-“লক্ষ্মীইইই!”- চাপা গলায় ডাক আসছে বাইরে থেকে। আস্তে আস্তে চারপাশটা দেখে নিয়ে টুপ করে বেরিয়ে পড়লো লক্ষ্মী। মা এখনো ওঠেনি তাই রক্ষে। ওর যে একটু খেলতে ইচ্ছে করে বিকেল হলে কিছুতেই বোঝে না মা!
লক্ষ্মী একেবারেই লক্ষ্মীমন্ত নয়। বরং লক্ষ্মীছাড়া বললে তবু কিছুটা বলে দেওয়া হয় লক্ষ্মীর নামে। ক্লাস নাইনে পড়ছে, বয়সও তা প্রায় পনেরো ছুঁই ছুঁই, এখনো পেয়ারা গাছে চেপে কাঁচা পেয়ারা চেবানো, ফড়িং ধরে বেড়ানো কী না করে! গল্পটা একটু বাংলা সিরিয়ালের মতো হয়ে যাচ্ছে না? তা হোক না! কিছুদিন সিরিয়াল বন্ধ ছিলো, সেটুকু ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে।
সন্ধেবেলা মুঠোভর্তি ঝিনুক কুড়িয়ে বাড়ি ফিরলো লক্ষ্মী। ওই কাদের বাড়ি বানাচ্ছে বলে বালি এনে রেখেছে, ওই বালি খুঁজলেই এই এত্ত ঝিনুক পাওয়া যায়৷ এই ঝিনুকগুলো অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ ধরে ঘষলে মাঝখানটা ফুটো হয়ে যায়। সেখানটা যা ধার হয় না! গ্রীষ্মকালে আমের খোসা ছাড়ানো খুব ভালো হয় ওই ঝিনুকে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে নিজের অত্যন্ত গোপন জিনিস ভরা বাক্সটায় ঝিনুকগুলো ভরতে যেতেই মায়ের গলা শোনা গেল, “এতক্ষণে ফেরার সময় হলো? ক’টা বাজে খেয়াল আছে? আজান পড়েছে সেই কখন!”
এদিকওদিক উঁকি দিয়ে দেখলো লক্ষ্মী। না! বাবা এখনো ফেরেনি৷ তাহলে ওকেই সামাল দিতে হবে পরিস্থিতি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ও, “মিষ্টিদের বাড়িতে অঙ্ক বুঝে নিচ্ছিলাম! দেরী হয়ে গেল!”
-“ও! অঙ্ক বইয়ে ঝিনুক ভরা থাকে নাকি আজকাল!”
মায়ের প্রশ্নে কী বলবে কী বলবে ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকলো ছেলেটা! গায়ে চেকচেক জামা, কাচ কাচ গায়ের রঙ, মুখে হাসি। বাইরে থেকে ওদের কথা শুনতে পেয়ে বলতে বলতে ঢুকলো, “কী গো কাকিমা? লক্ষ্মী এখনো শান্ত হয়নি?”
কিছুক্ষণ ছেলেটাকে চিনতে পারেনি লক্ষ্মী৷ এবারে চিনতে পারলো। অনেক ছোটবেলায় শিলিগুড়ি চলে গেছিলো বুবুনদা। বাবার বদলির চাকরি বলে বুবুন আর ওর মা শিলিগুড়িতে ওর মাসির বাড়িতেই থাকতো। আজ এতদিন পর! সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছে, বুবুনদা এখনো মনে রেখেছে লক্ষ্মীকে!
কোথা থেকে একরাশ লজ্জা এসে ঢেকে দিল লক্ষ্মীর মুখ। ছোটবেলায় খেলতে খেলতে কতবার ও আর বুবুনদা বর বউ সেজেছে। ইট গুঁড়ো করে সিঁদুর বানিয়ে সিঁদুর পরা, বুবুনদার মায়ের ওড়না নিয়ে শাড়ি পরা, দিন গেছে সেসব!
-“কী রে লক্ষ্মী? কোন ক্লাস এখন তোর?”
-“নাইন!”
মা ততক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বুবুনদাকে নিয়ে। কখন এল, কেমন আছে, যাবে কবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেশ করে মোড়ায় বসে হাতে একটা নাড়ু নিয়ে খেতে খেতে বুবুন বললো, “কত বড় হয়ে গেছিস রে লক্ষ্মী!”
-“তুমিও তো কত বড় হয়ে গেছো!”- এই প্রথম মুখ তুলে বুবুনের সঙ্গে কথা বললো লক্ষ্মী।
-“এখনো গাছে চড়িস?”- হাসতে হাসতে বললো বুবুন।
-“তা আবার চড়ে না! হনুমান তো!”- লক্ষ্মীর আগেই উত্তর দিয়ে দিল মা।
হেসে ফেললো লক্ষ্মী। সেই ছোটবেলাতেই বুবুনদা কার কাছ থেকে যেন শিখে এসে ওকে বলেছিলো, “কাকিমাকে বলবি তোকে যেন হনুমান না বলে। তুই মেয়ে! তুই হনুমতী, হনুমান নোস!”
-“নাড়ু খাবি?”- হাত বাড়ালো বুবুন।
-“না না! তুই খা! আমি ওকে দিচ্ছি!”- ব্যস্ত হয়ে উঠতে গেল মা!
-“আমি খাবো না! তুমি বসো মা!”- বলে দুদিকে মাথা নাড়লো লক্ষ্মী!
-“আরে নে না! এত লজ্জা কীসের!”- বলেই লক্ষ্মীর হাতে একটা নাড়ু প্রায় গুঁজে দিল বুবুন। দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই লক্ষ্মীর হাতটা একটু ছুঁয়ে দিল কি?
আমি কী করে জানবো!
গল্পটা এবার আরো একটু সিরিয়ালের দিকে গড়াচ্ছে তাই না?
বেশ! একটু সময় নেওয়া যাক! সবাই একটু ভাবো, কোন দিকে এগোতে পারে গল্পটা!
আমি একটু গেস করি কেমন? তোমাদের মধ্যে ফর্টি পারসেন্ট বলবে, এ পুরো বেণীমাধব কেস! আর ফর্টি পার্সেন্ট বলবে, পুরো মাখন! এক্কেরে হান্ডেড পাসসেন্ট লাব! আর বাকি কুড়ি পার্সেন্ট বলবে, “অঞ্জনা! তোকে শেষবারের মতো বলছি, যদি কাউকে মেরেছিস, যদি কিছু খারাপ করেছিস ছেলেমেয়েদু’টোর…তোর একদিন কি আমার একদি…”
বাপরে বাপ!
বেশ! আড্ডা হলো। এবার গল্পে এগোনো যাক।
দুপুরবেলা বেশ জোরে হাঁক এল বাইরে থেকে, “লক্ষ্মীইইই?”
বুবুনদার গলা! গায়ের ফ্রকটার দিকে তাকালো লক্ষ্মী। রঙটা চটে গেছে, সাইজেও হাঁটু অব্দি উঠছে৷ তাড়াতাড়ি দেওয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সামনের দিকের চুলগুলো একটু আঁচড়ে নিয়ে লক্ষ্মী বললো, “কে? বুবুনদা? এসো!”
-“আমি যাবোনা! তুই আয় বাইরে! একটা জিনিস দেখাবো তোকে!”
হাঁকডাক শুনে রান্নাঘর থেকে মা-ও বেরিয়ে এসেছে। শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে বীণা বললো, “ডাকছে তো যা! কিন্তু গল্প করতে করতে বিকেল করে দিও না! ভাত খাওয়ার আগেই ফিরে আসবি!”
কোনোরকমে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো লক্ষ্মী। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বুবুনদা। হাতে একটা ডি এস এল আর ক্যামেরা। এর আগে এত বড় ক্যামেরা কখনো হাতে নিয়ে দেখেনি লক্ষ্মী। বাবার কাছে শুনেছে এই ক্যামেরার নাকি অনেক দাম!
-“আজ ছবি তুলে বেড়াবো চল! রোদটাও বেশ ঝলমলে আজ! চল!”
খুশিতে প্রায় নেচে উঠলো লক্ষ্মী। একে তো সারা দুপুর বেড়ানো হবে, তার উপর মা পারমিশন দিয়েছে!
সামনেই পুকুরে একঝাঁক হাঁস চড়ছিলো। ক্যামেরাটা একটু ঠিক করে নিয়ে ক্লিক করে ছবি তুললো বুবুন। বললো, “কোথায় কোথায় ছবি তোলার মতো ভালো জায়গা আছে বল! নিয়ে চল আমাকে।”
চট করে গোটা গ্রামটা একবার ভেবে নিল লক্ষ্মী। ছবি তোলার মতো তো কিছুই নেই ওদের গ্রামে। পাহাড়, নদী, সূর্যোদয়… না! ধুস! ওদের গ্রামটা একটা বাজে গ্রাম।
-“কী রে! বল! কোথায় যাওয়া যায়!”
এবার মনে পড়লো লক্ষ্মীর। গ্রামের বাইরের দিকে গেলে তো হয়! গ্রাম শেষ হয়েই মাঠ শুরু হয়েছে। সারা মাঠ এখন সবুজ সবুজ ধানগাছে ভর্তি! হঠাৎ দেখলে মনে হয় সবুজ কার্পেট পাতা আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে৷ তাছাড়া ওখানে নীলদীঘিতে শালুক ফুটে আছে অনেক। ওসব নিশ্চয় ছবি তোলার জন্য বেশ ভালো জিনিস হবে!
-“তুমি এখন কী করো গো বুবুনদা?”- রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা পুটুস ফুল তুলে মধু খেতে খেতে বললো লক্ষ্মী।
-“আমি? আমি এই যে, ছবি তুলে বেড়াই, আর পড়াশোনা বলতে… ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি!”- অন্যমনস্ক ভাবে কথাগুলো বলতে বলতেই লক্ষ্মীর দু’টো ছবি তুলে নিল বুবুন। ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও মানা করলো না লক্ষ্মী। কেবল চুলটা কানের পাশ থেকে সরিয়ে হাত দিয়ে নাকের নীচের ঘাম মুছলো ও।
-“আরে! তুই তো দারুণ জায়গায় এনেছিস!”- শালুক ফুল দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠলো বুবুন। দৌড়ে গিয়ে দীঘির পাশে ক্যামেরাটা রেখে দীঘির জলে পা ডুবিয়ে বসে বললো বুবুন, “আঃ! কতদিন পর বসলাম এভাবে! সেই ছোটবেলায়, মনে আছে তোর লক্ষ্মী? তুই সাঁতার কাটতিস জলে আর আমি বসে থাকতাম!”
-“তুমি এখনো সাঁতার কাটতে পারো না?”
-“না রে! ভয় লাগে খুব!”
-“ধেড়ে খোকা!”- বলেই হেসে ফেললো লক্ষ্মী৷ ছোটবেলায় বুবুনদাকে কতবার বলেও কিছুতেই পুকুরে নামানো যেত না! কেউ পুকুরে স্নানের কথা বললেই বলতো, “কী দরকার! সাপ থাকবে!”
-“হ্যাঁ রে লক্ষ্মী! তোর মনে পড়তো আমার কথা?”- ক্যামেরাটা নিয়ে ফুলগুলোর দিকে ফোকাস করতে করতে বললো বুবুন।
ওর কথা শুনে পাশে বসে পড়লো লক্ষ্মী। তারপর বললো, “হ্যাঁ! তবে সত্যি বলতে কী, মুখটা মনে ছিলো না ভালো করে! কতদিন আগে চলে গেছো তুমি! আমার বোধহয় ছ’বছর বয়স তখন! সেই যে গেলে আর এলেই না!”
-“এই তো এলাম!”
-“সে তো এতদিনে!”
ক্যামেরা থেকে চোখ নামিয়ে লক্ষ্মীর দিকে তাকালো বুবুন। আস্তে আস্তে বললো, “দূরে থাকলে টান টা ভালো করে বোঝা যায় বুঝলি! রোজ, সবসময় একসঙ্গে থাকলে কাউকে ভালোবাসলে বুঝতেও পারবি না তুই! আসলে কাছে থাকলে সম্পর্কগুলো রোজকার খাওয়া, ঘুমোনোর মতোই খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়! ভেতরের যে ম্যাজিকটা সেটাই কেমন হারিয়ে যায়!”
বুবুনদা কি মনে মনে কারো কথা ভেবে কথাগুলো বলছে? বুবুনের চোখের দিকে তাকিয়ে খুঁজলো লক্ষ্মী। বুঝতে পারলো না কিছু। আস্তে আস্তে বললো, “তুমি তো অনেক পড়াশোনা করেছো? আমাকে অঙ্ক করাবে? অঙ্কে খুব ভয় লাগে আমার।”
-“বেশ! চলে আসিস সন্ধেবেলা! আমারও সময় কাটতে চায় না এখানে!”
হালকা হালকা শীতের হাওয়া আসছে মাঠের দিক থেকে। রোদটা গায়ে লাগছে না আর। মনটা কেমন খারাপ হয়ে আছে লক্ষ্মীর। বুবুনদা কেন ওরকম বললো? দূরে তাকিয়ে কার কথা ভাবছে বুবুনদা? ওর পা গুলো কেমন কাঠির মতো! বুবুনদা কত সুন্দর! কার কথা ভাবছে বুবুনদা?
কার কথা?
আমি জানি না!
“ছি ছি ছি! পাতি গুণে ভুল করছিস! মন কোথায় পড়ে থাকে? কর আবার ভালো করে!”- লক্ষ্মীর মাথায় একটা চাঁটি মেরে ধমকে উঠলো বুবুন৷
মুখটা রাগ রাগ করে গুণটা দেখতে শুরু করলো লক্ষ্মী। কোথায় যে ভুল করে ফেলে ও বুঝতেই পারে না! মাথা নিচু করে বেশ খানিকক্ষণ দেখে ভুলটা বুঝতে পারলো লক্ষ্মী৷ থমথমে মুখে ভুলটা ঠিক করে খাতাটা ঘুরিয়ে দিল বুবুনের দিকে। অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্মীর মুখটা দেখছে বুবুন। এবার আর থাকতে পারলো না ও। হা হা করে হেসে উঠলো বুবুন৷ হাসতে হাসতেই বললো, ” কাকিমা যে বলছিলো তোর নাকি লাজলজ্জা বলে কিছু নেই! এই তো! বেশ লজ্জা আছে, রাগও আছে ভালোই!”
এবার আর রাগটা সামলাতে পারলো না লক্ষ্মী৷ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বললো, “আমি খুব বাজে বলো! কেউ ভালোবাসে না আমাকে! মাও ভালোবাসে না! অঙ্ক পারি না, ফার্স্ট হই না! তুমিও হাসো আমার উপর! শুধু শুধু তোমার সময় নষ্ট করছি!”
লক্ষ্মী যে কেঁদে ফেলতে পারে সেটা ভাবতে পারেনি বুবুন৷ ওর রাগ রাগ মুখ দেখে ওর হাসি পেয়েছে তাই হেসে ফেলেছে। তাতে যে লক্ষ্মীর এত খারাপ লাগবে একটুও ভাবতে পারেনি ও। তাড়াতাড়ি লক্ষ্মীর চোখ থেকে জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললো ও, “তুই তো একদম পাগলি রে! কে বললো তোকে এসব কথা! সবাই ভালোবাসে তোকে! আর একটু আধটু অঙ্কে ভয় না পেলে তোকে আমি অঙ্ক করাতাম নাকি? তাহলে সেই আমার সন্ধেগুলো একলা একলা কাটতো! তুই আসিস বলে আমার কত ভালো কাটে সময়টা! এই তো চলে যাবো আবার! কত মিস করবো তোকে! কাঁদিস না প্লিজ!”
চোখ মুছে বুবুনের দিকে তাকালো লক্ষ্মী। কান্নাভেজা গলাতেই বললো, “চলে যাবে? কবে?”
-“চলে যাবো না তো এখানেই থেকে যাবো নাকি! এই তো! কালিপুজো শেষ হলেই ছুটি শেষ! এখন ক’টাদিন ছুটি বলে আসতে পেরেছি।”
-“আবার কবে আসবে?”
-“আবার? কেজানে! হ্যাঁ রে লক্ষ্মী! তোকে কেউ চিঠি পাঠায়?”
-“চিঠি! কেন?”- অবাক হয়ে বললো লক্ষ্মী।
-“আমাকেও কেউ লেখে না। অনেকদিন আগে একজন আমাকে বলেছিলো চিঠি লিখলে নাকি বন্ধুত্ব অনেক বেড়ে যায়! ভাব তো, যতক্ষণ লিখবি ততক্ষণ তার কথা ভাববি তুই! লিখতে লিখতে কাটবি, পছন্দ হবে না, কাগজ ছিঁড়ে ফেলে আবার লিখবি, নিজেই নিজের লেখা পড়ে হাসবি, বেশ ভালো না ব্যাপারটা? আমি তোকে ফোন করবো না লক্ষ্মী! প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাঠাবো তোকে! হাতে লেখা চিঠি! টাইপ করা নয়! তুই আমাকে চিঠি পাঠাবি লক্ষ্মী?”
কিছুক্ষণ বুবুনের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো লক্ষ্মী। সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বললো, “কেন? তোমার সেই বন্ধু তোমাকে চিঠি পাঠায় না?”
চমকে লক্ষ্মীর দিকে তাকালো বুবুন। অল্প হেসে বললো, “তোকে যতটা ছোট ভাবছিলাম তত ছোট তুই নোস দেখছি। না! ও চলে গেছে অনেকদিন আগে! ও আর চিঠি পাঠায় না!”
-“ফিরবে না আর কখনো? কেন চলে গেল?”
-“ও যেখানে গেছে সেখান থেকে কেউ আর ফিরতে পারে না!”- জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো বুবুন।
হঠাৎ বুবুনদার হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছে হলো লক্ষ্মীর। হঠাৎ নিজেকে অনেক বড় মেয়ে মনে করে বলতে ইচ্ছে হলো, “তুমি ভালো আছো তো বুবুনদা?”
বলা হলো না! চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো লক্ষ্মী। বুবুনই নিরবতা ভাঙলো। আবার আগের মতো গলায় বলে উঠলো, “সেই একটা অঙ্ক নিয়ে সন্ধে সাতটা থেকে বসে আছিস! আমি চলে গেলে অঙ্ক করা তো আবার ডকে উঠবে! এই ক’টাদিন করো অঙ্কটা মন দিয়ে!”
লক্ষ্মী,
অনেকদিন পর চিঠি লিখছি তোকে। অনেকদিন পর। হয়ে ওঠেনি ঝামেলা হওয়ার পর। তারপর তো চাকরি নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরতে হলো। মাঝে মাঝে ভাবতাম তুই বোধহয় ভুলেই গেছিস আমাকে। হয়তো একদিন কখনো হঠাৎ রাস্তায় দেখা হবে, হয়তো তোর সঙ্গে অন্য একজন থাকবে, তুই হঠাৎ চিনতে পেরে বলে উঠবি, “বুবুনদা, ও আমার বর!”
অবশ্য তোর সাথে দেখা হওয়ার কোনো চান্স ছিলো না। তুই যখন কলকাতায় কলেজে পড়ছিস, আমি তখন চাকরি নিয়ে নিউ ইয়র্কে, তারপর শুনলাম তুই কল্যাণীতে ছিলিস কিছুদিন, আমি তখন আবার শিলিগুড়িতে। আপাতত পাকাপাকিভাবে কলকাতার ব্রাঞ্চে জয়েন করেছি, আর এখন তুই গ্রামে।
লাষ্ট চিঠিটা কবে লিখেছিলাম মনে আছে তোর? তখন আমি সদ্য চাকরি পেয়ে ভুবনেশ্বরে জয়েন করেছি। তা প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। তখন প্রায় প্রত্যেকদিন চিঠি লিখতাম তোকে। প্রত্যেকদিন ডায়েরি লেখার মতো নিজের সব কথা লিখে সপ্তাহের শেষে তোকে পোষ্ট করে দিতাম। কী না হাসির সব কথা লিখেছি! তারপর তুই কলেজে ভর্তি হলি কলকাতায়। সত্যি বলবো লক্ষ্মী? প্রথম প্রথম না খুব হিংসে হয়েছিলো আমার। তোর অনেক বন্ধু হবে, অনেক নতুন নতুন ছেলে বন্ধু পাবি তুই! আচ্ছা, তোর ছেলে বন্ধু হলে আমার কী এসে যেত বল তো তখন? তোর মনে হবে কিছুই তো এসে যাওয়ার কথা না! অথচ বেশ খারাপ লাগতো আমার। তারপর একের পর এক চিঠিতে তোর বন্ধুদের কথা জানতে শুরু করলাম। কে তোকে এসপ্ল্যানেড চেনাতে নিয়ে যায়, কবে তোরা দল বেঁধে প্রিন্সেপ ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলি! খুব হিংসে হতো! আমি যে ভাবতাম পৃথিবীর সব জায়গা আমি তোকে হাত ধরে দেখাবো! কেমন একটা প্যাট্রিয়ার্কি মার্কা শোনাচ্ছে না কথাটা! সে তুই যা খুশি ভাবতে পারিস, কিন্তু আমি সত্যি যেখানে যেতাম, তোর কথাই ভাবতাম। তারপর নিউ ইয়র্ক যাওয়া নিয়ে তোর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলো একদিন ফোনে৷ বিশ্বাস কর, আমি সারাজীবন থাকার জন্য যাইনি! এই তো কেমন ফিরে চলে এসেছি! অথচ তুই আমাকে ভুল বুঝে কত কথা শোনালি! তারপর আমিও আর অভিমান করে চিঠি লিখিনি, ফোন করিনি, তুইও আর করলি না!
এখন এই যে ফিরে এসেছি, আর রাগ নেই তো?
তোর সঙ্গে আমার ক’দিন দেখা হয়েছে রে? ওই গ্রামের ক’দিন রোজ দু’বেলা, গ্রাম থেকে আসার পর তোর এইচ এসের সময় আরেকবার গ্রামে গিয়ে আটদিন, আর তোর কলেজে ভর্তির আগে একদিন সবাইকে লুকিয়ে৷ তোর মনে আছে, সেদিন তোর অনেক ছবি তুলেছিলাম? সব ছবি রাখা আছে আমার কাছে। যখন তোকে খুব মিস করি, ছবিগুলো দেখি।
তুই বলেছিলি আমি নাকি ওদেশের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে নেব৷ ধুর! আমার তোকে ছাড়া কাউকে ভালোই লাগে নি কখনো!
শোন না, একটা কথা বলি! বহু কষ্টে তোর খবর জোগাড় করেছি। তুই যে আদৌ আমার উপর রাগ করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিসনি, নাকি সত্যি সত্যিই বর খুঁজে নিয়েছিস তা তো আর জানতাম না! শেষে তোরই বেষ্ট ফ্রেন্ডকে ফেসবুকে খোঁজাখুঁজি করে কত কাঠখড় পুড়িয়ে জানতে হলো।
আমাকে বিয়ে করবি লক্ষ্মী?
মা বলছিলো আমাকে বিয়ের কথা৷ তোর মত না জেনে বলতে পারিনি। সেই তোকে একবার বলেছিলাম না, দূরে থাকলে ভালোবাসাটা বোঝা যায়! হয়তো তোর থেকে দূরে আছি বলেই এতগুলো বছর এত বেশী করে অনুভব করেছি কত বেশী করে ভালোবাসি তোকে৷ তোর অমত থাকলে বা মনে মনে কাউকে পছন্দ থাকলে জানাতে দ্বিধা করিস না৷ আমি খারাপ ভাববো না।
সেই যার কথা তোকে বলেছিলাম, ওর সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমার ফার্স্ট ইয়ারে। ও যেদিন সামান্য একটা কারণে বাবার উপর রাগ করে সুইসাইড করলো, খুব অভিমান হয়েছিলো। কেন! আমি তো বন্ধু ছিলাম! রাগ হয়েছিলো তো আমাকে বলতে পারেনি? তখন ভাবতাম, আর হয়তো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। তুই জীবনে না এলে বোধহয় বুঝতেও পারতাম না সত্যি সত্যি ভালোবাসা কেমন হয়৷ টানা চার বছর প্রত্যেক সপ্তাহে চিঠি দিয়েছি তোকে। কাকিমা বোধহয় আমাদের ব্যাপারটা একটু হলেও বুঝতে পেরেছিলেন না রে? এত চিঠি আসে মেয়ের নামে! আমার বাড়িতেও আপত্তি থাকবে না তুই রাজী থাকলে। প্লিজ আর রাগ করে থাকিস না! যদি রাজী থাকিস, চিঠিটা পেয়ে ফোন করিস কেমন! চিঠি আসার অত সময় আমি অপেক্ষা করতে পারবো না৷
অফিসিয়ালি প্রপোজ তোকে কোনোদিনই করিনি। তুইও বলিসনি আমাকে ভালোবাসিস কিনা! অথচ যখন দিনের পর দিন আর ফোন করলি না, চিঠি এল না, কী কষ্ট হতো! খালি মনে হতো, এই হয়তো ফোনে মেসেজ আসবে, আমি তোমাকে খুব মিস করছি বুবুনদা! আর ঝগড়া কোরো না!
থাকতে না পেরে ফোনে ট্রাই করেছিলাম তোকে। পাইনি। নাম্বার বদলে ফেলেছিলি কোনো কারণে৷ ব্যস! আরো রাগ হয়ে গেল!
এবার তো আমরা সবকিছু ঠিক করতে পারি, তাই না লক্ষ্মী? আবার বলছি,
রাজী থাকলে ফোন করিস! ফোন নাম্বার দিয়ে দিলাম সঙ্গে। আমি অপেক্ষা করছি।
বুবুনদা,
আমাদের গল্পটা সবার কেমন লাগবে? মারামারি নেই, কান্নাকাটি নেই, বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড নেই, শুধু ভালোবাসা আছে। কেমন লাগবে? জানিনা! তবে আমার না, খুব মিষ্টি লাগে। বোধহয় আমাদের নিজেদের গল্প বলেই৷
বিয়ের দিনে কিছু চাইতে হয়। তোমার কাছে একটাই জিনিস চাইবো, রাগ করলে দূরে চলে যেও না প্লিজ! সেবারে যখন ঝগড়া হয়, তার এক সপ্তাহ পরেই তুমি নিউ ইয়র্ক চলে গেলে। আমাকে তোমার ঠিকানা জানালে না পর্যন্ত! ফোন নাম্বার অব্দি দিলে না! আমি কী করে যোগাযোগ করতাম তোমার সঙ্গে? কাকিমাকে চাইতে পারতাম ফোন করে৷ কিন্তু আমিও তো খুব রেগে ছিলাম, তাই না? তাছাড়া তখন আমার সত্যি মনে হতো, হয়তো তুমি ওখানেই কারোর প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে সংসার করবে। আর যাই হোক, তুমি তো কখনো আমাকে মুখে বলোনি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো!
আমাকে কবে থেকে ভালোবাসো? নাকি কোনো দিনক্ষণ নেই, চিঠি লিখতে লিখতে আর মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে বলতেই ভালোবেসে ফেলেছো? আমি কিন্তু সেই ছোট্টবেলা থেকে তোমাকে ভালোবাসি৷ সেই যখন আমরা বর বউ খেলতাম তখন থেকে। তারপর তুমি গ্রামে এলে, আমার তখন সবে ক্লাস নাইন! ওইটুকু বয়সেই ধপাস করে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম৷ নিজেকে তোমার পাশে কী তুচ্ছ মনে হতো! মনে হতো, আমি তোমার যোগ্যই নই, কেমন করে বলবো ভালোবাসার কথা!
এত কথা চিঠিতে না লিখে ফোনে বলতে পারতাম, কালকের পর তো একসঙ্গেই থাকবো, তখন সামনেই বলতে পারতাম। কিন্তু সেই যে তুমি বলেছিলে চিঠি লেখার কথা, চিঠি লেখার মধ্যে যে আবেগটুকু আছে ফোনে বলায় সেটা নেই৷ বিয়ে হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে চিঠি লিখবে আমাকে?
কথা দিচ্ছি আমিও অভিমান কমাবো! ঝগড়া হলেও দূরে যাবো না! আমাদের জীবনে আর একটা এরকম চার বছর আসুক আমি চাই না! কতদিন একা একা বসে বসে ভেবেছি, হয়তো আমাকে ভুলেই গেছো তুমি! হয়তো আর কখনো দেখা হবে না! হয়তো একদিন গ্রামে ফিরে শুনবো, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি ওখানেই কোথাও সেটলড! ভালোবাসা থাকলে বিশ্বাস যেমন আসে, হারানোর ভয়ও তেমনি আসে! আমি যদি কেবল আমি না হয়ে আমার কোনো বন্ধু হতাম তাহলেই হয়তো বুঝতাম তুমি আমাকে ছেড়ে যেতেই পারো না! অথচ আমার ভয় হতো তোমাকে হারানোর। মিথ্যে মিথ্যে ভয় পেয়ে কাঁদতাম একা একা! মিস করতাম খুব! চিঠি লিখে ছিঁড়ে ফেলতাম! ঝগড়া করতাম তোমার সঙ্গে, তবু ফিরতে না তুমি।
তারপর একদিন তোমার চিঠি এল। তোমার মতোই সহজ সরল, বাহুল্যহীন। কত সহজ কথায় লেখা, আমাকে বিয়ে করবি? যেন এ তো হওয়ারই ছিলো, শুধু সম্মতিটুকুর অপেক্ষা৷
উত্তরটা ফোনে দিয়েছিলাম৷ না! আমার যে ধৈর্য ছিলো না তা নয়। কিন্তু অনেকদিন তোমার গলা শুনিনি! অনেকদিন তোমার কথা শুনিনি। কষ্ট হচ্ছিলো।
বাড়িতে আজ অনেক লোকজন। সবাই ডাকাডাকি করছে আমাকে। বিয়ের পর তোমার হাতে দেব চিঠিটা। বাড়ির সব অনুষ্ঠান মিটে গেলে উত্তর দিও৷ আমি অপেক্ষা করবো।
তোমার আমার হয়ে অক্ষরের সবাইকে কাল নেমন্তন্ন করে দিচ্ছি কেমন? এরা সবাই আমাদের ভালো চায়, আমাদের বোঝে।
অক্ষরের বন্ধুরা, কাল আমার আর বুবুনদার বিয়ে। ঠিক সিরিয়ালের মতো দু’টো পাঁচটা বউ হয়নি, তবু ভালো লেগে থাকলে এসে আশীর্বাদ করে যেতে ভুলবেন না। ভালো থাকবেন সবাই৷
পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়।