– গেট টুগেদারটা তবে শেষমেশ হলো বল !
অপালা লোপার লিভিং রুমের বড় সাদা বুদ্ধমূর্তিটা দেখতে দেখতে বললো
– আমি তো আগেই বলেছিলাম হবে
গার্গী একটু উত্তেজিত
মৈত্রেয়ী বললো
– আমার অফার টা ভাব এবার আমাকে কিন্তু ফিরতে হবে
লোপামুদ্রা বললো
– আমার কোনো আপত্তি নেই প্ল্যান কর
অপালা একটু চুপ বাকিরা তাকিয়ে ওরই দিকে
– কি রে তুই কিছু বল অপা আমরা যাচ্ছি তো?
গার্গী বলে
– আসলে আমার বেশিদূর যাওয়া হবেনা রে ওই এক রাত ম্যাক্সিমাম ( অপালা)
– কেন? এক রাত কেন? বর বারণ করেছে? ( গার্গী)
সবাই হেসে উঠলো অপা হঠাৎ বলে উঠলো
– না বারণ কেন করবে? আসলে আমি না থাকলে ওর খুব অসুবিধা হয়রে তাছাড়া বুমবুম আছে কিকরে সব ছেড়ে যাই বলতো? ( অপালা)
– বুমবুমকেও নিয়ে চল সবাই বাচ্চা নিয়েই চলুক অসুবিধা কোথায়? ( মৈত্রেয়ী)
অপালা আর কিছু বলেনা একটা বড় ট্রেতে খাবার দাবার সাজিয়ে এসে পড়েছে লোপা কোল্ড ড্রিঙ্কস এর গ্লাসগুলো সবার হাতে তুলে দিতে দিতে বললো
– কি ঠিক হলো তবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
– কিচ্ছু ঠিক হয়নি আমার পছন্দ কিন্তু পাহাড়আমি পাহাড় ছাড়া কোথাও যাবোনা
বাচ্চা মেয়ের মতো বায়না জোরে গার্গী মৈত্রেয়ী বলে
– আমারও পছন্দ পাহাড় তবে আমি সি বিচেও যেতে পারি…
– আমার পছন্দও পাহাড় ( লোপা)
– আমি একটু সময় নিয়ে জানাই তোদের? একদিনের মধ্যে জানাচ্ছি ( অপালা)
প্ল্যানটা আপাতত স্থগিত রইলো অপালা, লোপামুদ্রা, গার্গী আর মৈত্রেয়ী, সেই নার্সারি থেকে ওদের বন্ধুত্ব কত বছরকত যুগ… একসাথে বড় হয়ে ওঠা… তারপর একে একে বিয়ে হয়ে চারমূর্তি ছিটকে গেছিলো চারদিকেমৈত্রেয়ী বিয়ের পর স্বামীর সাথে পাড়ি জমালো নিউ ইয়র্ক… গার্গী টানা কয়েক বছর প্রেম করলো তারপর বিয়ে করে বেঙ্গালুরু চলে গেলো… অপালা আর লোপা কলকাতাতেই… লোপার স্বামীর রিয়েল এস্টেটের বিজনেস তাই লোপার শিকড় আটকে রয়েছে এখানেই… অপালার স্বামীর অফিস রাইটার্স বিল্ডিং… দীর্ঘ পনেরো বছর পর আজ আবার ওরা এক হয়েছে… মৈত্রেয়ীর একটি মেয়ে… মিঠু, বয়স পাঁচ… অপলার ছেলে বুমবুম, বয়স তিন, গার্গীর একটি ছেলে ডোডো, বয়স আড়াই … শুধু লোপার কোলে এখনো কোনো সন্তান আসেনি
#ওদের_কথা
#লোপামুদ্রা
বিশাল ফ্ল্যাটটায় রোজ একাই থাকে লোপা শমীক বেরিয়ে যায় দশটার মধ্যে… তারপর সারাটাদিন কিভাবে যে কাটে, বুঝে পায়না ও… একবার কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়ায়, ভালো লাগেনা, টিভি অন করে, বিছানায় শুয়ে ম্যাগাজিন ওল্টায়, ভালো লাগেনা… কিচ্ছু ভালো লাগেনা ওর আজকাল শরীরটাও ভারী হয়ে যাচ্ছে… আগের মতো তন্বি আজ আর নেই লোপা… শমীক বলে নাকি সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে… লোপা ভাবে… শমীক কেমন করে জানবে একলা ঘরে সারাটাদিন কেমন ভাবে কাটে লোপার রোজনামচা? লোপা জানে… লোপা যেখানেই যাক, যতোদিনের জন্যেই যাক, শমীক না করবেনা… বরং হয়তো কিছুটা খুশিই হবে…
