টোটো চালিয়ে ফিরছিল সুখু। রাত্রি তখন দশটা। কার্ত্তিক মাসের হালকা ঠান্ডায় রাস্তায় লোকজন নেই। রাজপথ ধরে ছুটে চলেছে ট্রাক, ম্যাটাডোর, মিনি-ট্রাক। তারই আলোয় সুখু দেখল, ভীমপুর ব্রীজের নীচ থেকে উঠে এল একটা লোক। আপাদমস্তক সাদা কাপড় জড়ানো, সঙ্গে একটা বোঁচকা। হাতের ইশারায় সুখুকে থামতে বলল। সুখু স্পীডটা কমাতেই লোকটা উঠে বসল টোটোয়।
সুখু জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা, যাবা কুথায়?’
লোকটা উত্তর দিল, ‘নওদাপাড়া বাপ।’
‘দশ টাকা লাগবে কিন্তু।’
‘বাপ রে, আমি গরিব মানষি, পয়সা কতি পাব বাপ। একটু নামিয়ে দিও ক্যানে।’
ভাড়া নিয়ে আর কোন কথা বলেনি সুখু। তবে টুকটাক কথা ও লোকটার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল। কোথায় বাড়ি, কী করে, কী নাম, এখনই বা কোত্থেকে আসছে এইসব আর কী। নওদাপাড়া বাসস্টপের আগে টোটোর স্পীড কমিয়ে বলেছিল, ‘শুন, পয়সা না থাকলে আর কুনোদিন আমার গাড়িতে চাপিও না।’
গাড়ি থামিয়ে তাকে নামাতে গিয়ে অবাক কান্ড! লোকটা কখন নেমে গেছে বুঝতেই পারেনি সুখু! যাক গে। টোটো নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে, মানে বাজারপাড়ার দিকে রওনা দিল ও।
সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে। তারপর একদিন। সেদিনও মঙ্গলবার। সুখু বিকেলে কয়েক প্রস্থ ভাড়া নিয়ে গিয়েছে। আর নয়, এবার বাড়ি ফিরবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাও দিতে হবে খানিক। তাই রাত্রি ন’টা নাগাদ রাধারঘাট মোড়ে এসে দাঁড়াল টোটো নিয়ে। এমন সময় চারজনের একটা দল ওকে সাঁকুরিয়া ভাড়া নিয়ে যেতে বলল। এর আগেও ও এদের নিয়ে ওখানে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। ভাড়াটা ভালই দেয়। তবু শীতে যেতে ইচ্ছে করছিল না সুখুর। ওরা চাপাচাপি করল। টাকার কথা ভেবে সুখুও রাজি হয়ে গেল শেষমেশ।
ফেরার সময় সুখু মেহেদিপুর বাসস্টপের কাছে খেয়াল করল, কে যেন ওর গাড়িতে বসে রয়েছে। নাকি, ওর মনের ভুল। সেই রকম, সাদা কাপড়ে জড়ানো! সুখু খুব সাহসী। কিন্তু এই মুহূর্তে একটু ভয় ভয় লাগছে তার। কখন, কোথা থেকে, কিভাবেই বা লোকটা তার গাড়িতে উঠল!
সুখু জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার, তুমি কখন উঠল্যা গো?’
‘তুমাকে আসতি দেখি উঠি পড়ছি। শীতে আর থাকতি পারছিলাম না।’
সুখু ভাবছিল, লোকটা কিভাবে উঠলো। ও তো স্পীড কমায়নি একটুও। এই রকম দুর্বল মানুষ, এত শক্তি পেল কোথা থেকে? নানান কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সুখু। আচমকা রাস্তার একটা গর্তে টোটোর একদিকের চাকা পড়তেই গাড়িটা টাল খেয়ে পড়ে গেল। সুখু গাড়িটা তুলতে গিয়ে দেখে, গাড়িতে কেউ নেই! একটা কুকুর ডেকে উঠল। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়েও কুকুর কিংবা ঐ লোকটা, কাউকেই দেখতে পেল না সে। গা’টা কেমন ভারী হয়ে উঠল।
টোটোতে স্টার্ট দিতে যাবে, এমন সময় ও দেখল, লোকটা রাস্তায় বসে একটা একটা করে কিছু যেন কুড়োচ্ছে। আর পেছন থেকে ধেয়ে আসছে একটা লরি! কিছু ভাবার সময় পেল না সুখু। চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছেন কী? উঠুন! চাপা পড়ে যাবেন যে!’
মুখের কথা মুখেই থেকে গেল সুখুর। ধেয়ে আসা লরিটায় ‘পটাস’ শব্দে সব শেষ হয়ে গেল।
পরপর কয়েকটা ট্রাক পেরিয়ে গেল সেখান দিয়ে। যাহ! কিছুই নেই! এ কী হচ্ছে? চোখে সামনে লোকটাকে চাপা পড়তে দেখল, অথচ সেখেনে না আছে রক্ত, না আছে ডেডবডি। ভীষণ ভয় পেল সুখু। আর মুহূর্ত দেরি করল না। খুব, খুব তাড়াতাড়ি সে টোটো চালিয়ে রওনা দিল। খানিকটা এগিয়ে যেতেই ও দেখল, সেই লোকটা, বোঁচকা নিয়ে রেল লাইনের পাশের খাদটায় নেমে গেল। ঠান্ডার দিনেও গরম লাগতে শুরু করছে সুখুর।
সুখুর কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল, লোকটা আর যাই হোক, মানুষ নয়। কপাল ভাল, তাই অন্য কোন বিপদ হয়নি। রেল গেটটা পার হতেই ও দেখল, পাশের পাড়ার গোপাল কাকাকে। টোটোটা এগিয়ে নিয়ে থামালো। মনের ভয় কাটাতে একটু হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘কাকা, কী ব্যাপার গো? এত রাতে এখানে?’
‘বিকালে এসিছিলাম। কেউ আসতি দিছিল না, জোর করি পলায় আসচি নাতিনের ঘর থেকি। ওরে বুলল্যাম, একটু হাঁটি আসি, খেল্যাম অনেক তো!’, গোপাল কাকা উত্তর দিল।
সুখু বলল, ‘ঠিক আছে। এখন গাড়িতে উঠো। কিন্তু ওরা তো চিন্তা করবে। একটা খবর তো দিতি হবে।’
‘সেই-ই তো ভাবছিল্যাম, আর পায়চারি করছিল্যাম। তুই চলি এলি। তা তুই কোত্থেকে আসছিস?’
গোপাল কাকাকে টোটোয় তুলে ফিরতে ফিরতে সুখু বলল, ‘কাকা, দু’দিন আমার যাওয়া হল, দুদিন-ই যে কী বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটল। তুমাকে না দেখতে পেলে আমার বোধহয় দম বন্ধ হয়ে যেত।’
গোপাল কাকা বলল, ‘কতি গেয়েছিলি?’
‘স্যাঁকরা’
‘তা কী হল, খুলে বল না ক্যানে!’
সুখু চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর যা ঘটেছে, সব খুলে বলল।
গোপাল কাকা সব শুনে বলল, ‘আর রাতে ওসব রাস্তায় যাসনি। অত রোজগেরে দরকার কী?’ তারপর বাড়ির কাছে নেমে সুখুর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘বংশী নাম বললি ত? ক বছর আগেই উ অ্যাকসিডেনে মরেছে। ওই হাইরোডেই। শুনেছি, মোজাম্মলের মেয়ের বিয়ের দিন কাজকম্ম সেরে বাড়ির লোকদের জন্য খাবার-দাবার পোঁটলা বেঁধে নিয়ে আসছিল।’
‘কুন মোজাম্মল?’
‘উ যে জমিদার বাড়িতে মালির কাজ করত।’
‘ও-ও-ও, তালে উ সব সত্যি বুলেছে আমাকে!’
‘হ্যাঁ, কথাগুল্যান সত্যিই বুলেছে। আসার সময় কুনো এক বাসে চড়তি যেয়ে অর ওই বোঁচকার জন্য খালাসী উঠা লায়নি। ধাক্কা খেয়েই হোক আর অন্য কুনো ভাবে হোক অর বোঁচকাটা পড়ি যেয়েছিল। খাবার দাবার সব ছিটিই ছতক্কার হয়ি রাস্তায় পড়ি য্যায়াছিল। উ সেই খাবার তুলার সময় পেছন থেকি একটা ট্রাক এসি উকে চাপা দেয়।’
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে থাকে। তারপর গোপাল কাকা বলে ওঠে, ‘কিন্তু এভাবে কাউকে দেখা দিইছে, এমন কথা আগে শুনিনি বাপু।’
সুখু জানতে চাইল তা কতদিন আগের ঘটনা হতে পারে। কাকা মনে করার চেষ্টা করে বলল, ‘তা অনেকদিন হুলো। বছর সাত-আট ত হবিই। আরে তু-ও তো বাসের লাইনে থাকতিস, তু শুনিসনি এ কথা?’
সুখু আর সেখানে দাঁড়াল না। ‘কাকা রাত হয়িছে, যেছি।’ বলে চলে এল।
গোপাল কাকার শেষ কথাগুলো শুনে সুখু কী যেন ভাবছিল। মনে করতে পারছিল না। রাস্তায় রোজই এমন কত ঘটনা ঘটে। বাসে কাজ করা কালীন ও নিজেও কতজনকে নামিয়ে দিয়েছে বা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে… হঠাৎ শিউরে উঠল সুখু! মনে পড়ে গেল কিছু। আরে, ও-ই তো একদিন বোঁচকাওয়ালা লোককে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। লোকটা খুব কাকুতি মিনতি করছিল বাসে ওঠার জন্য। বাসে সেদিন খুব ভিড় ছিল। সুখুর ঠেলা খেয়ে লোকটা বোঁচকা নিয়ে পড়ে গেছিল রাস্তায়। এদিকে বাসটাও ছেড়ে দিয়েছিল। পরে শুনেছিল, লোকটা লরি চাপা পড়েছে।
সব্বনাশ! সেই কারণেই লোকটা কি ওর পিছু নিচ্ছে, ওকে একলা দেখলে? এখন উপায়? এতদিন বাদে কী দরকার ছিল সব মনে করিয়ে দেওয়ার? সুখু বুঝতে পারছিল না…