তার অনেক পর ওর সাথে… কি জানি কিভাবে আমরা দু’জন একে অন্যের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলাম।”
আর থাকতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে দয়িতা। ভিতরের ঘর অবধি সে আওয়াজ পৌঁছায় নিশ্চয়ই। তাই পায়ে পায়ে ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে এসে অবাক গলায় প্রশ্ন করে ছোট মেয়েটা , ” বাবা, আন্টিটা কাঁদছে কেন ? তুমি কি আন্টিকে বকেছ ?”
“না বনি , একটুও বকিনি। ” শান্তনু নিজেকে সামলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে।
” তোমার নাম বনি ?” অবাক গলায় প্রশ্ন করে দয়িতা।
“হ্যাঁ, আমার ডাকনাম বনি তো। মা রেখেছে। জানো আজ বাপির জন্মদিন। মা তাই পায়েস রান্না করছে। আর চিংড়ি মাছও হবে। বাপি নিয়ে এসেছে এখুনি। কি মজা ! ” নাচতে নাচতে হঠাৎ থেমে গিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে বনি , ” আন্টি, তুমিও কি বাপির জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পেয়ে এসেছ ?”
চকিতে দিনটা মনে পড়ে যায় দয়িতার। আজ বাইশে সেপ্টেম্বর। শান্তনুর জন্মদিন।
চায়ের কাপ হাতে বসে আছে দয়িতা। সামনে সুপর্ণা। আর কেউ নেই ঘরে। প্রায় সমবয়সী হলেও দয়িতাকে সে আগাগোড়া দিদিই বলত। নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে সে
“কেমন আছো বনি দিদি ?”
ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয় দয়িতা , “ভাল।”
একটু আগেও যে মেয়েটার উপর রাগ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল হেরে গেছে তার কাছে, এখন আর তা মনে হচ্ছে না। সত্যি তো, সুপর্ণার কি দোষ ! কলেজ পাশ করার পর মাস্টার্স করার জন্য বেনারস চলে গিয়েছিল দয়িতা। সুপর্ণাও ফিরে গিয়েছিল তার নিজের বাড়িতে। দু’বছরের মধ্যেই খবর পেয়েছিল ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ফোনে মায়ের মুখে এটুকুই শুনেছিল সে। ওকে নিয়ে আর কোনো কৌতূহলও জাগেনি ওর মনে। নিজের স্টাডি, কারিয়ার এইসব নিয়েই মত্ত তখন সে। কিভাবে এই ভিড় থেকে উঠে নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করা যায়, সে স্বপ্নেই বিভোর তখন সে। শান্তনুকে যে একেবারে মনে পড়ত না তা নয়। মাঝে মাঝে একা অনুভব করলে ওর গলাটা শুনতে ইচ্ছে করত খুব কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিত সে। বোকা বোকা আবেগগুলোকে ধমকে চুপ করিয়ে দিত।
“বনি দিদি, তুমি যদি আমায় তোমার অপরাধী ভাব, তবে সে পাপ রাখার জায়গা হবে না আমার।” সুপর্ণা আবার বলে ওঠে।
“তোদের কারো প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই রে ! তোরা সুখে সংসার করছিস, দেখে খুব ভাল লাগল। তোরা ভাল থাক। ”
“দিদি…”
“আর কোনো কথা নয়, শান্তনুকে একবার ডেকে দিবি ? তোদের নিমন্ত্রনটা করে আমায় উঠতে হবে এবার।”
“হ্যাঁ।”
বনির হাত ধরে শান্তনু বেরিয়ে আসে। নতুন একটা পাজামা পাঞ্জাবি পড়েছে সে। ওর দিকে তাকিয়ে দয়িতা ভাবে এই শান্তনু একান্তই সুপর্ণার। এখানে আর বেশিক্ষন থাকাটা ঠিক নয়। কি জানি হয়ত আসাটাই ভুল হল। সোফার উপর কার্ডটা রেখে সে সংক্ষিপ্ত ভাবে বলে ,”তোরা আসিস। এলে আমার ভাল লাগবে।” বলেই “আসি।” বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে সে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। শান্তনু আসতে চায় সাথে। ওকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেটের মুখে এসে থামে সে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় একটা ক্যাডবেরি সেলিব্রেশনের ছোট প্যাকেট এনেছিল মেয়েটার জন্য, সেটা তো দেওয়াই হয়নি। ইস ! ওকে ওটা না দিয়ে চলে যাওয়াটা ঠিক নয়। তাই পায়ে পায়ে আবার উপরে ওঠে সে। কলিংবেল বাজানোর দরকার পড়ে না। দরজাটা খোলাই রয়ে গেছে। ভিতরের একটা ছোট্ট দৃশ্যের কোলাজ চোখে পড়ে… বনি বসে আছে শান্তনুর কোলে। আর হাতে পায়েসের বাটি নিয়ে সুপর্ণা একবার মেয়েকে আর একবার শান্তনুকে খাইয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট হাতে ‘হ্যাপি বার্থডে বাপি’ বলে তালি দিচ্ছে বনি। কিরকম যেন মোচড় দিয়ে ওঠে দয়িতার বুকটা। নিজেকে বড় অপাংক্তেয় লাগে। ক্যাডবেরিটা আর দেওয়া হয়ে ওঠে না। ক্লান্ত অবসন্ন লাগছে শরীরটা ! অথচ শেষ ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ফিরতে হবে তাকে নিজে হাতে তৈরি করা চেনা গন্তব্যে।
কিন্তু আজ আর কোনো তাড়াহুড়ো নেই কেন! এতক্ষন সন্দেহ হচ্ছিল, বারে বারে মনে হচ্ছিল এখানে এসে হয়ত ভুলই হল। কিন্তু এখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্পষ্ট বুঝতে পারছে দয়িতা। হ্যাঁ, ভুলই হয়েছে। খুব বড় ভুল। নাহলে কেন থেকে থেকে একটা বোকা বোকা প্রশ্ন উঠে আসছে মনে , ওই মধ্যবিত্ত আটপৌরে সংসারটায় সুপর্ণার ভূমিকায় সে থাকলে কি এমন ক্ষতি হত ! কেমন হত যদি সে থাকত ওই সংসারে ! যা পাওয়ারই স্বপ্ন
দেখেনি সে কোনোদিন, আজ তা হারিয়ে ফেলার কষ্ট কেন চেপে ধরছে তার সমস্ত সত্তা…
দূরে বাঁশি বাজিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। দৌড়োতে থাকে দয়িতা। দৌড়োতে থাকে খুব ওকে যে ধরতেই হবে ট্রেনটা…
সমাপ্ত