আমাদের গ্রামের দক্ষিণে একটা ছোট নদী। শুকনা মৌসুমে মরে যায়। ভরা বর্ষায় থৈথৈ করে। নদী পার হলে একটা মাঠ। মাঠের গা ঘেঁষে বট গাছ। সেই গাছটা কেন্দ্র করে মেলা বসে ফি বর্ষায়। আমার পিতার কাজ ছিল মাঝ রাত্তিরে নদীটায় ঝাঁপ দেওয়া। সাঁতরে পার হয়ে বট গাছটায় বসে থাকা। সকালে ওই গ্রামের লোক এসে দেখত একটা লোক বিবস্ত্র হয়ে বটের ডালে লটকে আছে। ছোকরার দল ঢিল মারত। সামা পাগলের লুঙ্গি ছাড়া, সামা পাগলের ‘পু…’ মারা। আমার জন্মের অনেক আগে থেকেই সামিউল ওরফে সামা পাগলের বটের ডালে লটকে থাকা মেলার একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। সেই বর্ষায় আমি যখন একটা বদ্ধ চৌবাচ্চায় সাঁতার কাটছি, ছয় মাস আগের উথাল পাতাল ভালোবাসার ঝড়ে সৃষ্টি হওয়া চৌবাচ্চায়, সামা পাগলা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীটায়, মাঝ রাত্রে না, ভর দুপুরে। আর উঠে আসল না সামিউল।
হেমন্তের মাঝামাঝি একটা রাত। চারদিকে ধান মাড়াই হচ্ছে। সেদ্ধ ধানের গন্ধে গুমোট গুমোট সুখ। ফজরের আজান পড়ে কি পড়ে নি, আমার আম্মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। কবে তার পায়ে পানি এসেছিল, মাথাটা ঘুরে উঠে চোখে অন্ধকার দেখতেন কেও খবর নেয় নি। চোখ উল্টে, সেদ্ধ ভাতের মত মুখে ফেনা তুলে তিনি খিঁচতে খিঁচতে একটা আদম সন্তান পৃথিবীতে ফেলে রেখে যখন বিদায় জানালেন, কি আশ্চর্য, এক ফোঁটা চোখের জল ফেলার মত নাকি কেও ছিল না নিষ্ঠুর এই জগতটায়। গ্রামের বুড়িটা যখন দাই সেজে আমাকে টেনে বের করে হাতে নিলেন, নিরুত্তাপ, নিথর আমাকে উল্টে পশ্চাৎদেশে চপেতাঘাত করলেন, আমি তখনো চুপ। সামা পাগলের বউটা বাচ্চা নিয়ে মরল, গোর দুইটা হবে, নাকি একটাতেই দাফন করা হোক, এই আলোচনা জমে উঠল। সকালেই যখন দপ দপ করে কোদালের শব্দ শুরু হলো, সবাইকে আশ্চর্য করে আমি কেঁদে উঠলাম। সামা পাগলার পোলার জন্মের পর কেও আজান দেয়নি।
জন্মের প্রথম একটা বছরের মধ্যেই নাকি আমি মরে যেতে পারতাম। একবার না, কয়বার সেটা কেও লিখে রাখেনি। নিজের পিতৃব্যগৃহে আমার ঠাই হয় নি। সেই দাই আমাকে নিয়ে যায় তার বাসায়। গ্রামের মাথারা ঠিক করে দেয়, খোরাকি বাবদ পিতৃব্যগৃহ থেকে জনা তিনেক পিতৃব্য কয়েকটা নোট দাই বুড়িকে মাসে মাসে ছুড়ে দিবে। কতদিন দিবে কে জানে? সেই দাইয়ের কাছে জন্মের পরের কয়েকটা দিন আমি চোখ উল্টে, হাত পা শক্ত বাঁকা করে খিঁচতাম। এই অসুখে নাকি কেও বাঁচে না। গ্রামের মানুষ তখনো হাসপাতাল, চিকিৎসকের ঠিকানা জানত না। দাই কবিরাজের ঠিকানা জানত, যদিও নিয়ে যাওয়ার কোন তাগিদ ছিল না তার। একটা সময় খিঁচুনি কমতে লাগল, বন্ধ হয়নি যদিও। কিন্তু আমি মরলাম না। আমার খাবার ছিল গাইয়ের দুধ। জল পাতলা করে তাল মিস্রি দিয়ে গেলানো হত আমাকে। দেড় মাসের মাথায় পেট ফুলে রক্ত পায়খানা শুরু হয়। দাইয়ের ততদিনে আমার উপর একটা মায়া পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু মায়ায় কি বাঁচে কেও? শুধু দোয়ায় চিকিৎসা হয়? কিন্তু কি করে সেবারও আমি বেঁচে গেলাম, আর নাম করে ফেলল মকবুল কবিরাজ।
