হিমাচলের কিন্নর জেলার একটি ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম- চিটকুল। ভারত-চীন সীমান্ত প্রদেশে ভারতবর্ষের শেষ গ্রাম। চারপাশে যেদিকেই দুচোখ যায় সেদিকেই প্রকৃতির অনুপম রূপলাবণ্য অপরিসীম মুগ্ধতার সঞ্চার করে। উঁচু পাহাড়গুলো যেন নিরাসক্ত ঋষির মতো ধ্যানস্থ। ঠাণ্ডা হাওয়া উপত্যকার সাথে খুনসুটি করে চলেছে অবিরত। একপাশে বাসপা নদী কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। আকাশ যে এত নীল হতে পারে, তা পাহাড়ে না গেলে বোঝা যায়না। দূরে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। ওই পাহাড়টা কিন্তু ভারতের নয়, ওটা চীনের পাহাড়। বেশ খানিকটা নিচে নেমে নদীর ধারে এসে বসেছিলাম আমি, সৌরভ, সুমন, প্রিয় আর দেবু।
গত সপ্তায় আমরা জনা দশেক বন্ধু মিলে চা মুড়ি সহযোগে নির্ভেজাল সান্ধ্য আড্ডায় মগ্ন ছিলাম। একথা ওকথা হতে হতে হঠাৎই বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলো, ব্যাস সবার মাথায় ভূত চাপলো। শেষপর্যন্ত কোন পরিকল্পনা ছাড়াই দুম করে চলে এলাম। সংখ্যাটা দশ থেকে নেমে পাঁচ হলেও অবশেষে এসেই পড়লাম। তাও আবার কলকাতা থেকে সুদূর হিমাচল। আমি ওই বরফাবৃত পাহাড়টার দিকে এক দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলাম। তারপর বললাম, “আশ্চর্য! এত প্রাণের প্রাচুর্য যেখানে, তাকে কেমন করে জড়, অচেতন বলি! পুরো জায়গাটা কেমন জীবন্ত!” অন্য সময় হলে আমার এই আবেগতাড়িত বক্তব্যের উত্তরে সুমন আমার পেছনে লাগতো, কিন্তু প্রকৃতির গুণেই হোক কিংবা বেড়াতে আসার আনন্দেই হোক, ও চুপ করে রইলো। বাকি সকলেও নিজের নিজের মতো করে পরিবেশটা উপভোগ করতে লাগলো। এমন অবস্থায় কথা বলার থেকে চুপ করে থাকতেই ভালো লাগে বেশী। তবে ভাবুক হয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকলেও চলবে না। দেবু এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। ও বলল, “এবার কিন্তু উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি একটা হোটেল খুঁজে নিতে হবে, নাহলে সারা রাত গাড়িতে বসে কাটাতে হবে।” কথাটা খুব ভুল বলে নি দেবু।
হোটেল বুক না করেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। সিমলা থেকে সারাহান হয়ে আজ চিটকুল এসেছি। কোথাও হোটেলের সমস্যা হয়নি যদিও। তবে এখানে হলো। অনেক খুঁজেও চিটকুলে কোন ঘর খালি পাওয়া গেল না। অগত্যা চিটকুলের মায়া ত্যাগ করে সাংলার দিকে পাড়ি দিলাম।
সাংলা মাত্র পঁচিশ ত্রিশ কিলোমিটারের মধ্যে হলেও পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আসতে একটু বেশিই সময় লেগে গেল। তখনও বিকেলের আলো রয়েছে। তাই চিন্তার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু কয়েকটা হোটেল ঘুরে একটাও ঘর না পেয়ে একটু চিন্তা হতে শুরু করলো। আর এই ফাঁকে সন্ধ্যে নেমে গেল। পাহাড়ে এমন ঝুপ করেই সন্ধ্যে নেমে যায়। সৌরভ বলল, “এখন প্রচুর ভিড়। এসব জমজমাট এলাকায় হোটেল পাওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। চল একটু দূরের দিকে দেখি।”
দেবু একটা সিগারেট ধরিয়ে এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে এলো। এসে বলল, “এখানে কোন হোটেল খালি পাওয়া যাবে না। পাঁচ সাত কিলোমিটার দূরে কয়েকটা হোম স্টে আছে। কপাল ভালো থাকলে ওখানে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে।”
পাঁচ সাত কিলোমিটার বলল বটে, কিন্তু প্রায় দশ কিলোমিটার এসেও কোন হোম স্টে দেখা গেল না। জায়গাটা ধীরে ধীরে নির্জন হয়ে যাচ্ছে। অনেক পর পর একটা দুটো মানুষ দেখা যাচ্ছে। একটা তেমাথার মতো জায়গায় এসে আমরা গাড়িটা থামালাম। কয়েকটা বাড়ি ঘর দেখা যাচ্ছে নিচের বাঁকটায়। একজন তার দোকানপাট বন্ধ করে বোধহয় বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। এখানে কোথায় যে কার বাড়ি, কোন পথ ধরেই বা তারা সেখানে যায় বোঝা শক্ত।
লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোন থাকার ব্যবস্থা আছে কিনা। সে জানালো সামনের রাস্তা ঘুরে নিচে নেমে একটা হোম স্টে ছিল বটে, কিন্তু বেশ কয়েক বছর হলো ট্যুরিস্ট আসে না। কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলাম। এই জনমানবহীন জায়গায় এমনিতেও কেউ থাকতে আসবে বলে মনে হয়না। তাই থাকার বন্দোবস্ত হবার সম্ভাবনা বেশী। নীচে নেমে গিয়ে বাঁদিকে একটু এগিয়ে একটা বাড়ি দেখলাম। অনেক আশা নিয়ে সেইদিকে হাঁটা দিলাম।
বাড়িটায় ঢুকতেই মুখোমুখি হলাম আপাদমস্তক কম্বলে জড়ানো একজন বয়স্ক জবুথবু লোকের। তাঁর শরীর শীর্ণকায়, চোখ দুটো ঘোলাটে, মুখের চামরা কুঁচকে বীভৎস রূপ নিয়েছে। যেন জীবন্ত কঙ্কাল। আচমকা দেখে একটু ভয় ভয় লাগলো। থাকতে চাই শুনে তিনি বললেন, “কতজন আছেন?”
আমরা বললাম- “এই তো পাঁচ জন।”
শুনে তিনি কি যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা আসুন।”
বাড়ির মাঝখানে একটা উঠোন। তার দুদিকে দুটো বাড়ি। একটা দোতলা, আরেকটা একতলা। একতলা বাড়িটায় ভদ্রলোক থাকেন। সামনের দোতলা বাড়িটাই অতিথি নিবাস। জানতে পারলাম পুরোটাই খালি। কিন্তু উনি বারবার বলতে লাগলেন, ওনার একতলা বাড়িটায় ওনার পাশের ঘরটায় যদি কষ্ট করে পাঁচজন থাকতে পারি। এরকম বলার কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, “বয়স হয়েছে তো। এখন আর আগের মত চালাতে পারছি না। কিছু দরকার হলে রাতে উঠে দোতলায় যেতে কষ্ট হয়, তাই পাশের ঘরে থাকলে সুবিধা হয়।”
আমরা জানালাম, রাতের খাবার মতো কিছু হলেই শুধু চলবে। আর আমাদের কোন দরকার হবে না।
আমাদের কথায় ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত নিমরাজি হলেন। আমরা দোতলার ঘর দুটোই পছন্দ করলাম।
দিব্যি খাসা ঘর। দুটো সুন্দর সাজানো, পরিপাটি ঘর। খাট বিছানা, বড় কাঠের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, দেওয়াল আলমারি সবই রয়েছে। বাথরুম টাও বেশ বড়, পরিষ্কার আর গরম জলের ব্যবস্থাও আছে। বুড়ো কি পাগল নাকি! এমন সুন্দর ঘর খালি পরে রয়েছে, তার উপর দুটো ঘরের ভাড়া পাবে; তবুও বোকার মতো একটা ঘরেই ঢুকিয়ে দিতে জোর করছিল কেন! এই জন্যই ট্যুরিস্ট হয়না। ফ্রেস হয়ে নিয়ে সবাই মিলে জমিয়ে চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম। দরজায় টোকা পড়লো। ভদ্রলোক এসেছেন। জানতে চাইলেন রাতে আমরা কি খাবো। সবাই মিলে আলোচনা করে জানালাম রুটি আর চিকেন হলে ভালো হয়।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার সময় খেয়ে নিতে হবে! পাহাড়ের অবশ্য এমনিই নিয়ম। রাত আটটার মধ্যে নিশুতি হয়ে যায়।
