ভূতের এক আড্ডায় গিছলাম সেদিন।
সে দারুণ জমাটি এক আড্ডা।
আড্ডাটি কোথায় জমেছিল জানতে চাও?
বাড্ডায়, মানে বাড্ডার কাছেই জমাট বেঁধেছিল আড্ডাটি।
কেন গিছলাম ওই আড্ডাখানায়, জানতে চাইছ তো এখন? তো বলি, ন্যাড়ার জন্যেই– আমার বন্ধু ন্যাড়ার গতিকেই– আমাকে খানাখন্দকের দুর্গতি উপেক্ষা করে ওই আড্ডাখানায় শামিল হতে হয়েছিল।
বেশ কদিন হল, ন্যাড়ার কণ্ঠে কোনো ভূতের গল্প শোনা হয়ে ওঠেনি; গল্প লেখাও হয়ে ওঠেনি সেই সুবাদে।
ন্যাড়াকে তাই সেদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে বাধ্য হয়েই বলতে হয়েছিল, তুই যেন কেমনটি হয়ে গেছিস রে!
কেন? কেমনটি হয়ে গেছি?– ন্যাড়া ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেছে।
তুই জানি কেমন অ-বন্ধুসুলভ হয়ে যাচ্ছিস দিনকে দিন– দিব্যি টের পাচ্ছি আমি।– উত্তর এড়িয়ে মন্তব্য ছুড়ে দিই আমি।
একটু ঝেড়ে কাশি দে না রে বাবা, অতি রহস্য করতে লেগেছিস কেন?– ন্যাড়া কিঞ্চিৎ ক্ষিপ্ত হল যেন।
না, মানে বেশ কদিন ধরে দেখছি, তুই আর আগের মতো নোস।– পরিবর্তিত ন্যাড়াকে আমি ওর চোখের সামনে মেলে ধরতে চাইলাম।
ন্যাড়ার তরফ থেকে একটা জুতসই গাঁটা উড়ে এসে আমার ব্রহ্মতালুতে জুড়ে বসার আগেই বলে ফেলি, আচ্ছা, ভূতের গল্প বলা কি তুই ভুলে বসে আছিস?
ন্যাড়া আমার চোখে চোখ রেখে বলল, কী বলতে চাইছিস, পষ্ট করে বল।
আমি তখন আমার চোখা কথা শুনিয়ে দিই।– কোনো ভূতের গল্প আমাকে শোনাসনি তুই আজ কমাস হল, সে খেয়াল আছে?
ন্যাড়া আমার দিকে খানিক পিট পিট তাকাল। তারপর স্কুলের আমগাছটার দিকে তাকিয়ে খানিক ভাবাভাবি করে গেল।
তারপর বলল, হুম, তা অনেকদিন হয়ে গ্যাছে, না রে?
সে তো বটেই!– আমি সুর মেলাই।– তোর কাছ থেকে কোনো গল্প আদায় করতে পারিনি বলে কমাস ধরে আমারও গল্প লেখা দায়।
হুম!– ন্যাড়া দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে এবারে।– তা, আমি কী করতে পারি বল? নিজে নিজে তো আর গল্প তৈরি করতে পারি না! আমার সোনাকাকু শহরে থাকলে নাহয় কথা ছিল…।
তোর সোনাকাকু?– ভুরুতে সামান্য গিঁট মেরে বলি।
হুম, আমার সোনাকাকু– এককথায় ভূতের গল্পের ভাঁড়ার। ওর কাছ থেকেই তো রাজ্যির ভূতের গল্প শুনে শুনে তোর কাছে রিলে করে বেড়াচ্ছি এ্যাদ্দিন ধরে।
তাই! কই, কখনও তো তোর সোনাকাকুর কথা আমার কাছে বলিসনি!– ন্যাড়ার উপর আমার অভিমান হল খুব। গল্পগুলোর উপর ¯^ত্বটা ন্যাড়া নিজের আমসত্ত¡ ভেবে এতকাল চেটেপুটে খেয়ে আসছে জেনে সোনাকাকুর উপর মায়াও জমে গেল একটু।
বলিনি তো বলিনি! তোর আম খাবার শখ, আম খেয়ে যাবি– গাছ গোনাগুনতির দরকার কী তোর?– আমার অভিমানের বড় একটা তোয়াক্কা না রেখে ন্যাড়া খামোকা আমের প্রসঙ্গ টানে।
প্রতিবাদে কিছু একটা বলতে যাব, তার আগেই ঢংঢং শব্দ করে টিফিন পিরিয়ডটি শেষ হয়ে গেল।
পরদিন বিকেল অব্দি ন্যাড়ার সাথে ওর সোনাকাকু নিয়ে কোনো তর্ক বাঁধাতে পারিনি।
তবে স্কুল ছুটি হতেই এবং ছাত্র-বন্ধুরা একে একে ছত্রাকারে ছড়িয়ে পড়ার মিনিটখানেক আগে ন্যাড়া আমাকে কাছে ডেকে বলল, ছোটলু, একটা কথা তোকে বলা হয়ে ওঠে নি– সোনাকাকু ঢাকায় ফিরেছে।
ফিরেছে! – ডগোমগো গলায় বলি।
হুম, ফিরেছে– আর আজ রাতেই আমাকে তাঁর বাড়িতে গল্প শোনার জন্যে যেতে বলেছে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, বিলকুল। তুইও চলে আয় না কাকুর ওখানে। কাকুর সাথে পরিচয় হবে আর নিজ কানে কাকুর গল্প শুনবি– যাকে বলে স্ট্রেইট ফ্রম দি হর্সেস মাউথ– আমাকেও তখন কষ্ট করে গল্পটা তোকে শোনাতে হয় না!