মাঘ সেইবার শেষ হয় হয় করে হচ্ছিল না। একটা মাত্র পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে দাই নিশ্চিন্ত ঘুম দিত। আমি সেই কাপড় সারারাত ভিজিয়ে রাখতাম। একবার ভিজত, শুকানোর সময় না হতেই আবার ভিজত। সকালে উঠে দাই দেখত আপদটা হলদে হলদে জলে লেপটে আছে। আমার মৃত জনক জননী কে যথাসম্ভব গালিগালাজ আর আমার পরিপাক এবং রেচনতন্ত্রকে অভিসম্পাত করে আমাকে পরিষ্কার করা হত। একদিন আমার শরীর আগুনের মত গরম। মকবুল কবিরাজ ওষুধ দিল। আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হল রাতে। মকবুল আরেকটা অব্যর্থ বড়ি দিল, ভেঙে খাওয়াতে হবে। শেষ রাতের দিকে আমার দম যায় যায়। দাই সেই রাত্রে আর ঘুমায় নি। চব্বিশঘণ্টার মধ্যে তৃতীয়বার যখন মকবুলের কাছে ছুটে গেলেন তিনি, আর সেও ভয় পেয়ে হাত পা কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘জননী, এই ছাওয়াল বাঁচবার নয়। তবে সদরের হাসপাতাল খুলছে একটা। ওইখানে যদি একবার নেওয়া যায়…’। সেই হাসপাতাল আরও দুইটা গ্রাম পার হয়ে, গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে, পাকা সড়কের শেষ মাথায়। দাই সেদিন আমাকে বুকে আগলে যখন দৌড় দিল, আর চির পর এক পিতৃব্য টাকা দিতে এগিয়ে আসল, তখন নাকি আমি বুকের খাঁচা ভেঙে নীল হয়ে গেছি। আমাদের গ্রামটা যখন শেষ করে শীতের শুকনো নদীটা হেঁটে হেঁটে পার করছিল দাই, একবার চমকে উঠলেন, বুকটা ধক করে উঠল। সামা পাগলা এই নদীটায় জান দিয়েছিল না!
একুশদিন পর যখন জীবন্ত আমাকে নিয়ে দাই ফিরে আসল, একটা চাঞ্চল্যই জাঁকিয়ে বসল গ্রামে। হাসপাতালে কি মানুষ থাকে না অবতার, রগ ফুঁড়ে ফুঁড়ে পানি দিয়ে জাদু করে অপ্সরীরা, এসব আলোচনার চাইতে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠল, সামা পাগলার পোলাটার মধ্যে কিছু একটা আছে। ‘বিলাইর হাড্ডি’, ‘কই মাছের জান’ জাতীয় বিশেষণে আমি ভেসে গেলাম। লাভের লাভ হল, দাই বুড়ির খোরাক এখন সারা গ্রাম দিবে। আর কষ্ট থাকবে না বিধবা মহিলাটার। দশটা দিন আগে হলে হয়ত দাই পান জর্দায় লোহিত বিশ্রী দাঁতগুলো বের করে হাসত। কিন্তু সেদিন তিনি ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন। গ্রামের কেও কেও সেই কান্নায় সংক্রমিত হল। সামা পাগলা যেদিন মারা গেল সেদিন কেও কাঁদেনি, বউটা ছাড়া। বউটা যেদিন মাটি পেল তখনো কেও কাঁদেনি। যেই সন্তানটা আনতে গিয়ে তাকে জীবন দিতে হল, শুধু সেই কাঁদল, তাও কত দেরি করে। আর আজ সেই শিশুটার জন্য দেখুন, কত লোক কাঁদছে। এই নাটকীয়তা সৌরজগতের অন্য কোন গ্রহে পাবেন না। পৃথিবীটা অদ্ভুত মানবিক একটা গ্রহ।
আর তাই দুই দিন যেতেই আবার সবাই আমাকে সহ দাইয়ের কথা ভুলে গেল। দাই আমাকে কোলে নিয়ে গান শোনাত, গল্প করত, খাটি সর্ষের তেল বুকে পিঠে ডলতে ডলতে আবদার জুড়ে দিত, আমারে মা ক’, ক’বি না মানিক! তিনি হয়ত আমার নানির বয়সের হবেন, কিন্তু গ্রামে কেও বয়সের হিসেব রাখে না। সব চলে এখানে। কত পাড়াতো নাতি নাতনি, নানা’র বিয়ে খেতে এসে পড়ে এখানে (প্রথম বিয়ের কথাই বলছি)।