রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া এর সুর।সারা ঘরে ধুপ ধুনোর গন্ধ ,স্নান করে ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বালাও হয়ে গেছে।কিন্তু ,ঘড়িতে সবে সাড়ে চারটে বাজে। এই মেট্রোসিটিতেও জীবনের এতগুলো বছরের পরেও মহালয়ার ভোরের চিরন্তন অভ্যেসটা আজও পাল্টায়নি কৌশিকীর।দেখতে দেখতে জীবনে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। বিবাহিত জীবন প্রায় ন বছরের।তাও যেন আজও সবটুকু বাদ পড়ে যায় নি;চেষ্টা করেও বারবার ফিরে আসা ফেলে আসা স্রোতের টানে।
কৌশিকীর মেয়ে বছর ছয়ের, ছোট্ট শ্রী।মায়ের সব সময়ের সাথী; যদিও বা মায়ের শাসন এর চোটে বাবাই সবচেয়ে কাছের মানুষ।সারাদিন হাজার একটা বায়না- আবদার- খুনসুটিতে সময় কেটে যায় কেমন করে, তা নিজেও বুঝতে পারে না কৌশিকী!
আর আরেকজন ,মানে অনন্য;সে থাকে নিজের পৃথিবীতে। নিজের কাজ, ল্যাপটপ, অফিস, প্রজেক্ট, ক্লাইন্ট আর তার মাঝে এক চিলতে অবকাশ ছোট্ট শ্রী।কৌশিকী পুরোপুরি চেষ্টা করে শ্রীকে নিজের ধাঁচে তৈরি করতে,মেয়েটাও আজকালকার দিনেও বড় অন্যরকম। মায়ের সাথে সন্ধ্যা প্রদীপ দেয় হাতে করে, বসে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে- সেই তখন থেকে যখন ও বছর দুয়েকের হবে। তাই মা এক বার ডাকতেই ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে। কৌশিকী বলে-
“বেটু দুর্গা মাকে টিভিতে দেখাচ্ছে, তুমি চল আমি তোমায় নিয়ে যেয়ে দেখাবো।”
নরম নরম দুটো হাত দিয়ে স্ত্রী জড়িয়ে ধরে মামমামের গলা-
” দুর্গা মা লাওনের পিঠে চেপে এসে অসুর কে মারবে কি?”
“তুমি দেখবে, না পরে উঠবে?”
” না আমি দেখব।”
” আচ্ছা চলো বেশ ,আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
উঠতে উঠতে শ্রী ডাকে অনন্য কেও।বাবা সাথে না থাকলে ও যেন কোন কিছু করেই মজা পায় না!
“বাপি চল না দুর্গা মা আসছে টিভিতে দুজন মিলে দেখব।”
“কাল অনেক রাত্রিতে ঘুমিয়েছি মামমাম, একটু পরে উঠে আমি!”
“না এক্ষুনি ,আমার সাথে।”
“চল না। বছরে তো একটা দিন। মহালয়া তো আর দিন দিন আসে না! উঠে পড়ো। আজকে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে নেই। না হয়, হয়ে গেলে এসে শুয়ে পড়বে!”
“রিপিট টেলিকাস্ট আসবে আবার একটু পরেই।”
“ঠিক আছে ঘুমাও তাহলে।”
বলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যায় কৌশিকী।
অনন্যকে উঠতে হয় বাধ্য হয়ে।এই রকম ভালো একটা দিনে বউকে রাগিয়ে লাভ নেই; অতএব গৃহিণীর ইচ্ছেতেই কর্ম হওয়াই ভাল!
একটু বেলা হতেই অনন্য কে বলে কৌশিকী,
“তুমি তৈরী হয়ে যাও। ১২ টায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। বাবা মা আসছে আনতে যেতে হবে।”
“আমি কিন্তু এসে অফিসের জন্য বেরোবো; আমার ছুটি নেই ।ওদেরকে ম্যাপটা শেয়ার করে গাড়ি বুক করে দিলে কি ওরা নিজেরা আসতে পারবে না!”
“একটা কথা কেন বারবার তোমাকে বলতে হয়, ওরা তো বোঝে না- তোমার কাজ আছে। পরে এটা নিয়েই খারাপ লাগবে, কথা হবে! না হয় তোমার অসুবিধে করেও ,তুমি একবার যেয়ে নিয়ে এসো!”
“আচ্ছা আমার জামা কাপড় গুলো বার করে রেখো, আমি স্নান করে বেরোচ্ছি।”
” হ্যাঁ ব্রেকফাস্ট করে দিচ্ছি খেয়ে যাও।”
রান্না ঘরে যে লুচি ভাজতে ভাজতে চোখটা ছল ছল করে ওঠে কৌশিকীর।জন্ম থেকে বিয়ের আগে অব্দি কখনো একটা দিনও পুজোর সময় মাকে ছেড়ে কোথাও থাকত না ও!অথচ, আজকে কোথায় কত দূরে একলা একটা বাড়িতে নিঃসঙ্গ পড়ে আছে বাবা-মা। চোখের জলটা উপচে বেরিয়ে আসে। গ্যাস টা বন্ধ করে সোফাতে এসে বসে ও ।ফোনটা হাতে নিয়ে মায়ের নাম্বারটা ডায়াল করে।
“কি করছ মা?”
” কিছু না ,এই একটু মুড়ি খাব।ছোলা সেদ্ধ করে রেখেছি, আলু আর গোটা জিরা দিয়ে ভাজবো।”
“মুড়ি কেন মা, একটু লুচি করো না!”
“না রে শরীরটা ভাল না তো! একা একা থাকি ।বড্ড ভয় করে আজ কাল। এমনিতেও বয়স হয়েছে আমাদের। তুইও নেই, কার জন্য করি এসব বল!”
গলার কাছে যন্ত্রণাটা দলা পাকিয়ে ওঠে।
“আমি সবসময়ই তোমার সাথে ফোনে কথা বলব। তুমি ভালো করে থাকো, পুজোর সময় মন খারাপ করোনা।”
“তোর শ্বশুর-শাশুড়ি কখন আসছে?”
” এই বারোটার সময় নামবে। অনন্য আনতে যাবে।”
“আচ্ছা ভালোভাবে থাকিস। আজ একটু ভাল করে রান্না করিস ওদের জন্য। আমি তো নেই যে করে দেবো! পুজোর দিনেও তোকে কাজ করতে হবে!… সময় যখন পাবি ফোন করিস।বেশি কথা বলার দরকার নেই এখন আমাদের সাথে।”
“কি যে বল মা, আমি কি ছোট আছি এখনো?আমি কি ঘরে কাজ করি না?”
” হ্যাঁরে জানি তুই বড় হয়ে গেছিস,খুব তাড়াতাড়ি। কখন বড় হয়ে গেলি বুঝতেই পারলাম না!মায়ের কাছে তো সন্তান কখনো বড় হয় না!”
মায়ের দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজটা যেন দূর থেকেও অনুভব করতে পারল কৌশিকী ।আর কথা বলতে পারলো না বেশিক্ষণ ।সবার সামনে শক্ত হয়ে থাকতে হবে, এটাই বোঝাতে থাকে বারবার, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে। দুর্বল যে হতে মানা !তাই শক্ত হয়েই বললো ,
“আচ্ছা মা অনেক কাজ বাকি। অনন্য বেরোবে। পরে কথা বলব।শুভ মহালয়া।সাবধানে থেকো।”
শ্রী খুব ঝোঁক করল অনন্যর সাথে যাবার জন্য। ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল একসাথে।
নিজের ঘরে যেয়ে, বিয়ের আগের অ্যালবাম টা খুলে বসলো কৌশিকি। রান্নাবান্না আপাতত সব শেষ।। তাই ইচ্ছে করলো, স্মৃতির সরণি ধরে একটু পেছন ফিরে যেতে!
সাধারণ মধ্যবিত্তের সংসার!অনেক না পাওয়া, না পূরণ হওয়া চাহিদা, অতৃপ্তি তবুও সব কিছুর মাঝেও যেনো তৃপ্তির প্রাচুর্য।অভাব-অনটনের সংসারেও মা যেন, দশ হাতে সামলে রাখতে নিজের সংসার কে, সন্তানদের গায় আঁচ লাগতে দিত না।কৌশিকী মুখে না বললেও,ও যেন ওর মায়ের প্রতিচ্ছবি ।মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনার মাঝে মায়ের একমাত্র কাছের মানুষ, একমাত্র অবলম্বন।ওর মনে পড়ে না কখনো মাকে ছেড়ে একা একা নিজের জামাকাপড় ও কিনেছে পুজোর সময়ে! ছেলেবেলা থেকেই ও বড্ড মা নেওটা।যত ভাব, তত ঝগড়া- সব মায়ের সাথে। তবুও একটা রাতও যদি মা ওকে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতো,সারাটা বাড়ি যেন তাড়া করে বেড়াতো ওকে !মাকে ছেড়ে যে কি করে থাকতে হয়, তাও বুঝতে শেখেনি কখনো বিয়ের আগে।
মায়ের অমত ছিল বলে নিজের ভালোবাসার মানুষকেও বিয়ে করেনি কৌশিকী। বেশ একটা ভাল দৈনিক পত্রিকার অফিসে চাকরি করতো বিয়ের আগে, জুনিয়র জার্নালিস্ট হিসেবে। অথচ যখন অনন্যর সাথে বিয়েটা ঠিক হলো, ওর মা বলেছিল-
”আমি চাই তুই তোর জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচ। এই অভাবের সংসার থেকে অনেক দূরে গিয়ে সুখী হ।স্বার্থপরের মত দুটো টাকার জন্য, তুই আমাদের রোজকার করে খাওয়াবি বলে, এই বয়সে এসে তোর জীবনটা আমি শেষ হতে দেবো না ।আমি শুধু চাই আমার একটাই সন্তান, সে যেন সুখী হয়!”
নিজের একটা একটা গয়না কৌশিকীকে হাতে করে সাজিয়ে দিয়েছিল মা। জমিয়ে রাখা একটা একটা টাকা খরচা করে সব দিয়ে বিয়ে দিয়েছিল মেয়ের।ওর শশুর বাড়ির লোকেরা যদিও বা কোনো পন বা দাবি-দাওয়া রাখেনি।তবু হাজার একটা আবদার ওরাও পূর্ণ করেছিল।তবুও যেদিন সকাল বেলা বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে আসছিল কৌশিকী, সামান্য কিছু ভুল ত্রুটির জন্য কৌশিকীর শাশুড়ি মা ফোন করে বলেছিলেন-
” ওদের বাড়ি থেকে একটা তত্ত্বের জিনিসও আনব না। এই আমরা মেয়েটাকে নিয়ে আসব, আর ওদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবো না॥”
কোনদিন ভুলবে না সেই মুহূর্তটা কথা কৌশিকি।ওর বাবা-মা অনন্যর হাত ধরে কেঁদে বলেছিল-
” আমাদের তো এই মেয়েটা ছাড়া আর কিছু নেই বাবা। দেখো ওকে যেন না কেউ কোনো কষ্ট দেয়! ও আমাদের বড্ড অভিমানী।”
বাবা মার অসহায়ত্বটা ওর বুকের ভেতরে যেন ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছিল। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি গাঁটছড়াটা খুলে নিজেকে মুক্ত করে বলে-
” যাও আমায় থাকতে দাও আমার বাবা মার মেয়ে হয়ে। কারোর স্ত্রী র তকমা আমার প্রয়োজন নেই।”
-অথচ গরিব বাবা-মার ওপর অপবাদ যন্ত্রণার বোঝা চাপিয়ে দিতে পারেনি সেদিন। সব যন্ত্রণা বিষের মতো পান করে ,শশুর বাড়ি এসেছিল যন্ত্রণার বোঝা নিয়ে।
তারপরে কেটে গেছে ন’টা বছর।আজো প্রতিটা দিন সবার সামনে ওকে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়।প্রমাণ করতে হয় ও ভালো পুত্রবধূ। প্রমাণ করতে হয় ও ভালো স্ত্রী ,ও ভালো মা, অথচ….. বাকি শব্দ গুলো চাপা পড়ে যায় পরিস্থিতির চাপে।অস্ফুট থেকে যায় অনেক না বলা কথা।
অনন্য অবশ্য খুব ভালো স্বামী! যথেষ্ট সম্মান দেয় কৌশিকী কে। অনন্যর হাত ধরেই, নতুন করে বাবা মার সাথে সম্পর্কটা আজ হয়তো অনেকটা সাবলীল; তবুও কোথাও যেন একটা কাঁটা গলার মধ্যে আটকে থাকে।
হঠাৎ করে কলিং বেলের বেলটা বেজে উঠলো।
ভেতরে ছুটে এল শ্রী –
“জানো মা,দাদাই ,ঠাম্মা আমার জন্য কত ড্রেস চকলেট সব নিয়ে এসেছে। আচ্ছা আচ্ছা সেসব হবে। আগে দাদু ঠাম্মাকে ভেতরে আসতে দাও।”
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো কৌশিকী শ্বশুর-শাশুড়িকে।
“কোন অসুবিধা হয়নি তো মা ?”
“নানা অসুবিধা কেন হবে তোমাদেরকেই তো বললাম ওখানে আসতে? তোমরা আসতে পারবে না বললে বলেই তো, আমাদের আসতে হল সোসাইটির পুজো ছেড়ে।”
“হ্যাঁ মা আমার তো স্কুল ছুটি; অনন্যর আসলে ছুটি নেই।”
” হ্যাঁ ঠিকই আছে।”
“ফ্রেশ হয়ে নিন আমি জলখাবার দিচ্ছি।”
বলে ভেতরে চলে গেল কৌশিকী। শ্রী তখন খেলায় ব্যস্ত দাদু ঠাম্মার সাথে।
নিজের সাধ্যের থেকেও বেশি চেষ্টা করে ও, এ সংসারে সবাইকে খুশি রাখতে। কিন্তু আজও নিজে বুঝে উঠতে পারেনি, কেন কেউ কখনো খুশি হয় না!
নিজের মুখের অপর একটা মেকি ভালো থাকার মুখোশ চাপিয়ে ,সারাদিন হাসিমুখে অজস্র যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকে।হাতে হাতে খাবার, জলখাবার প্রত্যেকটা প্রয়োজনীয় জিনিস সামনে এনে হাজির করে।তবুও দিনের শেষে মনে হয় যেন কিছু খুঁত রয়ে গেল!রাত্রিবেলায় শোবার সময় ঘরে গিয়ে ফোন করে মাকে।দিনের শেষে দুটো কথা; শুধু বাবা মা ভালো আছে এটুকু আশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করা, মনে মনে নিজেকে তৈরি করা- আগামী দিনের যুদ্ধের জন্য॥
অথচ অনন্যর বাবা-মার অজস্র অযাচিত অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন মুখ বুঝে শুনতে হয় কৌশিকী কে ।ছেলের কেন বেশী শেভিংস হচ্ছেনা?কেন এখনো নিজে বাড়ি কিনছে না? ওদের কেন আরো একটু বেশি টাকা পাঠাচ্ছে না? কেন ঘনঘন ওদের কাছে যাচ্ছে না? এসব আরও অজস্র প্রশ্ন- আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কৌশিকী।শুধু এত অজস্র প্রশ্নের ভিড়ে একবারও কেউ কি জিজ্ঞেস করে না ওর অসুস্থ বাবা-মার কথা। অবশ্য সে আশাও করে না ও!
আজ ষষ্ঠী। কৌশিকীর উপোস। ষষ্ঠীর দিন সব মায়েরাই নিজের সন্তানের মঙ্গলের জন্য উপোস করে। ছোট থেকে তেমনটাই শিখেছে ও নিজের মায়ের কাছে।মন্দির থেকে এসে মাকে ফোন করতে যাবে ফোনটা বেজে উঠলো-
“বেটা মায়ের খুব শরীর খারাপ।”
বাবার গলাটা কাঁপছে। হাত পা গুলো কাঁপতে শুরু করল কৌশিকীরও।মানুষটা ফোনের ওপারে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে ততক্ষনে।
“কি হয়েছে বাবা?মায়ের কি হয়েছে বাবা?”
” সকাল থেকে বলছে খুব বুকে ব্যথা করছে। বুঝলি, খুব ঘামছে। আমি ডাক্তারকে ডেকেছি। কিছু বুঝতে পারছি না।”
” দাও একবার দাও মাকে; একবার ফোন দাও।”
” নারে কথা বলতে পারছে না তোর মা। তুই কিছু কর। একবার ..একবার তোর মায়ের কাছে আয় না!”…. বলে ফোনটা কেটে যায়।
চিৎকার করে অনন্য কে ডাকে কৌশিকী। কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। সামনে দাঁড়িয়ে শ্রী, শাশুড়ি মা, শ্বশুর মশাই।
“মাকে বাঁচাও অনন্য। আমার মা’কে বাঁচাও।”
“তুমি শান্ত হও। আমি এক্ষুনি টিকিট দেখছি। আমরা এখনই চলবো মায়ের কাছে।”-শ্রী ও তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে, কৌশিকীর কোলের ভেতর এসে ঢুকে বসেছে।
হঠাৎ শাশুড়ি মা বলে ওঠেন-
” খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম হবে! বয়স হয়েছে তো! একটু এসিডিটির ওষুধ খেতে বলো, ঠিক হয়ে যাবে, এখনই টিকিট কেটে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“একে পুজো চলছে তারপর এক্ষুনি টিকিট দেখতে গেলে ফ্লাইট এর টিকিট এর দাম অনেক বেশি।আমরা তো নিজে টিকিট কেটে এলাম তাই জানি।”
কিছু বলতে যাচ্ছিল অনন্য, তার আগেই চিৎকার করে ওঠে, কৌশিকী।
“কত দাম ফ্লাইট এর টিকিটের?আমার মায়ের থেকে বেশি মূল্য? এতদিন আমি একটা কথাও বলিনি। চুপ করে মুখ বুজে সব সহ্য করেছি।বিয়ের পর থেকে একটা পুজো কাটাইনি আমার বাবা মার সাথে।কারণ আমি আপনার ছেলের স্ত্রী।কারণ আমার বাবা মা সাধারণ মধ্যবিত্ত, টাকার হিসেব বোঝেনা আপনাদের মত! মেয়েদের তো বাপের বাড়ি থাকতে নেই! তাই না। মেয়েদের বাবা-মা থাকতে নেই! মান সম্মান থাকতে নেই !অনুভূতি থাকতে নেই! চাওয়া-পাওয়া থাকতে নেই! কারন আপনারা দয়া করে আপনাদের ছেলের সাথে বিয়ে দেন আমাদের।”
“এসব কি বলছ তুমি বৌমা? এসব তোমার মায়েরই তো শিক্ষা!”
“না মা আমার মায়ের শিক্ষা বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। তা যদি বুঝতেন ,আমার মাকে এভাবে অপমান করতে পারতেন না! আমার মা আমার কাছে ভগবান। কারণ ভগবান শুধু ক্ষমা করতে জানেন,উনি তাই করেছেন।আমাকেও তাই শিখিয়েছেন। কিন্তু যদি আজকে সেই মায়ের সম্মানের প্রশ্নে আমাকে লড়াই করতে হয়, আমিও অহংকার আর মেকি আভিজাত্যের অসুর কে রক্তাক্ত করতে একবারও ভাববো না।কারণ ভগবানের থেকে অসুরের ক্ষমতা কখনো বেশী হতে পারে না।”
“সে তো হবেই! তোমার মা তো ভগবানই হচ্ছেন বটে, আমরা চুনোপুটি,পাপী মানুষ।”
“জানেন মা এত কিছুর পরেও, এত অপমানের পরেও আমার মা আমাকে বলেন -যেন আমি আপনাদের কখনো অসম্মান না করি। আপনারা পছন্দ করেন না, তাই যেন আপনাদের বর্তমানে মাকে বেশি ফোন না করি। তাহলে আপনাদের মনে হবে- আমি আমার মাকে বেশি গুরুত্ব দিলাম।শুনেছি মার কথা এতদিন ,আমি যা করেছি, তা শুধু আমার মায়ের শিক্ষা। কিন্তু একটা মানুষ যখন আজ এই অবস্থায় ,তখনো আপনাদের মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করছে না!তাই আজ আমি একটা কথা পরিষ্কার বলছি। আমার মায়ের জন্য যদি আপনাদের সবাইকে আমায় ছেড়ে যেতে হয়, আমি যাব। আমিও দেখি কে কি করে আমায় কেও আটকায়!”
সবার চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে কৌশিকী । অবাক হয়ে দেখতে থাকে সবাই ওকে। অনন্য কখনো এভাবে দেখিনি কৌশিকী কে, বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত!আসলে, যন্ত্রণার পারা টা চড়তে চড়তে এক সময় তা বিস্ফোরণ ঘটাতে বাধ্য হয়।
সেদিন রাত্রের ফ্লাইটে কৌশিকী ফিরে আসে নিজের মায়ের কাছে। না খুব সাধারন কিছু ছিল না! আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়। একটা মেজর হার্ট অ্যাটাক।আজ দুদিন পর বেশ খানিকটা ভালো।হাসপাতালের এর রুমে মায়ের বেডের পাশে, হাত দুটো ধরে বসে ছিল কৌশিকী।মা কথা বলছে।আমি দুজনের চোখে ছল ছল করে উঠলো।চারিদিকে ঢাক-ঢোল, বাজি পটকার আওয়াজ, আজ মহা নবমী।মেয়ের হাত ধরে মা বলে-
” আজ আমায় একটু মন্ডবে নিয়ে যাবি? হসপিটালের পাশে পুজো হচ্ছে। মাকে দর্শন করা হয়নি একবারও! আমি না হয়, হুইল চেয়ারে বসে থাকবো!”
-অসহায় ছোট শিশুর মত মায়ের আবদার ফেলতে পারে না কৌশিকী।তখন সন্ধি পুজো শুরু হয়েছে। সারা মন্ডপ ধুয়তে, ধুপে ঢাকের আওয়াজে গমগম করছে।মায়ের হাত ধরে শ্রী দাঁড়িয়ে, আর কৌশিকীর হাতে নিজের মায়ের হুইল চেয়ার। তিন প্রজন্ম দাঁড়িয়ে জগৎজননীর সামনে।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো কৌশিকীর মায়ের। চন্ড মুণ্ড কে বধ করার জন্য,মা চামুণ্ডা রূপ ধারণ করেছিলেন। হয়তো, আমাদের সমাজে আজও প্রয়োজনে সমাজরুপি অসুরকে বধ করার জন্য বারবার মাকে ফিরে আসতে হবে!কৌশিকী ও তখন এক মনে মাকে ডেকে চলেছে,মনে মনে –
“যেমন তোমাকে আমরা বরণ করি মা তোমায় প্রতিবছর ,ঠিক তেমনি যেন সব মেয়ে তার মাকে কাছে পায় চাইলেই।তার জন্য এভাবে যন্ত্রণা না পেতে হয়! মায়ের তো শ্রেণীবদল হয় না মা!”
চোখের জল গড়িয়ে গাল ভিজিয়েছে। মুক্তি হোক, শুদ্ধ হোক সব। আবার এসো মা। তোমার সব সন্তানরা ভরে থাক মাতৃস্নেহে।আজ একটু হলেও কোথাও মনে হচ্ছিল, ও হয়তো মেয়ে হিসেবে সার্থক। ভালো মেয়ে না হলে, ভালো মা হবে কি করে!