#মৈত্রেয়ী
মৈত্রেয়ী শীতের ছুটিতে দেশে ফিরেছে… পাঁচ বছর পর ফিরলো… মেয়ে হওয়ার পর আর আসা হয়নি… মেয়ের অন্নপ্রাশন টা সবার সাথে উপভোগ করবে ভেবেছিল মৈত্রেয়ী… অনিক আসতে দেয়নি, নিজেও আসেনি… বলেছিলো…
– জানোই তো আমি থাকতে পারিনা মিঠুকে ছাড়া… এখন কাজের এত চাপ… ইন্ডিয়া যেতেই পারবোনা… মিঠু একটু বড় হোক… যাবো…
অনিকের মুখে মুখে কথা বলতে ভালো লাগেনা মৈত্রেয়ীর… তাই কথা বাড়ায়নি আর… তাই দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ফেরা…
#গার্গী
গার্গী শশুর শাশুড়ি, স্বামী সন্তান নিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে… বাকিদের তুলনায় এম্বিশন ওর বরাবরই কম ছিল… যা পেয়েছে, যেটুকু পেয়েছে… তা নিয়েই খুশি থাকতে চায় মেয়েটা… মন প্রাণ ঢেলে সংসার করে… শশুরের চশমা পাল্টানো, শাশুড়ির বাতের ওষুধ আনা, শুভ্রর নিত্যদিন অফিস ট্যুর সামলানো, ডোডোর বায়না… সব একা হাতে সামলায় ও… আগে শুধুই শুভ্র আর গার্গীর সংসার ছিল বেঙ্গালুরুর এই ফ্ল্যাটটা… ডোডো আসার পর শুভ্রর বাবা মাও চলে এলেন এখানে… মৃদু আপত্তি তুলেছিল তখন গার্গী… লাভ যদিও হয়নি কোনোই… দীর্ঘস্বাসটা গিলে নিয়েছিল ও… প্রতিবছর এই সময়টায় বাড়ি ফেরে গার্গী… সারাবছর প্রাণপাত করে সকলের মন জুগিয়ে চলে বলে বোধহয় শুভ্র এই সময়টায় ওকে আর আটকায়না, হয়তো এটা ওর পারিশ্রমিক…
#অপালা
ছেলে বুমবুম আর স্বামী প্রত্যুষ কে নিয়ে সংসার অপালার… খুব সাধারণ জীবনযাত্রা প্রত্যুষের… মানিয়ে নিয়েছে ও… সুখে দুঃখে কেটে যায় দিনগুলো… তবে প্রত্যুষ প্রাণ ঢেলে আগলে রাখে স্ত্রী আর ছেলেকে… তাই দুঃখগুলোও সুখের আকারে ধরা দেয় ওর কাছে… বহুবার অপালা চেয়েছে কিছু একটা কাজ করতে… প্রত্যুষ বলে…
– কি দরকার অপা ? তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?
– অসুবিধা আমার হচ্ছে না তুষ… আরেকটু ভালো থাকার জন্যেই বলছিলাম… তুমি না চাইলে থাক…
কথা থেমে যায়… সংসার চলতে থাকে…
রাতে সব কাজ ফুরোলে বুমবুমকে ঘুম পাড়ায় অপালা… পাশের ঘরে প্রত্যুষ গিটার বাজাচ্ছে… দারুন বাজায় ও গিটারটা… ছেলের গায়ে কম্বলটা ভালো করে টেনে দিয়ে প্রত্যুষের পাশে গিয়ে বসে…গিটার থামিয়ে দেয় প্রত্যুষ… বলে…
– কেমন আড্ডা হলো আজ তোমার? পুরোনো বন্ধুদের কাছে পেলে, তবু মুখটা শুকনো কেন অপা? কি হয়েছে?
প্রত্যুষের গায়ের কাছে ঘেঁষে আসে অপালা… প্রত্যুষের কাঁধে মাথাটা রেখে চুপ করে বসে থাকে… প্রত্যুষ বোঝে কিছু একটা হয়েছে… বলে…
– কি হয়েছে অপা?
