বনবাস

বনবাস

বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই পলা মেয়েকে বলল, চল তোদের বাপবেটিকে এই রবিবার বৃন্দাবন দেখিয়ে আনি।

রোজই তো আমাদের বৃন্দাবন দেখাচ্ছো, এই রবিবার আবার নতুন করে কি দেখাবে!” স্বামী তমালের চটজলদি জবাব।

– তোমার সবসময় ইয়ার্কি; এই রবিবার বৃন্দাবন যাব একটা স্টোরি তৈরী করতে। তোমাদেরকেও নিয়ে যাব। সঙ্গে ফটোগ্রাফার গুরমিতও যাবে।

প্রবাসী বাঙালী ঘরের মেয়ে অদ্রিজা বৃন্দাবন দেখানোর মানে না বুঝলেও এই রবিবার কোথাও বেড়াতে যাওয়ার গন্ধে উচ্ছসিত হয়ে উঠল। কম্প্যুটার খুলে বসে গেল কি কি দেখার আছে সেই সন্ধানে।

রবিবার সকালে গুরমিত একটা বড় গাড়ি নিয়ে হাজির। গাড়িতে বসে গুরমিত আর পলার কথাবার্তা শুনে তমাল বুঝল যে পলার মিশন হল বৃন্দাবনে যে সব বিধবারা এসে বাস করে তাদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করা। একদশক টেলিভিশ নে কাটিয়ে বছর দুয়েক হল তমালপত্নী এক বাঙলা কাগজের দিল্লি ব্যুরোয় কাজ করছে। সাধারণত দিল্লির রাজনৈতিক মহলে ঘোরাঘুরি করে খবরের সন্ধানে। এই ধরনের কাজ করতে এই প্রথম দেখছে।

বৃন্দাবনের বিধবা শুনেই তমালের মনে পড়লো নবদ্বীপের করুণামাসীর কথা। বালবিধবা করুণামাসী মাঝেমধ্যেই ওদের গ্রামের বাড়িতে আসত। পরম নিষ্ঠাবান মহিলা একাদশীর দিন কোন কথা বলত না, মানে মৌনব্রত। তমাল বা ওর দাদা অনেক চেষ্টা করত কথা বলানোর, নানা প্রশ্ন করত। তখন করুণামাসী সিমেন্টের মেঝের উপর পেন্সিল দিয়ে জবাব লিখে দিত। হঠাৎ করুণামাসীর তমালদের বাড়ি আসা বন্ধ হয়ে গেল, পরে খবর পাওয়া গেল যে বৃন্দাবনের কোন এক আশ্রমে কৃষ্ণের চরণে ঠাঁই নিয়েছে মাসী।

পথে এক ধাবায় আলু পরোটা আর দহি দিয়ে প্রাতরাশ করে বৃন্দাবন পৌঁছতে সাড়ে দশটা বাজল। প্রথমেই গেল বিন্ধ্যবাসিনী আশ্রমে, প্রায় হাজার দেড়েক বৃদ্ধা আটচালায় বসে ভজন গাইছিলেন। বেশ কয়েকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল বসে থাকার ক্ষমতা নেই। অনেকেরই গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে কিনা সন্দেহ হচ্ছিল।আশ্রমের ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে পরিচয় দিতেই সাদরে ওদেরকে বসতে বললেন। তারপরই পলা বলল, “ আমাদের কাগজে বৃন্দাবনের বৃদ্ধাদের নিয়ে একটা রিপোর্ট লিখতে চাই। তাই আপনার কাছে এলাম কিছু তথ্য জানতে।”
ম্যানেজার বলল, “ হাঁ, হাঁ, যা জানতে চান জিজ্ঞেস করুন। সব উত্তর পাবেন।”

ম্যানেজারের কাছে জানা গেল এই আশ্রমে প্রায় দেড় হাজার জন ভজন করেন, আট ঘন্টা ভজনের পর তাঁদের হাফ কিলো আটা আর চল্লিশ টাকা দেওয়া হয়। এই টাকাটা রাজস্থানের এক অগ্রওয়াল ট্রাস্ট থেকে আসে। এই আশ্রমে থাকার ব্যাবস্থা নেই। ওনারা বাইরে হল ভাড়া করে দলবল মিলে থাকেন, অনেকে রাস্তাতেও বাস করেন। আর এই ভজনকারীরা প্রায় সকলেই বাঙালী।

যখন ওরা ম্যানেজারের সাথে কথা বলছিল তখন তমালরা বাপবেটিতে ভজনের ওখানে দাঁড়িয়ে এক মহিলার সাথে কথা বলছিল। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় অদ্রিজা থমথমে মুখে বলল, মাম্মি, এদের কি কষ্ট জানো? একদিন ভজনে না আসতে পারলে সেদিন না খেয়ে থাকতে হয়।

রাস্তায় বেরোতেই কানে এলো, “ মা, তোমরা বাঙালী?” রাস্তার পাশে তাকিয়ে দেখল এক থুরথুড়ে বুড়ী। পলা কাছে গিয়ে বলল, “হাঁ, মা।আপনি এখানে বসে কেন?”

– আজ আসতে দেরি হয়েছিল, নামগানের দলে জায়গা হয় নাই। তাই ভিখ মাগছি। নইলে খেতে পাব না মা।

একটা একশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে পলা বলল, “আজ আর ভিক্ষা করতে হবে না। চলুন আপনার থাকার জায়গায়। দু’চারটে কথা বলব।

– তোমার ভালো হোক মা, স্বামী কন্যা নিয়ে সুখে থাকো। কিন্তু আমাদের থাকার ঘরে গিয়ে কি করবে মা! তোমাদের ভালো লাগবে না। তার চেয়ে বরং এখানেই কথা বলি।

– না মা চলুন, আপনার ঘরেই যাব।” এই বলে তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা দুজনে গাড়ী নিয়ে সব মন্দির দেখে এস, ঘন্টাদুয়েক পর ইস্কন মন্দিরে চলে এস।

মিনিট দশেক হেঁটে একটা বাড়ির পিছন দিকে এক ঘুপচি হলঘরে পৌঁছল।

– এই যে মা, এই আমাদের বাসস্থান। এই ঘরে ষাটজন থাকি। সবাই মন্দিরে, আশ্রমে বেড়িয়ে গেছে। শুধু কনকপিসি আছে। ওর শরীলটা খারাপ, যেতে পারে নাই। ওর জন্যই তো আমার দেরি হল।

পলা দেখল ঘরের এক কোনে একটা কম্বলের উপর এক বৃদ্ধা শুয়ে। কাছে গিয়ে দেখেও বয়স বুঝলো না।

– কনকপিসির বয়স তো বিরানব্বই, চুরানব্বই হবে। এই বিন্দাবনেই ত্রিশ বছর হল। শরীল খারাপ হলে আমরাই দেখি। ঠিকঠাক থাকলে কোন মন্দিরের সামনে বসে ভিখ মাগে।

এই বয়সেও! পলার মুখ থেকে শুধু এটুকুই বেরোল।

– এ কি দেখছ মা! এ রকম অনেকজনই আছে। ললিতাপিসি তো একশো বছর হয়ে গেছে। এখনো রোজ মন্দিরের সামনে বসে। কি করবে বলো, যাবেই বা কোথায়?

– আচ্ছা, শরীর খারাপ হলে কি হয়, ডাক্তার কোথা থেকে ডাকেন?
– ডাক্তার কি করে ডাকব মা! ধরাধরি করে আমরাই হাসপাতালে নিয়ে যাই। যা ওষুধ দেয় তাই খাই, ওষুধ কেনার টাকা কোথায় আমাদের! মন্দিরে নাম গেয়ে আর ভিক্ষে করে যা পাই তাতে পেটটাই চলে।
– আপনার বাড়ির লোকেরা খোঁজখবর নেয় না?
– না মা, আমার তিনকুলে কেউ নাই, কে খোঁজ নেবে? আর থাকলেই বা কি হত? ওই ললিতাপিসিই তো দশবছর আগে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। ছ’মাসের বেশি টিকতে পারে নাই। ফিরে এসেছিল।
– কেন?
– সে নিয়ে পিসি কারোর কাছে মুখ খোলে নাই। এসে আবার মন্দিরে মন্দিরে ভিক্ষে করছে। বিন্দাবনের আশিটা মন্দির ওর চেনা।

ওখান থেকে বেরিয়ে আরো দু’টো আশ্রমে ঘুরল। লালাবাবুর মন্দিরের সামনে ভিখারী মহিলাদের সাথেও কথা বলল। সব শেষে স্থানীয় এম এল এর কাছে হাজির হল। এম এল এ সাহেব বোঝালেন বৃদ্ধাদের মঙ্গলের জন্য কি কি করেছেন ওনারা। হঠাত পলা বলল, “ কিন্তু স্যর, ওনারা ভজন গেয়ে যা পান তাতে দু’বেলা খাওয়াদাওয়া ছাড়া আর কিছু বাঁচে না। ভজনে যেতে না পারলে সেদিন অনাহারে থাকতে হয়। আর মেডিক্যাল ফেসিলিটিও তেমন নেই।”

– “পত্রকার ম্যাডাম, এখানে যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করি। এর বেশি করা সম্ভব না। সব বিধবারাই আসে আপনাদের বঙ্গাল থেকে। কিন্তু, এই সব আশ্রম চালাতে প্রচুর টাকার দরকার হয়, বাঙ্গালীরা একটা টাকাও দেয় না। এই সমস্যার সমাধান যদি চান তবে আপনার ভাইবেরাদরদের বলুন তারা যেন ঘরের মা বোনদের তাড়িয়ে না দেয়।

এ কথা শোনার পর পলার মুখে আর কিছু এল না। ইস্কন মন্দিরের সামনে গাড়িতে বসতেই মেয়ে অদ্রিজা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ মাম্মি, এ’রকম অ্যাসাইনমেন্ট কখনো নেবে না।” তার চোখের জলের দিকে তাকিয়ে পলা বলল,” সমস্যার দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিলেই সমস্যা চলে যায় না রে মা।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত