নিজেকে প্রথম আবিস্কার করি বিশাল এক বিপনিতে,তখন অল্প অল্প কথা বলতে শিখেছি মাত্র; বুদ্ধিও কিছু কিছু গজিয়েছে।তারই প্রথম একটা বুদ্ধি খরচ করে জেনেছিলেম এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল সপিং সেন্টার অব আমেরিকা; আভিজাত্যের গর্ভে বুক ফুলিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আজকের এ দুখের দিনে কত কথাইনা মনে পড়ছে। কোনটা ধরি, কোনটা ছাড়ি, স্থির করতে দুস্কর মনে হচ্ছে।যাহোক যেটা বলব সেটাই বলা হবে।কোন এক খ্যাতিমান কবির গানে শুনেছিলুম –“তোমার এ মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাকো প্রভু।” সে সূত্র ধরেই মনে স্বস্তি পাই; হারাবে না হারাবে না।
মজার ব্যাপারটা বলি-আমি ঝুলেছিলেম; ভাবছেন ফাঁস টানিয়ে, না , একটা হ্যাঙ্গারে ; আমার মাথার উপরে আরও দুজন ঝুলে ছিল। কিভাবে আমার জন্ম হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না, কেউ তার জন্ম ইতিহাস জানেনা; আমিও জানিনে।
সুখেই কাটছিল আমার দিনগুলো। কত জাত-বেজাতের লোকের সাথে পরিচিতি,কি বিচিত্র তাদের ভাষা,কি বিচিত্র পোষাক-আষাক,মুখায়বব,চলন বলন।
হ্যাঁ প্রথমে আমি ভেবেছিলেম আমার মাথার উপর যে-দুজন ঝুলে আছেন তেনারা আমার জনক-জননী;কারন আমা থেকে ঢের বড় কিন্তু সে ধারনা ভুল,ক্রেতাদের আড়-ঠার ভাবে পরে বুঝেছি আমরা তিন সহোদর; আমি সবার ছোট। তাহলে আমার পিতা-মাতা কে? যখন বুৎপত্তি কিছুটা বেড়েছে তখন জেনেছি প্রানীকুলের মত প্রজননগতভাবে আমার জন্ম হয়নি,কারনটা আপনারাও জানেন আমি প্রানী নই; বিশেষ দীর্ঘ দিনের পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমার জন্ম। বড় সহোদরের কাছে যেটা শুনেছিলেম সেটাই বলি-
আমাদেরও একটা গোত্র আছে,সেই বিখ্যাত চাইনিজ কিংখাব,যার রোড ছিল চীন থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তান হয়ে মিশর পর্যন্ত। হ্যাঁ আমি মধ্যযুগের কথা বলছি। অধুনা পশ্চিমা বিশ্বে প্রাচ্যের পোষাকের রমরমা বাজার, যদিও প্রাচ্যের আগের সেই আভিজাত্য তেমন নেই।
প্রথমে ভেবেছিলেম সেই পুরনো পথ ধরেই এখানে আমার আগমন; কিন্তু নাঃ, আমার পেটের উল্টো দিকে যখন এক ভদ্র মহিলা ঠোঁট উল্টিয়ে পড়ছিল-‘মেইড ইন বাংলাড্যাশ’।বাংলাড্যাশ শব্দটা আরও শুনেছি, বোধহয় ক্রিকেট খেলার মৌসুমে; হ্যাঁ তাই,ভাষ্যকার বাংলাড্যাশ বাংলাড্যাশ বলে মাঝে মাঝে টিভিতে বাহাবা দিত; বলা বাহুল্য আমার সামনেই ছিল ঢাউস আকৃতির এক টিভি।
যাহোক আরও পরে জেনেছিলেম বাংলাড্যাশ নয় বাংলাদেশ। ইংরেজি ভাষায় ‘দ’ এরম ত কোন ধ¦নি নেই বলে ঐ রকম উচ্চারণ।
যেদিন থেকে জেনেছি আমার জন্ম-স্থান বাংলাদেশ ,সেদিন থেকে জন্মভূমিকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল হয়ে থাকতো; আর ভাবতাম আমি এখানে কী করে এলাম। বড় সহোদর কিছু কিছু জানতো সে কথা, কিন্তু বড়দের কথায় নাক গলাতে নেই বিধায় আর তেমন জানা হয়নি।
পূর্বোল্লেখিত ভদ্রমহিলাই আমাকে প্রথম ৫০০ ডলার দিয়ে কেনে তার পাঁচ বছরের বাচ্চাটির জন্যে। বাচ্চাটিও এসেছিল সাথে, কী মিষ্টি তার হাসি! জো গলে গলে পড়ছিল যেন তার ঠোঁটের কোন বেয়ে।
ছেলেটি পড়তো ন্যাশনাল কিন্ডার গার্টেনে, সে সুবাদেই কত জনের সাথে আমার পরিচয়। কেউ ফুটফুটে, কেউ টুলটুলে,কেউ চটপটে,কেউ নটঘটে কত বিচিত্র তার ইয়ত্তা নেই, যেন বুনো বাগানে অজ¯্র ফুল; কিন্তু হাসিটা সবার এক ; ভূবন-মোহিনী। ও হ্যাঁ এখন পর্যন্ত গল্পে গল্পে বাচ্চারটির নামটিও বলা হয়নি। ওর নাম ছিল এডমন্ড জেনিফার লিটুস; তবে ডাকনাম লিটুস । জিনিয়ার সঙ্গে ওর খুব ভাব।
বলছিলেম কত জনের সঙ্গে পরিচয়। লিমা,টনি,মেরি, সায়মন; সবাই আমাকে ভালভাবে চেনে। চেনে অনেকেই। তারা লিটুসের গায়ে নরম হাত বুলিয়ে বলেছিল – ‘হাউ উইস’!
সকালের সোনা রোদ। আমার গায়ে ফুল আঁকা জরিগুলো যখন লিটুস আলতো করে বুলাতো,সেই সোনা রোদ তার মুখে ঠিকরে পড়তো,আমাকে ভীষণ সন্মান দেখাতো লিটুস আর ওর মা।
দিনকাল ভালই যাচ্ছিল,কিন্তু চির দিন সবার সমান যায়না; আমারও গেল না।কী একটা ব্যামোতে অবাঞ্চনীয় ভাবে আমাকে কাঁদিয়ে, মাকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যায় লিটুস। লিটুসের বাবা ছিলনা,একমাত্র আদরের ধনের শোকে মা পাগলি হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় লিটুসের মা।
আমি পড়ে থাকি ওই বাড়িতে,একা একা কিচ্ছু ভাল লাগেনা। মনটা সব সময় মুষড়ে উঠে লিটুসের জন্য। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আমার দেহে লিটুসের ছোঁয়া অনুভব করি;আবার আতঙ্কিত হই। অযত আর জীর্ণতায় আমি মলিন হয়ে উঠি।
ঘরের মালিক একটা একটা করে পুঁটলি খুলছে আর গ্রেড অনুসারে সাঝিয়ে রাখছে। যারা একটু সম্ভ্রান্ত গোছের অথবা যাদের গায়ে কিছুটা জৌলুস রয়েছে তাদের তুলনামুলক কিছুটা ভাল স্থানে রাখছে। তার কদরও একটু বেশি।
আমার গায়ে তখনও কিছুটা জৌলুস অবশিষ্ট ছিল,তাই আমাকে অপেক্ষাকৃত একটু ভাল স্থানে রাখা হয়েছে। যেদিন সে আমার গায়ে গরম লোহা দিয়ে ডলে আমার কোঁকড়ান চামরা গুলো সোজা করল সেদিন আমার অনেক কষ্ট হয়েছিল যদিও কিন্তু আজ আমার বাহারি চেহারা দেখে সে দুঃখ অনেকটা ভুলে গেছি। “গতস্য শোচনা নাস্তি”, আশায় বুক বাঁধি, দেখি সামনে কী হয়!
এখানেও অনেক লোকের সমাগম,কিছুটা দীনতা তাদের পোষাক-আষাকে। বুঝলাম এরাও খরিদ্দার। কান পেতে তাদের ভাষা বুঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলামনা।
কতদিন কেটে গেল বলতে পারব না কেননা আমার কাছে কোন ক্যালেন্ডার ছিলনা। তত দিনে এখানকার ভাষা অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছি। জানলাম এটি বাংলাদেশ, আমার স্বপ্নের দেশ:মনে প্রানে নেচে উঠলাম আমার জন্মভ’মিতে এসেছি। আর যেখানে আছি এর নাম –‘গুদরী পট্টি’ বা ‘খাড়া পট্টি’। এ পট্টিরও যৎসামান্য ইতিহাস ও রয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরনো কাপড়ের বাজার এটা তাই নাম হল ‘গুদরী পট্টি’; এ বাজরে ক্রেতাদের জন্য বসবার কোন ব্যবস্থা নেই, দাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে চয়েস করে কাপড় কিনতে হয় বিধায় এর নাম ‘খাড়া পট্টি’।
যাহোক, যেখানেই থাকিনা কেন, নিজের জন্মভ’মি তো! কী যে ধন্য আমি তা ভাষায় বুঝাতে পারবনা।
আরও অনেক পরে জায়গাটির মাহাত্ম বুঝতে পেলাম। ‘গুদরী পট্টি বা ‘খাা পট্টি’ অনেকটা বৃদ্ধাশ্রমের মত। আমাদের যারা জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়েছে তাদেরই এখানে স্থান আর নি¤œ শ্রেনীর লোকেরাই এখানে বেশি আসে আমাদের জ্ঞাতী ভাই বোন বা কাকা জেঠাদের কেনার জন্য।
একদিন এক স্থানীয় ভদ্রলোক আমাকে দেখে তার খুব পছন্দ হল,যদিও আমার আগের জৌলুস তেমন নেই। সোনার পাতগুলো অনেক আগেই পড়ে গেছে,সেখানে শুধু ম্যাপের মত সুতোর ডিজাইন গুলো কুচকে আছে,তবুও সম্ভ্রান্ত বলে কথা। কিন্তু ভদ্রলোকের বড় আফসোস আমি নাকি তার ছেলের গায়ে খাপবোনা, ছেলেটির বয়স ঢের বেশি। কেনা হলনা তার।
কিছুদিন পরে এল আরেক ভদ্রলোক,পরনে ধুতি কোন কোন খানে রিপু করা , গায়ে ফতুয়া স্থানে স্থানে তালি দেয়া; একটি ফুটো দিয়ে তার পৈতার একাংশ দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম ইনি হিন্দু ভদ্রলোক। বয়স চল্লিশের কাছে,চামড়ায় সামান্য ঝোল পড়েছে।
ও হ্যাঁ বর্ননা মতে কেউ তাকে ভদ্রলোক ঠাওরাবেনা কিন্তু পরের কাহিনীগুলো শুনলে ভদ্রলোক বলে কারও দ্বিমত থাকবেনা।
শুনলাম লোকটির নাম বিপিন। তার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আছে; আমাকে তার জন্য পছন্দ।দামাদামী সেরে কমরের খুট থেকে বিভিন্ন প্রকারের নোট সম্বলিত পাঁচ শত টাকার তিন টাকা কম এবং কিছু রেজগি পয়সাও ছিল, তা বের করে দোকানদারের হাতে দেয়। দোকানদার দয়া পরবশে তিন টাকা ছাড় দিয়েছে। তখন ভদ্রলোকের আনন্দ দেখে কে! নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এলেন।
বউ তখনও ঘুমায়নি,ভদ্রলোক বউয়ের হাতে আমাকে দিলে তার খুব পছন্দ হয়েছে বলে জানায়। সকালে তিনি ও তার বৌ মিলে আমাকে মেয়েটির গায়ে পরিয়ে দেয়; সে কী আনন্দ তাদের।
আমাকে কেনা হয়েছিল পূঁজো উপলক্ষে,কিন্ত হায়রে নিয়তি ; দুদিন বাদেই মেয়েটির ভীষণ জ্বর হল। কত ডাক্তার কবিরাজ এল , কিছুতেই কিছু হলনা, না পথ্যে না বদ্যে। তের দিনের দিন পাঁজর ছিন্ন করে সেও চলে গেল লিটুসের মত। তার বাবা মুখ আগুন করতে করতে পাগল হয়ে গেল কিন্তু আমাকে লুকিয়ে রাখল বুকের কাছে ঠিক রবি ঠাকুরের ‘কাবুলি ওয়ালা’-র মত। তার বিরহ দেখে আমিও সইতে পারছি না আর।
শুনলাম, ওই ভদ্রলোককে লেখক কাকা বলে ডাকেন। লেখক তার বিপিন কাকাকে সময় অসময়ে এসে অনেক সান্তনা দেন। লেখকের বিপিন কাকাকে কখনও বিড়ি টানতে দেখিনি অথচ এখন বিড়িই তাকে টানছে। আমি লেখক মহোদয়কে জানাতে চাই- আমার তবে কবে মুক্তি, আমি যে আর তার বিপিন কাকার দুঃখ সইতে পারছি না।