– ওরা বলছিলো পাহাড়ে বেড়াতে যাবে… আমি কিছু বলতে পারিনি…
একটু চুপ থাকে প্রত্যুষ… বলে
– কবে যাবে?
– এই মাসেই… মৈত্রেয়ী এসেছে ছুটিতে… ছুটি শেষ হলে ফিরে যাবে… তাই এই মাসেই…
– আর বুমবুম?
– বাচ্চাদের নিয়েই যাবে বলছে ওরা…
– হুম… তোমাকে তো কোথাও নিয়ে যেতে পারিনা আমি… শুধু ওই দুবার দিঘা আর একবার পুরী নিয়ে গেছি এতগুলো বছরে… তুমি যাও অপা… ঘুরে এসো… আমি ব্যবস্থা করছি…
– না তুষ… আমার এভাবে ভালো লাগেনা…
– কেন? বলছিতো আমি…
– তোমাকে ছাড়া কোথাও গিয়ে আনন্দ করতে আমার ভালো লাগেনা তুষ…
নিজের কাছে টেনে নেয় অপালাকে প্রত্যুষ… দেখে চোখদুটো একটু ভিজে ভিজে যেন…
– জানি আমি… কিন্তু এইবারটা আমি তোমাকে যেতে বলবো… শখ আল্হাদ সবই তো ছেড়েছো আমার জন্য… আর কি কি ছাড়বে অপা? যাও ঘুরে এসো..
– যাবো তুষ?
– হুম যাবে…
– চলো রাত হলো অনেক… কাল তোমার অফিস আছে… বুমবুম উঠে কাউকে দেখতে না পেলে কেঁদে বাড়ি মাথায় করবে…
হেসে ওঠে দুজনেই…
লিভিং রুমে ফোন কানে ব্যস্ত শমীক… কোথায় নাকি কন্সট্রাকশনের ফিল্ডে কি ঝামেলা হয়েছে… খুব রেগে রেগে চিৎকার করছে… লোপা ঘরে ঢুকলো… লোপাকে শমীক দেখেও দেখলোনা… ব্যস্ত ফোনে… লোপার এখন অভ্যাস হয়ে গেছে… এসব ওকে ছুঁতে পারেনা… টিভি টা ওন করলো ও… লো ভলিউমে… চ্যানেল সার্ফ করছে… আরো কিচ্ছুক্ষন চিৎকার করে থামলো শমীক… এসে বসে পড়লো সোফায় ঝপাৎ করে…
– কি বলবে?
– বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবো… আজ সবাই মিলে ঠিক করলাম…
– কত টাকা লাগবে?
চোখের কোনায় তাকালো লোপা শমীকের দিকে… শমীকের দৃষ্টি অন্যদিকে… লোপা বলে…
– তোমার কষ্ট হবেনা শমীক আমি কদিন না থাকলে?
– কষ্ট কেন হবে? আমাকেও তো যেতে হয়… তাই না?
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন বহুক্ষণ দমবন্ধ করে রেখেছিলো… এইমাত্র সে যেন মুক্তি পেয়েছে… বললো লোপা…
– হুম… ঠিক… ঠিকই তো…
– কত লাগবে বোলো… ট্রান্সফার করে দেবো…
উঠে পরে লোপা. ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলে…
– শুভ রাত্রি শমীক…
– হুম… গুড নাইট…
রাতে মৈত্রেয়ী মিঠুকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দেখলো অনিক ঘরে ঢুকেই আলমারি খুলে কি বেশ যেন খুঁজছে… জিজ্ঞেস করলো…
– কি খুঁজছো?
– এখানে একটা ব্লু ফাইল ছিল… তুমি রেখেছো কোথাও?
– আমি দেখিনি অনিক… কিসের ফাইল?
– উফ ! বুঝবেনা তুমি… ইম্পরট্যান্ট ফাইল ওটা… কালকের মধ্যে মেইলটা করতে না পারলে আমি ভীষণ… কোথায় গেলো? এইখানে তো ছিল…
– তুমি তো ছুটি নিয়ে এখানে এসেছো অনিক… কিসের এত কাজ তোমার বলোতো ?
– যা বোঝোনা তা নিয়ে কথা বোলো না মৌ…
চুপ করে যায় মৈত্রেয়ী… হঠাৎ বেডসাইড টেবিলের ওপর নীল একটা ফাইল দেখতে পায় ও… হাবিজাবি জিনিসে ঢাকা পড়ে গেছে… ফাইলটা সাবধানে বের করে ও…
– অনিক… এটা খুঁজছো?
হাসি ফুটেছে অনিকের মুখে… হাত থেকে ফাইলটা নিতে নিতে একবার আলগা আলিঙ্গন করলো মৈত্রেয়ীকে… বললো…
– থ্যাংক্স মৌ…
– আমার একটা কথা আছে অনিক… তোমার কি শোনার সময় আছে?
– বলো… ফাইলটার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো অনিক…
– আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাচ্ছি… এই মাসেই…
মুখ তুলেছে অনিক… চোখে প্রশ্ন…
– বেড়াতে যাবে মানে? বেড়াতেই তো এসেছো !
– বেড়াতে এসেছি… আবার এখান থেকে বেড়াতে যাবো…
– শোনো মৌ… তোমার বন্ধুরা সবাই এখানেই থাকে… ওরা করতেই পারে যা ইচ্ছা… তুমি পারোনা… আমাদের হয়তো আগেই ফিরতে হতে পারে… সো… বুঝতেই পারছো…
– টিকিট কেটে ফেলেছো?
– না… দেখি কবে ফিরতে হয়…
– তাহলে একটা কাজ করো… তোমার একার টিকিট কেটে নাও… আমি ঘুরে আসি… তারপর মেয়েকে নিয়ে ফিরে যাবো…
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে অনিক… কি বলবে বুঝতে পারছেনা… তবু বলে…
– মেয়েকে নিয়ে একা তুমি এতটা রাস্তা ফ্লাই করবে? তুমি পারবেনা…
– পারবো… পাঁচ পাঁচটা বছর পর দেশে ফিরলাম এক মাসের জন্যে… এই কটা দিন অন্তততো প্রাণ ভরে বাঁচতে দাও আমাকে অনিক…
অনিক কিছু বলেনা আর… ফাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়…
রাতে ফোন করে গার্গী শুভ্রকে… শুভ্র মনে হয় ড্রিংক করছিলো… যদিও শুভ্র কোনোদিন স্বীকার করেনা যে গার্গীর অনুপস্থিতিতে সে এটা করে…
– বলো
– কি করছো?
– এই তো বসে ছিলাম… তুমি? ডোডো?
– ডোডো ঘুমিয়ে পড়েছে… তুমি আবার ড্রিংক করছো শুভ্র?
– না তো! আমি তো…
– থাক শুভ্র বলতে হবেনা আর… বোকার মতো আমিই বা কেন যে বলি বারবার…
– আজ তোমার কাদের সাথে দেখা করার ছিলোনা? যাওনি?
– গিয়েছিলাম… সেটা জানাতেই ফোন করেছি… আমরা বেড়াতে যাচ্ছি…
– মানে???
– বেড়াতে যাচ্ছি… তার আবার মানে জানতে চাইছো? অদ্ভুত…
– শোনো তুমি কোথায় গেছিলে,কার সাথে গেছিলে আমি জানতে যাইনি… বাট আর কোথাও তুমি যাচ্ছনা… বুঝেছো?
– আমি যাচ্ছি… আমি ওদের কথা দিয়েছি…
– পয়সা লাগবেনা যেতে? আমি তো দেবোনা… কিভাবে যাবে?
অপমানে চোখগুলো ভিজে যাচ্ছে গার্গীর আজ… প্রথম নিজের জন্যে কিছু চেয়েছিলো গার্গী আজ শুভ্রর কাছে… বদলে শুভ্র ফিরিয়ে দিলো অপমান… কান্নাটাকে লুকিয়ে রেখে উত্তর দিলো গার্গী…
– দেখি… কিভাবে যেতে পারি…
– তুমি যাবেনা… এখানে বাবা মা সারাদিন একা… ডোডোকে দেখতে পাচ্ছেনা… আর তুমি বলছো বেড়াতে যাবে ! এসব কি মৌ?
– তাঁরা যদি নাতিকে এতোই ভালোবাসেন তাহলে এটুকু অপেক্ষা তো করাই উচিত ওনাদের… তাই না শুভ্র? ভুল বললাম কি খুব ?
– যা ভালো বোঝো করো… কত পাঠাবো বোলো… তুমি তো কথা শুনবেনা…
– কিছু লাগবেনা… আমি দেখছি…
– অমনি রাগ হয়ে গেলো তো?
– আমার আর রাগ হয়না শুভ্র… গুড নাইট…
সকালবেলায় কনফারেন্স কলে বসে চারমূর্তি ঠিক করে ফেললো ওরা মানালি যাবে… কলকাতা থেকে ফ্লাইটে দিল্লি… সেখান থেকে ট্রেনে মানালি…
নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে গেছে ওরা মানালিতে… পাইন গাছের জঙ্গল, তাকে ছুঁয়ে বহমান বিপাশা, অন্যপাশে উদ্ধত শির হিমালয়… বিপাশার ঠিক গা ঘেঁষে চলে যাওয়া গাড়ি চলার রাস্তা… ওরা চারমূর্তি বসে ছিল নদীর ধারের পাথরগুলোর ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে… জলে পা ছোঁয়ানো যাচ্ছেনা… প্রচন্ড ঠান্ডা… ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের… কাঁপিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যেই… লোপা হঠাৎ বললো…
– বাচ্চাগুলো কি করছে কে জানে? ওনাদের অসুবিধাও তো হতে পারে?
ওর কথায় সমে ফিরলো বাকি তিনজন… হোটেলেই এক বয়স্ক দম্পতি উঠেছেন… বাঙালি… বাচ্চাদের নিয়ে মেয়েরা বেড়াতে এসেছে দেখে ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন পুরোপুরি… সবাই উঠে পড়লো… ফিরছে হোটেলে…
ওঁদের ঘরে গিয়ে দেখলো গুছিয়ে বসে গল্প শুনছে তিনটে বিচ্ছু… ভদ্রমহিলা একদিকে একজন আর অন্যদিকে দুজন কে নিয়ে বসে গল্প শোনাচ্ছেন… ভদ্রলোক একটু দূরে বসে কিছু একটা পেপারব্যাক পড়ছেন…
গার্গী জিজ্ঞেস করলো…
– আমরা এসে পড়েছি মাসিমা… খুব বিচ্ছু ওরা… খুব জ্বালিয়েছে নিশ্চই? আপনি এবার একটু রেস্ট করুন…
– বিচ্ছু কোথায়? এরা হচ্ছে এক একটি গোপাল… তোমরা বরং রেস্ট করো একটু… ওরা থাক আমাদের কাছে আরো কিছুক্ষন….
চারমূর্তি নিজেদের ঘরে চলে গেলো… গুছিয়ে বসেছে চারজন… ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে ফায়ার প্লেসে…
– বল এবার কে কেমন সংসার করছিস? ( গার্গী)
– তুই তো নিশ্চয়ই দারুন সংসার করছিস… তাই তোর ইন্টারেস্ট সবার চেয়ে বেশি… ( মৈত্রেয়ী )
– ঠিক বলেছিস… আমার কথায় পরে আসছি… তোদের কথা বল… শুনি… অপালা তুই শুরু করনা…
– কি বলি বলতো? সত্যিই আমি ভালো আছি রে… হয়তো অনেক বড় ফ্ল্যাট আমার নেই, গাড়িও নেই… দামি গিফট হয়তো দিতে পারেনা তুষ আমাকে… কিন্তু ওর ভালোবাসায় কমতি নেই কোনো… না আমার প্রতি না বুমবুমের প্রতি… ও ভাবে আমার হয়তো কোনো কষ্ট আছে, কোনো না পাওয়া আছে… ও হয়তো বোঝেনা, তোরা তো সেই ছোট্টবেলার বন্ধু আমার… তোরা ঠিক বুঝবি… তুষ আমাকে ওর নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে, বুমবুমকে দিয়েছে, আমার নিজের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট দিয়েছে, ছোট হয়তো… তবু নিজের তো… সেখানে আমি আমার একফালি বারান্দাটায় গাছের টব ঝোলাই, ফুল ফোটাই… কোনোদিন ফুল ফুটতে দেখেছিস তোরা? আমি দেখি, প্রায়ই দেখি… বন্ধ কুঁড়ি থেকে একটা একটা করে যখন পাপড়িগুলো মেলতে শুরু করে, কি অপূর্ব দেখতে লাগে… তবে ধৈর্য রাখতে হয়… আমার সংসারটা আমার বড্ডো প্রিয় রে… ওটাই আমার ভালোথাকার ঘর, আমার ভালোবাসার ঘর… আমার সর্বস্ব…
গলাটা অল্প ধরে গেছে অপালার… চুপ করে যায় ও… হাসে অল্প… বলে,
– আমি তো বললাম… এবার নেক্সট কে?
– আমার ঘরের বুদ্ধমূর্তিটা তোর খুব ভালো লেগেছিলো… নারে অপা ? (লোপা)
লজ্জা পেয়ে যায় অপালা… বলে…
– আমি এমনিই দেখছিলাম… যদিও ওটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর…
– এত কথা বলে ফেললি আমাদের… আর এটা বলতে এতো হেজিটেশন অপা ? এই আমরা তোর বন্ধু?
(লোপা)
– হ্যাঁ সত্যিই সুন্দর… ভালো লেগেছিলো…
– হুম…
গার্গী বলে…
– নেক্সট? লোপা? তুই বল…
কিছুক্ষন সময় নিলো লোপা… তারপর বললো…
– আমার গল্পটা ভালো লাগবেনা তোদের… তবু বলবো… না বললে বলতে হবে আমি তোদের বন্ধুই নোই… আজ তাই বলবো… শমীক একজন আদ্যপ্রান্ত কাজপাগল লোক… কাজপাগল বলবো নাকি টাকা তৈরির মেশিন ঠিক জানিনা আমি… আমি প্রথম থেকেই এমনটাই দেখে আসছি… দিনে দিনে আরো বেড়েছে, আমি অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো কোনো একদিন ও বুঝবে আমাকে! বোঝেনি… একটা বাচ্চাও দিতে পারলোনা দেখ… কতবার বলেছি একবার চলো ডক্টরের কাছে… ওর জেদ… ও যাবেনা… যখন কোনোকিছুতেই কিছু হলোনা, বললাম তাহলে দত্তক নিই… তাতেও রাজি হলোনা… নিজের বাড়ি গিয়ে বাবা মার সাথে কি সব আলোচনা করে এসে আমাকে বলেছিলো… ওসব অজাত কুজাতের রক্ত তাদের বাড়িতে ঢুকলে বংশের মান থাকবেনা… তবু রয়েগেছি… পার্টি করি, শপিং করি, গান শুনতে শুনতে ড্রিংক করি, সব করি… আর ভাবি… আমার বোধহয় সং সাজাটাই সার হলো… সংসার আর হলোনা… ব্যাস এই… এই আমার গল্প…
– তুই একটা আফেয়ার ট্যাফায়ার করতো… সুরসুর করে পথে আসবে বাছাধন… ( গার্গী )
– সবার সব কিছু হয়না গার্গী… মন থেকে যা করতে সায় পাইনা, তা করবো কেমন করে বলতো?
আবার সবাই চুপ… ঘরের পরিবেশটা থমথম করছে… ঘড়ির কাঁটায় রাত ঘুরছে… ওরা বাচ্চাদের নিয়ে এলো এবার… খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে তিনজনকে… একটাই ডর্মেটরিতে সবাই একসাথে… সুবিধে হয়েছে অনেকটাই তাতে… খাবার সামনে নিয়ে বসে রয়েছে চারজন… গার্গী বললো…
– বাকি রইলাম আমি আর মৈত্রেয়ী… তুই বলবি না আমি?
– আমি বলছি… তুই শুরু করেছিলি এই খোঁচাখুঁচির কাজটা… শেষটাও তুইই কর…
গার্গীর মুখে একটা ফিচেল হাসি খেলা করে গেলো…
– সবাই ভাবে বিদেশে আছি, দারুন আরামে আছি কেউ ভাবেনা কতটা বন্দি আমি এইতো দেখ পাঁচ বছর পরে দেশে ফিরলাম… মেয়েটার পাঁচ বছর বয়স হয়ে গেলো এখনো নিজের দেশের কিছুই চিনলোনা, জানলোনা যাদের স্কাইপে কোনোদিন দেখেনি, তাদের দেখলেই নাক কুঁচকোচ্ছে কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি ভাবতে পারবিনাবাড়িতেও অনিক বাংলায় কথা বলতে দেয়না মেয়েকে একটা বাংলা বলেনা ও দেখছিস তো তোরা অনিক এমন করে যেন মিঠু আমার কেউই নয় মিঠু কি করবে, কোথায় যাবে, সব সব ঠিক করবে অনিক আমি আছি কাজের জন্যে রান্না করবো, বাসন ধোবো, কাপড় কাচবো, হাউস ক্লিনিং করবো গ্রোসারি যাবো, কাঁচা মাছ মাংস কিনবো আচ্ছা তোরা বলতো এই লাইফ টা আরো ভালোভাবে তো ইন্ডিয়াতে থেকেই আমি লিড করতে পারতাম তাইনা? তার জন্যে সবাইকে ছেড়ে ভালো থাকার অভিনয় করতে আমাকে বিদেশে কেন থাকতে হয় বলতে পারবি তোরা আমাকে?
নিঃশব্দ কষ্টগুলো আজ ঝরে পড়তে চাইছে ভীষণ ভাবে অপালা হাত রাখলো ওর কাঁধে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মৈত্রেয়ী বলে উঠলো
– আমি বলতে চাইনা এসব কথা কোনোদিন… বলতে গেলেই ভীষণ কষ্ট হয় ইনফ্যাক্ট আমি মনেই করতে চাইনা আজ তোরা সবাই সবটা বলছিস… তাই আমিও বলেই ফেললাম
গার্গী বললো
– বেশ করেছিস বলেছিস বলবি এবার আমি তাই তো?
– হ্যাঁ তুই ( সবাই বলে উঠলো)
– আচ্ছা তোদের আমাকে দেখে ঠিক কি মনে হয় বলতো ! দারুন আছি তাইতো? কিরে বল
– হ্যা, মনে তো হয় (মৈত্রেয়ী)
– এই ট্রিপটায় শুভ্র আমাকে আসতে দিতে চায়নি জানিস বলেছিলো ও টাকা দেবেনা পরে দিতে চেয়েছিলো আমি নেইনি ওর টাকা ডোডো যখন হলো নাতিকে দেখতে যাওয়ার নাম করে বেঙ্গালুরু এলো আমার শশুর শাশুড়ি বিশ্বাস কর আমি ভাবিওনি ওঁরা পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন যখন বুঝলাম, শুভ্রকে বললাম শুভ্র নির্বিকার হয়ে জানালো ওর বাবা মা এখানেই থাকবে কারণ? তাঁরা নাতিকে চোখে হারান ভাবলাম আমার বাবা মাও তো নাতিকে চোখে হারান তাহলে তাঁদের জন্যে জায়গা নেই কেন শুভ্রর সংসারে? তবু বুঝতে দিইনি কোনোদিন সবটা আমি একা হাতে করি রে ওখানে বাই তেমন পাওয়া যায়না ল্যাংগুয়েজ প্রব ও হয় একটু আগে মৈত্রেয়ী যেমন বললো আমিও করি জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ তবু মন পাইনা রে কারো তুমি শুধু করে যাও কখনো যদি ভুলবশত কিছু চেয়ে ফেলো নিজের জন্যে সামলে ফেলো নিজেকে মনকে বোলো”Mind your steps”
এতদিন তাই করতম এবার তোদের পাশে পেয়ে মনটা একটু শক্ত হলো বললাম আমি যাবো তোমার টাকা ছাড়াই যাবো ব্যাস চলে এলাম
কিছুক্ষন সবাই চুপ তারপর লোপা বললো
– তারমানে কি দাঁড়ালো? আমাদের মধ্যে হ্যাপিয়েস্ট তাহলে কে হচ্ছে?
– দি অ্যাওয়ার্ড গোজ টু অ – পা – লা ( গার্গী ও মৈত্রেয়ী একসাথে )
অপালা সামান্য হাসলো বললো
– জানিস ভালো থাকার জন্যে একটা ইচ্ছার দরকার হয় আমাদের সবার মধ্যেই সুপ্ত থেকে যায় এই ইচ্ছাগুলো অনেক সময় জাগাতে পারিনা আমরা এই ইচ্ছাগুলোকে তারপর একদিন হয়তো ভুলেও যাই এদের কথা ভালো থাকার ইচ্ছেরা হয়তো এমনি করেই নিজেদের অজান্তেই হারিয়ে যায় জীবন থেকে আর আমরা ভালো না থাকার অসুখে ভুগতে থাকি
গার্গী বলে…
– ঠিক বলেছিস অপা তবে একতরফা ইচ্ছেগুলো এমনিতেও খুব ভঙ্গুর হয় বোধহয় যখনতখন ভেঙে যাওয়ার ভয় থেকেই যায়
লোপা বলে,
– তবু তো তোদের নিজেদের কেউ আছে মা বলে ডাকার কেউ আছে কারো দুস্টুমি সামলানোর আছে, কারো বায়না মেটানোর আছে, কারোকে আদর মেশানো শাসন করার আছে আমার কি আছে বল? আমার ইচ্ছাগুলো তো সত্যিই মরে গেছে অনেক আগেই
মৈত্রেয়ী বললো
– তবু তুই অন্তত আমার চেয়ে ভালো আছিস লোপা মা হতে পারিসনি সেই কষ্ট যেমন সত্যি একজন মায়ের অধিকার প্রতিমুহূর্তে ছিনিয়ে নেওয়ার কষ্ট কিন্তু ততটাই সত্যি আমি প্রতিনিয়ত ভোগ করে চলেছি সেই কষ্ট সেই যন্ত্রনা জানি এর থেকে মুক্তি নেই আমার তুই চাইলে তবু হয়তো বেরিয়ে আসতে পারিস আমার তো সে পথ ও বন্ধ
ঘুমে চোখ জুড়ে আসছে প্রত্যেকের এবার অনেক রাত এখন রাত যত বাড়ছে, ঠান্ডাও বাড়ছে ততো ওরা ঘুমিয়ে পরলো
পরের চারদিন ওরা শুধুই ঘুরে বেড়ালো একদিন হিড়িম্বা দেবীর মন্দির, ক্লাব হাউস, রিভার রাফটিং করে কাটালো পরদিন গেলো রোটাং পাস রাস্তার দুধারে জমে রয়েছে পুরু বরফের আস্তরণ, রাস্তার মাঝে গাড়ির চাকার ছাপ কেটে বসেছে বরফের চাদরের ওপর গাছের পাতার ওপর জমে রয়েছে নরম বরফ সবুজ আর সাদার সমারোহ মনটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো ওদের চারজনে রোটাং পাসের স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে ওদের চারজনের মনের ভিতর একটা অদ্ভুত টান কাজ করছিলো সব রয়েছে, তবু কি যেন একটা নেই কি নেই?
পরদিন ফেরা তাই হোটেলে ফিরে সব প্যাকিঙ করছিলো ওরা গার্গী ব্যাগ গোছাতে গোছাতে হঠাৎ বিছানায় বসে পড়লো বলে উঠলো
– আমি তোদের একটা কথা লুকিয়েছি আজ
– কি? কি লোকালি? ( লোপা)
– আজ আমি ওকে দারুন মিস করেছি ইনফ্যাক্ট এখনো করছি
– তাহলে তো আমারও উচিত কনফেস করা কারণ আজ রোটাং পাসে অন্যান্য কাপলদের দেখে আমারও মনে পড়ছিলো শমীককে
– আমারও মনে পড়ছিলো অনিকের কথা আজ আমি ভাবলাম বোধহয় আমি একাই এখন তো দেখছি তোরাও
সবাই এবার অপালার দিকে তাকালো অপালা বললো,
– আমি তো এসে থেকে রোজই মিস করছিলাম তুষ কে তোরা এতো রেগে ছিলি বরদের ওপর, সাহস পাইনি বলার
দিল্লি থেকে ট্রেন এ উঠে প্রত্যেকে ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছিলো আজ ফোনগুলো অন করার সাথে সাথে অগুনতি কল এলার্ট ঢুকে পড়ছে শব্দ করে অনিক, শুভ্র, শমীক, প্রত্যুষ নামগুলো আবার জুড়ে যাচ্ছে ওদের চারমূর্তির সাথে চুপি চুপি মান অভিমান মিটছে আজ, আজ হয়তো আবার খুলছে বন্ধ মনের দরজারা হয়তো বা কেউ বলে যাচ্ছে ওদের কানে কানে তোলো ছিন্নবীনা, বাঁধো নতুন তারে..
– সমাপ্ত –