দশ চক্রে

দশ চক্রে

আমি বললাম, তুমি কে ?
ভুত বলল, আমি ভুত। গলাটা আমার কানে বেশ মেয়েলী শোনাল, বললাম, পেত্নী বলো। ছায়া মূর্তি ঘাড় নাড়ল, ওই একই ব্যাপার।

-তো আবার ফিরে এলে যে ? ভালই তো ছিলে পরলোকে।

কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ। পেত্নী উবে গেছে বলে যেই না ঘরের আনাচে কানাচে তাকাচ্ছি, ওমনি দেখি টেবিলের ওপরে একদম পদ্মাসনে উঠে বসেছে। মনে হল নড়বার পাত্রী সে আদৌ নয়। হাত ভাঁজ করে মাথায় দিয়ে কাত হলাম তার দিকে, কি বলছ তাড়াতাড়ি বল।

পেত্নী বলল, তোমার ভয় লাগছে না ?

– নাঃ আমার খুব ভাল লাগছে ।
– কেন ?
-এই একটা পেত্নী দেখলাম, কত কিছু জানতে পারবো ।
– কি জানতে চাও ?
-‍ তুমি যা জানাতে চাও, আমি অন্ধকারে তার দিকে চাইলাম ।
– ওঃ তুমি আমাদের কথা জানতে চাও না ?
-ওসব জেনে কি হবে, সেতো একদিন না একদিন দেখতেই পাবো ।

পেত্নী খিল্ খিল্ করে হাসল, আমরা জানো তো, অন্য রকম। ভাবলাম বেড়ে ঝামেলায় পড়া গেল তো। ভোর থেকে উঠে ক্লাশনোট মুখস্ত করতে হবে, ঠিক চারদিন বাদে এনাটমি ভাইভা- লোকে বলে আই এ এস পরীক্ষার চেয়েও কঠিন । পেত্নী আর সময় পেলো না। বলে না, মেয়েদের পেটে কথা থাকে না। এর রকম সকম দেখে মনে হচ্ছে গৌড় চন্দ্রিকা করছে– পেছনে মহাভারত আছে। বললাম- “দেখ,ওসব ফালতু কথা না বলে কেটে পড়ো। মাঝ রাতে ঝামেলা কোর না।”

পেত্নী মুখ নিচু করে বসে আছে -একটু দুঃখ পেলো মনে হয়। গলাটা তুলে বললাম, “ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারি, তার মাঝে কিন্তু গল্প শেষ করতে হবে “। পেত্নী লাফিয়ে উঠল, না না গল্প না, সত্যি কথা।

এই উপদ্রবটি শুরু হয়েছে গত পরশু রাত্রি থেকে । কারণটা হল পটলা ডোম। আমাকে “দাদা নিন না”, “দাদা নিন না” করে পটিয়ে পাটিয়ে একটা হাড়ের সেট গচিয়ে গেছে সেদিন । পটলা দামটা কম নেয় বলে শুনেছিলাম আর আমারও উঞ্ছবৃত্তি করে পরীক্ষার বাজারে হাড্ডি জোগাড় করতে ভল্লাগে না, তাই রেখে দিলাম। অর্ধেক দাম এখনও দিই নি। আসলে হাড্ডি না হলে এনাটমি আয়ত্ব করা বেশ কঠিন – হাড়ের গায়ে স্কেচ পেন দিয়ে মাংসপেশী কোথা থেকে বেরোল আর কোথায় থামল সেটা এঁকে দিলে কোন জায়গায় কি আছে তার একটা ধারণা তৈরী হয়, মনেও থাকে বেশ। আমার তো ইচ্ছে ছিল এটাকে রেখেই দেব কাছে। কিন্তু প্রথম দিনেই কঙ্কালের সাথে তার এক্স মালিক এসে বেড়ালের মতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করল। আমার রুমমেট নেই। অনেক কষ্টে, লোকজন ধরে টরে হস্টেলের একদম শেষ প্রান্তে এই ঘরটা বাগিয়েছি। ছোটবেলা থেকে একলা ঘরে থাকাটাই পছন্দ করি, বাড়ীতেও নিজের ঘর আছে । ঘরে আর কেউ থাকলে ঘুম আসতে চায় না। প্রথমে ভাবলাম বিড়ালই হবে। কিন্তু এমন কিছু মাল পত্র ঘরে নেই যে দেখা যাবে না সেটাকে। তারপর ভাবলাম ইঁদুর, তাও দেখতে পেলাম না। হঠাৎ লোডশেটিং হতেই বোঝা গেল সেটি একটি প্রেত – একটা অস্পষ্ট চেহারা, সিগারেটের ধোঁয়ার মত অস্হির। কিন্তু সেদিন ওই একবারই। আলো আসতেই ভোঁ ভাঁ। তবে গভীর ঘুমের ভেতরে বোধহয় নানারকম শব্দ শুনছিলাম, যদিও পাত্তা দিইনি। কালকে ভুত ছিল না, আবার আজকে এসে জুড়ে বসেছে।
বললাম, তুমি কি এ লাইনে নতুন ?

প্রেতিনী ঘাড় নাড়ল, “দেখছ না, কঙ্কালটা বেশি দিনের নয়। ওই জন্যেই তো কথা বলা শিখছি – কালকে বলতে পারি নি, আজ কত চেষ্টা করে বললাম।”

কি যেন বলছিলে তোমার কথাটা, পেত্নীকে কথা ধরিয়ে দি, নাহলে নতুন কথা বলার আনন্দে সাতকাহন শোনাবে।

– হ্যাঁ বলছি বলছি, আসলে হয়েছে কি আগে বল তুমি রাগ করবে নাঃ।

কি রে বাবা, আমি বেজার মুখে পেত্নীকে দেখি, এসব ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে কেন। আমার চুপ থাকাই ভাল। পেত্নী নিজের কথার পিঠে কথা চাপায়, আমরা তো ভুত, তাই সময় আমাদের ধরতে পারে না। আমি বেজায় বিরক্তিতে বললাম, কি যাতা বলছ, ভুত হয়ে ক্ষেপে গেলে নাকি ?

– না গো, সত্যি বলছি – এই ধরো তুমি কি গতকালে যেতে পারো ? আমি পারি, গতকাল আগামী কাল সব কালে আমি ইচ্ছে করলেই যেতে পারি।

পেত্নী আমায় ছাড়বে না, বেশ বুঝতে পারছি। এসব আবোল তাবোল বকে আমার ঘুমটাই বরবাদ করে দেবে। উপুড় হয়ে শুলাম – জোরে হাই তুলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি বিরক্ত। কে শোনে কার কথা। পেত্নীকে তখন গল্পের নেশায় পেয়েছে। শুনলাম পেত্নী বলছে, এই ধরো গত কাল তুমি ঠিক দুপুর বারোটায় কি করছিলে তোমার মনে আছে? আমি একটু চিন্তা করে বললাম, লাইব্রেরীতে ছিলাম বোধহয়। পেত্নী আবার খিল্ খিল্ করে হাসল -“দাঁড়াও বই পড়ছিলে, কি বই বলছি, সি এল আই” আড় চোখে দেখলাম ছায়ামুর্তির মাথাটা একটু ওপরে উঠে গেল, অনেক দূরের জিনিষ দেখতে যেমন করি আমরা, সেই রকম- তারপর “ক্লিনিকাল এনাটমি” কথাটার অক্ষরগুলো পর পর বলে গেল। ঠিক ই বলছে বোধহয় হাজার হলেও পেত্নীতো। কিছু একটা বিশেষত্ব না থাকলে ভুত হয়ে মানুষের লাভ কি। বললাম, বলতো কাল আমি কোন জামা পড়ব ? সাথে সাথে উত্তর ভেসে এল, লাল চেক শার্ট। আমি বললাম অসম্ভব, কালকে আমি ইচ্ছে করেই ওটা বাদ দিয়ে অন্য জামা পরবো, বুঝলে এবার তুমি কত নিরেট। পেত্নী বুঝতে পারল তার ভুল হচ্ছে, প্রায় কেঁদে ফেলল সে, না সত্যি বলছি, আমি পরিস্কার দেখতে পেলাম তো। ভুতেরা বোধহয় ভুল প্রমাণিত হলে ঘাবড়ে যায় । আমি আশ্বাস দি, এখনও তুমি নতুন, ঠিক শিখতে পারো নি -দুদিন যাক শিখে যাবে। পেত্নী একটু দমে গেছে, এবারে যা বলার বলে পালাক, এত ঘুম পাচ্ছে নাহ্, পেত্নীকে বললাম-” বলো কি বলবে তাড়াতাড়ি বল। পাঁচ মিনিট কবে হয়ে গেছে, দশ মিনিট হতে চলল “। একটা ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ শব্দ শুনে বুঝলাম পেত্নী কাঁদছে। একটু মায়া হল, রাত বিরেতে শ্যাওড়া গাছ ছেড়ে পরপুরুষের ঘরে ঠায় বসে আছে -নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে। একটু বাদে কান্না থামল, পেত্নী আবার বলতে লাগল, আমারই তবে ভুল হয়েছে, আমি জানতাম আমার ছেলেটাকে ভুল অসুধ দিচ্ছে, এখন দেখছি আমার ভুল হয়েছে।

– ছেলে আবার কোথায়।

আবার পেত্নীর কান্না শোনা গেল-” তোমাদের হাসপাতালের বাচ্চাদের ঘরে, দশ নম্বর বেডে। গত পরশু থেকে ভর্তি”। পেত্নি এখন ডুকরে কাঁদছে। এরপর আর শুয়ে থাকা যায় না, বিছানায় উঠে বসলাম। বল শুনি কি হয়েছে তার – দেখি যদি কিছু করা যায়।

-তোমরা বলছ ম্যা,ম্যা, ভুত তোতলাতে থাকে,যেন কি একটা পড়তে চেষ্টা করছে। আমি সহজ করে দি, ম্যালেরিয়া? পেত্নী উত্তেজিত হয়ে ওঠে -” হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই কালকে বলেছে। আর তিন দিন পরে দেখছি বলছে -ম্যা ম্যা” আবার তোতলায় পেত্নী। আমি তাকে উপায় বাতলাই, যা দেখতে পাচ্ছ বানান করে করে পড়। পেত্নী বানান করে পড়ে মেনিনজাইটিস। অবস্হা সুবিধের নয়। এদিকে পেত্নীর কান্না থামছে না। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করি, মেনিনজাইটিস সেরে যায়, এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন !

-নাঃ ও আর বাঁচবে না, পেত্নীর কান্না ক্রমাগত বেড়ে চলে , “আমি দেখছি ওকে ঘিরে সবাই কাঁদছে। এইতো, এইতো ওর বাবা বলল, খোকা আর নেই ।” – গলা ধরে আসে পেত্নীর । আমি একবার শেষ চেষ্টা করি–” আরে বাবা, চিকিৎসার একটা নিয়ম আছে তো । লক্ষণ টক্ষণ দেখে চিকিৎসা করতে হয়, মেনিনজাইটিস বললেই কি হয়ে যাবে নাকি “। কিন্তু পেত্নীর কান্না থামেই না, “ও ডাক্তারবাবু একটু দয়া কর । ওরা যখন লিখবে তখন আমার ছেলে আর বাঁচবে না গো ” । রাতের ঘুমটা গেল । অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে জামাটা তুলে গায়ে চড়ালাম । আর লাইট জ্বালতে ভাল লাগছে না । দরজার পেছনে একটা পেরেকে আমার স্টেথোটা থাকে -জুনিয়র ডাক্তারদের এটাই পরিচয়পত্র । তার ঠিক তলায় আর এটা পেরেকে থাকে তালাচাবি – হস্টেলের এটাই নিয়ম । দু মিনিটের মধ্যে করিডরে পৌছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, আর পারা যায় না, পেত্নীটাকে অসহ্য লাগছে।

হাসপাতাল হচ্ছে এমন জায়গা যেখানে দিন রাত হয় না শুধু হ্যাণ্ডওভার হয়। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে বিস্তর কাগজ ওল্টাতে হল, বলতে হল আমার খুবই পরিচিত লোক, মা মরা ছেলে, একটু নজর রাখবেন। মশারী ঢাকা দশ নম্বর বেড, ভেতরে একটা বাচ্চা শুষছে। ফ্যালসিপারাম পসিটিভ । সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া এখনও বলা যায় না, তবে ঘাড়টা একটু শক্ত লাগল, খুব প্রথমে এরকম হতে পারে অবশ্য – চিকিৎসা সব দেওয়া আছে। যেটুকু শিখেছি তাতে তো চিকিৎসার ভুল ধরতে পারলাম না। অন ডিউটি দাদার ঘরে হাসপাতালের বেড পাতা, ওখানেই শুয়ে রাত কাটালাম। শুধু সকালে হস্টেলে ফেরার সময় খেয়াল হল, আরে জামাটা তো লাল চেক। পেত্নী এটা ঠিক মিলিয়ে দিয়েছে।
নাঃ। সে বাচ্চা মরে নি। ভাল হয়ে বাড়ী গেছে। পেত্নী যে কত ভুল সেটা প্রমাণ হয়েছে – তাই বোধহয় লজ্জায় আর এ মুখো হয় নি। কঙ্কালটা পটলাকে ফেরৎ দিয়ে দিয়েছি – কে আর মাঝ রাতে মরা কান্না শুনবে । তবে পেত্নীকে আর দোষ দেব কি , ডাক্তার মানেই তো এখন খলনায়ক, সব চিকিৎসাই নাকি ভুল হচ্ছে– দশ চক্রে ভগবান ভুত হয় আর সামান্য ডাক্তার!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত