সহজ মৃত্যু

সহজ মৃত্যু

দ্বাদশ চন্দ্রমাসের ২৩ তারিখে আমি ছিলাম লাহওয়ান গাঁয়ে। সেখানে আমাকে ফৌজীদের গরীব পরিবারগুলোর নববর্ষ-কালীন সাহায্যদান তত্ত্বাবধান করতে হচ্ছিল। আমি থাকতাম চৌ চাচীর বাড়ীতে। সেই পরিবারে আরো ছিল চাচীর ছেলে, ছেলের বউ আর চৌদ্দ বছরের নাতনী। ছেলেটি এগারো বছর ধরে ফৌজে। আর ইদানীং সে কোরিয়া ফ্রন্টে স্বেচ্ছাসেবক। সেখানকার একজন ব্যাটেলিয়ান কমাণ্ডার।

এর আগে তিনবার চৌ-চাচীর বাড়ীতে ছিলাম। ফলে আমাদের সম্পর্ক ছিল মধুর। বিপ্লবী কর্মীদের সব সময়েই চাচী সাদরে অভ্যর্থনা জানান। তাছাড়া তার ছেলে বউ সুই-লান গাঁয়ের মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী। তাই তাদের পরিবারের চৌহদ্দিতে চান্দ্র নব-বর্ষের সময়টা আরামেই কাটছিল।

আমি উঠোনে পা দিতেই আওয়াজ শুনে চৌ-চাচী জানালা দিয়ে উঁকি মেরে চেঁচিয়ে বললেন—

‘চিন তাহলে তুমি এসেছ? আমি এখখুনি কাউকে দিয়ে খবর দেব ভাবছিলাম। তোমার কথা মত পুরানো গুদামটা ভেঙ্গে কি পেয়েছি জানো? আচ্ছা, ভেতরে এসো দেখাচ্ছি।

ঘরে ঢুকে দেখলাম, বাড়ীর সবাই কাং-এর ওপর গোশ্‌ত বানাচ্ছে। উত্তর চীনে ঘরের মধ্যে ইঁটের তৈরী এক ধরনের বেদীকে কাং বলে। শীতের দিনে এটাকে সব সময় গরম রাখা হয়। আমি ঢুকতেই খুকী চেন ছুটে গিয়ে টেবিল আয়নার পেছন থেকে কি যেন একটা টেনে আনল।
‘দেখুন তো এটা কি।’

অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া, কোন একজনার একটা ফটো। ফটোটা চায়ের দাগের মত হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। এক কোনে বুড়ো আঙ্গুল আয়তনের একটা দাগ। মনে হয় যেন পুড়ে গেছে।
‘ছবিটা কার?’ জানতে চাইলাম।

‘আগে কাং-এর উপরে উঠে গরম হয়ে নাও। সব বলব।’ —চৌ-চাচী বললেন।

কাং-এ উঠে গোশ্‌ত বানাতে সাহায্য করতে লাগলাম। সুই লান চা করে দিতে চাইলে তাকে নিরস্ত করতে বেগ পেতে হল। যা হোক চাচী তার গল্প আরম্ভ করলেন।

সে ১৯৪৭ সালের কথা। যখন কুওমিনটাং ফৌজ এলাকাটাকে দোজখ করে তুলছে। ওই ছবিটা খুকুর বাবার। ডাকে চেন ছবিটা পেয়েছে। তিনমাস না হতেই চারদিককার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। ও করল কি, ছবিটা কয়েকটা বই চাপা দিয়ে কাং এর চুলোয় রেখে দিল। এর মধ্যে একদিন তিনটা কুওমিনটাং সৈন্য ভিতরে এসে শুরু করল অনাসৃষ্টি। চেন দুরু দুরু বুকে ওদের দেখছিল। ওরা যখন চুলোটা হাতড়াবে এই সময় ও চুলোর উপরে ঝুঁকে পড়ল। দেখতে ছোট্ট খাট্ট হলে কি হবে ও হাত পা গুলো চালু। বইগুলো ছিনিয়ে এনে ও দিল ছুট। একটা শুয়োর পিছনে ছুটলো। ও ঠিক উঠোনের শেষে গিয়েছে, ফটক পিছলে বেরোবে এমন সময় লোকটা গুলি করল। বুলেটে বই ফুটো হয়ে গেল। এতে বাচ্চাটার বুদ্ধি গুলিয়ে গেল। ও বুঝতেই পারলনা কি হচ্ছে। কোনমতে ওধারের উঠোনে গিয়ে ছবিটা জঞ্জলো গাঁদায় গুঁজে দিল। মাথা মোটা সৈন্যটা ওকে ধরে পেল কয়েকটা বইমাত্র। তখন গোটা চারেক চড় চাপটা গালিগালাজ ঝেড়ে চলে গেল। বাচ্চাটা পড়ে গিয়ে তা ভয়েই আড়ষ্ট……।

এই পর্যন্ত বলে চৌ-চাচী থামলেন। বাকীটা শেষ করল খুকু—

‘পারে মা বললেন ছবিটা যত্ন করে রেখে দাও। তোমার বাবা এলে দেখান যাবে যে মানুষের কি কষ্টই না গিয়েছে। ছবিটা লুকিয়ে রাখলাম গোলাঘরে—যে ঘরটার কথা আপনি বলছিলেন।’

সুই-লাম ক্ষেতের কাজে অভ্যস্ত হাতে দ্রুত গোশ্‌ত বানাছিল। এবারে সেও হেসে গল্পে শরীক হোল। ‘মুক্ত হবার পরে আমরা গোলাঘরে গিয়ে ছিলাম কিছু দানা আনতে। তখন আমি বলেছিলাম যে ছবিটা আমাদের খোঁজা উচিত। চেন বলল ওটা একটা কাঠের বাক্সে দেয়ালের কোনে পুঁতে রাখা। খুঁড়তে ওর বইয়ে ভরা বাক্সটা পেলাম, কিন্তু ছবিটা নেই। আমি এত বিরক্ত হয়েছিলাম যে, ওকে কাঁদিয়ে না ফেলা পর্যন্ত বকলাম। তারপর যেদিন গোলাটা ভাঙ্গলাম,—ভাবতে পার কি হয়েছিল? ছবিটা দেখলাম দেয়ালের ফাটলে আটকে আছে। চিন তোমার পরামর্শ না হলে ওটা আমরা এখনও পেতাম না।’

দিন পনেরো আগে যখন চৌ-চাচীর ওখানে ছিলাম সেই সময় লক্ষ্য করে ছিলাম যে, তাক ও কাং-এর উপর ময়দা শস্য ইত্যাদির বস্তা স্তুপ করে রাখা হয়েছে। তখন শুনলাম ঘরের এক কোণে যাঁতাঘর ও কাঠগোলার মধ্যে আগে একটা শস্য গোলা ছিল। অনেক আগে পরিস্থিতির যখন অবনতি ঘটে তখন তারা দরজাটা মাটি দিয়ে বন্ধ করে কাদা লেপে দিয়েছিল। মুক্তির পর ছোট দরজাটা ভাঙ্গা হোল বটে কিন্তু, তখন তাকে আর ঘর বলা চলে না, আবইনাগার মাত্র।

এই বছর বাড়ীটা পারস্পরিক সহযোগিতা সংস্থায় যোগ দিয়েছে। তাতে সুই লানের পাঁচ ম্যু (এক একবারের দু’ভাগে এ ভাগ) জমিতে আশাতীত ভুট্টার ফসল হয়েছে। অন্যান্য জমিতেও ফসল বেড়েছে শতকরা দশ থেকে বিশ ভাগ। সমস্ত ফসল রাখবার জন্য ফাঁকা জায়গা মিলছিল না। তাই ওদের বলছিলাম যে, বছর বছর যখন ফসল বাড়তেই থাকবে আর গোলার অভাবটাও বড় হয়ে দেখা দেবে তখন পুরানো গোলাঘরটা ভেঙ্গে বড় করা হোক। আমার উপদেশ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ওরা ছবিটা পেয়ে যায়।

হঠাৎ চৌ-চাচী হেসে বললেন—‘ছবির ঘটনাটা আমাকে আর একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। চেন তখন আটবছরটি। একদিন ও আমাকে বলল, ‘ঠাক্‌মা’ যে সব বাচ্চাদের বাবা অষ্টম বাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারা সবাই বাড়ীতে ছবি পাঠায়, বাবা পাঠায় না কেন? তার কাছে ছবির জন্য চিঠি লেখা উচিত।’ আমি বললাম ‘সোনা তুমি দেখতে ঠিক তোমার বাবার মত হয়েছে। তোমাকে দেখলেই বাবাকে দেখা হয়। ছবি দিয়ে কি করব বল। ‘এখন দ্যাখ চোখের পলকে বাচ্চাটা কতোবড় হয়েছে।’

চেন তার ভাগের প্যাস্ট্রি খেতে খেতে চোখ তুলে হাসল—‘কমরেড চিন, জানেন, মা বলেছিলেন, ছবিটা আমাদের কোরিয়া পাঠিয়ে বাবাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে, মানুষ কত কষ্টে মরেছে। তাতে মার্কিন দস্যুদের সঙ্গে তিনি আরও জোরে লড়বেন।’

সুই লান গৌরবের লজ্জায় একটু লাল হয়ে চেনের দিকে তাকাল ‘এ্যাহ ক্ষুদে শয়তান, তোর সবকিছু ফিরিয়ে বলতে হবে, না?’