খাওয়া শেষ করে ঘরের দিকে আসছি। ভদ্রলোক বললেন, “রাতে আর বাইরে বেরোনোর দরকার নেই। অচেনা জায়গা। ঘরেই থাকবেন।”
তিনি বিদায় নিলেন। আমরা বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখতে লাগলেন। দূর থেকে মনে হলো যেন একটা মুখ ভেসে যাচ্ছে, শরীর দেখা যায়না। তাঁর সারা শরীরে জড়ানো কম্বলটা অন্ধকারের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। দেখেই কেমন গা ছম ছম করলো। চারপাশে কোন শব্দ নেই। বিরাট বিরাট পাহাড় কালো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দরজা বন্ধ করে একটা ঘরেই পাঁচজনে বসলাম। এত তাড়াতাড়ি ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই তাস, আড্ডায় সময় কাটিয়ে একটু রাত করেই ঘুমাবো ঠিক করলাম।
দেবু একটা কোণের খাটে বালিশ পিঠে নিয়ে আধ শোয়া হয়ে বলল, “তোরা তাস খেল। আমার জ্বর জ্বর লাগছে।” বলে ডি.এস.এল.আর টা বের করে নিজের তোলা অসাধারণ সব ছবিগুলো দেখতে লাগলো। প্রিয় বলে উঠলো, “ব্যাস, কোণের খাট আর জ্বর, দুটোই ওর পেটেন্ট নেওয়া!” সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। আর তখনই কে যেন বাইরে কোথাও বিকট চিৎকার করে উঠলো। চারিদিক ফাঁকা আর নিস্তব্ধ, তাই কতটা দূরত্বে এই শব্দ হলো বোঝা গেল না। অনেকটা আর্তনাদের মতো। বুকের ভেতরটা প্রচণ্ড কেঁপে উঠলো। সকলের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। তার জায়গা অধিকার করেছে আশঙ্কা আর ভয়। ফ্যাকাশে মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয় বলল, “লোকটার কোন বিপদ হলো না তো! যা অবস্থা, পরে টরে গেল নাকি?” সৌরভ বলল, “একবার দেখবি নাকি বাইরে গিয়ে?” দেবু বলল, “একদম নয়। কোন দরকার নেই। লোকটা বারণ করলো দেখলি না!” এমন সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দ। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল, আবার তার গতি বেড়ে গেল। কে এলো এখন! সৌরভ জিজ্ঞেস করলো, “কে?” কোন উত্তর এলো না। পরিবর্তে আবার ঠক ঠক করে দরজায় ঘা পড়লো। দেবু বলল, “দরজা খোলার দরকার নেই। যে হয় হোক।” আমি ভাবলাম নির্জন জায়গায় চোর ডাকাত হলেও অবাক হবার কিছু নেই। কেউ কোন শব্দ না করে চুপ করে বসে রইলাম। আবার ঠক ঠক শব্দ হলো। একটু একটু করে মাঝের বিরতি কমতে লাগলো এবং শব্দটা ঘন ঘন হতে লাগলো। ভয়ে নাকি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়, তা জানি না, এবার সবাই মিলে চিৎকার করে উঠলাম, “কে রে?” বাইরে থেকে কোন উত্তর এলো না। তবে শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। আমাদের আড্ডা, তাস কোনটাই জমছে না। সবাই কান পেতে আছি দরজার দিকে, যেন শব্দটায় বিরক্ত হতে হতে সেটারই অপেক্ষায় বসে আছি। আমি নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, “হোটেল বুক না করে আর কোনদিন কোথাও যাচ্ছি না।” সুমন বলল, “এখান থেকে বেঁচে ফিরলে আবার ভাবা যাবে। বুড়োটা সব জানে, কিছু বলল না। নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে এই বাড়িতে।” দেবু বলল, “সে তো আছেই। নাহলে এমন সুন্দর বাড়িতে ট্যুরিস্ট আসেনা!” সৌরভ আর প্রিয় পরস্পরের দিকে তাকালো। কোন কথা বলল না। ওদের মতলবটা আমি আন্দাজ করতে পারলাম। ওরা নিশ্চয়ই দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার কথা ভাবছে। জানার কৌতূহল তো আমাদের সবার হচ্ছে কিন্তু সাহস হচ্ছে না। যা ভাবলাম সেটাই হলো। সৌরভ আর প্রিয় উঠে গিয়ে দরজা খুলতে গেল। দেবু আর সুমন আপত্তি জানালো। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলো না। উৎকণ্ঠায় সকলে অপেক্ষা করছি। এমন সময় দরজায় আবার ঠক ঠক শব্দ হলো। আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। দেবু খানিক চমকে উঠলো। সৌরভ প্রায় লাফিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। এক ঝলক কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে এলো, যেন হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। বাইরেটায় নিকষ কালো অন্ধকার। কাউকে দেখা গেল না। প্রিয় ওর মোবাইলের আলোটা জ্বেলে বারান্দায় বেরোলো। কেউ কোথাও নেই। বারান্দার আলো জ্বালালো। তখন আমাদেরও একটু সাহস হলো। সকলে মিলে বেরিয়ে এলাম। চাঁদনী রাত হলে এমন পার্বত্য উপত্যকা স্বর্গের মতো দেখায়। কিন্তু আজ একটুও আলো নেই। সামনের আপেল গাছগুলোকে মনে হচ্ছে একেকটা প্রেত। পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছে দানব। কিছুক্ষণ সেখানে পায়চারী করে মনে একটু সাহস এলো। শন শন করে হাওয়া দিচ্ছে। পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ফিরে এলাম ঘরে। সৌরভ বলল, “দরজাটা খোলা থাক। বাইরের দরজা তো বন্ধ। বাইরে থেকে কেউ আসতে পারবে না।” সুমন বলল, “হ্যাঁ, ভূত ছাড়া!” একটু হাসার চেষ্টা করলাম। তারপর সবাই মিলে খাটের উপর বসলাম। দরজার দিকে সজাগ দৃষ্টি সকলেরই। টুকটাক কথার মাঝে মাঝে দরজা দিয়ে দেখে নিচ্ছে সবাই। এমনি করে কিছু সময় কাটলো। সৌরভ বলল, “ঠক ঠক আওয়াজটা মনে হয় হাওয়ায় হচ্ছিল। দরজা খোলা রাখার জন্য আর হচ্ছে না সেটা।” ওর কথা শেষ হতেই সকলে একসাথে আঁতকে উঠলাম। দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলে দরজার সামনে বারান্দার অন্ধকার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে অন্ধকারে তাকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
একটা বাচ্চা ছেলের আসাটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয় কিন্তু ঘটনা পরম্পরা আর আকস্মিকতায় আমাদের ভেতর যে ভয় তৈরী হয়েছিল, তার জন্যই এমন অবস্থা। ছেলেটা একটুও নড়ছে না। প্রিয় বলল, “কে তুই? কিছু বলবি?” ছেলেটা কোন কথা বলল না। সৌরভ বলল, “দরজায় কে আওয়াজ করছিল? তুই?” কোন জবাব এলো না। সুমন ফিসফিস করে বলল, “বুড়োর নাতি নাকি! কিন্তু ঢোকার সময় তো বাড়িতে কাউকে দেখলাম না!” আমি বললাম, “তাই হবে। তখন হয়তো ভেতরে ছিল কোথাও!” প্রিয় এবার খাট থেকে নেমে দরজার দিকে এগোলো। ছেলেটা তখনই হাওয়ার মতো ছুটে ছাদের সিঁড়ির দিকে চলে গেল। প্রিয় ডাকলো, “ওই শোন শোন, এদিকে আয়!” বাইরে বেরিয়ে প্রিয় দেখলো ছেলেটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, “দুস্টু আছে! চল ছাদে গিয়ে দেখি। বুড়োর ঘরে দিয়ে আসি ওকে।” দেবু বলল, “কি দরকার! থাক না। বেড়াতে এসে এসবের খুব দরকার আছে কি!”
প্রিয় বলল, “একটা বাচ্চা ছেলেকেও ভয়। সত্যি তোরা পারিস বটে! থাক আমি একাই যাচ্ছি।”
একসাথে এসেছি যখন, যা করবো একসাথেই করবো, তাই ইচ্ছে না থাকলেও সবাই ওর সাথে বাইরে এলাম। ছেলেটাকে দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় গেল ছেলেটা!” প্রিয় বলল, “ওই তো সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদে গেল মনে হয়!”
দেবু বলল, “ছাড় না প্রিয়, কি দরকার ঝামেলায় পড়ার। ঘরে গিয়ে আড্ডা দিই চল। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে, কাল আবার সকাল সকাল কল্পা যেতে হবে।”
আমি বললাম, “তোর জ্বর জ্বর লাগছে বললি, তুই বরং ঘরে থাক।” দেবু কিছু বলল না। তারপর সবাই মিলে সিঁড়ির দিকে এগোলাম। সৌরভ বলল, “আরে পাহাড়ের কোলে রাত কাটানোর সুযোগ কি পাবি! না হয় ছাদে গিয়ে একটু ধূমপান করে নিবি তোরা!” মনে হলো, তা বটে। মন্দ বলেনি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম আমরা। সামনে প্রিয় আর সৌরভ। পিছনে আমরা তিনজন। ছাদের সিঁড়ির কোন আলো খুঁজে পাওয়া গেল না। সবাই মোবাইলের আলো জ্বেলে এক পা এক পা করে উঠতে লাগলাম। ছাদে পৌঁছাতে ঠাণ্ডাটা আরো তীব্রভাবে অনুভব করলাম। ঘন অন্ধকারের চাদর যেন পৃথিবীকে মুড়িয়ে রেখেছে। সেই অন্ধকারে ছেলেটাকে কোথাও ঠাহর করা গেল না। প্রিয় বলল, “কোথায় রে ছোটু?” কোন সাড়া নেই। হঠাৎ সুমন চমকে উঠে বলল, “কে যেন আমার পুল ওভার টা ধরে টানলো।” আমরাও আতঙ্কিত হয়ে মোবাইলের আলোয় দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। আমার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে কেউ। মনে হয় বাকিদেরও একই হাল। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম কিন্তু কেউ নেই। এমন সময় আমার প্যান্টে হালকা টান অনুভব করলাম। সামনে দুহাত দূরত্ব লাফিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “এই কে রে?”
সুমন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তোকেও?”
প্রিয়র দিকে তাকালাম। ওকে বোঝানোর জন্য যে কিছু একটা সমস্যা আছে এখানে। আর থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু মোবাইলের আলোয় দেখলাম ও ছাদের কোণের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত চোখে, মুখ টা হাঁ হয়ে আছে। ওর দৃষ্টিপথের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। ওই বাচ্চা ছেলেটা ছাদের উপর একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। একটা আবছা অবয়ব, মুখ চোখ বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে। কয়েক সেকেন্ড জড়বৎ তাকিয়ে থাকলাম সকলে। তার একটা হাত দূরের দিকে পাহাড়ী রাস্তার বাঁকটার দিকে কিছু দেখাচ্ছে। কিছু উপলব্ধি করার আগেই সে ঝাঁপ দিল ছাদ থেকে। আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট একটা চিৎকার সমস্ত উপত্যকা কাঁপিয়ে তুললো। দেবু সংজ্ঞা হারিয়ে ছাদের উপর পড়ল। বাকিদের অবস্থাও একইরকম। কোন চেতনা নেই যেন শরীরে। ঠকঠক করে কাঁপছে শরীরগুলো। এমন সময় সেই বৃদ্ধ লোকটি একটা জোরালো আলো নিয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, “নিচে চলুন বাবু, নিচে চলুন।” কিভাবে যে আমি আর সুমন নীচে নেমে এলাম জানি না। প্রিয় আর সৌরভ দেবুকে কোলে করে নিচের ঘর অবধি যে আসতে পেরেছিল তা হয়তো সেই বৃদ্ধ লোকটি এসে পড়ার জন্যই।
কি ঘটে গেছে তা উপলব্ধির ক্ষমতা হারিয়েছি। সারা রাত একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। শুধু মনে আছে, বৃদ্ধকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম কিন্তু পারিনি, জিভটা অসাড় হয়ে গেছিল।
সকালের নরম রোদ কাচের জানালা দিয়ে ভেতরে এসে পড়ছে। দেবুর জ্ঞান ফিরেছে। আমরাও একে একে উঠে বসেছি। ঘুমিয়েছিলাম কিনা ঠাহর করতে পারছিনা। কিভাবে সময়টা কেটেছে কোন ধারণা নেই কারো। বৃদ্ধ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তিনি সারা রাত জেগেই কাটিয়েছেন। তারপর হাত জোড় করে বললেন, “আপনাদের বলেছিলাম বাবু, বাইরে বেরোবেন না।”
সৌরভ একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, “কি ব্যাপার একটু বলবেন?”
বৃদ্ধের কাছ থেকে যা শুনলাম, তা শুনে মনে হলো, নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি। দু বছর আগে এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রী পুত্র নিয়ে এখানেই রাত্রিবাস করেন। তখন তাঁর এই হোম স্টের রমরমা ছিল ভালোই। আসলে হোটেলগুলো সব বাজারের কাছে, জনবহুল বসতির মধ্যে। কিন্তু তাঁর এই হোম স্টে একেবারে পাহাড়ের নির্জন একটা ধাপের উপর। ঘরের পাশেই তাঁর বিস্তীর্ণ আপেল বাগান। হাত বাড়ালেই রসালো আপেল হাতে ছোঁয়া যাবে। ব্যবসা ক্রমেই জমে উঠছিল কিন্তু তারপরই হলো এক বিপত্তি। ওই পরিবারটি ফিরে যাচ্ছিল। এমনই কপাল, বেশিদূর যেতে হয়নি, দুটো বাঁক পেরোতেই তাঁদের গাড়িটা ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যায় খাদে। এত উঁচু থেকে পড়লে মৃত্যু ছাড়া আর কিই বা হতে পারে। পরে ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রীর দেহটা পাওয়া গেলেও পুত্র সন্তানের দেহটি পাওয়া যায়নি। তার পরেও সপ্তাহ খানেক বৃদ্ধের ব্যবসা চলেছিল ঠিকঠাক। কিন্তু তারপরই ট্যুরিস্টরা বলতে শুরু করলো তারা একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পাচ্ছে। কেউ বলল, সারা রাত একটা বাচ্চার কান্নায় তাদের ঘুম হয়নি। তবে অনেকে আবার নির্বিঘ্নেই রাত্রিবাসও করে গেছেন। কিন্তু এমনি কথা শুরু হলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা চললো না। ট্যুরিস্ট আসাও বন্ধ হয়ে গেল। একদিন রাত্রে বৃদ্ধ নিজের চোখে দেখলেন একটা বাচ্চা ছাদ থেকে লাফ দিল। আর সঙ্গে সেই বিকট চিৎকার। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখার পর থেকে তিনি নিজেই আর কাউকে থাকতে দেন না। গত কয়েক মাস ধরে আর কিছু না ঘটায় তিনি আমাদের থাকতে দিতে রাজী হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, আবার যদি সব আগের মতো হয়ে যায়, আবার ব্যবসাটা শুরু করা যায়। কিন্তু আজকের পর তিনি যে এই দুঃসাহস আর এই জীবনে কখনো করবেন না তা বলাই বাহুল্য।
দিনের আলোয় মনোমুগ্ধকর পার্বত্য চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো, জগতের কোন স্তরে কি চলছে তা আমাদের বোধ বুদ্ধির অগোচর। এগিয়ে গেলাম পাহাড়ী নদীর ধার ঘেঁষে, পিছনে এক নির্মম করুণ ইতিহাস বুকে নিয়ে পরে রইলো ছোট্ট উপত্যকাটি।