আমার সেই ‘মা’ এখন উদ্বিগ্ন হওয়ারও সময় পান। ‘মানিক, তুই হাসিস না ক্যান, একটু তাকায়া হাস না বাপ। মানিক তোর বছর হয় হয়, এহনও বসস না ক্যান। ঘাড়টাও দেখি বাজানের ঝুইক্কা পড়ে’। গ্রামের সেই মা জানত না, জন্মের পরে একবার কান্না দেরি হলে, জীবনটাতেই পিছিয়ে পড়তে হয়। আমিও তাই শুধু একটা কাথায় শুয়ে হাত পা ছুড়তাম। আমার মা কত নিশ্চিন্ত! এই বাচ্চাকে রেখে গেলেও পড়বে না, হাত মাথা ভাঙবে না। আবার আরেকটা বর্ষা আসে গ্রামে। আবার মেলা বসে। গ্রামের সবাই কাকে যেন খুঁজে পায় না মেলায় এবার। আমাকে ঘুমে রেখে মা গেলেন দুপুরে পাশের বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে ভর সন্ধ্যা। ঘরে এসে দেখেন আমি নেই। চৌকিতে নেই, তলে নেই, উঠোনে নেই, উঠোনের জাংলায় নেই। হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন তিনি। লোক জড়ো হল। আমি নেই তো নেই। ‘বর্ষা নামছে না? সামা আইছে ফিরা। পোলারে টাইনা নিছে রে’। কুসংস্কার যখন বিধি হয়ে চারদিক আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, আশেপাশের বাড়ির ছেলে ছোকরাগুলো পিঠে পশ্চাৎদেশে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘরে বন্দি হচ্ছে, না জানি সামা আর কার কার পোলা তুইলা নেয়, তখন কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘পাইছি রে, পাইছি। সামার পোলারে পাইছি। এই দেখ, ডোবার ধারে আয়। হিজল গাছটার তলে আয়। দেখ সামার পোলা শুইয়া আছে’। নিশ্চিত শিকারটা হাতছাড়া করে গরগর করতে করতে একটা বাঘডাশা দৌড়ে পালায়।
দেড় বছরের মাথায় এসে আমি একটু একটু বসতে শিখি। ইয়া মোটা একটা পেট, আর কাঠির মত হাত পা দেখে আমার মা আমাকে বলতেন, ‘পাঁচফুল পুত্তুর’। আমাকে তিনি গল্প বলতেন, আমি ঠিকঠাক কানে শুনতাম না, কিছুই বুঝতাম না, না বুঝে খিলখিল করে হাসতাম না, তবু তিনি গল্প বলতেন। তার একটা অসুখ ছিল। বকবক করার অসুখ। চুপচাপ থাকলে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হত। আগে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে অযথাই আবোল তাবোল বকতেন, তাতে হয়ত একমুঠো ভাত, এক গামলা মাড়, ত্যানার মত জীর্ণ একটা শাড়ি জুটেও যেত। এখন তিনি আমাকে ফেলে কোথাও যান না। আর সব গল্পের ঝাঁপি ভাঙত আমার ছোট্ট, এবড়ো থেবড়ো মাথায়। তার একটা প্রিয় গল্পে এক রাজকন্যার কঠিন অসুখ। তুলোর মত মেয়েটার ওজন মোটে পাঁচটা গোলাপের সমান। সবাই বলে ‘পাঁচফুল কন্যা’। একদিন এক রাজপুত্র এসে। আমার মা আমাকে সুদূর আগামির এক রাজকন্যার লোভ দেখাতেন, আর আমি ঘুমিয়ে যেতাম।
আমাকে টেনে তুলে নিয়ে পরিষ্কার করা হত মাঝে মাঝে। রাতে চৌকিতে হয়ত শুয়ে আছেন মা, আমাকে নিয়ে, সকালে উঠে দেখেন আমি নিচে। একটা সময় সবাই জেনে গেল পোলাটা বাপের মত পাগলা বাতাস পেয়ে গেছে। মাটি এই পোলারে টানে। বিছানার ওম এই ছেলের কাছে হাবিয়ার উত্তাপ। এইটাও বড় হয়ে বাপের মতই পাগলা হবে। মা শুনে আঁতকে থুথু ছিটিয়ে দিতেন।কুসংস্কারের কালি বৃত্ত হয়ে কপালটায় শোভা বর্ধন করত।
মা’র অসুখের দাওয়াই এক সময় তার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। যতক্ষণ তিনি গল্প বলছেন, ততক্ষণ আমি ঠিক আছি। গল্প শেষ হলেই , মা, আরেকটা ক’, বলে কান্না। মা হয়ত আরেকটা কিসসা শুরু করতেন। মা, জোরে ক’, হুনি নাতো, আবার চিৎকার। কিঞ্চিত বধির ছেলেটার জন্য মায়ের গলা চড়তে থাকে। একটা সময় গল্প শেষ হয়, ধৈর্য শেষ হয়, সময় তো আর শেষ হয় না। গণ্ডদেশে চড় খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি হাঁটতে থাকি। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকি মাটির বিছানায়। এখন আর বাঘডাশার ভয় নেই। নিজেরাই নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করেছে। শেয়াল, কুকুর জেনে গেছে মানুষের বাচ্চাটা শত্রু নয়, ওদেরই সমগোত্রীয় জীব। আমার পিঠের উপর কতদিন জলত্যাগ করে দেয় ব্যাঙ। আমি আবার এই উষ্ণজল ধারা আতরের মত মেখে নিতাম শরীরে। পানির সাপ কামড়ায় না, ভয়ও দেখায় না, কিন্তু সবাই ভয় পায়। এই সাপগুলো ভয়েই মনে হয় কাছে ঘেঁষত না। সারাটা গ্রাম আমাকে ভুলেই থাকত। আমি ছিলাম চরম উহ্য একটা সত্য। তাই কেও ঝাড়ফুঁক করার, তাবিজ মাদুলি বেঁধেরাখার, অন্তত পুরুষাঙ্গের কিছুটা উপরে কোমরে কোন মন্ত্রপুত দড়ি বেঁধে রাখার কথা মনেও করেনি। আমার মা মাঝে মধ্যে মনে করতেন কি করতেন না, কিন্তু খরচের ভয়েই হয়ত চুপসে যেতেন।
বছরে বছরে আমি বাড়তে লাগলাম ঠিক সামাজিক মানুষ নয়, বরং বন্য জীবের মত। তাই আমি হয়ে উঠলাম একজন পরম শান্ত শ্রোতা।বনের পাখির কলতান, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, জোনাকির জিকির সব আমার মুখস্ত।ছোট ছোট মাছ পুকুরের জলে সাঁতরে বেড়ায়। দেখাদেখি কাদাজলে আমিও হাত পা ছুড়ি। আমি হাঁটি পাখির মত দুই হাত ছড়িয়ে।
আমার যখন পাঁচ কিংবা ছয় বছর, তখন মা আমাকে নিয়ে গেলেন মেলায়। ভরা বর্ষা, নৌকায় আমরা পারাপার হচ্ছি, কি এক ভয়ে মা আমাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখলেন। নদীর জল আমার দেখার সৌভাগ্য হয় নি সেদিন। কি জানি, কি আছে শান্ত জলে! মেলার খুব ভিতরে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন না মা। ‘মা, ওইটা কি গাছ? গাছের তলায় কে বইসা আছে’? মা যেন বিরক্ত হয়েই আমাকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমাদের গ্রামে কোন বটগাছ ছিল না। সেদিন তাই আমি গাছটার নাম জানতে পারলাম না।
রাতে মায়ের জ্বর আসল। আগুনের মত পুড়ে পুড়ে যাচ্ছিল। মাঝরাতে মা যখন প্রলাপ বকছেন, আমি তখন চৌকির তলায় মাটিতে শুয়ে মেলার সেই বড়গাছটার তলায় বসে থাকা বুড়োটার কথা ভাবছি। সারা সন্ধ্যা বৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের ঘরের মেঝে কাঁদা জলে মেখে আছে। নকশিকাঁথার মত আমি যখন কাঁদার সর গায়ে জড়িয়ে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি, একটা রাত জ্বরে পুড়তে পুড়তে মা আমার মরে গেল। সেইরাত থেকে আমাকে অসুখে পেল। স্বপ্ন দেখার অসুখ।
পরের বছরগুলো আমার কাটল স্বপ্ন দেখে। সেই বাড়িটা দুই দিনেই হাতবদল হয়ে কে যে নিয়ে গেল মনে নেই। ভালোই হল তাতে। গ্রামের যত নোংরা নীড় সব আমার জগত। আমি সেই জগতের রাজা, যুবরাজ, কিংবা যা ইচ্ছে তাই। আবার একদিন বর্ষা নামে গ্রামে। মরা নদীটা জেগে উঠে। আমি এখন সেই নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থাকি। কেও আমাকে বুকে লুকিয়ে রাখে না। ওই পাড়ে যাব কোন নৌকা আমাকে নেয় না। আমার টাকা নেই, সেটা বড় বিষয় না। ‘তুই সামা পাগলার পোলা না? তোরে নৌকায় তুইলা মরুম নাকি’! ‘সামা পাগলার পোলা’ কথাটার প্রতি আমার এক ধরনের ভালোবাসা জন্মায়। আমি আমার একটা অজানা পরিচয়ের গন্ধ পাই। আমি ততদিনে সাঁতার কাটতে শিখেছি। একদিন ঝাঁপিয়ে পড়ি সেই নদীর জলে। সবাই চেঁচিয়ে উঠে, ‘ ওরে, ওরে, সামা পাগলার পোলা নদীতে ঝাঁপ মারছে রে’। আর কি আশ্চর্য, আমি যখনই নদীটা পার হয়ে কাঁদায় দাঁড়ালাম, মনে হল আমার বয়স এক লাফে কয়েক বছর বেড়ে গেল। কয়েক জন্ম বাড়লেও অবাক হব না। বটগাছটার দিকে আমি যখন হেঁটে যাচ্ছি, আমার মাথাটা শক্ত ঘাড়ের উপর উঁচু হয়ে জ্বলছিল। অথচ এর আগে মনে হত মাথাটা খালি ভনভন করে দুলছে। আমার কানের মধ্যে আজন্ম আটকে থাকা তালাটা ঝং শব্দ করে খুলে গেল। আমাকে দেখে ভয় পাওয়া লোকগুলোর বুকের ধুকধুকানি পর্যন্ত আমি শুনতে পাচ্ছি। অস্থি আর চর্মের মাঝখানে প্রতিটি মাংসপেশির দৃঢ়টা আমি অনুভব করছি। আর চোখটা জ্বলজ্বল করছে, আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার দৃষ্টি শুধু সেই বটগাছটার দিকে। বটগাছটা থেকে সুর ভেসে আসছে।
‘ওরে, ওরে, কাঁকনদাসি অট্টহাসি চোখেতে অনল,
গর্জে ওঠে বজ্র কণ্ঠে সাক্ষাৎ নারী খল,
যতই কর ছলাকলা, যতই ভোলাও মন,
তোমার খেলা, সাঙ্গের বেলা করি সমাপন।
কাজলরেখাদুখী কন্যা ফেলে চোখের জল,
হীরামন বন্ধু আমার, কোথায় থাকিস বল’।
আমি যখন জটলায় প্রবেশ করছি, সবাই সরে সরে আমাকে জায়গা করে দিচ্ছিল। সেই বুড়ো লোকটা কিসসা থামিয়ে দেয়, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা সময় হেসে উঠে, আর কেঁপে উঠে আকাশ বাতাস। ‘সামিউলের পোলা না তুমি? তোমার কথা কইত তোমার বাজান। “দোস্ত, আমার একটা পোলা হইব দেখিস। তুই আর কি কিসসা শুনাস, ওই পোলা আইসা তোরে হারায়া দিব”। হা হা, আইস দেখি হারাইতে পার নাকি। বুড়া হইয়া গেছি বাজান। তোমার বাপ আমারে দোস্ত বানাইছিল। একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি রাইখা গেছিল নেংটা পাগলটায়। কয়, আমার পোলারে দিও, দোস্ত। এই দেখ, দশটা বছর ঝোলায় নিয়া বইসা আছি। বছর বছর মেলায় বইসা কিসসা কই আর চায়া থাকি। সামিউলের পোলা কবে আহে, কবে আহে। না, এইবার আমার মুক্তি। লও বাজান’।
জটলা তখন সমুদ্র। সেই সমুদ্রের মধ্যমণি হয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমার শরীরে পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। অনেক গরম। আহা, পিতা আমার এত উষ্ণতা সহ্য করতে পারত না, আর সবাই বলত পাগল। আমি পারব সহ্য করতে? আমি দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। আমার মুখ খুলে না। আমার জিহ্বা নড়ে না। আমার হাতে টান পড়ে, ‘ক বাজান, কিসসা ক’।
আশ্চর্য শান্ত, দৃঢ়, পরিষ্কার উচ্চারনে আমার ঠোঁট কাঁপতে থাকে।
‘আমি গল্প বলতে এসেছি’।
আমি যেন শুধু গল্প বলতেই এসেছি এই পৃথিবীতে।