ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলছিল। রাস্তায় লোকজন যাওয়া-আসা করছিল। এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে সোনামণিদের পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল।
সবাই ভাবলো- এ আর নতুন কি! কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো বিদ্যুৎ চলে আসবে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। শান্ত পরিবেশে কিছু বাসায় বিকট শব্দে জেনারেটর চলতে লাগলো। কয়েকদিন ধরে বেশ গরম পড়েছে।
জানালার পর্দাগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে বাতাস আসবে বলে। কিন্তু বাতাস যেন কোথায় হারিয়ে গেছে! গাছের পাতাগুলো একেবারেই নড়ছে না, বাতাস আসবে কোত্থেকে!
শাহান বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা বাতাস নেই কেনো? বাবা উত্তর দেন, বাতাস বেড়াতে গেছে। শাহান: কখন আসবে?
বাবা: এইতো চলে আসবে।
ঘরে ঘরে মোমবাতির আলো জ্বলছে। মুদি দোকানগুলোতে মোমবাতি বিক্রি বেড়ে গেছে। ১০ টাকারটা ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাত বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে গরম। শরীর ঘামছে সবার।
আশপাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে শিশুদের কান্না ভেসে আসছে। অনেক শিশুর ঘুম ভেঙে গেছে। বাবা-মা সন্তানদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন। বাতাসের খোঁজে অনেকেই বাড়ির সামনের রাস্তায়, খোলা মাঠে বেরিয়ে এসেছেন।
গভীর রাত। অন্ধকারে রাস্তার ফুটপাতে বসে কিছু লোক কথা বলছে। কারো কারো হাতে হাতপাখা। ভারি দেহের মানুষগুলো ঘামে ভিজে যাচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে কেউ কেউ আবার ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটা বিপদেরই কথা।
বিরামহীন চলতে থাকা জেনারেটরগুলো একে একে বিকল হয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ধীরে ধীরে আলোগুলো আঁধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার আর ভালো লাগছে না কারো। পাশের বাড়ির কোনো বাবা তার ছোটমণিকে অন্ধকার আর ভূতের গল্প শোনাচ্ছিলেন। জানালা খোলা ছিল। বাবার সঙ্গে বিছানায় শুয়ে থাকা শাহান গল্পের কিছু অংশ শুনতে পেল।
শাহান জিজ্ঞেস করলো- বাবা ভূত কি কালো হয়?
বাবা: হ্যাঁ, ওরা অন্ধকারে আসে। আবার আলো দেখলে চলে যায়।
শুনে শাহান বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে- বাবা আলো আসবে কখন?
বাবা: জানি না আব্বু।
হঠাৎ কী যেন পড়ার শব্দ শোনা গেল। শাহান চমকে উঠলো। বাবাকে শক্ত করে জাপটে ধরলো। রান্নাঘর থেকে মা বলে উঠলেন- বিড়ালের জ্বালায় আর বাঁচি না। দুধ খেতে গিয়ে পুরো পাতিলটাই মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। এখনই না ধুয়ে রাখলে পিঁপড়ে আসবে।
মা বাথরুমের কল ছেড়ে দেখেন পানি নেই। ভীষণ রেগে বললেন- মনে হচ্ছে ভূতের বাড়িতে আছি। শাহান আবারো বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
পুরো শহরটাই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। টিভিগুলো চলছে না। মোবাইলফোনে চার্জ না থাকায় রেডিও অন করে কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শাহান যে বিছানায় শুয়ে আছে সেখান থেকে কিছুক্ষণ আগেও কিছু বাড়িতে সামান্য আলো দেখা যাচ্ছিল, সে আলোও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি ওই বাড়িগুলোতে ভূত এসেছে!
ঘরে আর মোমবাতি নেই বলে মা জানালেন। বাইরের দোকানগুলোও তো বন্ধ হয়ে গেছে- বললেন শাহানের বাবা। মা শাহানকে কোলে নিতে নিতে বললেন, তবে আর কী করা, অন্ধকারেই বসে থাকি। শাহান মনে মনে ভাবছে, তাহলে কি এ বাসাতেও ভূত এসে গেল নাকি! ভয়ে সে মায়ের বুকে মুখ লুকালো।
হঠাৎ ঠাণ্ডা হওয়া গায়ে এসে লাগলো। শাহানকে সঙ্গে নিয়ে মা বারান্দায় এসে বসলেন, বাবাও এলেন। আকাশে মেঘ ডাকছে। বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে, সঙ্গে বৃষ্টি। রাস্তায় টিনের চালা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। খোলা দরজা, জানালাগুলো বাতাসের ধাক্কায় একবার বন্ধ হচ্ছে, আবার খুলছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে শাহান মাকে বললো- এটা আবার কোন ধরণের ভূত? শুনে বাবা-মা দুজনই হেসে উঠলেন।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। অনেক সময় চলার পর ঝড়ের গতি কিছুটা কমেছে। রাস্তার পাশে লাগানো কিছু মেহগনি গাছ ভেঙে পড়েছে। গাছগুলো বেশ বড় হয়ে উঠেছিল। উপড়ে পড়া গাছের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার ছিড়ে জড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ যে সহসা আসছে না সেটা অনুমান করা গেল।
আকাশের অবস্থা দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কখন ভোর হবে, পাখি ডাকবে। সবাই ভোরের প্রতীক্ষায় রইলো।