কথাটা মনে ধরল।
এবং সে রাতেই আমি সোনাকাকুর তরফ থেকে ফার্স্ট হ্যান্ড গল্প শোনার বাহানায় বাড্ডার বাড়িতে হানা দিই।
গলির ভেতরে বাড়িটা যে একটা পড়োবাড়ির শামিল– সে কথা তোমায়-আমায় বলে দিতে হবে না। ডান-বামের বাড়িগুলোর জানালা গলে টিমটিমে আলোর দ্যাখা মিললেও, সোনাকাকুর বাড়িজুড়ে কেমন থমথমে অন্ধকার। সন্ধে হয়েছে খানিক আগে– কিন্তু এরই মধ্যে একতলা বাড়িটির ভুতুড়ে সাজ।
ভাবলাম, ভূতের গল্পের কারিগরের মানানসই বাড়ি একখানা বটে!
ঠিকানাটা অবশ্যি ন্যাড়া স্কুলেই জানিয়ে দিয়েছিল। পথ-নির্দেশনা দিয়েছিল খানিকটা। বলেছিল, বড় রাস্তায় বাসটা চলতে চলতে একটা জায়গায় এসে হোঁচট খেয়ে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলবে যখন– তক্ষুনি বাস থেকে নেমে পড়বি।
হোঁচট খাবে মানে?– আমি হোঁচট খেয়ে জিজ্ঞেস করি।– বাড্ডাতে যেতে হলে হোঁচট খেতে হয় বুঝি?
তা হয় তো! হোঁচট খেতে হয় একটা বিশাল গাড্ডা– মানে প্রকাণ্ড একটা গর্তের কারণে।– বাড্ডা পৌঁছুনোর শর্ত জানায় ন্যাড়া।
ও!– আমি সমঝে নেবার কসরত করি।– বাড্ডা নামটি কি তাহলে ওই গাড্ডার জন্যেই?
আমার নিষ্পাপ সওয়ালে ন্যাড়ার সায় মেলে।– তাই হবে হয়তো। সমাস করলে তো ওরকমটিই দাঁড়ায়–বিশাল গাড্ডা আছে যাহার– কোন সমাস বল তো?
ন্যাড়ার ব্যাকরণিক প্রশ্নের জবাব দিতে– বিশেষ করে স্কুল ছুটির পর– আমার কোনো উৎসাহ হল না। বরং বলি, হুম, তারপর? বাস থেকে নেমে কোথায় যাব?
নেমেই দেখবি বড়রাস্তা ঘেঁষে একটা গলি এলাকার ভেতর এঁকেবেঁকে গ্যাছে। সব গলির মাথায় একটা পান দোকান থাকে– এখানেও পাবি একটা। দোকানিই সোনাকাকুর বাড়িটা দেখিয়ে দেবে তোকে।… আচ্ছা, তাহলে দ্যাখা হবে রাত্তিরে, কেমন?– বলতে না বলতে ন্যাড়া রিকশা-খরচ বাঁচাতে যেয়ে একটা বাসে চড়াও হল।
… সন্ধেবেলা একটা বাড্ডামুখো বাসে চড়ে… না, বসতে আর পারলাম কই, পাদানির উপর দাঁড়িয়ে অনেকটা বাদুড়ঝোলা হয়ে বহু খানাখন্দকের ক্যাঁচর-ম্যাঁচর ঝাঁকুনি খাবার পর একসময় বিশাল একটা গহŸরে বাসের চাকাটি ঝপাস করে পড়ল যখন– আর আমিও বাসের মায়া ত্যাগ করে ধপাস করে গহŸরপাশে আশ্রয় নিলাম– তখন বুঝে নিতে একটুও অসুবিধে হল না– গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।
আমার সাথে বাসের আরও দু-চারজন যাত্রীও– আমার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে যেয়ে কিনা কে জানে– রাস্তায় যাকে বলে ভুলুণ্ঠিত হলেন বলে মান বাঁচে আমার।
রাস্তার উপরেই একটা ওষুধের দোকান।
দোকানের এক কর্মচারী– আমাদের বাস-ছিটকানো দৃশ্য অবলোকন করার জন্যেই বোধকরি– দোকানের সামনে আলস্য-দণ্ডায়মান।
আমরা ধরাশায়ী হতেই কর্মচারীটি কার উদ্দেশে যেন বলল, ওস্তাদ! খদ্দের এসেছে!– বলেই আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আসুন! আসুন! আমাদের ফার্মেসিতে আসুন! সবকিছু মওজুদ এখানে– মলম আছে, ট্যাবলেট আছে, ইনজেকশন আছে– সবকিছু আছে। মাথাপিছু খরচ একশ’ টাকা। আসুন! আসুন!