‘তুমি নিজে আমাকে বলেছিলে না?’ চেন অদুরে গলায় বেনী দুলিয়ে বলল।
সুই লান ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে বাঁশের ট্রেতে একটা গোশতের টুকরো ছুড়ে দিয়ে বলল—‘ক্ষুদে বিচ্ছু, তুই জানিস শুধু ফিচকামী কথা। কয়েক বছরের স্কুলের পড়া বিদ্যে অবিশ্যি তোর মগজে আছে। তবুও যদুর তোর শেখা উচিত তা থেকে অনেক পিছে আছিস।’

কোনঠাসা হয়ে চেন গরগর করতে লাগল আর কথাবার্তার ধারা অন্য খাতে বইতে শুরু করল। আঁধার হয়ে যাচ্ছে দেখে চাচী উঠে বাঁতি জ্বালিয়ে রাতের খাবার তৈরী করতে পাশের ঘরে গেলেন। চেন শ্লেষের কণ্ঠে বলতে লাগল— ‘মা, তুমি মহিলা সমিতির সদস্যই হও আর যাই হও, আমি পরোয়া করিনা। তুমি কি পেরেছ ঠাক্‌মাকে রান্নাঘরের নৈবেদ্য দেওয়া থেকে বিরত করতে। জান, ঠাক্‌মা আমাদের না বলে তরমুজ মণ্ডা কিনে এনেছে। নিশ্চয়ই এতে রান্নাঘরের দেবতার নৈবেদ্য হবে। কেবল তাকে মুর্ত্তিটা কিনতে দেখিনি। সবখানে খুঁজেও আমি ওটা পাইনি।’

চীনের কোন কোন অঞ্চলে দ্বাদশ চান্দ্র মাসের তেইশ তারিখে রান্নাঘরের দেবতাকে নৈবেদ্য খাওয়ানের প্রথা প্রচলিত ছিল। নৈবেদ্য তৈরী হত চিনি দিয়ে তরমুজের আকারে। উদ্দেশ্য ছিল, দেবতার মুখ চটচটে মিঠাই-এ লেগে যাবে আর স্বর্গে গিয়ে ঘরবাড়ীর বিশৃঙ্খলা সম্বন্ধে কোন নালিশ করতে পারবে না।

‘এখন বাজারে আর রান্নাঘরের দেবতা বিক্ৰী হয় না। খুব কম লোকই আজকাল এসব কেনে।’ সুই লান গুরুত্ব দিয়ে বলল। মনে হল সে যেন কোন ফন্দি আঁটছে।
একটু পরেই বলল—

‘চিন তুমি ওকে বোঝাও। আমাদের কথার অর দাম নেই ওর কাছে। অবাক লাগে। এই যুগেও কুসংস্কার আছে। কয়েক বছর তাকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি।’

এমন সময়ে পর্দা উঠিয়ে চৌ চাচী ভিতরে এসে চেঁচিয়ে বললেন, মা-মেয়েতে কি নিয়ে পরামর্শ হচ্ছিল, সব শুনেছি—বললেন বটে কিন্তু তার মুখে কোন বিরক্তির চিহ্ন ছিল না। কথাটা বলে চাচী কাং-এ উঠে পাইপ বের করে বাতির শিখায় ধরালেন। সুই লান ও তার মেয়ে চওড়া বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারা কোন মতে হাসি চেপে রাখল।
পাইপ টেনে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধা শুরু করলেন—‘তোমাদের বাস অল্প। তোমরা বুড়োদের ব্যাপারের কি জান? বালিকা বয়স যখন কড়াই-খুন্তি নিয়ে রান্নাঘরে দিন কাটত, তখন সব সময় শঙ্কিত চোখে চুলোর ওপর দেবতার দিকে চাইতাম। অবাক লাগে না? কিন্তু সব সময় ভয় লাগত, এই বুঝি বুড়ো দেবতাটা ভেবে বসে যে, আমি খাবার নষ্ট করছি, হেসে উড়িয়ে দিওনা। কথাটা সত্যি, সারা জীবন রান্নার সময় কোন খাবারই নষ্ট করতে সাহস হয়নি। পরে যার সঙ্গে বিয়ে হয় সে গরীব ছিল বটে কিন্তু বোকা ছিল না। বছর বছর আমি রান্নাঘরে দেবতাকে নৈবেদ্য দিয়ে প্রার্থনা করতাম

‘মাননীয় দেব, দ্রুত পৃথিবীতে এস। দুর্ভাগ্য উড়িয়ে নিয়ে সৌভাগ্য আর আনন্দ নিয়ে এস, প্রয়োজনের বাতাস ও বৃষ্টি, ফসলের প্রাচুর্য, পরিপুণ শস্য ভাণ্ডার, মানুষের মধ্যে শান্তি, আর যা লাগে নিয়ে এস।’ চাচী হাসিতে ফেটে পড়লেন। দম ফাটা হাসিতে প্রত্যেকের ছায়াগুলো নাচতে লাগল।
চেী চাচী পাইপ ভরে আবার আরম্ভ করলেন—

‘বছর বছর প্রার্থনা করতাম, ফি বছর নতজানু হয়ে সশব্দে মাথা ঠুকতাম। ব্যাপারটা কেমন তোমরা ভাবতেও পারবে না-এ যেন তোমার ঠিক সামনেই বিবর্ণ মুখ, লম্বা দাড়ি দেবতার আর তোমার হৃদয় কুঁচকে খাচ্ছে দুশ্চিন্তায়। এভাবে আমাদের দু’কুড়ি বছর কাটল একই দারিদ্রে। পরে, জাপানীদের সঙ্গে গোলযোগের সময় অষ্টম বাহিনী সবাইকে কুসংস্কার মুক্ত হতে আহবান জানান। সর্বোপরি চেন খুকুটার বাবা তখন জাপানীদের সাথে লড়তে গিয়েছে, আহ্‌ বলা উচিত না। তারপর হোল ভূ-সংস্কার। সবাই বলাবলি করতে লাগল, জীবনভোর দেবতা পূজা করেও স্বর্গ থেকে একদানা শস্য আসেনি। অথচ এখন চেয়ারম্যান মাও নেতৃত্ব নিয়েছেন, আমাদের জমি হয়েছে, ইত্যাদি। বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে এই, সেই দ্বাদশ মাসটা আসে তখন নিজে নিজে বলি, এবার আর নৈবেদ্য টবেদ্য না। এসবে বিশ্বাস করে কিইবা লাভ। কিন্তু বিশ তারিখের পর থেকেই মনে হতে থাকে কাজটা ভালো হচ্ছে না। দেবতাকে ভোগ না দেওয়াটা পাপ। সুই লান তুমি প্রতিবছর আমাকে যুক্তি দেখাও, আমি শুনি না, যে তাও নয়, ওহ…. মরাটে মুখ, লম্বা দাড়িওয়ালা দেবতার ছবি। একটু ভেবে দ্যাখ, ষাটটা বছর এভাবে কাটাবার পর হঠাৎ কি সব কিছু ঝেড়ে ফেলা সহজ?’

ঠাক্‌মা সব যখন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি তখন এ বছরে ভোগ দিচ্ছ, না দিচ্ছো না? চেন মুখখানা তুলে চটপট্‌ জানতে চাইল। ‘এই বছর, গোল্লায় যাক ভোগ নৈবেদ্য।’ কাং-এর পাশে পাইপ ঠুকতে ঠুকতে চৌ চাচী দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন। ‘বা, বা কি মজা, কি মজা।’ চেন হাততালি দিতে লাগল।

‘এই বানর, অসভ্যতা রাখ।’ সুই-লান শঙ্কিত হচ্ছিল যে বৃদ্ধা ক্ষেপে যেতে পারেন।
চৌ চাচী বললেন, ‘ওকে ফুর্ত্তি করতে দাও, আর করা উচিত আমি একটা বুড়ো হাবড়া। ভাবত, পার্টির তরুণদের নেতৃত্বের পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে মেয়েদের মেয়েরা যদি ক্ষেতের কাজে না যেত, আমার ছেলে বৌ যদি প্রগতিশীল না হতো তা হোলে কি এই হেমন্তে এত ফসল তোলা যেত, তোমার কি মনে হয় ? এবার মরাটে মুখ লম্বা দেড়ে বুড়োটা নিজেই স্বর্গে যেতে পারে আমি আর ওকে পাঠাচ্ছিনা।
‘মা, তুমি সত্যি বলছ?’ আনন্দে উত্তেজনায় বিহ্বল হয়ে সুই লান জানতে চাইল।

‘‘কেন বলবো না?’ চৌ চাচী হাত মুঠি বন্ধ করলেন, ‘আমি তরমুজ খণ্ডটা তোমাদের সবাইকে খাওয়াব।’ তিনি সত্যই তাকের বাসন কোসন হাতরে একটা কাগজের ব্যাগ এনে কাং-এর উপর রাখলেন।

‘নাও খাও। এবার জিভ-পিছল বাচ্চাটা খবরটা স্কুলে নিয়ে যেতে পারবে। বড়রা পারবে বাচ্চার বাপের কাছে লিখতে আর পার্টির সভ্যেরা পারবেন জনগণের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে দিতে।’
সবাই হাসল। সুই লান বলল, ‘শোন মা, কি সুন্দর কথা বলছেন।’
চৌ চাচী হেসে চুলোর আগুনটা উস্কে দিতে গেলেন।

রাতের খাবারের পর সবাই গোশ্‌ত বানাতে লাগল। সারাদিন হাটার ক্লান্তিতে আমি পশ্চিমের কোঠায় গিয়ে একটু পরেই শুয়ে পড়লাম। চৌ-চাচী আমার কাং-এ আগুন জেলে দিতে ভিতরে এলেন কিন্তু কয়েকটা কাঠি ধরিয়ে সেইযে বাইরে গেলেন আর ফিরলেন না।

এখন সারা গাঁয়ের রাতের খাবার হয়ে গেছে। রাস্তার দিকে শোনা যাচ্ছিল বাচ্চাদের চীৎকার, হাসি আর বাজী পোড়ার আওয়াজ হঠাৎ আমার কয়েক বছর আগের একটা দৃশ্য মনে পড়ল। সময়টা ১৯৪৩, জাপানের সাথে যুদ্ধের সবচাইতে দুর্বৎসর। এই অঞ্চলে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল আর আমরা রাতের আড়াল ছাড়া কাজ করতে পারতাম না। দ্বাদশ চন্দ্রমাসের তেইশের রাতেও আমরা একদল নিশাচর, শত্রু অধিকৃত এক গ্রামের পথ দিয়ে সন্তর্পনে যাচ্ছিলাম। প্রায় একশ পা দুরে দুরে ঝোলান লাল লণ্ঠনের সারিতে লেখা ছিল, সম্রাটের পথের সুখের দেশ। পূর্ব এশিয়া সহ উন্নয়ন এলাকা দেখে দেখে চোখ জ্বালা করছে।

রাস্তায় বেরিয়ে এখন একটু দেখব ভাবলাম। দরজার বাইরে পা দিতেই দেখি চৌ-চাচী আধারে উঠোনে দাঁড়িয়ে। হাত জোর করে বিড়বিড় করছিলেন— ‘রান্নাঘরের দেবতা সত্যিই যদি থেকে থাক, তাহলে এখন দুর্গে ফিরে গিয়ে বাসা কর। কারণ তোমার আগমনের আর কোন দরকার নেই। এমনকি দোকানেও তোমার ছবি আর বিক্রি হয় না। লোকে তোমাকে বিশ্বাস করে না। তোমাকে আর মান্য করে না।

এমন সময় পুর্বের কোঠার দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে চেন বানর ছানার মত বাইরে লাফিয়ে এসে হাসিতে ফেটে পড়ল।
‘হো, হো, হে, হো, ঠাক্‌মা তুমি ভয় পেয়েছ, তুমি আমাদের হাসিয়ে মেরে ফেলবে, হো, হো, হো, হো,।
দরজার আড়াল থেকে সুই লানের উচ্চ হাসি শোনা যেতে লাগল।

চৌ-চাচী রাগ করলেন না। হাসলেন ও না। শুধু ধীরে পূর্বের কোঠায় ঢুকলেন। চেন আমার কাছে দৌড়ে এসে অতি বর্ণনা করে পবের কোঠায় ফিরে গেল। দীর্ঘ সময় ধরে মা-মেয়ের থেমে থেমে হাসি শোনা যায়। একটু পরে চৌ-চাচী আস্তে বললেন, ‘হাসি থামা, থামাবি ? চিন শুনলে সবাইকে ঠাট্টা করবে।’

কিন্তু কী খিক্ খিক্ না করে পারছিল না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য তারকা খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কি যেন অকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে মনে হল। রান্নাঘরের দেবতা নয়, ছোট্ট চেনের স্ফটীক স্বচ্ছ রিণরিণে হাসি তারাদের বলতে যাচ্ছে মানুষ কি করে নিজের শক্তিতে ইতিহাসের অজ্ঞাত পরিবর্তন এনেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত