ঘটনাটি আমার বন্ধু ডমরু ধরের কাছ থেকে শোনা। লোকে বলে শোনা কথায় বিশ্বাস করতে নেই। আমিও প্রথম প্রথম বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ডমরু ধর তার কাহিনীর সমর্থনে এমন কিছু অকাট্য প্রমাণ হাজির করেছিল যে আমার বিশ্বাস না করে থাকার আর কোনো উপায় ছিল না।
সেদিন ছিল শনিবার, তার ওপর ঘন অমাবস্যা। হাতের পশমতো দূরে থাক চোখের উপর না রাখলে হাতের আঙুল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না। কিছু অলক্ষুণে নিশুতি পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো সাড়া শব্দ ছিল না। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকা উৎকটভাবে ডেকে উঠছিল। কয়েকটা বেওয়ারিশ কুকুর অদ্ভুতভাবে কাঁদছিল যেন নিকট কোনো স্বজন হারিয়েছে।
ডমরু ধরের বাড়ির পেছনে শ্যাওড়া গাছের দিক থেকে মিহি সুরে কোনো নারীর কান্না ভেসে আসছে। বাড়ির উত্তর দিকে শ্যাওড়া গাছ থাকা অলক্ষুণে হলেও ডমরু ধরদের এসব সংস্কারমুক্ত বাড়িতে শ্যাওড়া গাছটি টিকে আছে প্রায় শত বছর। সেই বিবেচনায় শ্যাওড়াগাছটি ছিল ডমরু ধরের দাদার বয়সী।
মিহি সুরে নারী কণ্ঠের কান্না শুনে ডমরু ধর ভাবলো পাশের বাড়ির বিজয়ের ঠাম্মা বুঝি ঘুমের ঘোরে বেরিয়ে পড়েছে। বিজয়ের ঠাম্মার অনেক বয়স, রাতে চোখে দেখতে পায় না, ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক চলে যায়। ডমরুর বয়স তখন মাত্র চৌদ্দ হলেও দায়িত্বজ্ঞানে সে ছিল অত্যন্ত পরিপূর্ণ যুবা। বয়স্ক লোকটিকে রাত-বিরেতে আমি হলে জীবনেও দেখতে যেতাম না, কিন্তু ডমরু তাই করল যেটা অনেকেই করে না।
বিজয়ের ঠাম্মাকে বাড়ি পোঁছে দেয়ার জন্য শ্যাওড়া গাছের দিকে ছুটে গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। অন্য কেউ হলে ভয়ে মূর্ছা যেত, কিন্তু এটা ডমরু ধর যে কিনা যমরাজকে পর্যন্ত ফাঁকি দিয়ে এসেছিল একাদশীর দিন পুঁইশাক খায়নি বলে। আমি আপনাদের সেই ঐতিহাসিক ডমরুধরের কাহিনীই বলছি। স্বর্গীয় ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বয়সকালে যাকে নিয়ে গল্প লিখে বেশ নাম যশ কুড়িয়েছিলেন।
থাক সেসব কথা, যে কথায় ছিলাম সে কথায় ফিরে আসি। কাউকে না দেখে ডমরু ধর নিশ্চিত মনে ফিরে আসছিল, যেন ভুল শুনেছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য রকম। তারা ডমরু ধরকে কিছুতেই যেতে নেবে না। তারপর যা ঘটল সেটা একটা ইতিহাস, কিন্তু হাল আমলের লোকে বলবে কল্পকাহিনী। কিছু কিছু সত্য ঘটনা মাঝে মাঝে গল্পকেও হার মানায়। এ ঘটনাটাও ছিল ঠিক সে রকম।
মহাপরাক্রমশালী ঝগড়াবিল রাজ্যের মহারাজ বাসঞ্চোরা। বাসঞ্চোরার একমাত্র কন্যা ছিল শাঁকচুন্নি। প্রত্যেক অঞ্চলের নামকরণের কিছু বিশেষ প্রবণতা আছে, যেমন আমাদের অঞ্চলে মেয়েদের নামের শেষে ‘আক্তার’ কিংবা ‘খাতুন’ থাকে তেমনি পুরুষ ভূতদের নামের শেষে ‘চোরা’ আর নারী ভূতদের নামের শেষে ‘চুন্নি’ থাকে। চোরা ও চুন্নির বাংলা পারিভাষিক রূপ যথাক্রমে সম্মানীয় এবং সম্মানীয়া। অনেক মানুষই এই চোরা-চুন্নি উচ্চারণটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে করে। জ্ঞানের স্বল্পতাজনিত কারণে তারা এই শব্দদ্বয়কে তস্কর অর্থে ব্যবহার করে। মূলত ভূত সমাজে চৌর্যবৃত্তির মতো কোন হীনকর্ম নেই।
লেনদেনের জন্য তাদের কিছু ব্যাংক থাকলে ঋণখেলাপী, ঋণ মওকুফ, তহবিল তসরুপ, আর্থিক প্রতারণা এ ধরনের কোন শব্দ ভূতাভিধানে নেই। সততা ও ন্যায়পরায়ণতা শব্দগুলো ভূতদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ভূত সমাজে বৈষম্য নেই বললেই চলে। ভূত সমাজে ভূতশ্রুতি আছে- বহুবছর আগে এক ভূত ইচ্ছাকৃতভাবে আরেকজন ভূতের খাবার খেয়েছিল, তারপর আদালতের রায়ে সেই ভূতের ভৌতত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল এবং ইউরেনাস গ্রহে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। আবারও ধান ভানতে শিবের গীত, মূল কথায় আসি।
অপরূপা শাঁকচুন্নির যেমন রূপ তেমন তার গুণ। এসব কোন মানবিয় রূপ-গুণ নয়, নিতান্তই ভৌতিক রূপ-গুণ। মানুষ কখনো এসব রূপগুণ কল্পনা করতে পারবে না, বর্ণনা করতে পারবে না। নানাবিধ ভৌতিক গুণের পাশাপাশি তিনি কিছু মানবিক গুণও রপ্ত করেছিলেন। ভূত সমাজে তাই তার কদর ছিল অনন্য। বিভিন্ন রাজ্যের ভূত রাজপুত্রগণ তার পাণিপ্রার্থী হয়ে নিজেদের ধন্য করতেন। কিন্তু শাঁকচুন্নি মড্ডিংর কাউকেই পছন্দ হতো না।
‘মড্ডিং’ শব্দটি ইংরেজি ম্যাডামের ভৌতিক পারিভাষিক শব্দ। বর্ণনার সুবিধার্থে আমি মড্ডিংর বদলে ম্যাডামই ব্যবহার করব। ম্যাডাম শাঁকচুন্নিকে এক নজর দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ লাইন পড়ে যেত। তাকে এক নজর দেখার জন্য কত ভূত যে পদদলিত হয়ে অক্কা পেয়েছে তা সর্বশেষ ভূতশুমারিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। ভৌতিক সংখ্যাগুলো টাইপ করা যায় না, কারণ বাংলা কি-বোর্ড তৈরির সময় ভূতদের বর্ণমালা সম্বন্ধে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না।
ভূত সমাজের মহামারীগুলো এরকমই। তাদেরতো রোগ-বালাই নেই, তাদের মৃত্যু হতো অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনার প্রেক্ষিতে। মানুষের ভাষায় এটাকে রোগও বলা যেতে পারে। কিন্তু তাদের হাম, যক্ষা, পোলিওর মতো কোনো রোগ ছিল না। একবার মোদকচুন্নি নামের এক ভূত নর্তকীর নাচ দেখতে এসে সুরের মূর্ছনায় ত্রিশং ভূত মারা গিয়েছিল। ত্রিশং একটি সংখ্যা। এটাকে অংকে লেখার জন্য যথেষ্ট সংখ্যা আমদের গণিতে নেই। একারণেই এসব ভৌতিক সংখ্যা।
শাঁকচুন্নি ম্যাডামের মানবিক গুণগুলোর কিছু বর্ণনা দেয়া যাক। প্রতিদিন দুইবার ব্রাশ করতেন, যদিও ভূতদের কোন দাঁত থাকে না তবু তিনি মাড়ি পরিষ্কার করতেন, প্রতিদিন গোসল করতেন-ভূতদের রোগজীবাণুর ভয় নেই বিধায় তাদের গোসল করতে হয় না। কিন্তু শাঁকচুন্নি ম্যাডাম নিয়মিত গোসল করতেন। ভূতদের পৃথক সঙ্গীত থাকার পরও তিনি প্রতিদিন সকালে মনুষ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করতেন। যদিও মানুষের কানে তা নিতান্ত আশাস্ত্রীয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের কাছে চৈনিক ভাষা যেমন দুর্বোধ্য ভূতদের ভাষা ঠিক তেমনি। মাঝে মাঝে মনে হবে পাখির ডাক, মাঝে মাঝে মনে হবে পশুর ডাক, মাঝে মাঝে মনে হবে পোকামাকড়ের ডাক। ডমরুধর কয়েকদিনে ভূতদের কিছু শব্দ আয়ত্ব করতে পেরেছিল বিধায় এ বর্ণনাগুলো পাওয়া গেছে, নইলে মানব জাতি এসব জ্ঞান থেকে চিরকালের মতো বঞ্চিত হতো।
ফিরে আসি শাঁকচুন্নি ম্যাডামের গুণের কথায়, তার সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী গুণ ছিল তিনি মানুষের খাবারের কয়েকটা মেন্যু খুব ভালভাবে রান্না করতে পারতেন। তার স্বাদ গন্ধ ছিল নিতান্তই ভৌতিক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ভৌতিক শব্দটি কোন নেতিবাচক শব্দ নয়। এটা নিতান্তই ভূতের বিশেষণ। তিনি হরেক রকম পদের রান্না শিখলেও খাওয়ানোর মতো কাউকে পাচ্ছিলেন না। কারণ ভূতদের জিহ্বা ও দাঁত না থাকার দরুণ তারা মানুষের খাদ্যের স্বাদ উপভোগ করতে পারতো না।
ভূতদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। ভৌতিক গন্ধ ছাড়া তারা পৃথিবীর অন্যান্য গন্ধ কিছুতেই বুঝতে পারতো না। তাই শাঁকচুন্নি ম্যাডামের রান্না করা খাবারগুলো দীর্ঘদিন যাবত ভূতদের বিশেষ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে ভূতদের আগুনের কাছে যাওয়া বারণ বিধায় তারা রান্না-বান্নায় একটি বিশেষ ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল। ডমরুধর সেই যন্ত্রের একটি এই ভূলোকে নিয়ে এসেছিলেন শাঁকচুন্নি ম্যাডামের হাতে-পায়ে ধরে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্রকে নিয়ে নানা গবেষণা চালিয়ে তৈরি করেছিলেন মাইক্রোওয়েভ ওভেন। নইলে পৃথিবীর মানুষের কখনো মাইক্রোওয়েভ ওভেন দেখতে হতো না।
একদিন শাঁকচুন্নি ম্যাডামের শখ হল নুডলস রান্না করবে এবং একজন মানুষকে সেই রান্না করা নুডলস খাওয়াবে। কিন্তু তার জন্যতো একজন মানুষ লাগবে। শাঁকচুন্নি চাইলে পৃথিবীর যেকোন মানুষকেই ধরে নিয়ে আসতে পারে। সেই দিন ডমরু ধরের সঙ্গে যা হয়েছিল এই ছিল তার শানে নুযূল।
মূলত শাঁকচুন্নির নুডলসের স্বাদ-পরীক্ষা করার জন্যই ডমরু ধরকে বিশেষ যানে চড়িয়ে ভূতলোকের ঝগড়াবিল রাজ্যের বাসঞ্চোরা রাজের প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই যানের বিস্তারিত বলা নিষেধ থাকলেও ডমরু ঘোরের মধ্যে যে বর্ণনা দিয়েছিল তাতে ধারণা করা যায় এই যানের পঞ্চান্ন জোড়া স্বয়ংক্রিয় পাখা ছিল। তাই অনুমান করা যায় ভূতদের পরিবহন ব্যবস্থা অনেক পূর্বেই চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল।
ডমরু ধর বেশ কয়েকদিন বাসঞ্চোরা রাজের প্রাসাদে কাটিয়ে দিয়েছে শাঁকচুন্নির হাতের রান্না খেয়ে। এই বিষয়ে ডমরু ধরের আত্মজৈবনিক গ্রন্থের ৫৬ নাম্বার অধ্যায়ের ৩৩ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত দেওয়া আছে। অত্যন্ত চমৎকার সব ভৌতিক স্বাদের রান্না শাঁকচুন্নির দেয়া বিভিন্ন ভৌতিক নামে খাবারগুলো পরিচিত। টানা সাত ভৌতদিন কাটার পর এবার নুডলস রান্নার পালা। ভূতলোকের সময়ের হিসাব পৃথিবী থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা।
নুডলস বানানোর ঘটনা এক এলাহি কাণ্ড। আমাদের বাজারের মতো সেখানে ইনস্ট্যান্ট কিংবা মিহি স্টিক নুডলস নেই। একটি বিশাল মেশিনে বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে চালিয়ে দেয়া হলো। মেশিনের অন্য প্রান্ত দিয়ে আখের টুকরোর মতো মোটা মোটা নুডলস বেরুতে থাকলো। একসঙ্গে প্রায় মানুষের হিসেবে ১০০ মন নুডলস তৈরি হলো। এই নুডলসগুলকে আরেকটি মেশিনে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। এই মেশিনকে বলে ড্রায়ার। এটাতে কয়েক সেকন্ডেই ১০০ মন নুডলস শুকিয়ে গেলো। এমন অদ্ভুত নুডলস দেখে মানুষের ভুল হতে পারে- এটাস নুডলস না পানির পাইপ। আসলে নুডলসের আকৃতির ডিজাইন করা হয়েছিল ভূতদের খাদ্যাভ্যাস বিবেচনা করে, যদিও ভূতরা এসব খাবার খায় না। কিন্তু তাদের চিন্তাশক্তিতে তখন পর্যন্ত নুডলসের আকার এর থেকে মিহি করা সম্ভব হয়নি।
এবার রান্নার পালা সব কাজ শাঁকচুন্নি একাই করছে। রান্নাঘরে শাঁকচুন্নি কাউকে সহ্য করতে পারে না। এতে তার মনো-সংযোগে ঘাটতি দেখা দেয়, খাবারের রঙ-গন্ধ-স্বাদে বিরূপতা দেখা দেয়। শাঁকচুন্নির রান্নাঘরে বিশাল বিশাল পাত্র, তারচেয়ে বিশাল ওভেন, ওয়াসার মেইন লাইনের মতো বিশাল মোটা পাইপে অনেক বড় টেপ লাগানো। মিনিটেই কয়েক লাখ লিটার পানি বের হয় সেই পাইপ দিয়ে। বড় বড় ড্রামে মসলা রাখা রয়ছে। মুহূর্তে এসবের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
একশ মন নুডলস থেকে এক মন নুডলস আলাদা করে একটি বিশাল পাত্রে সেদ্ধ করা হলো। তারপর তাতে নানা রকম মসল্লা দিয়ে ওভেনে ঢুকিয়ে দিল। ওভেন থেকে তিনবার বের করে নুডলসগুলো উলটে পালটে দিল, যেন সব উপাদান ভালোভাবে মেশে। টমেটো সস, অয়েস্টার সস, সয়া সস আর কত কি মেশাল! বোল্ডারের মতো বড় স্ফটিকাকার টুকরো দিল এগুলো নাকি লবণ।
১০০ ভৌতিক সেকন্ডে নুডলস রান্না হয়ে গেল। তারপর একটি বিশাল গ্যাসীয় প্লেটে ডমরু ধরকে নুডলস পরিবেশন করা হলো। আহা সে কি মমতা মেশানো সেই নুডলস রান্না! ডমরুধরের আবেগে চোখে পানি এসে গেল। এমন ভৌতিক নুডলস সে কখনো খায়নি। এমন ভৌতিক গন্ধ পোলাও- কোর্মা তার কাছে কিছুই না। ডমরু ধর আখের আটির মতো নুডলসের আটি চিবুতে থাকলো।
সেই চিবুনোতেই ডমরু ধরের ভূতলোক অবস্থান কাল শেষ হলো এবং ভূলোকে ফিরে আসল। আজও ভূতলোক থেকে আনা এক টুকরো নুডলস ডমরুধরের বাসায় সংরক্ষিত আছে।