এমন করে বলল যেন বিয়েবাড়িতে সেকেন্ড ব্যাচে খাবারের অনুরোধ জানাচ্ছে।
লোকটি আমাদের পালা করে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনে। আমার চোট খুব একটা লাগেনি– এক মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান যাত্রীর উপর হুমড়ি খেয়েছিলাম তো, তাই! বাকি তিনজন ককাতে-ককাতে গজরাতে গজরাতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে নালিশ জানাতে জানাতে ওষুধের দোকানের দিকে এগোল।
একজন বললেন, উফ! উফ!… আমাকে উত্তরা নিয়ে যাবার কথা বলে বাসটা বাড্ডায় নামিয়ে দিল কেন?… উফ! উফ!
দ্বিতীয়জন বললেন, উহু রে!… এই নিয়ে আটবার! গুনে গুনে আটবার বাসটা আমাকে এই জায়গাটিতে ফেলে দিয়েছে। ষড়যন্ত্র! ঘোর ষড়যন্ত্র!… উহু রে!
তৃতীয়জন বললেন, উফ মাগো!… মনে হয় এই ওষুধের দোকানের মালিকটাই রাস্তায় এই গর্তটি খুঁড়ে রেখেছে– খদ্দের ধরবে বলে। মামলা ঠুকব, বলে দিচ্ছি এবারে সত্যি-সত্যি মামলা ঠুকে দেব আমি। আমার এ নিয়ে নবার হল।… উফ, মাগো!
আমি ওষুধের দোকানে সটান ঢুকে এক কর্মচারীকে পাকড়াও করি।– আচ্ছা ভাই, এখানে পানদোকানটা কোথায়, বলতে পারেন?
কর্মচারীটি বলল, পানদোকানের খবর পরে হবে নাহয়, আগে তো তোমার জখমে একটু মলম-টলম লাগিয়ে দিই! নাকি ইনজেকশন দেব একটা?
কর্মচারীর মোলায়েম তদবির শুনে বুক শুকায় আমার। মুখ দিয়ে আতঙ্কিত প্রতিবাদ বেরোয়– না না, আমার ওসবে দরকার নেই। আমাকে শুধু একটু বলে দিন– পানদোকানটি কোথায়?
আমার কোনো চোট লাগেনি– বাসটি প্রচণ্ড হোঁচট খাওয়া সত্তে¡ও– শুনে কর্মচারীটি বেজায় চটে গেল। বলল, লাগেনি মানে? ইয়ার্কি নাকি?
না, সত্যি বলছি, লাগেনি একটুও।
এক্ষণে মোটাসোটা ভদ্রলোকটি– যার পিঠে একটু আগেই সওয়ার হয়েছিলাম আমি– ককাতে ককাতে কন, উফ উফ… ছেলেটি ঠিকই বলছে কম্পাউন্ডার সাহেব… উফ উফ… আমার পিঠের উপর আছড়ে পড়েছিল বলে… উফ মাগো… ওর পাওনা জখমগুলো আমার গা-গতরে এখন… উফ উফ… দিন এখন, ওরটা-আমারটা মিলে দু-দুটো টিটেনাস ইনজেকশন ফুটিয়ে দিন এখন আমার হাতে…।
ভদ্রলোকের কাতর-ভাষণে কর্মচারীর চোখেমুখে ¯^স্তির আভাস ফুটে ওঠে। যাক-বাবা-ব্যবসার-কোনো-ক্ষতি-হয়-নি– চোখেমুখে এমনটি ভাব।
মুখে হাসি টেনে কর্মচারীটি বলল আমাকে, এ বয়সেই পান খেতে শুরু করেছ? সিগ্রেটও চলে নাকি এক-আধটা?
আমি ঝটিতি প্রতিবাদ জানাই, না, না, আমি ওসবে নেই। সিগ্রেট ঠোঁটে করে ঘুরে বেড়াব, অতটা গ্রেট আমি নই।
কর্মচারীটিও দেখলাম কম রসিক নয়। বলল, তাহলে যে পানদোকানের হদিস চাইছ? সিক্রেটটা কী?
সিক্রেট আবার কী! ওই পানদোকানেই সোনাকাকুর বাড়ির খোঁজ মিলবে– শুনেছি আমি।
সো-না-আঁ-আঁ-আঁ!!!– কর্মচারী আর্তনাদ শোনায় আমাকে। দোকানের বাকি দুজন কর্মচারীও আহত যাত্রীদের মলম লাগানো আর ট্যাবলেট গছানো সহসা মুলতুবি রেখে আমার দিকে চমকে তাকিয়ে বলে, ওরে বাবা! …আহত যাত্রীরাও ব্যথা-ট্যথা ভুলে ধুয়া তুলল, ওরে বাবা!
আমিও কম অবাক হলাম না। কর্মচারীকে বলি, ও কী! চমকে গেলেন যে?
চমকাব না কেন? আলবত চমকাব!– কর্মচারী কাউন্টার থাবড়ে তার চমকানোর অধিকারটি কায়েম করে।– সোনা তোমার কে হয়?
বললাম তো– সোনাকাকু! সম্পর্কে উনি আমার চাচা।– আমি ন্যাড়ার ভাস্তেপনাটি একরকম ভেস্তে দিয়ে সোনাকাকুর উপর আমার দখলি¯^ত্ব দাখিল করি।
কর্মচারী আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টি হানে।– কী কাজ তোমার, ওই সোনাকাকুর ওখানে?
বিশেষ কিছু নয়, ভূতের গল্প শুনব তার কাছে– এই তো!
ভূতের গল্প? তা বেশ। তার গল্পগুলো তো সব ভূতেরই হবে– নাকি বলেন ভাইয়েরা?
সে তো বটেই! সে তো বটেই! ভূতের গল্প তো বটেই!– দোকানের সবার কণ্ঠে একই সংলাপের ঐকতান শুনে বিস্মিত না হয়ে পারি না।
বিস্ময় ঠেলে বলি, এখন সোনাকাকুর বাড়িটি কোথায়, সেটি জানার জন্যে গলির মাথায় একটা পানদোকান খুঁজছি আমি।
পানদোকানটি এখন আর নেই। ব্যবসা লাটে উঠেছে।– জানান দ্যায় কর্মচারীটি।
লাটে উঠেছে মানে?
রোজ রোজ পান-সিগ্রেট হাতিয়ে নিলে ব্যবসার বারোটা বাজবে না তো কী?
তা গল্প-গুজব করতে গেলে একটা-আধটা পান-সিগারেট না হলে চলে না, এতে তো দোকানদারের ব্যবসার উন্নতিই হবার কথা।
তাই বলে বিনি পয়সায় পান-সিগ্রেট– তার উপর গ্যালনকে গ্যালন চা?– সহকর্মীদের সাথে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে কর্মচারীটি।
এরই মধ্যে আরও একটি বাস রাস্তার সেই গর্তের আবর্তে যাকে বলে নিপতিত; সেই সবাদে দু-চারজন দোদুল্যমান যাত্রী টুপটাপ বাসের আবাসস্থল ত্যাগ করে ধরায় শয্যা পাতেন; ওঁদের ধরাধরি করে ওষুধের দোকানে ঠাঁই করানো হয়েছে।
দোকানভর আহত যাত্রীদের আহাজারি আর আহাজারি।
আনকোরা খদ্দেরের আগমনে গদগদ কর্মচারীটি হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে আমাকে বিদেয় করতে লাগে। বলল, খুব হয়েছে এখন– তুমি এখন যাও তো! আমার এখন ম্যালা কাজ– একদম দম ফেলার সময় নেই– দেখতেই তো পাচ্ছ! তবে হ্যাঁ, ফুটপাথ ধরে শখানেক কদম পেরুলে গলির মাথাটি পাবে। বন্ধ পানদোকানটিকেও পাবে। ওই গলি ধরে গুনে গুনে বাঁয়ের এগারটি বাড়ি পেরিয়ে গেলে পর ওই… ওই… ইয়ের বাড়িটাকে পাবে তুমি… চিনতে তোমার একটুও ভুল হবে না– বাতিগুলো সব নেভানো থাকে তো!
… ‘দোকান বিক্রয় হইবে’– মার্কা নোটিস ঝোলানো পানদোকানটিকে ডাইনে ফেলে গলির ভেতর পা গলিয়ে খানিক বাদেই যে সোনাকাকুর বাড়িটি খুঁজে পেয়েছিলাম, সে তো তোমাদের একটু আগেই জানিয়েছি।
বৈঠকখানার দরজাটা ক্যাঁকর-ক্যাঁকর শব্দ তুলে খুলে যেতে ঘরের ভেতর ঢুকেই দেখি জনা তিনেক লোক একটা টিমটিমে মোমবাতিকে ঘিরে গল্পেতে মশগুল। বোঝা গেল, আড্ডাটা অনেক আগেই শুরু হয়ে গ্যাছে।
আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা চোখ তুলে তাকায়। আধো অন্ধকারে দেখি একজনার ঠোঁটে সিগ্রেট, একজনার ঠোঁটের কাছে চায়ের কাপ আর তৃতীয়জনের মুখের ভেতর যে আস্ত একটা খিলিপান দলাই-মলাই হচ্ছে, সে তার কণ্ঠধ্বনিতে বোঝা গেল।
বলল সে, তু-উ-মি ক্যা-য় রে বাওয়া? (কাচুম-কুচুম শব্দ)।
ঘরের আধো-অন্ধকারটা তখন চোখ-সওয়া হয়ে এসেছে। তিনজনার চেহারা-সুরতের দিকে ফিরে তাকাই। কেমন শুটকোপনা চেহারা। গায়ের রং ধোঁয়াটে। কাউকেও– সোনাকাকু দূরে থাক, নিপাট ভদ্রলোক বলে মনে হল না।
বাধো-বাধো গলায় বলি, আ-আমি স্-সোনাকাকুর কাছে এসেছি। আপনাদের মধ্যে সেনাকাকু কে?
সিগ্রেটফোঁকা লোকটি উল্টো প্রশ্ন করে, তুমি-ই বা কে হে?
আমি? আমি ছোটলু।
ছোটলু? ফোঃ! এটা আবার কোনো নাম হল নাকি?– লোকটি সিগ্রেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকায়।
চায়ের কাপে সুলুপ-সুলুপ চুমুক দিতে দিতে দ্বিতীয়জন বলল, না, হয় না। ছোটলু কোনো নামই হয় না– একদম বিটকেলে– কেমন ছোটলোকি-ছোটলোকি মনে হয়।
পান-খেকো পান চিবুতে চিবুতে ভরাট মুখে কী যে বলল, বোঝা গেল না।
আমার নাম সোনা হালিম।– সিগ্রেটখেকো লোকটি না-চাইতেই ভুরু নাচাতে নাচাতে প্রকাশ্য করে নিজেকে। তারপর একে একে চা-খেকো আর পান-খেকোকে লক্ষ করে বলে, ও হচ্ছে সোনা কালিম আর ও সোনা তালিম। কী সুন্দর সুন্দর নাম আমাদের!
সোনা কালিম বলল, আর, আমরা কেউ তোমার সোনাকাকু নই, বুঝেছ?
সোনা তালিম তাল মেলায়, ইঁয়্যা, তো-মি আ-আ-দের কা-উর ভা-স্তে নও।
এরই মধ্যে দেখি সোনা হালিমের হাতের সিগ্রেটটা ফের লম্বাটে হয়ে নতুন এক শলায় রূপান্তরিত। কখন যে নতুন একখানা সিগ্রেট ধরাল লোকটি, টেরও পেলাম না। যেমনটি টের পাইনি– সোনা কালিমের চায়ের পেয়ালাটা ফের ভরাট হয়ে গেল কখন, আর কোন ফাঁকেই-বা সোনা তালিম মুখে নতুন এক খিলি পুরে ফেলেছে!
আমি মাথা চুলকাতে থাকি।
আমার অসহায় ভাবটি দেখে সোনা কালিম বলল, তুমি সোনা গালিমের ভাস্তে নও তো?
অন্ধকারে আলোর ছটা দেখতে পেলাম আমি। নকল সোনা ছেড়ে আসল সোনার হদিস পেলাম যেন।
বলি, তাই হবে হয়তো!
হবে হয়তো মানে?– খেপে যায় সোনা কালিম। এক চুমুকে চায়ের পেয়ালা সাবাড় করতে না করতেই পেয়ালাটা ফের চায়েতে ভরাভরতি।– নিজের চাচার খবর রাখো না তুমি?
আমার চাচা নন উনি; মোটেও আমার চাচা নন।– আমি চিঁচিঁ করে শোনাই। ন্যাড়ার সোনাকাকুর সাথে আমার পাতানো আত্মীয়তার ইতি টানি আমি– নিমিষেই।– আমার যে বন্ধু– ন্যাড়া, ওই ন্যাড়ারই চাচা উনি। ওই ন্যাড়ার সাথেই সোনাকাকুর যত মিলমিশ।
ন্যাড়া!
হুম, ন্যাড়া। ওরও আসার কথা এখানে।
য়্যাহ্!– মুখ বাঁকায় সোনা কালিম।– ন্যাড়া! কী বিচ্ছিরি নাম রে!
আমার অন্য এক বন্ধুও আছে– পিচ্চি!
ঘরের তিনজন এবারে বিস্বাদ-ভরাট গলায় কোরাস গায়।– য়্যাহ!
ওদের আসল নামও আছে কিন্তু!– নাম সংকীর্তনটাকে স্বাদীর্ঘ করার চেষ্টা চালাই আমি।– যেমন, ন্যাড়ার আসল নাম হচ্ছে…।
ও শুনে আমাদের কাজ নেই।– আমার সাধুবাদ শুনতে সোনা হালিমের প্রচণ্ড অনীহা।– তার চাইতে শুনি, এখানে সোনা গালিমের খোঁজে কেন এলে?
হ্যাঁ, কেন এলে?– সোনা কালিমও জানতে চাইল।
সোনা তালিমও বাদ পড়ার পাত্তর নয়। বলল, য়্যাঁ, ক্যা-ও এ-এ?
গল্প শুনতে। সোনাকাকুর মুখে গল্প শুনতে এসেছি আমি।– অকপটে বলে যাই।
তিনজন হেলেদুলে বসে– তিন-তিনটে বাঁশকাঠি বাতাসে দোল খেল যেন।
গল্প?– সোনা হালিম বলল।– বাহ্, বেশ তো! আমরাও তো বসে আছি ওর গল্প শুনব বলে।
তাই নাকি!– আমার বিস্ময় লাগে। ফাঁকা একটা চেয়ারে বসে পড়ি।
নয়তো কী? ওর গল্প শুনব বলেই তো এতদিন হাপিত্যেশ করে বসে আছি।
তাই নাকি!– আমি আমার বিস্ময়োক্তি দোহরাই।– আপনারাও কি সোনাকাকুর গল্পের ভক্ত?
ভক্ত না ছাই। ভক্ত-টক্ত নই মোটেও, তবে ভুক্তভোগী বলতে পার। আমরা তিনজনাই ভুক্তভোগী তোমার এই সোনাকাকু নাকি যেন বললে, ওর কারণে।
ভুক্তভোগী! গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে সোনাকাকু আপনাদের ভুক্তভোগী বানিয়ে ছেড়েছে বলতে চান?– আমি অবাক হই।
সোনা তালিম বলল, গম-ম্ আম্ শৌন পেয়্যাম কহ!
আমি সপ্রশ্ন তাকাই সোনা হালিমের দিকে।– উনি কী বললেন?
বলল, গল্প আর শুনতে পেলাম কই! লুট করা সোনা হাপিস করে আমাদের তিনজনাকে একা ফেলে ও কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সোনাগুলোরই-বা কী ব্যবস্থা করল– সে গল্প শোনার জন্যেই তো সোনা গালিমের অপেক্ষায় আছি এ্যাদ্দিন ধরে।
বলতে বলতে সোনা হালিমের সিগ্রেটটা ফের লম্বাটে হয়ে গেল, সোনা কালিমের চায়ের পেয়ালা ফের কানায় কানায় পূর্ণ হল আর একখিলি পান মুখের কোনায় গুঁজে দিল সোনা তালিম।
এইসব দেশেশুনে নয়, বরং সোনা হালিমের কথা শুনে আমার মাথার ভেতর কী যেন হয়ে গেল।
মাথার ভেতর কী যেন হয়ে গেলে মানুষ যা বলে বসে, আমিও তাই বলে বসি। বলি– ঘুড়–ৎ!
আমার বেহাল অবস্থা দেখে সোনা কালিম সরাসরি ব্যাখ্যায় চলে যায়। বলল, বেশ ছিলাম গাঁয়ে, আমরা তিনজনায়। ক্ষেতে-খামারে কাজ করতাম। ধান-পাট ফলিয়ে দিব্যি ছিলাম। তারপর একদিন সোনা গালিম– আমাদেরই আরেক বন্ধু– গাঁ ছেড়ে শহরে বসত করেছিল– গাঁয়ে এসে হাজির।
সোনা কালিম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয়ার অবকাশে সোনা তালিম বলে ফ্যালে, এহেই বয়-ও, চ-ও আঁ-আঁর হা-তে হহড়ে চ-ও!
আমি সোনা হালিমের দিকে আসহায় চোখে তাকাই।– কী বললেন উনি?
সোনা কালিম প্রসঙ্গে ফেরে।– হ্যাঁ, ওই কথাটিই সোনা গালিম বলেছিল বটে। আরও বলেছিল– ঘাটে-মাঠে কী সব বেগার খাটছিস– শহরে চলে আয়, আমার সাথে খাবি-থাকবি আর ম্যালা পয়সা কামাবি। তাই না চলে আসা– এই শহরে, এই বাড়িতে। সোনা গালিম আমাদের চা-খাওয়া শেখাল, হাতে সিগ্রেট ধরানো শেখাল, যখন-তখন পান-চিবুনো শেখাল। এই তো, গলির মোড়ে যে পানদোকান, ওখান থেকেই ও এগুলো জোগাড় করে আনত– আর আনত বড় রাস্তার ধারের রেস্টুরেন্ট থেকে রাজ্যির পরোটা-শিক কাবাব। ধার করেই আনত জিনিসগুলো মনে হয়– শহরে নবাবি করতে হলে পয়সার দরকার পড়ে না তো!…
কথা বলতে বলতে সোনা কালিম উদাস হয়ে যায়।
সোনা হালিম তখন কথার রেশ ধরে বলে, বেশ কদিন হল– মানে সোনা গালিমের গল্প শুনব বলে যেদিন থেকে ওর পথ চেয়ে এখানে বসে আছি– সেদিন থেকে কিন্তু আর চা-পান-সিগ্রেট পাচ্ছি না আমরা। হাত-তিনটে আমাদের পাঠিয়ে যাচ্ছি দোকান বরাবর, কিন্তু শূন্য হাতেই ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে আমাদের। কী? দেখতে চাও তো ঠিক বলছি কী না? তাহলে এই দ্যাখো।
এই না বলে, তিন বন্ধু তাদের তিন-তিনটে হাত শরীর থেকে হাতছাড়া করে ফেলল আর দেখতে না দেখতে হাত-তিনটে ঘর থেকে উড়ে বেরিয়ে গেল– ফিরে এল মিনিটখানেক বাদে– ওই শূন্য হাতেই!
আপন হাতটি কাঁধে জোড়া লাগাতে-লাগাতে সোনা তালিম বলল, কয়্যা? ডেহকটো পাওস্য ত?
আমি কিছু শুধানোর আগেই সোনা হালিম বন্ধুর বাক্য শোধরায়।– ও বলছে, কী? দেখতে পেলে তো?
হতচ্ছাড়া কাণ্ড দেখে আমি চোখ ছানাবড়া করে জবাব দিই।– তা পেলাম বটে।
সোনা হালিম সখেদে বলে, তাই কী আর করা! সেদিন থেকেই একই সিগ্রেট বারবার ফুঁকে যাচ্ছি, একই চা পান করে যাচ্ছি, একই পান চিবিয়ে যাচ্ছি আর একই মোমবাতি জ্বালিয়ে যাচ্ছি। ছ্যাঃ!
আমি মোমবাতিটার দিকে তাকিয়ে দেখি আধখানা মোমবাতির ওপরে কখন যেন খোয়ানো আধখানা ফের জুড়ে বসেছে।
সোনা কালিম ওর গল্পের খেই ধরে ফের।– সোনা গালিম আমাদের চুরি-ডাকাতির তালিম দেয়া শেষ করার কদিন পর কাজে লেগে পড়া গেল। সোনাদানাই লুট করতে শিখেছিলাম আমরা– তাই করে যেতে লাগলাম। প্রথম প্রথম বিয়ে বাড়িতে হানা দিয়ে চাকু উঁচিয়ে কনের গলা থেকে গয়নাগাঁটি হাতিয়েছি। তারপর পরপর কয়েকটা গয়নার দোকানের তালা ভেঙে লুট করেছি। পুলিশের খাতায় ততদিনে আমাদের নামের পেছনে ‘সোনা’– নামটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু হলে কী হবে, ওইসব সোনাদানার কণাটুকুর ভাগ পেলাম কী আমরা? পেলাম না তো!
সোনা কালিমের আক্ষেপ সোনা হালিমের গলায়ও শোনা গেল। বলল সে– না, পেলাম না তো!
বলত কেবল, সোনাগুলো দিয়ে ও নাকি কী যেন বানাবে।– বলে যায় সোনা কালিম।– কী বানাবে বলেনি কিছু, তবে একদিন এক বস্তা বিস্কুট বাড়ি বয়ে নিয়ে এসে বলল, ওগুলোই নাকি লুট করা গয়নাগাঁটি!
সোনা তালিম কথার মাঝে ফোড়ন কাটে।– মা-ওয়াঁ-আ-আ-জি আ-ও জায়-আ পেয়ে না! হুঃ!
আমি নিরুপায় ভাব নিয়ে সোনা হালিমের কাছে তরজমা খুঁজি!
সোনা হালিম নিরাশ করল না আমাকে। বলল– ও বলছে– মামদোবাজির আর জায়গা পেলে না! হুঃ!… আমিও তাই বলি।… বিস্কুটগুলো এখনও এই ঘরের কোনায় পড়ে আছে। বিস্কুটের রং ওই সোনার মতন হলে কী হবে– চকচক করলেই যে সোনা হয় না, সে কথা আমরা জানি না? খুব জানি!
সোনা কালিম বলে এবারে– বিস্কুটগুলো চেখেও দেখেছি– একেবারে অখাদ্য। কামড় বসানোই সার– এমন শক্ত! কী হে, তুমিও চেখে দেখবে নাকি– একটু?
আমার হ্যাঁ বা না শোনার অপেক্ষায় না থেকে সোনা কালিম ওর হাতদুটো শরীর থেকে আলাদা করে ঘরের কোনায় রাখা একটা চটের বস্তা তুলে এনে কড়াৎ করে টেবিলের উপর আছড়ে ফ্যালে। আছাড়ের দাপটে বিস্কুটের মতন কয়েকটা সোনার টুকরো টেবিলে গড়াগড়ি খেল।
দেখলে তো কেমন কড়াৎ করে শব্দ হল? অমন বিস্কুট কি খাওয়া যায় বল? তুমিও একটু খেয়ে দ্যাখো না– কেমন লাগে বুঝবে তখন। ওই যে বললাম– কামড় বসানোই সার– ঠিক বলেছি কী না, যাচাই করে দ্যাখো না একবার!
আমার খিদে নেই।– সোনার বিস্কুটে আমার যে ভীষণ অরুচি, তারই সার-সংক্ষেপ শোনাই আমি।
তাহলে বোঝো! বিস্কুটের চেহারা দেখেই খিদে উবে গ্যাছে তোমার। আর সোনা গালিম কিনা বলল আমাদের– এই রকম কয় বস্তা বিস্কুট নাকি জাম্বো ওস্তাদের গুদামে পাওয়া যাবে। ওগুলো হাতাতে পারলেই নাকি আমাদের ছুটি।
কথা বলতে-বলতে সোনা কালিম হাঁপিয়ে উঠেছিল বুঝি, সোনা হালিমকে তাই খেই ধরতে হয়। বলল, এক অমাবস্যায় জাম্বো ওস্তাদের ডেরায় সিঁদ কেটে ঢুকেছি, দুটো বিস্কুটের বস্তা সোনা গালিমের মাথায় চাপিয়েও দিয়েছি, অমনি কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, বোঝা গেল না, অন্ধকারে জাম্বো ওস্তাদের দল গোলাগুলি শুরু করে দিল– আমাদের বুকে-পিঠে তিন-চারটে করে গুলি লাগতেই প্রাণ হাতে করে পালিয়ে বাঁচি। সোনা গালিমও পালিয়েছে– ওই বিস্কুটের বস্তা মাথায় করেই পালিয়েছে। কিন্তু যাবেটা কোথায়– একদিন না একদিন ওকে তো বাড়ি ফিরতে হবেই– তাই বসে আছি ওর অপেক্ষায়। …
নতুন এক খিলি পান মুখে করে সোনা তালিম কী যে বলল, বোঝা গেল না। বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমি তখন ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার ফিকিরে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েছি।
তাই না দেখে সোনা হালিম খনখনিয়ে ওঠে।– ও কী! উঠে দাঁড়ালে যে? তোমার কথাটি বললে না? তোমাকেও কি তোমার সোনাকাকু ঠকিয়েছে?
আমি জবাব না দিয়ে ঠকঠক কাঁপতে-কাঁপতে দরজা খুলে একলাফে রাস্তার উপর। ঘর থেকে বেরুবার কালে ঠিক ঠিক শুনতে পেলাম– সোনা হালিম পেছন থেকে বলছে– দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে যে! ছেলেটা জ্যান্ত নাকি?
অন্ধকারে ছুট লাগানোর প্রস্তুতি নেব, অমনি রাস্তা ফুঁড়েই যেন পা থেকে মাথা অব্দি সাদা আলখাল্লায় ঢাকা এক ছায়ামূর্তির অভ্যূদয় ঘটল।
আমাকে যুগপৎ অভয় দান ও অবাক করে দিয়ে ছায়ামূর্তিটি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে ওঠে, আমাকে নিয়ে খুব গল্প হচ্ছিল বুঝি?
কথাগুলো মুখ নয়, যেন গলা ফুঁড়েই বেরিয়ে এল।
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলি, আপনি… আপনি কি ন্যাড়ার সোনাকাকু?
ছায়ামূর্তি বুঝি দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।– না হে, আমি কারু কাকু-টাকু নই। কোনো ভাই-টাই-ই নেই আমার– তায় আবার ভাস্তে!
আমি মাথা চুলকাই।– তাহলে কি আপনি… সেরেফ সোনা গালিম? কারু কাকু-টাকু খালু-টালু মামা-টামা নন?
না হে, আমার কোনো জ্ঞাতিগোষ্ঠী নেই। আমি একা এবং একমাত্র। কেন, কমাস আগে আমার সম্পর্কে কাগজে যে খবর বেরিয়েছিল– পড়নি সেটা?
আমি স্মৃতি হাতড়াই। কিছু মনে পড়ে। কিছু মনে পড়ে না।
আমি বলি, আপনি আপনার বাড়ি ছেড়ে এখানে দাঁড়িয়ে যে? ভেতরে যাচ্ছেন না কেন ? আপনার বন্ধুরা সব… সব… ইয়ে হয়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে যে!
নিজের বাড়িতে কেমন করে ঢুকি বল?– আপসোস করে ছায়ামূর্তি।– কেমন করেই-বা মুখ দেখাই বন্ধুদের কাছে? আমার আর দ্যাখানোর মতন সে-মুখ আছে কি?
আমি চুপটি মেরে থাকি।
ছায়ামূর্তি বলে চলে, বেশ তো মাঠে মাঠে ধান-পাটের সোনা ফলিয়ে যাচ্ছিল ওরা– আর আমি কিনা ওদের ফুসলিয়ে নিয়ে এলাম শহরে– আমারই স্বার্থে! ভাবলাম– তাগড়া জোয়ান সব– ওদের দিয়ে জাম্বো ওস্তাদের গুদামটা লুট করতে পারলে যে সোনাদানা পাব, তা বিক্রি করে বিদেশ চলে যাব– আর দেশের মুখ দেখব না। এদিকে কদিন এদিক-সেদিক লুটতরাজ চালিয়ে যা সোনাদানা পেয়েছি, সব তো গলিয়ে সোনার পাত করে ওদের হাতে গছিয়ে দিলাম, কিন্তু ওরা ওগুলোকে অখাদ্য বিস্কুট বলে ঠাউর করলে আমার করার কী থাকতে পারে, বল?
আমি সুরাহা করতে এগোই।– এ কথাটা একটু ওদের বুঝিয়ে বললেই তো হয়!
কেমন করে বলি, বল? বললাম তো– বলার মতন সে মুখ আছে নাকি আমার? জাম্বো ওস্তাদের বন্দুকের আট-দশটা গুলি যে আমার বুকে-পিঠে না লেগে মাথায় লেগেছিল– তার কারণে মাথার খুলিটা কোথায় যে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ল! আজতক খুঁজে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করছ না আমার কথা? তাহলে এই দ্যাখ।
এই না বলে ছায়ামূর্তি ওর গা থেকে সফেদ চাদরটা সরিয়ে ফ্যালে। দেখি– ছায়ামূর্তির মাথাটার স্থানে মুণ্ডু-ফুণ্ডু বলে কিস্যু নেই। বিলকুল ফাঁকা। গলার উপরের অংশটুকু সম্পূর্ণ বিলুপ্ত– বলতে গেলে নির্বংশ! আরও দেখি– মুণ্ডহীন, ধোঁয়ার মতন কী যেন একটা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে।
এইসব দেখে আমি তক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাব মনে করে সোনা গালিমের দেহ ভেদ করে গলির ভেতর দিয়ে ছুট লাগাই। দৌড়ুনোর ঝাঁকুনিতে মাথার জটগুলো খোলতাই হতে থাকে। মনে পড়ে তখন, খবরের কাগজে পড়েছিলাম, জাম্বো ওস্তাদের সাথে কী নিয়ে লড়াই করতে করতে একগণ্ডা ডাকাতের নিহত হবার কথা। ন্যাড়াও নিশ্চয়ই খবরটি পড়ে থাকবে। তারপর সোনাকাকুর নাম করে সোনা গালিমের বাড়ি বরাবর আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাড়িটির ভুতুড়েপনার কথা প্রচার হয়ে যেতেই, ওর ধারেকাছে পুলিশসুদ্দু আপামর জনমানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে।
… এখন, ভূতের মুখে শোনা গল্পটা তোমাদের শোনাতে পারলেই বাঁচি; তবে শোনা কথায় তোমরা বিশ্বাস করতে গেলে তো!